শরৎের_তৃতীয়_দিবস,পর্ব-০২

0
160

#শরৎের_তৃতীয়_দিবস,পর্ব-০২
#Tahmina_Akther

—তুমি???

—- যেভাবে অবাক হচ্ছিস মনে হচ্ছে আমি মঙ্গল গ্রহে গিয়েছিলাম সেখান থেকে ফিরে এসেছি। মুখটা বন্ধ কর। চোখদুটো ছোট কর। মনে হচ্ছে কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।।

—- কাগজটা কে দিয়েছে? তুমি দাওনি তো আবার?

ইতসস্ত হয়ে আহনাফকে কাগজটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলো মেহের। আহনাফ মেহেরের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে খুব সুন্দর করে ভাঁজ করলো। তারপর,, পকেটে ঢুকিয়ে মেহেরকে বললো,,

— তোকে দিয়ে পড়িয়ে দেখলাম বানানে কোনো ভুল আছে কিনা? যাক ভুল যেহেতু নেই তাহলে সমস্যা দূর হয়ে গেছে।

কথাটি বলে বেশ আয়েশ করে চেয়ার গা এলিয়ে দিতে গিয়েও দিলো না। কারণ,, জায়গাটা অনুপযোগী। মেহের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে বললো,,

— তুমি একটু বসবে আমি ম্যানেজারের কাছ থেকে ছুটির কথা বলে আসি। দেখি ছুটি দেয় কি না?

— আরে ছুটি নিবি কেন? ডিউটি শেষ কর তারপর একসাথে বেরিয়ে যাব৷ বাইরে ওয়েট করছি আমি।

মেহের কিছু বলতে গিয়েও বললো না। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি শ্বাস ছাড়লো। আহনাফ চলে যাওয়ার নিজের কাজে মনোযোগী হলো। কিন্তু,, আশেপাশে যারা আছে তারা কিন্তু মোটেও মেহেরের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কেউ বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে,, কেউ ফিসফিসিয়ে আরেকজনের কানে কথা তুলছে। এই হলো অবস্থা! মেহের সবটাই টের পেলো কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করলো না। কারণ,, অন্যের পরনিন্দা করার জন্য মানুষের চেয়ে আর কোনো জ্ঞানী প্রাণী আছে নাকি? অন্য প্রাণীরা নিজের খাবার জোগাড় করবে,, বেলা গড়ালে বাসস্থানে ফিরে যাবে। তাদের জীবন চলে নিয়মমাফিক। মানুষের মতো অত সময় তাদের নেই পরনিন্দা চর্চা করার জন্য।

ঘড়ির কাটা পাঁচটায় এসে ঠেকলো। ডেস্কের কাগজপত্র গুছিয়ে ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বের হয়ে এলো মেহের। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মিমি পেছন থেকে ডাক দেয়। মেহের দাঁড়ায়। মিমি তড়িঘড়ি করে মেহেরের সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,

— হিরোটা কে রে?

— আমার বাবার বন্ধুর ছেলে+ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷

মেহের হাতঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে উত্তর দেয়।

— বাপরে যেভাবে ব্যাংকে এন্ট্রি নিয়েছে আমি তো ভেবেছিলাম এই শহরের কোনো বড়ো ধরণের মানুষ এসেছে। কিন্তু,, সে কিনা তোর বেস্টফ্রেন্ড বের হলো!

শেষের কথাটিতে কিছুটা বিদ্রুপের ঘ্রাণ পায় মেহের। মেহের মুচকি হাসি দিয়ে মিমির কপালে টোকা দিয়ে বললো,,,

— সিটি করপোরেশনের মেয়রের ছেলে আহনাফ চৌধুরী। ভাবসাব তো তেমনি থাকবে তাই না? বড়ো মানুষদের নিয়ে না ভেবে বাড়ি ফিরে যা। আমিও চলি লেইট হয়ে যাচ্ছে।

মেহের চলে যাচ্ছে। মিমি সেদিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। কারণ,, ছেলেটার পরিচয় না জেনে সে কি থেকে কি বলে ফেললো? সঙ্গে মেহেরকে ছোট করে দেখলো।

মেইন রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিকসেদিক তাকিয়ে আহনাফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মেহের। কোথাও তার ছায়াও নেই৷ নিজের চুলে টান পরতেই আহ শব্দ করে কুকিয়ে উঠলো মেহের। ব্যাথায় চোখে জমে উঠলো। চোখেমুখে কাঠিন্যতা বজায় রেখে চুলগুলো ছাড়ানোর জন্য আহনাফকে বললো,,

— দেখো ভালো হবে না বলছি। চুল ছাড়ো ব্যাথা পাচ্ছি আমি।

আহনাফ আরও শক্ত করে চুলগুলো আঙুলে পেঁচিয়ে মেহেরের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,

