শরৎের_তৃতীয়_দিবস-০৬

0
130

#শরৎের_তৃতীয়_দিবস-০৬
#Tahmina_Akhter

—-ঠাসস,,ঠাসস

দুটো থাপ্পড়ের শব্দে পুরো কক্ষ জুড়ে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। শোভন আর শিম্মির রিয়াকশন আপাতত বড়ো রকমের হ -া হা। কাজি সাহেব নিজের দুটো গালে দুহাত দিয়ে রেখেছেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে থাপ্পড় দুটো উনার গালে পরেছে।

আহনাফ বিস্মিত হয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইলো। শান্তশিষ্ট মেহের যে রণমুর্তি ধারন করবে আহনাফ কি তা জানত! গালদুটো বেশ জ্বলছে। কিন্তু,, আপাতত সেদিকটা না ভেবে মেহেরের কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে আহনাফ ভাবছে আসলেই কি আহনাফের দ্বারা কোনো ভুল হয়েছে???

— নিজেকে কি ভেবেছো? যখন ইচ্ছে কাছে আসবে আবার যখন ইচ্ছে হবে দূরে চলে যাবে! কখনো জানতে চেয়েছো আমি কি চাই? আমি তোমাকে আমার জীবনে চাই কিনা? হুট করে কারো জীবনের দখলদারি করবে আবার হুট করে ক্ষমতা ছেড়ে দিবে! ডিভোর্স দিবে তো দ্যান ফাইন আমিও তোমাকে আজ ডিভো…

বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলো না মেহের তার আগেই আহনাফ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। এতটুকু স্পর্শের বুঝি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। বিড়াল ছানার মতো নরম স্পর্শ পেয়ে আহনাফের বুকে নাক ডুবিয়ে কাঁদতে থাকে মেহের। কক্ষে যে আরও তিনজন প্রাণী আছে তা বোধহয় আহনাফ কিংবা মেহেরের স্মরণে নেই।

হুট করে মনের দৃশ্যপটে অতীতে ঘটে যাওয়া আহনাফের করা কর্মকান্ড একে একে দৃশ্যমান হতে থাকে মেহেরের মনে ৷ কাজি অফিসে এনে জোরপূর্বক বিয়ে করা। তারপর,,দূরে ঠেলে দেয়া এই বলে যে মাথা ঠিক ছিল না তাই এমন কান্ড করে বসেছে। মেহেরের কাছ থেকে সে কোনোদিনও স্ত্রীর অধিকার চাইবে না। মেহের যাকে ভালোবাসে তার কাছে ফিরে যেতে পারবে। বিয়েটা যেমন গোপনভাবে হয়েছে ঠিক সেভাবেই ওদের বিচ্ছেদ ঘটবে। প্রতিউত্তরে সেদিন মেহের কিছুই বলতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দশ বারো দিন কাটিয়ে দেয়। ভেবেছিল হয়তো আহনাফ ফিরে আসবে কিন্তু না ও ফিরে আসেনি। বরং,, আহনাফের কাছের এক বন্ধু একদিন কল করে বললো,,আহনাফ ইন্ডিয়ায় গিয়েছে ওখানে ওর প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে। ব্যাপারটা কাকতালীয় কিনা জানা নেই। নাকি প্রকৃতির নেয়া কোনো প্রতিশোধ! নয়তো,, মেহের কেন সেদিন আহনাফের বন্ধুর কল রিসিভ করে ভয়ংকর কথাখানি জানতে পেরেছিল! সময়ের ঘূর্ণনে আজ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ-মেহের। তখনও মনে সংশয় ছিল আজও আছে। মেহেরের মনে আহনাফের জন্য সেই আগের মতো ভালোবাসা আছে কিন্তু আহনাফের মনে?? আগেরবার যেভাবে তার সঙ্গে ছলনা করলো এবার যে করবে না তার নিশ্চয়তা কি?

— আহনাফ??? এই আহনাফ???

