[ ১৮+ সতর্কতা ]
গল্পঃ শাপলার মৃত্যু
পর্বঃ ৩
জনরাঃ থ্রিলার
লেখিকাঃ আতিয়া আদিবা
ক্রাইম সিনের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রাইসুল সিগারেট ফুঁকছে। তিনি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। নরম আলোয় মাখা আজকের এই সকাল ভীষণ ঝলমলে, প্রাণবন্ত। নদীতে ক্ষীণ স্রোত বহমান। এরকম সুন্দর একটি সকালে অসুন্দর এবং অশোভন মুহূর্তের সাক্ষী হচ্ছে রাইসুল।
তার টীম এখনো ক্রাইম সিন পর্যবেক্ষণ করছে। কথায় আছে, There is no perfect crime, only imperfect investigation. তাই তদন্ত হতে হবে নিখুঁত।
নিরূপমা ক্রাইম সিনে পৌঁছালো ঠিক এগারোটা ত্রিশ মিনিটে। রাইসুল এগিয়ে এসে হাত মিলিয়ে তাকে স্বাগত জানালো।
‘হ্যালো মিসেস চক্রবর্তী। ওয়েলকাম ব্যাক টু দ্যা ফিল্ড।’
নিরূপমা হেসে বলল,
‘থ্যাংক ইউ দাদা।’
‘আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো?’
‘না। কোনো সমস্যা হয় নি।’
‘ঠিকাছে। বাকি কথা পরে হবে। লেটস গেট ব্যাক টু ওয়ার্ক’।
রাইসুল নিরূপমাকে নিয়ে ক্রাইম সিনের সামনে গেলো। বলল,
‘একবার ভেতরে গিয়ে দেখে এসো।’
ইতোমধ্যে ক্রাইম সিনের চতুর্দিকে হলুদ রঙের ফিতা দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নিরূপমা হলুদ ফিতা ধরে তার নিচ দিয়ে ক্রাইম সিনে প্রবেশ করল। শাপলার লাশ যেখানে ছিলো সেখানে চক দিয়ে এঁকে রাখা হয়েছে। নিরূপমা লক্ষ করল, লাশের মাথার ঠিক বা পাশে চক দিয়ে একটি বৃত্ত আঁকা। সে জিজ্ঞেস করল,
এখানে কি ছিলো?
পাথর। ক্রাইম সিন থেকে পাওয়া একমাত্র বস্তু, যার সাহায্যে মার্ডার করা হয়েছে। পাথরটি পরীক্ষার জন্য ফরেন্সিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। চব্বিশ ঘন্টার আগে ফরেন্সিক থেকে কোনো রিপোর্ট পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
ঠিকাছে।
নিরূপমা ক্রাইম সিন থেকে বের হয়ে এলো। বলল,
আমি তাহলে গ্রামের সবার সাথে একটু কথা বলে দেখি। এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। কার মনের অবস্থা কেমন, তা জানা প্রয়োজন।
রাইসুল তার টীম থেকে জাফর নামের একজনকে ডাক দিল।
নিরূপমা। ইনি অফিসার জাফর। নতুন জয়েন করেছে। ইনভেস্টিগেশন এর সময় ইনি তোমার সাথে থাকবে।
ওকে, দাদা।
ঠিকাছে। এই টেরিটোরি এখন তোমার। তুমি তোমার তদন্তের কাজ শুরু করো। উই উইল টক অভার ফোন।
শিওর।
রাইসুল তার জীপে গিয়ে বসলো। জাফর নিরূপমাকে জিজ্ঞেস করল,
ম্যাডাম, প্রশ্নপর্বের কাজটা কি ভিক্টিমের বাসা থেকে শুরু করবেন?
নিরূপমা মিষ্টি করে হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
*
মনোয়ারা রান্না করছে। তার ঠোঁটের কোণায় রক্ত। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। হোসেন বাড়িতে নেই। বাহিরে গেছে। তবে যাওয়ার আগে মনোয়ারাকে প্রহার করতে ভুলে নি। প্রহার করার কারণ, মনোয়ারা দুপুরে রান্না করতে চায় নি। গত রাতেও বাড়ির চুলায় আগুন জ্বলে নি। মাঝ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত তারা শাপলার নিথর দেহের পাশেই স্থির ছিল। দুপুরেও হোসেন না খেয়ে থাকবে নাকি?
