শরৎের_তৃতীয়_দিবস,পর্ব-০৩

0
179

#শরৎের_তৃতীয়_দিবস,পর্ব-০৩
#Tahmina_Akhter

— আপনার কথামতো আমি মেহেরকে ইমপ্রেস করার জন্য কতকিছু করলাম কিন্তু মেহের তো আমাকে দেখে দেখলো না। উল্টো আজ নিজের মানসম্মান হাতে নিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে এসেছি।

কথাটি বলতে বলতে কপালের ঘাম মুছলো আবির নামের এক ছেলে। মেহেরের খালা পান চিবুতে
চিবুতে ছেলেটাকে আরও একবার খুব ভালো করে দেখে নিলো।

— তোমাকে তো আমি সুন্দর ভাবছিলাম। কিন্তু,, তুমি তো দেখি সুন্দরের স তে নাই। এই জন্যই হয়তো লোকে বলে মিষ্টি কথায় মজতে নাই।

মেহেরের খালা রুমানার কথার মর্ম বুঝতে পারে আবির। মাথা নীচু করে ফেলো তৎতৎক্ষনাৎ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাকির হুট করে আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললো,,,

— আপনের দেহি বিরাট সাহস! মাথায় নাই চুল কিন্তু ম্যাডামরে বিয়া করার জন্য উঠেপড়ে লাগছেন । আপনের পাশে ম্যাডামকে দাঁড় করাইলে কি মনে হইব জানেন?? শোক দিবস চলতাছে। সাদা রঙ হইলো ম্যাডাম আর বিশেষ রঙটা হলো আপনে মানে কালা রঙ।

— আহ্ জাকির তোমাকে আমি কি বলেছিলাম তা কি তুমি ভুলে গেলে? যাও এখান থেকে।

“সত্য কথা বললে হাজি সাহেবের মুখ বেজার হয়”

এতকাল শুনছি আজ চোখের সামনে দেখে নিলাম। কথাগুলো মনে মনে বলতে বলতে বাড়ির বাইরে চলে যাচ্ছে জাকির।

জাকির চলে যেতেই আবির উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। রুমানা তা দেখে কিছু বললেন না।

— আমি আসছি।

— এসো। তবে মেহেরকে তোমার কাছে বিয়ে দিব না। অন্য কোথাও পাত্রি খোঁজ করো।

রুমানার কথার পিঠে আবির কিছুই বললো না। ভারাক্রান্ত মনে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। মেইন গেটের কাছে যেতেই জাকিরের সামনে পরলো আবির। আবিরকে চোখের সামনে দেখে মনে মনে এক গাদা গালি দিয়ে মনটাকে শান্তি করলো জাকির। বেচারা আবির যদি জাকিরের গালিগুলো শুনতো তবে বেচারা নির্ঘাত বধির হয়ে ভিক্ষা করতে নামতো।

********************

আহনাফ চোখের সামনে থেকে যতক্ষণ না পর্যন্ত আড়াল হলো ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত মেহের ঠিক একইভাবে তাকিয়ে রইল৷ আহনাফ চোখের আড়াল হলে নিঃশব্দে পা বাড়ায় বাড়ির ভেতরের দিকে। মাথায় একশ রকমের চিন্তা নিয়ে ভঙ্গুর দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ারা বড্ড কষ্টদায়ক। বাহির থেকে দেখলে কে বলবে ভেতর থেকে কতটা ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া এই দেহটা!

ব্যাগ থেকে চাবি বের করে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো । অন্ধকার হাতরিয়ে সুইচ বের করে লাইটের সুইচ অন করলো।

ছিমছাম সুন্দর একটা ড্রইংরুম। একসেট সোফা,, তার সামনে টি-টেবিল, পাশে একটা চমৎকার বুকসেলফ। বড়ো জানালা দিয়ে শীতল বাতাসের আনাগোনা।

মেহের এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। দরজা লক করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে৷ নির্জীব শরীরটায় যেন প্রাণ নেই৷ চোখদুটো থেকে জল গড়িয়ে পরতে লাগল। ঠোঁটদুটো তিড়তিড় করে কাঁপছে। কান্নার দমকে পুরো শরীর বারবার কেঁপে ওঠছে৷ মুখ চেপে ধরে কান্নার শব্দকে বাইরে বের না করার অদম্য চেষ্টা চলছিল মেহেরের মাঝে।

এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠল। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছলো মেহের৷ কল ছেড়ে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো যেন কান্না চোখ বোঝা না যায়। পরনের শাড়িটা যে তখনও ভেজা তা খেয়ালই ছিল না মেহেরের। ভেজা শাড়ি গায়ে জড়ানো অবস্থায় গিয়ে দরজা খুললো।

আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। মেহের দুই পা পিছিয়ে যায়। কারণ,, আহনাফকে সে এই মূহুর্তে এই জায়গায় কল্পনাও করেনি। কিন্তু,, সে তো রওনা হয়ে গিয়েছিল তার নিজ গন্তব্যে!

মেহেরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আহনাফ। মেহেরক ভেজা শাড়িটায় অনেকক্ষণ ধরে দেখছে। কিন্তু,, নতুন করে মেহেরের ভেজা দু-চোখ,, বিমর্ষ মুখখানি দেখবে এটা কল্পনা করেনি সে৷ ভেবেছিল দীর্ঘদিন পর ব্রেস্টফ্রেন্ডকে দেখলে অন্তত ভালোবাসায় ব্যর্থ কুঁজো হয়ে যাওয়া হৃদয়টাকে সটান করে দাঁড় করাতে পারবে। কিন্তু,, পরিস্থিতি যে আজ অন্যরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেহেরের এমন মুখখানা দেখার পেছনে কি আহনাফের দোষ নেই? সে যদি তখন রিকশায় ওমন বেয়াদবি আচরণ না করত তবে কি মেহেরকে আজ কান্নারত অবস্থায় দেখতে হতো? কখনোই না।

আহনাফ লজ্জিত মুখে হাতের ব্যাগটা মেহেরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,

— ব্যাগটা রিকশায় রেখে নেমে গিয়েছিলি।

মেহের আড়ষ্ট হয়ে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিলো। আহনাফ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কিন্তু পেছন থেকে মেহেরের ডাক যখন থমকে যায়। পেছন ফিরে তাকালো আহনাফ।

— কতদিন পর দেখা হলো আমাদের? বাড়ির চৌকাঠে এসে ফিরে যাচ্ছো! অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যাও।

আহনাফ দরজার কাছে ফিরে এলো। মেহেরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেই ফেললো,,

— সেই আগের মতোই আছিস! যেই মানুষটা তোর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে নিঃস্ব করেছে সেই মানুষটাকে, কেন তার একটিবার বলার কারণেই তোকে তার সঙ্গে এক রিকশায় আসতে হবে? কেন তুই তোর বাড়িতে আসার জন্য সাধবি?কেন এক কাপ চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করবি? তোর উচিত আমাকে ইঁদুর মারার ঔষুধ খাইয়ে মেরে ফেলা। আমি জাস্ট নিতে পারছি না মেহু। আমার গিল্ট ফিল হয় তোর সামনে এলে। গত ছ’মাস ধরে আমি বহু চেষ্টার পর মনের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করে আজ আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মাফ চাইতে এসেছি তোর কাছে। সাহস হচ্ছিল না তাই ওভাবে ফিরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু,, তোর ব্যাগের জন্য আমাকে আবারও ফিরে আসতে হলো। তোর এই কান্না মাখা মুখ,, আমাকে দেখতে হলো। আমি তো চাইনি কখনো তোকে কষ্ট দিতে? সবসময় চেয়েছিলাম ভালো বন্ধু হিসেবে সবসময় যেন তোর পাশে থাকতে পারি। কিন্তু, তা আর হলো কই? সব পাল্টে গেছে। একটা ছোট অনুভূতি আমাদের পুরো জীবনটাকে বদলে দিয়ে গেছে।

আহনাফ মুখে রাগের ছাপ। মেহেরের কাছ থেকে কিছু কথা এই মূহুর্তে আশা করেছিল আহনাফ। কিন্তু,, মেহেরের মন্যতা আহনাফের আশায় গুড়ে বালি দিয়ে যায়।

— আগের মতো করে সবকিছু করা যায় না?