শোভনের ডাকে আহনাফের ঘোর কাটলো। মেহেরকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মেহের তো এবার লজ্জায় হোক কিংবা অস্বস্তির কারণে কারো দিকে তাকাতে পারলো না।

আহনাফ আর মেহেরের কান্ডে কাজি সাহেব সহ,, শোয়েব,, শিম্মি হাসতে থাকে। ওদের হাসি দেখে মেহের পারছে না পাতালে ঢুকে নিজের পুরো শরীর ঢুকিয়ে দেয়। আহনাফ মাথা চুলকানোর ভাব নিয়ে কাজি সাহেবকে বললো,,,

— আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার এত মূল্যবান সময় আমাদের পেছনে ব্যয় করার জন্য।

— একটা সংসার বাঁচান মানে আল্লাহর ঘর মসজিদ বাঁচান। আমার আম্মায় বলতো কথাটা। আমিও সেই ছোটকাল থেকে এই কথা শুনে নিজেকে সেইভাবে প্রস্তুত করেছি। আমার কাজি অফিসে আজ পর্যন্ত কোনো তালাক হয় না। বলতে গেলে আমি করতে দেই নাই। মন চাইলে কোর্টে যাও তবুও আমি পারব না। দোয়া করি তোমরা যেন ভালো থাকো সুখে থাকো। রাগ-অভিমান তো সব সংসারে থাকে তাই বইলা তালাক দিবা এটা ঠিক না। যাও ; বাড়িতে যাও।

কাজি সাহেবের কথায় শোভন,,শিম্মি আর আহনাফ মুগ্ধ হলো। শুধু মুগ্ধ হতে পারলো না মেহের। কারণ,, পর মাথায় আপাতত যা চলছিল তা হলো যা কিছু কাজি অফিসে ঘটেছে সবটাই ছিল প্রি-প্ল্যানড। মানে এত বড়ো ধোঁকা!!! তারমানে আহনাফ এবারও ওর মন – অনূভুতি সবটা নিয়ে খেলছে!!

আহনাফকে কিছু না বলেই মেহের কাজি অফিস থেকে বের হয়ে সোজা একটি রিকশায় চড়ে। মেহেরকে ওভাবে চলে যেতে দেখে আহনাফ পেছন পেছন রাস্তায় আসে। ততক্ষণে দেরি হয়ে যায় কারণ মেহেরের রিকশা তখন নিজ গন্তব্যের পথে রওনা দিয়েছে। আহনাফের পেছনে এসে শোভন আর শিম্মি এসে দাঁড়ায়। আহনাফ পেছন ফিরে ওদের দিকে তাকিয়ে নিজের কপালে হালকা চাপড় মেরে বললো,,,

— ভাই রে আমার জীবনটা আর আমার নাই। মেহের যবে থেকে আমার জীবনে এলো সেদিন থেকে ছিনিমিনি খেলছে। কবে যে নিস্তার পাব কে জানে?

শোভন আহনাফের কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,,

— ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যত যুদ্ধ করবি ততই তার মনের ঘাটিতে শক্ত অবস্থান করতে পারবি। ভালোবাসতে পারলি কিন্তু সহ্য করে ভালোবাসার কাঁটার গুঁতো সহ্য করতে পারবি না তা তো হবে না বন্ধু।

শোভনের কথার মমার্থ বুঝতে পারলো আহনাফ। ওদের দুজনকে বিদায় দিয়ে মেহেরের খালার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো আহনাফ। এখন যেহেতু মেহের ওকে চায় তবে কোনো বৃত্ত ফিত্তের সঙ্গে বিয়েটিয়ে হবে না। এটাই গিয়ে বলতে হবে।
যাব মিয়া বিবি রাজি তো ক্যেয়া কারে গা কাজি!!

কিন্তু,, আহনাফ তো জানতে পারল না মেহের কতটা ভাঙা হৃদয় নিয়ে সে জায়গা থেকে প্রস্থান নিয়েছে!

মেহের রিকশা থেকে নামার পর আহনাফের গাড়িটা দেখতে পেলো ওর খালার বাড়ির গেটের সামনে। মেহের পেছনে ঘুরে ফিরে যাওয়ার জন্য কিন্তু আহনাফ মেহেরের হাত ধরে টেনে ধরে। মেহের পেছনে ফিরে আহনাফের দিকে তাকায়। সেই চোখ কিছু তো একটা বলছিল আহনাফকে। দৃষ্টির মর্মাথ বুঝতে পারে আহনাফ। এবার আহনাফের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা মিললো। তবু্ও,, মনের কোণে সাহস আছে যে সবটা সামলাতে পারবে সে। যদি পৃথিবীর বাইরে গিয়ে বাঁচতে হয় ; এর বিনিময়ে মেহেরকে পাবে তবে তাই সই।

আহনাফ এবার মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বললো,,

— বিশ্বাস করিস তো আমায়???