কপালে ছিলো তাই মেয়ে মারা গেছে। হোক সে খুনের শিকার! মামলা মোকাদ্দমার ঝামেলা হোসেন চায় না।
অফিসার জাফর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ল।
‘কেউ আছেন?’
মনোয়ারা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
জ্বি।
জাফর নিরূপমাকে দেখিয়ে বলল,
ম্যাডাম আপনার সাথে একটু কথা বলবে।
মনোয়ারা কপালের ঘোমটা ঠিক করতে করতে বলল,
কি বিষয়ে?
আপনার মেয়ে শাপলার বিষয়ে।
মনোয়ারার মুখে অন্ধকার নেমে এল। সে নিচু স্বরে বলল,
আমার স্বামী অহন বাড়িত নাই। যখন আসবো তার লগে কথা কইয়েন। এই বিষয়ে আমি কিছু কইতে পারমু না।
নিরূপমা মনোয়ারার দিকে এগিয়ে গেলো। ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
আপনার ঠোঁটের পাশে কি হয়েছে? রক্ত জমে আছে যে!
মনোয়ারা ইতস্তত করে বলল,
কিছু হয় নাই। আপনারা অহন যান। আমি ব্যস্ত আছি।
নিরূপমা বলল, দেখুন! আপনার মেয়েকে কেউ নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। আপনি চান না আপনার মেয়ের খুনি শাস্তি পাক?
মনোয়ারার গাল গড়িয়ে পানি পড়ল। সে হেসে বলল,
আফা চাওয়া পাওয়ার হিসাব বাদ দিছি মেলা আগে। আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া পাওয়া নাই। আফনারা চইলা যান।
মনোয়ারা কথা বাড়ালো না। রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
অফিসার জাফর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
ম্যাডাম, এ মহিলা তো বহুরূপী। সারা সকাল মেয়ের খুনির বিচার চেয়ে আকাশ কাঁপিয়ে কাঁদল। আর এখন আমাদের সাহায্য করতে নারাজ।
নিরূপমা হেসে বলল,
জাফর সাহেব। উনি অবশ্যই আমাদের সাথে কথা বলবেন। মহিলা ভায়োলেন্সের শিকার। বেধড়ক মারা হয়েছে তাকে। সেজন্যই এখন চুপসে আছে। উনি স্বাভাবিক হলেই আমাদের সাথে কথা বলবেন। এক কাজ করি চলেন। আমরা প্রতিবেশীদের সাথে সাক্ষাৎ করে আসি। ইনভেস্টিগেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো কি কি জানেন তো?
জানি। ম্যাডাম। Who – What – Where – When – How.
এক্স্যাক্টলি। ‘Who’ এর এন্সার খোঁজার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীরাই আমাদের সবচেয়ে বড় উপকারে আসবে।
তাহলে ম্যাডাম, মকবুলের বাড়িতে যাবেন?
মকবুলটা কে?
লাশের কাছে সর্বপ্রথম মকবুলই গিয়েছিলো।
যাবো তো অবশ্যই। তবে এখন নয়। আগে যাবো পাশের বাড়িতে। কেননা, নিজের বাড়ির খবর সে বাড়ির মালিক ছাড়া যদি আর কেউ ভালো জেনে থাকে – তাহলে তা পাশের বাড়ির ভাবী অথবা আন্টিরাই হয়।
জাফর হেসে ফেলল।
নিরূপমা জাফরকে নিয়ে পাশের বাড়িতে গেলো। বাড়ির মালিক মনির এবং তার স্ত্রী রমলা দুজনকেই সেখানে পাওয়া গেলো। তারা সাদরে নিরূপমা এবং জাফরকে বসার ব্যবস্থা করে দিলো। মনির ব্যস্ত হয়ে স্ত্রীকে বলল,
কই গো! স্যার ম্যাডামের জন্য খাবার পানির ব্যবস্থা করো।
নিরূপমা বলল,
না না। এত আয়োজন করার প্রয়োজন নেই। আমরা এমনি কথা বলতে এসেছি।
মনির বলল,
তা যে কাজেই আসেন। গ্রামে আমার একখান ইজ্জত আছে না? আমার বাড়িতে আইয়া না খাইয়া যাবেন। এ আমি সহ্য করুম না।
নিরূপমা অসহায় ভঙ্গিতে জাফরের দিকে তাকালো। জাফর একটু কঠিন গলায় মনিরকে বলল,
দেখেন আমাদের হাতে সময় কম। খাবারের ব্যবস্থা করার দরকার নেই। আপনার স্ত্রীকে ডাকুন। আমরা কথা বলে চলে যাবো।
মনির নাছোড়বান্দা। এক কাপ চা হলেও খেতে হবে। অবশেষে নিরূপমা এবং জাফর দুজনেই চা খেতে রাজি হল। কিছুক্ষণের মাঝে মনিরের স্ত্রী রমলা বড় প্লেটে দু কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে উঠোনে এলো।
নিরূপমা চায়ের কাপে একটি চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা, শাপলার সাথে তার মা-বাবার সম্পর্ক কেমন ছিলো?
