#শরৎের_তৃতীয়_দিবসপর্ব-০৪
#Tahmina_Akhter
— তোমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে???
সবে বিছানায় শুয়েছিল আহনাফ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর মা ওকে কথাটি বলে ফিরে গেলেন। আহনাফের কপালে ভাজ পরলো। কারণ,, ওর সঙ্গে বাড়িতে এসে সরাসরি কথা বলবে এমন কোনো মানুষ নেই। পরিচিত কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-আত্মীয় যারা আছে সবাই আহনাফের কাছে কল করে জিজ্ঞেস করবে দেখা করার সময় আছে কি-না? যদি অবসর থাকে তবেই দেখা করতে আসে।
আহনাফ শোয়া থেকে ওঠে বসলো। দু-হাত দিয়ে মুখটা মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ড্রইংরুমে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলো খুব পরিচিত একটি মুখ৷ আহনাফ ভাবতেও পারেনি এই মানুষটাকে ওদের বাড়িতে দেখবে?
— বড়োলোকের ব্যাটার তো দেখাই মিলে না।
মেহেরের খালা রুমানার কথায় আহনাফ লজ্জা পেলো। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় রুমানার সামনে। সালাম দিয়ে বললো,,
— খালা আসলে হয়েছে কি,, মানে??
— হয়েছে কি,, মানে,, শব্দগুলো কখন ব্যবহৃত হয় জানো যখন মানুষ কোনো মিথ্যা বাহানা কিংবা মনগড়া কাহিনি বলার প্রস্তুতি নেয়। আমি চাই না তুমি আমার কাছে বানিয়ে বানিয়ে কোনো গল্প বলো। আমি চাই সত্য গল্প শুনতে যে গল্পটা বিগত ছ’মাস আগে তোমরা দুজনে তৈরি করেছো এবং অসমাপ্ত অবস্থায় ইতি টেনেছো সেই গল্পের।
রুমানা খালার দিকে রইলো আহনাফ। মানুষটা বড্ড চালাক। চট করে সবকিছু বুঝে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা হয়তো আছে তার মাঝে।
— আপনি নিশ্চয়ই কারো কাছ থেকে ঘটনাটি জেনেছেন। তবে আমার কাছ থেকে নতুন করে জানার কি দরকার?
আহনাফের প্রশ্নে রুমানা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,,
— যার কাছ থেকে ঘটনাটি জানলাম আমি তো শুধু তার কথাই জানলাম। কিন্তু,, তোমারটা তো অজানা রয়ে গেলো। কিন্তু,, আমার তো সবটা জানার প্রয়োজন আছে।
কথা বলার ফাঁকে সার্ভেন্ট কফি,, বিভিন্ন রকমের নাশতা,, ফ্রুটস দিয়ে গিয়েছিল। রুমানা হাত বাড়িয়ে কফির একটা মগ তুলে নিয়ে তাতে এক চুমুক দিয়ে আহনাফকে বলতে অনুরোধ করলো। আহনাফ দৃষ্টি নীচু রেখে পেছনের গল্প বলতে শুরু করলো।
“” কলেজে ওঠার পর বাবার দাপটে হোক পুরো ক্যাম্পাসে তান্ডব চালাতাম মারপিটের নয় হৈ-হুল্লোড়ের। একগাদা বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আমার জীবন তখন চলছিল। একদিন ক্লাসে নতুন একটি মুখ দেখলাম। কেন যেন ভীষন ভালো লাগলো তাকে দেখে। সবার থেকে আলাদা ছিল সে। নিয়মিত ক্লাসের অনিয়মিত ছাত্র আমি হুট করে ক্লাসে নিয়মিত হতে থাকলাম। কারণ, সেই মেয়েটাকে দেখার একটুখানি সময় আমার কাছে অনেককিছু তখন৷ বন্ধুরা এই ব্যাপারটা নিয়ে ভীষন ভাবে আমাকে টিজ করত। কিন্তু,, আমি গায়ে মাখতাম না। ছুটির সময় কিংবা ক্লাসের বিরতিতে মেয়েটাকে যখন দেখতাম ক্যাম্পাসের মাঠে শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখাতো তখন তার চোখেমুখে আলাদা এক আনন্দের রেখার দেখা মিলত। সেই আনন্দের রেখার রেষ বোধহয় আমার শরীরে ইফেক্ট করতো। মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকে দেখতাম৷ তার কাছে গিয়ে কখনো এটুকু বলতে পারিনি দেখো আমি কিন্তু রোজ তোমার পাশের বেঞ্চে বসে তোমাকে দেখে ক্লান্ত হই। তুমি কি কিছুটি টের পাও??