আহনাফের কথায় তাচ্ছিল্যের সুরে মেহের বললো,,,

— তোমাকে বিশ্বাস করব কিন্তু কেন?? বিশ্বাস করার মতো এমন কোনো কাজই তুমি করোনি। আমার কাছ থেকে কেবল কেড়ে নিয়েছো। বহুবার সুযোগ নিয়েছো এবার আর নয়।

আহনাফ মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ,, এই মেহেরকে সে চেনে না। যেই মেহের আহনাফের হৃদয়ে বসবাস করে সেই মেহের তো কেবল ভালোবেসে মিষ্টি চোখে তাকায়। কথা বলার সুর নদীর ঢেউয়ের তালের মতো। যাকে দেখলে আহনাফ আশেপাশের দুনিয়ার খবর থেকে বেখবর হয়ে যায় সেই মেহের তো ওমন কাটা কাটা কথা বলতে পারে না!

— আজকের পর থেকে আমি তোমাকে আমার আশেপাশে দেখতে চাই না। খালা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে আর আমারও এই বিয়েতে…

বাকি কথা সম্পূর্ণ করার আগে মেহেরের গালে একটি থাপ্পড় মেরে দেয় আহনাফ। রাগে আহনাফের পুরো শরীর কাঁপছে। ভালোবেসেছে ঠিকই তবে এতটা সাহস তো মেহেরকে দেয়নি যে বিচ্ছেদের মতো ব্যাপার ওদের মাঝে টেনে নিয়ে আসবে! মরে গেলে তবেই মেহের ওর কাছ থেকে মুক্ত হবে তারআগে নয়।

— তুই আগেও যেমন মাথা মোটা ছিলি এখনও তাই আছিস। এই তোকে যে আমি ভালোবাসি কিংবা পছন্দ করি এটা কি তোর মাথায় একবারও আসেনি? আরে মেয়েদের নাকি অসীম ক্ষমতা থাকে ছেলেদের মন বোঝার। আরে তোকে সরাসরি না হয় ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি কিন্তু ইনিয়েবিনিয়ে কম তো বুঝানোর চেষ্টা করিনি। তুই বল কোনো ছেলেবন্ধু তার মেয়েবন্ধুকে নাকের ফুল উপহার দেয়? কোন ছেলেবন্ধু তার মেয়েবন্ধুকে রাত-বিরেতে কল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে? কোন ছেলেবন্ধু তার মেয়েবন্ধুর অসুস্থতার কথা শুনলে পাগলের মতো দৌড়ে যায় রাত তিনটা বাজে শুধুমাত্র একটুখানি তার মুখটা দেখার জন্য? তুই তো বুঝবি না কারণ তুই একটা মাথামোটা। তুই শুধু জানিস কি করে কাগজেকলমে হিসেব শেষ করে নতুন হিসেব খুলতে হয়। তুই একটা মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা নিয়ে জন্মাসনি মেহু।

মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। মানুষটা যা বলছে তা কি সত্য! নাকি মেহের ভুল শুনছে। যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে এতকিছু করার খুব কি প্রয়োজন ছিল? যেদিন তিন কবুল বলে স্ত্রী বানালো সেদিন মেহেরের চোখে চোখে রেখে বলে দিত,, মেহু রে আমি তোকে ভালোবাসি।

— এতদিন বললে না কেন??? কেন আমাকে তোমাকে না পাওয়ার দহনে পুড়িয়ে কয়লা বানালে? প্রতিনিয়ত কেন নিজেকে ছোট ভাবতে বাধ্য হতাম যে আমার মতো এতিম মেয়ে আহনাফ চৌধুরীকে পাওয়ার যোগ্য নয়। কেন বিয়ে করার পরও নকল প্রেমিকার খবর সাজিয়ে আমার কাছে পাঠালে??

অশ্রু জমা টলমলে চোখে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। মেহেরের চোখের পানি যে কোনোকালেই আহনাফের পছন্দের ছিল না। আজও সহ্য করতে পারল না। মেহেরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুচোখের পানি মুখে মুছে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,,

— “ভালোবাসি” বলতে ভয় পেতাম যে তাই। ভালোবাসার দাবি নিয়ে তোর সামনে দাঁড়ালে তুই যদি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে দিস এই কারণেই আমি তোর সামনে যেতাম না একবুক ভালোবাসা নিয়ে। তোর সামনে যেত ভালোবেসে প্রতিনিয়ত ভেঙেগুড়ে যাওয়া একটি দূর্বল দেহ। যার দেহ ছিল,, প্রাণ ছিল কিন্তু ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য ছিল না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here