রমলা বলল,
মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো আছিলো। মায়ে অনেক আদর করতো। কিন্তু বাপটা ভালো না।
জাফর বলল,
কেন? ভালো না কেন?
রমলা বলল,
মাইয়াডারে হুদাই মারত। আর বউরে তো প্রতিদিনই মারে। আজকেও একটু আগে বাড়ির উঠানে কি হুড়াহুড়িডাই না লাগাইছিলো।
এবার রমলা গলার স্বর একটু নিচু করে বলল,
হের নেশা পানি খাওনের স্বভাব আছে। মেয়ে মাইনষের দোষও আছে। উত্তরে যে খারাপ পাড়া আছে। হেনে তার যাতায়াত আছে।
নিরূপমা সবকিছু বুঝে ফেলেছে এমন ভাবে মাথা নাড়ল।
মনির জাফরের দিকে তাকিয়ে বলল,
আসলে স্যার, জায়গা জমি নিয়া নিজেগো ভাইয়ের মধ্যে একটু সমস্যা আছে। বাপে মরনের আগে জায়গা জমি সব বড় পোলার নামে লিখা দিয়া গেছে। থাকার মধ্যে শুধু এই ভিটাডাই আছে। তাও হের বড় ভাই দিন কয়েক আগে আইয়া চিল্লাচিল্লি কইরা গেছে। এই ভিটা তার পোলার নামে লিখা দিতে কয়। এহন হোসেনের পোলা থাকলে এই ভিটা বাঁচাইতে পারত। মেয়াডা হওনের পর থিকা চেষ্টা করতাছে বাচ্চা নেওয়ার। কিন্তু বাচ্চা হয় না।
রমলা ভীত কন্ঠে বলল,
হব কেমনে? হের বউয়ের তো খারাপ বাতাস লাগছে।
নিরূপমা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
মানে?
হ আফা! হের বউরে নাকি রাইত বিরাতে গ্রামে ঘুরতে দেহা যায়। সাদা কাপড় পইরা।
আপনি কখনো দেখেছেন?
না।
নিরূপমা মনিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
ভীটা মাটি কেন রাখতে পারবে না? আইন অনুযায়ী তো ১/২ ভাগ সম্পত্তির মালিকানা শাপলা পেত।
মনির হেসে ফেলল। বলল,
দ্যাশে কি আইন আছে আফা? সম্পত্তির মামলা হইলো অভিশাপের মত। যে পরিবারে এই অভিশাপ লাগে, সেই পরিবাররে নাইড়া কইরা ছাড়ে। ট্যাহা পয়সা চুইষা লয়।
নিরূপমা কথার সাথে পুরোপুরি অমত প্রকাশ করতে পারল না। মুসলিম আইন সম্পর্কে তার কিছুটা জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়েছে ইন্দ্রজিৎ এর কাছ থেকে।
সে মাথা নেড়ে মনিরের কথার সাথে একমত প্রকাশ করল।
মনির ক্ষণিককাল চুপ থেকে বলল,
আফা একখান কথা কইতে চাই।
কি কথা?
অই মুদির দোকানদার মকবুলরে নিয়া।
(চলবে…)