—- বন্ধুত্ব হলো কি করে তোমাদের???
রুমানা খালা কফির মগটা টি-টেবিলের ওপর রেখে আহনাফকে মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো।আহনাফ মাথা নীচু করে সেই আগের মতো ঘটনায় ফিরে গেলো।
—মেহের হয়তো বিড়াল নামক প্রাণীটাকে জমের চেয়েও বেশি ভয় পায়। একদিন ফাঁকা ক্লাসে হুট করে জানালা দিয়ে কোত্থেকে একটি বিড়াল এসে লাফিয়ে মেহেরের সামনের বেঞ্চে ওঠে আসে। এতটুকু দেখে মেহেরের মূর্ছা যায়। ভয়ে ওর চোখমুখ কেমন চুপসে যায়৷ একটা সময় পর হয়তো নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনি দেয় এক চিৎকার৷ আমি তো ওর পাশের বেঞ্চের বসে ছিলাম। ওর চিৎকারের মানে তখনো বুঝতে পারেনি। কিন্তু,, ওর চিৎকার যে আমার কপালে খারাপ কিছু ডেকে এনেছিল তা খুব ভালো করেই টের পেলাম। পাশের ক্লাসের নোমান স্যার সহ জুনিয়ার,, সিনিয়র ,, আমাদের ক্লাসমেট সবাই দৌড় এলো। এসে দেখলো ফাঁকা ক্লাসে শুধু আমি আর মেহের সম্পূর্ণ একা। তারা ভেবে বসলো অন্যকিছু। মেহেরকে দুজন মেয়ে এসে স্বান্তনা দিচ্ছিলো।আমার বাবাকে তো সবাই চিনে তবুও একটা মেয়ের সম্মানহানির ব্যাপারটা তারা মানতে পারছিল না। দুএকজন সিনিয়র ভাই এগিয়ে এসে আমার কলারে ধরে মারমুখি হয় তার আগে মেহের কম্পিত গলায় সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,,,
— আহনাফের দোষ নেই। আসলে আমি বিড়াল দেখলে ভীষন ভয় পাই। বিড়াল দেখে ওভাবে চিৎকার দিয়েছি।
এমনসময় বিড়ালটি কোনো এক বেঞ্চের নীচ থেকে বেরিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়।প্রকৃত ঘটনা জানার পর স্যাররা কিছু বললেন না চলে গেলেন। বাকি সিনিয়র,, জুনিয়ার সবাই হুট করে হু হু করে হাসতে শুরু করলো। এত হাসির মাঝেও আমি আর মেহের সহজ হতে পারলাম না। কারণ,, ঘটনাটি আমাদের দুজনের জন্য ভীষন লজ্জাজনক ছিল।
এরপর,, টানা একসপ্তাহ মেহের কলেজে আসেনি। আমি তো রোজ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য। অষ্টমতম দিনে সে এলো ধুসর রঙা শাড়ি পরে। তাকে প্রথমবারের মতো শাড়িতে দেখে মনে হয়েছিল শাড়ি নামক স্পেশাল এই বস্তুটাকে আমি এর আগে কখনো দেখেনি। মেহের পরেছে বলেই আজ চিনতে পারলাম। আমি যখন আড়চোখে মেহেরকে দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনি শাড়ি পরিহিতা মেহের মাথা নীচু করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। খুব কাছাকাছি নয় আবার বেশ দূরেও নয়। প্রথমবারের মতো সেদিন মেহের আমার সাথে সরাসরি কথা বললো। সেদিনকার ঘটনার জন্য সরি বললো। আমি তাকে কিছুই বলতে পারলাম না। বলব কি করে কথা এসে গলায় আঁটকে আছে।
আমার নিরবতা দেখে মেহের ভাবলো আমি হয়তো ওকে ক্ষমা করতে পারিনি। তাই মেহের মন খারাপ করে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো। আমি তো আর মেহেরের মন খারাপ হতে দিতে পারি না তাই। অনেক কষ্ট করে গলা দিয়ে কিছু শব্দ উচ্চারণ করলাম,, বলেছিলাম,,
— আমার বন্ধু হবে?? যদি বন্ধু হও তবে সবকিছুর জন্য মাফ।
আমি কথাটি বলার পর আহাম্মক হয়ে ভাবছিলাম আসলেই কি মেহেরকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দেয়া উচিত হয়েছে? আমি কি ভেবে ওকে এমন প্রস্তাব দিলাম? যাকে দেখলে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচি। তাকে হয়তো ভালোবাসি বলব নয়তো বিয়ের প্রস্তাব দিব। তা না করে আমি কি করলাম বন্ধু হবার জন্য অফার করলাম!