— ব্যাথা দেয়ার জন্যই তো এত আয়োজন৷ নয়তো,, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওমন বোকা কান্ড করার কার ইচ্ছে আছে? নে যা ছেড়ে দিলাম।

আহনাফের কাছ থেকে নিজের চুলগুলো উদ্ধার করে মেহের কোনোমতে খোঁপা করে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলো৷ তবে,, ঘোমটা দিতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ,, শাড়ির আঁচল আজ ছোট করে রেখেছিল যার দরুন ঘোমটা পুরোপুরি দিতে পারছিল না। শেষমেশ না পেরে মাথায় আঁচল টেনে আঁচলের কোণা ধরে রইলো।

আহনাফ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহেরকে দেখছিল। এমনসময় রাস্তা দিয়ে একটা খালি রিকশা দেখে আহনাফ ডাক দেয়। রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসে ওদের দিকে। এসেই জিজ্ঞেস করলো,,

— কই যাবেন মামা??

— এই তো বিজয়নগর যাব।

— এত দূরে যাইবেন তাইলে মামা একটা সিএনজিতে কইরা চইলা যান।

— সিএনজিতে গেলে কি আর তোমাকে ডাকতাম? আজ রিকশায় যাব।

কথাটি বলে আহনাফ রিকশা উঠে বসলো। এদিকে মেহের বোকার মতো আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বিরক্ত হয়ে মেহেরকে ধমক দিয়ে বললো,,

— এভাবে তাকিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই বাড়িতে যেতে পারবি না! উঠে আয়।

— তোমার গাড়ি কই?

— গাড়ি নাই। বেঁচে দিয়েছি। গাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে আজ রিকশার ভাড়া মেটাবো। হাওয়াই মিঠাই খাব। হয়েছে? এবার উঠে আয়।

মেহের জানে আহনাফ কখনোই সোজাসাপটা উত্তর দেয় না। বরং কথাকে কি করে ইন্ডিয়া বর্ডার ক্রস করে নেপাল পর্যন্ত টেনে নেয়া যায়। মেহের যখন রিকশায় উঠছিল তখন আহনাফ ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু মেহের তা দেখেও না দেখার ভান করে রিকশায় বসে।

— বইছেন আপনেরা??

— জি মামা।

মেহের উত্তর দিয়ে রাস্তার বামদিকে তাকিয়ে রয়। ধীরে ধীরে রিকশা চলতে শুরু করে। চারদিকে কোলাহল ; শহর জুড়ে তখন মানুষের নীড়ে ফেরার তাগিদ। মেহের এদিক সেদিকে তাকিয়ে দেখছে। পাশে যে একজন মানুষ বসে আছে সেটা হয়তো খেয়ালও নেই।

হুট করে আকাশে গর্জন হয়। মেঘের গর্জন। হুট করে পুরো আকাশে অন্ধকার নেমে আসে। ধীরে ধীরে বাতাস শীতল হয়ে আসে। পরিবেশের এমন হটাৎ পরিবর্তন দেখে মেহের গুনগুনিয়ে গান গাইতে থাকলো।

রিকশার হুডে টিপ টিপ বৃষ্টির ফোঁটা পরছে। ব্যস্ত মানুষেরা রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। রিকশাওয়ালা মামা কিন্তু সেই আগের মতো পা চালিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার রিকশাকে।

অঝোরে বৃষ্টিতে,, ধূসর আকাশের আবছা আলোয় দেবির মতো মুখটায় তাকিয়ে কিছু সময়ের জন্য আহনাফ থমকে যায়। মুখটায় তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে বেড়ায়৷ খুঁজে পায় না বরং আরও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

স্নিগ্ধ মুখটা প্রভাতের প্রথম প্রহরের মতোই আছে। একেবারে পবিত্র আর শীতল। চোখদুটোতে একরাজ্য সমান মায়া তো আছেই। কিন্তু,, মাঝে মাঝে ওই চোখ দুটোতে তাকালে অভিমান খুঁজে পায়। কিন্তু,, অভিমান কার জন্য জমা করে রেখেছে?

হুট করে আহনাফের কি যে হলো? অভাবনীয় একটি কান্ড করে বসলো।

আকাশের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মেহের। কাজের ফাঁকে কখনোই এত চমৎকার শরৎের হুটাৎ বৃষ্টি দেখা হয় না। যান্ত্রিক জীবনে হুট করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা পেলে মন্দ হয় না। বরং, খুশিটাকে মনের মাঝে চেপে রেখে উল্লাশ করতে বেগ পোহাতে হয়৷ ছোটবেলায় চেচিয়ে চিৎকার করে কত বৃষ্টিতে ভেজা হয়েছে। কিন্তু,, এখন কি আর সেই আগের মতো হুৈ-হুল্লোড় করার সময় আছে?

