শরৎের_তৃতীয়_দিবস-০৫

0
124

#শরৎের_তৃতীয়_দিবস-০৫
#Tahmina_Akhter

—সখি ভালোবাসা কারে কয়???

সবে মাত্র একটি গ্রাহককে বিদায় করে চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করব ভেবেছিলাম। কিন্তু,, তা আর হলো কই?? সয়ং,, আহনাফ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিমূর্তি হয়ে। মানে ওকে কেউ যদি দেখে বলবে হয়তো পাগল নয়তো কাউকে খুন করার বর পেয়েছে আজ। ওর রিয়াকশন দেখে অবাক হয়েছি বটে কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয়েছি ওর বলা গানের একটি লাইন শুনে!

—- কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন?? নাকি মনের কোণে ফাগুনের হাওয়া বইছে?

— দেখো আহনাফ এটা পাব্লিক প্লেস সিনক্রিয়েট করো না।

কথাটি বলে আরও একবার সবার ডেস্কের দিকে তাকালাম। না সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত । আহনাফ তো আমার ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তো এমনসময় একজন গ্রাহক এসে আহনাফকে অনুরোধের সুরে বললো,,,

— ভাই একটু তাড়াতাড়ি করেন। যতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি বিশ্বাস করেন যদি টিসিবির গাড়ির পেছনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম তবে কম সমমূল্যের বাজার পেতাম।

আহনাফের পেছনে দাৃড়িয়ে থাকা লোকটার কথা শুনে কেন যেন আমার হাসি পেলো! এতটাই জোড়ে আমার মুখ দিয়ে হাসির আওয়াজ বের হলো যে পুরো ব্যাংকের মানুষ আমার দিকে ইয়া বড়ো বড়ো চোখে তাকালো। ভাগ্যিস মানুষের চোখে সাধারণ। যদি গুলি চালানোর ব্যবস্থা থাকত এই চোখে তবে প্রত্যেকটা বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে গুলি বের হতো। ডিসকিআও,,, ডিসকিআও,,,ফুওওওও।

ম্যানেজার স্যার এসেই আমার ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে আহনাফের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। দু-তিন সেকেন্ড পর স্যারের চেহারা স্বাভাবিক দেখালো। এতটাই স্বাভাবিক দেখালো যে মনে হলো আজ স্যারের জীবনের শান্তি দিবস।

— তুমি না মানে সরি আপনি মেয়র সাহেব নওয়াজ স্যারের ছেলে তাই না?

আমি দেখলাম আহনাফ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো। ম্যানেজার স্যার যেমন তেমন কিন্তু আহনাফের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার রিয়াকশন দেখে মনে হচ্ছে উনার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজ বুঝি আজই পেলেন।

— এহেম.. মেহের??

— জি ; স্যার?

— স্যার কেন এসেছেন ব্যাপারটা দেখো? আর স্যার আপনি বসুন আমি আপনার জন্য চা নাকি কফি কিংবা কল্ড ড্রিংকস নিয়ে আসব?

ম্যানেজারের কথায় আহনাফ প্রচুর বিরক্ত হয়ে জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো,,,

— আমি চা,,কফি,, কোল্ড ড্রিংকস চাইতে এসেছি এখানে!!! আমার মেহেরকে দরকার। এই মূহুর্তে মেহের আমার সঙ্গে না গেলে আই সয়্যার আমি কি করব আপনারা কল্পনা অব্দি করতে পারব না!

ম্যানেজার স্যার আহনাফের কথায় এতটা ভড়কে গেলেন যে মেহেরের সামনে হাত উচু করে বিনীত অনুরোধ করলো যেন এই মূহুর্তে আহনাফের সঙ্গে চলে যায়। মেহের এবার যথেষ্ট বিরক্ত হলো আহনাফ ওপর। যেখানে-সেখানে ওর এমন দাপটে ভাব পছন্দ না। কিন্তু,,,, কিছু বলতেও যে পারে না ওকে।

মেহের ওর ডেস্কের ওপর থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলো। আহনাফ এতক্ষণ যার জন্য অপেক্ষা করছিল তাকে হাতের নাগালে পেয়ে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে তড়িঘড়ি করে হেঁটে যাচ্ছে ব্যাংকের বাইরে।

আহনাফের তাড়াহুড়ো দেখে মেহের জিজ্ঞেস করলো,,,

— কি হয়েছে?? এত তাড়াহুড়ো করছো কেন???

মেহেরের কথায় জবাব দিল না আহনাফ। রাস্তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একমিনিট পর কালো রঙের একটা কার ওদের সামনে এসে ব্রেক কষলো। কারের দরজা খুলে মেহেরকে বসিয়ে আহনাফ বসলো। ড্রাইভার এবার গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হলো।

মেহের গাড়িতে বসার পর দু’বার আহনাফকে জিজ্ঞেস করেছে যে ওরা কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু,, আহনাফ এবারও নির্বাক। মেহের যখন বিরক্তের চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং কঠিন কিছু কথা বলার জন্য মুখ খুলবে ঠিক তখনি গাড়ি থেমে যায়। আহনাফ গাড়ি থেকে নেমে মেহেরের পাশের ডোর খুলে ওর হাত ধরে নামালো। মেহের আহনাফকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না। কারণ,, জায়গাটা বড্ড চেনা। এই জায়গায় যে জীবনের সবচেয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল মেহেরের।

— এখানে কেন নিয়ে এসেছো আমায়???