— মেহের রাজি হয়েছিল??
রুমানা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো আহনাফকে। আহনাফ হাসি দিয়ে বললো,,
— হুম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে রাজি হয়েছিল। সেদিন থেকে তার সঙ্গে আমার নতুন অধ্যায় শুরু হলো। আমি তাকে রোজ একটু একটু করে ভালোবেসে শেষ হচ্ছিলাম অথচ তাকে বলার মতো সাহস আর পরিস্থিতি কিছুই তৈরি হলো না। যদি সাহস করে “ভালোবাসি” বলতে যেতাম তবে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ হয়ে যেত। তাই সাহস জুটিয়ে ভালোবাসার কথা জানাতে পারলাম না ওকে।
দশটি বছর একসাথে আমাদের পথচলা। মেহেরকে নিজের করে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা মনে রেখে দিব্যি চলছিলাম। একদিন হুট করে মেহের এসে জানালো,,,
“সে কাউকে ভালোবাসে?? তাকে না পেলে মেহের মরে যাবে।”
মেহেরের বলা দুটো বাক্য যথেষ্ট ছিল আমার পুরো জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়ার জন্য। আমি সহ্য করতে পারিনি। রাগে দুঃখে সেদিন জীবনের মস্ত বড়ো ভুল আমার দ্বারা হয়েছিল।।
আহনাফের চোখেমুখে অস্বস্তি ফুটে ওঠে। রুমানা এরপরের ঘটনা জানে তাই আর জোর করলেন না আহনাফকে বলার জন্য। সোফা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। আহনাফ রুমানার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো।
— বাকি ঘটনা আমি জানি আহনাফ। তাই জানার ইচ্ছে নেই। আমি এসেছিলাম শুধু তোমার পক্ষের ঘটনাটুকু জানতে। জানতে পারলাম এতটুকুতেই সন্তুষ্ট আমি৷ জানি না আমার মেহেরের ভাগ্যে কি আছে?? কিন্তু,, তোমাকে এতটুকু বলে রাখি মেহেরের সম্মান এতটুকু যেন তোমার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়৷ গতকাল যা কিছু হয়েছে সব আমার কানে এসেছে। এরকম ঘটনা পুনরাবৃত্তি হোক আমি চাই না।
— খালা আসলে গতকালের ঘটনা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটেছে। এতে মেহেরের কোনো দোষ নেই৷
— আমি জানি মেহেরের দোষ নেই। কিন্তু,, সমাজের লোক??
আহনাফ মাথা নীচু করে ফেললো। রুমানা কাঁধের ব্যাগ থেকে একটি কার্ড বের করে আহনাফের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আহনাফ প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে রইলো রুমানার দিকে। রুমানা রহস্যময় হাসি দিয়ে কিছু না বলে আহনাফদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।
আহনাফ কার্ডটা খুলে ভেতরের ভারি কারুকাজে সজ্জিত কাগজটার লেখাগুলো পড়লো।
বিয়ের ইনভিটেশন কার্ড। বরের জায়গায় নাম লেখা রেদওয়ান জামান বৃত্ত। কনের জায়গায় নাম লেখা,, মেহনুবা খান মেহের।
আহনাফের হাত থেকে কার্ডটা মেঝেতে পরে রইলো অনাদরে। আহনাফের ভেজা চোখ তখন মেহেরকে হারানোর বেদনায় মত্ত।
#চলবে