শাড়ি ভেদ করে একটি শীতল হাত মেহেরের কোমড় পেঁচিয়ে শক্ত করে নিজের দিকে টেনে নেয়। মেহের চকিত নজরে তাকায় আহনাফের দিকে। বৃষ্টির ছিটায় আহনাফের চোখের পাতা ভেজা দেখাচ্ছে। কপালে,, থুতনিতে বৃষ্টির ফোঁটা জমে আছে। কোমড় থেকে আহনাফের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।

মেহেরের অস্বস্তি হয়। অস্বস্তি কমাতে রাস্তার অন্যপাশে তাকিয়ে থাকে কিন্তু আহনাফ হাত বাড়িয়ে মেহেরের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনে৷ মেহের আবারও মুখ ফিরিয়ে নিতে চায় কিন্তু পারে না। আহনাফ শক্ত করে মেহেরের থুতনিতে চেপে ধরে। মেহের আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো,, এই দুটো চোখ বড্ড চেনা। যে চোখে তাকিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল ঠিক সেই চোখদুটো আজ তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটাসময় খুব করে চাইত এই দুটো চোখের মালিক দিন-রাত্রি তার দিকে চাতক পাখির ন্যায় ক্লান্তিহীন চোখে তাকিয়ে থাকুক৷ যেই চোখে তাকালে ভালোবাসার তৃষ্ণা মিটে যাবে। হাজার বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগবে। এমনটাই আশা করেছিল। কিন্তু,, সেই আশা জেগে ওঠার আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। নিজ হাত সেই ধ্বংসলীলা চালিয়েছে সে।

নতুন করে সাহস জুটেনি ওই চোখে তাকিয়ে নিজেকে সর্বহারা করার। নিরবে, নিভৃতে শুধু কেঁদে দিন পার করেছে। তাহলে, এতদিন পর কেন ওইদুটো চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে এভাবে বিলীন করে দিতে মন চাইছে? এই মানুষটার বুকে জায়গা না হোক অন্তত পায়ের তলায় যদি জায়গা মিলত? এমন খেয়াল-ভাবনা কেন মস্তিষ্কে এসে কিলবিল করছে? ভালোবাসা কেন মানুষকে এতটা অসহায় আর আত্মসম্মানহীন করে তুলে? যে ভালোবাসা গর্ব করে বলার জিনিস সেই ভালোবাসা কেন হৃদয়কে ছোট করে তুলে। নিজেকে নিজের কাছে কেন তুচ্ছ করে তুলে?

—- ভয় পাচ্ছিস মেহু???

আহনাফের কথায় টনক নড়ে মেহেরের। জোড়াজুড়ি করে আহনাফের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। আহনাফ মেহেরকে ছেড়ে দেয়। অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি থেকে কি করে ফেললো কিছুই বুঝতে পারছে না! নিশ্চয়ই মেহের এখন তাকে ছ্যাচরা ভাবছে!

মেহেরের কাঁদতে ইচ্ছে করছে তাও গলা ফাটিয়ে। কিন্তু,, পাশে যে তার ভালোবাসার মানুষ বসে আছে।
যার স্পর্শ পাওয়ার কল্পনায় বিভোর হয়ে গভীর রাত হয়ে যেত। সে আজ তাকে স্পর্শ করেছে হয়তো মনের ভুলে কিন্তু করেছে তো। কিন্তু,, এমনটা না হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? দিব্যি ভালো ছিল আহনাফকে ভালো না বেসে। কিন্তু,, এবার আহনাফকে ভালোবাসাতে না পারার অক্ষমতা,, এই স্পর্শকে ভুলে থাকার স্নায়ুযুদ্ধে এবার বুঝি মেহেরের মৃত্যু হবে।

ধীরে ধীরে বৃষ্টি কমে আসে। রিকশা এসে বিজয়নগর ৩নং কলোনিতে থামে। ভেজা শাড়ির আঁচলটা কোনোমতে টেনে এনে গা ঢেকে রাস্তার একপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আহনাফ রিকশা থেকে নামছে না দেখে মেহের ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলো,,

— নামছো না যে?

—আজ যাব না। তুই ফিরে যা। তুই বাড়ির গেইটে ঢুকলেই আমি চলে যাব।

— কিন্তু???

— পরে আবার আসব। তুই যা।

মেহের আর কথা বাড়ালো না। ধীরে ধীরে ওদের কোয়ার্টারের গেইটে ঢুকলো। মেহের যখন চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেলো তখন আহনাফ রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করলো আবারও সেই জায়গায় যেতে যেখান থেকে ওরা রিকশায় ওঠেছিল। রিকশাওয়ালা মামা তাই করলো। আহনাফ চলে যাচ্ছে কিন্তু পেছন থেকে যে দুটো অশ্রুশিক্ত চোখ তাকে বিদায় জানাচ্ছে তা মোটেও টের পেলো না সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here