মেহেরের কথায় আহনাফ জবাব দিতে গিয়েও দেয় না। শুধু এতটুকু বললো,,

— ভেতরে চলো সব জানবে।

আহনাফের কথায় পাল্টা জবাব দিতে পারলো না মেহের৷ আহনাফ ভেতরে চলে যায়। মেহের কিছু একটা ভাবলো তারপর সেও ভেতরে চলে যায়।

সেই একই টেবিল,, দুটো চেয়ারে আহনাফ আর মেহের বসে আছে। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের বন্ধু শোভন আর শিম্মি। সামনে চেয়ারে বসে থাকা সেই দাঁড়িওয়ালা,, পেট ভারি কাজি সাহেব। যে কিনা মুখভর্তি পান চিবুচ্ছে আর একটু একটু পর চপাত চপাত করে পানের পিচকি ফেলছে জানালার সামনে গিয়ে। যদিও লোকটার এমন বদঅভ্যেস মেহেরের দেখতে মোটেও ভালো লাগে না কিন্তু অনুপোযোগী সময়ের কারনে কিছু বলতেও পারছে না।

— বিয়ে করতে আসছেন??

কাজি সাহেব মুখে পান নিয়ে প্রশ্ন করলেন। মেহের চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। আহনাফ মেহেরের দিকে একপলকের জন্য তাকালো। মেহের আহনাফের দিকে তাকানোর আগে নিজের চোখ ফিরিয়ে কাজি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,,,

— বিয়ে তো আটমাস আগেই করেছি। তাও আপনার সামনে; মনে নেই আপনার?

—- কত বিয়ে করাই এতজনকে মনে রাখব কেমনে? বিয়া করবা না তাহলে কাজি অফিসে আসছো কেন? ডিভোর্স দিবা নাকি???

“ডিভোর্স” শব্দটা শুনে আহনাফ-মেহের একে-অপরের মুখের দিকে তাকালো। দুজনের চোখে কিছু তো একটা ছিল তখন। হারানোর বেদনা হয়তো!! মেহের চোখে স্পষ্ট কিছু দেখলো না ঝাপসা হয়ে আসছে সব। চোখের পানিগুলো ইদানীং বেহায়া হয়ে গেছে যখনতখন ফুরিয়ে বের হয়ে আসে!

— জি ; ডিভোর্সের জন্য এসেছি।

আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো মেহের। এতটা নিষ্ঠুর সে যদি একটিবার টের পেতো মেহের। তবে এমন নির্দয় মানুষকে মন দেয়া তো দূরের কথা ছায়ার কাছেও আসার সুযোগ দিতো না।

আহনাফ জানতে চায় মেহেরের মনের কথা। আজ সবটা জেনে তবেই মেহেরকে মুক্ত করে দিবে এই মিথ্যা বিয়ে নামক সম্পর্ক থেকে। যেই বিয়ের কোনো স্বীকৃতি নেই অন্তত সেই বিয়েকে বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে নেই!

আজই সবকিছুর শেষদিন। ফয়সালা আজই হবে। হয়তো এপাড় নয়তো ওপাড়।

*****************

— ম্যাডাম আপনে খালি একবার আমারে তার ঠিকানা দেন। তারে আমি এক পলকের মইধ্যে ধইরা আনব আর আপনের সামনে হাজির করব। আমার ম্যাডাম তারে এত পছন্দ করে আর সে কিনা পাত্তা না দিয়া গায়ে হাওয়া লাগিয়ে উড়ে বেড়ায়??

মিজানের কথা শুনে রুমানা ভ্রু কুঞ্চিত করে সোফায় হেলান দিয়ে বললেন,,

— দেখো আবার নাম শুনে ভয়ে তোমার হাঁটুতে কাঁপা-কাঁপি না শুরু হয়ে যায়?

— আমি হইলাম বাগেরহাটের পোলা। বাগেরহাট শব্দটা নিয়া একটু গভীরভাবে ভাবলে টের পাইয়া যাইবেন। বাগেরহাটে মানে হইলো যেহানে বাঘ বেচাকেনার হাট বয়।

মিজানের যুক্তি শুনে রুমানা তব্দা খেয়ে চুপ হয়ে গেলেন। বাগেরহাট নামক অঞ্চলের যে এতটা ঐতিহাসিক বর্ণনা শুনতে পারবেন তিনি কখনো ভাবেননি।

— নওয়াজ চৌধুরীকে তো চেনো এখানকার মেয়র?

রুমানা এবার মিজানের সাহস কতটুকু তা যাচাই করার জন্য মিজানকে পরিচয়টা দিয়েই ফেললো।

— জি ম্যাডাম। উনারে কে না চেনে?

—উনার ছোট ছেলে আহনাফ চৌধুরীর সাথে কোনো এককালে তোমার ছোট ম্যাডামের বন্ধুত্ব ছিল। আর সেখান থেকে ঝামেলা শুরু বুঝলে। এখন বলো মেয়রের ছেলেকে কি করে টাইট দিব?

চটপটে মিজান এবার চুপসে যায়। কোনো কথা বলে না। কথার মেমরিকার্ড হয়তো ফরম্যাট হয়ে গেছে? রুমানা মিজানের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। চারপাঁচ সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর মিজান আস্তে আস্তে রুমানার সামনে থেকে সরে যায়। এতটাই সরে যায় যে ওকে একশ হাত দূরত্ব পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মিজান আকাশপাতাল ভাবনা মাথায় নিয়ে যখনি বাগানের পথ অতিক্রম করে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি দেখতে পেলো ওর ম্যাডাম মেহের। তবে আজ ম্যাডাম একা আসেনি সাথে একজন পুরুষ আছে। মিজান একপ্রকার দৌঁড়ে যায় মেহেরের সামনে। দেখার জন্য যে মেহেরের সঙ্গে আজ কে এসেছে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here