আহনাফের কথায় মেহের হাসি দিয়ে বললো,,

— সবটাই তো আগের মতো আছে।

— আগের মতো কিছুই নেই। তুই পাল্টে গেছিস।

— আমি বদলায়নি। তুমি বদলে গেছো। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা না বলে ভেতরে এসে কথা বলতে পারতে। ঘরে এসো।

মেহের দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ায় কিন্তু আহনাফ তার জায়গা থেকে এক চুলও নড়ে না। সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

মেহের কিছু বলার আগে হুট করে আহনাফ মেহেরকে খুব শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আহনাফের আকস্মিক কান্ড দেখে মেহেরের মনের ভেতরকার যে কি অবস্থা শুধুমাত্র মেহেরেই জানে! আহনাফ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো প্রলাপ বকছে,,

— তুই আগের মতো নেই মেহু। এই মেহেরকে আমি চিনি না। আমার বন্ধু মেহের অন্যরকম। সবার থেকে ভীষন আলাদা।

মেহের আপ্রাণ চেষ্টা করছে আহনাফের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। এমনসময় সিঁড়ি দিয়ে তিনতলার ভাড়াটিয়ার ছেলে ইশতিয়াক নেমে আসছিল। মেহের এবং আহনাফকে ওমন অবস্থায় দেখে কিছুটা বিব্রতবোধ করতে করতে ওদের দিকে যায়। হুংকার ছেড়ে আহনাফকে এক ঝটকায় মেহেরের কাছ থেকে সরিয়ে এনে সপাটে কিল-ঘুষি মেরে বসে। আকস্মিক ঘটনায় মেহের এবং আহনাফ দুজনেই অবাক। ইশতিয়াক আবারও আহনাফকে মারার জন্য উদ্ধৃত হলে মেহের আহনাফের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ইশতিয়াককে উদ্দেশ্য করে বললো,,,

— ভাইয়া,, প্লিজ ওকে মারবেন না।

— তুমি সরে যাও সামনে থেকে। কত্ত বড়ো সাহস! বিল্ডিংয়ে ঢুকে দিনদুপুরে সিঁড়ির সামনে মেয়ে-মানুষকে জড়িয়ে ধরে! এটা কি সিনেমা করার জায়গায়? তোমাকে আমি ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি যে এরকম বের হবে কে জানত? এই জন্যই হয়তো বিল্ডিংয়ের মালিকরা একা মেয়ে মানুষ বাসা ভাড়া দিতে চায় না।

মেহের মাথা নীচু করে ইশতিয়াকের কটু কথা হজম করছিল। অন্যদিকে আহনাফ ইশতিয়াকের সব কটুবাক্য শুনলো। মাথা ঠান্ডা রাখার বৃথা চেষ্টা করে মেহেরের সামনে গিয়ে বললো,,

— এখানে থাকার দরকার নেই। চল আমার সঙ্গে।

কথাটি বলে মেহেরের হাত ধরে একটুখানি সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে দৌঁড়ে আসে ইশতিয়াক। আহনাফের কাছ থেকে মেহেরকে ছাড়িয়ে আনলো। আহনাফ বিস্মিত হয়ে ইশতিয়াক নামক লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

— এই তুই কি আরও মার খেতে চাইছিস? মেহেরকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? তুই যেখান থেকে এসেছিস সেখানে যা না। ওকে নিয়ে টানাটানি করার কে তুই?

আহনাফ নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। দুম করে ইশতিয়াকের গালে ঘুসি মেরে বসলো। ইশতিয়াকের যেন চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এলো। ঠোঁটের কাছটা বুঝি কেটেই গেছে৷ রক্ত বের হচ্ছে বোধহয়! ইশতিয়াক ঠোঁটের কাছে একটা আঙুল লাগিয়ে এনে চোখের সামনে ধরে দেখলো আঙুলের ডগায় টকটকে লাল রক্ত লেগে আছে। ইশতিয়াক কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগে আহনাফ ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে হুশশ শব্দে করে ইশতিয়াককে কথা বলতে বারণ করলো। এরপর নিজেই বলতে লাগলো,,,

— তুই আমার আর মেহুর মাঝখানে কথা বলার কে? তুই জানিস আমি কে? আমি নওয়াজ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। নওয়াজ চৌধুরীকে তো চিনিস? এই শহরের মেয়র। আর বললি না মেহুকে টানাটানি করার আমি কে? তবে কানদুটো খোলা রেখে খুব ভালো করে শুনে রাখ,, ও আমার বৌ। বুঝতে পারছিস ও আমার বৌ। তোর সঙ্গে আবারও দেখা হলে যেন আমার পরিচয় দিতে না হয়। খুব ভালো করে আমার পরিচয়টা তোর মাথায় গেঁথে রাখিস। মাইন্ড ইট।

কথাটি বলে একপলকের জন্য মেহেরের দিকে তাকায় আহনাফ । তারপর,, বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যায়। মেহের তখন ঘোরের মাঝে আছে। স্বপ্ন দেখছে না তো আবার?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here