#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_১২,১৩
#অধির_রায়
১২
প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সমস্ত ছাঁদ। তেজস্বী সূর্য থেকে নিজের ত্বক বাঁচানোর জন্য ওড়না টেনে আমার মুখমণ্ডল ঢেকে নিলাম৷ মাথা নিচু করে ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই বিশাল দেহী কারোর সাথে ধাক্কা খাইলাম৷ মুখপ্রাণে চেয়ে দুই কদম পিছিয়ে আসলাম৷ পিশাচের মতো হাসি দেখে আমি শুকনো ঠুক নিলাম৷ আমতা আমতা করে বললাম,
“ইমন ভাইয়া আপনি এখানে কি করছেন? অসভ্যর মতো আমার পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
ইমন ভাইয়ার চোখে মুখে ভয়ংকর হাসি৷ বাসায় তেমন কেউ নেই৷ তার উপর ইমন ভাইয়ার চোখে মুখে ক্ষিধে দেখতে পাচ্ছি । আমার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন৷ আমি চিৎকার করে বললাম,
“ভাইয়া আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না৷ আমি সব সময় আপনাকে নিজের ভাইয়ার নজরে দেখেছি। সেদিনের মতো ভুল করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না৷”
পিশাচের মতো মুচকি হেঁসে বলল,
“পৃথিবীর সবাইকে বোনের চোখে দেখলে নিজের চাহিদা মেটাবো কাকে দিয়ে? নিজের চাহিদা মেটানোর জন্যই তোমাকে আমি বোনের নজরে দেখি না৷ আমার চোখে তুমি সব সময়ের জন্য হ*টি৷”
আমি ধীরে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছি ইমন ভাইয়ার আমার দিকে এগিয়ে আসছেন৷ আমি ভেজা গলায় বললাম,
“ভাইয়া আমি আপনার পায়ে পড়ি৷ আমাকে ছেঁড়ে দেন৷ আপনি তো বিবাহিত। কেন আপনি এক নারীতে সন্তুষ্ট নয়? অন্যের দিকে নজর দেওয়া মহাপাপ।”
“শ্রুতি আমার বিয়ে করা বউ৷ শ্রুতিকে কাছে টানতে কোন সংকোচ নেই৷ সে নিজের ইচ্ছায় কাছে আসে৷ আমার তো পছন্দ জোর করে কাউকে পাওয়ার৷ জোর করে কাছে পাওয়া বরাবরই আমার ভালো লাগে৷”
ভাইয়ার কথা শুনে ঘৃ*ণা*র নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে৷ পিছনে তাকিয়ে দেখি আমি একদম ছাঁদের কিনারায় চলে আসছি৷ আকাশের প্রাণে তাকিয়ে বললাম,
“হ্যাঁ আল্লাহ আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলাম৷ আমি কিছুতেই নিজের জীবন নরপশুর হাতে তুলে দিতে পারব না৷”
ছাঁদ থেকে লাফ দেওয়ার আগেই ইমন ভাইয়া আমাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেন৷ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলে আমার ঘাড়ে জোরে কা’ম’ড় বসান৷ আমি চিৎকার করে উঠতেই মুখ চেপে ধরেন৷ ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আমার কাছে আসতে তোমার কিসের আপত্তি? আমি তোমাকে সব সময় সুখে রাখব৷ টাকার কোন অভাব পড়বে না৷ চোখে সব সময় সোনা দেখবে৷”
“ছি ভাইয়া! আপনি এতো নিচ মনের মানুষ। শ্রুতি ভাবীর মতো এতো সুন্দর বউ থাকতে আপনি অন্য মেয়ের দিকে কিভাবে নজর দেন? আপনার মতো স্বামী পেয়ে সবার গর্ব করা উচিত৷ কিন্তু আপনাকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে না শ্রুতি ভাবী৷ আমার তো কষ্ট হচ্ছে শ্রুতি ভাবীর জন্য৷ যখন জানতে পারবে তার স্বামী এমন জ*গ*ণ্য কাজ করেন৷
আমার কথায় ভাইয়া আরও রেগে যান৷ ঠাস করে কয়েকটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দেন৷ মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে৷ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে৷ ঠোঁট কেটে যাওয়ার ফলে মুখ থেকে রক্ত ঝরছে৷ সামনে শুধু ইমন ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি৷ চোখ দু’টো লাল টাকবক করছে৷ ইমন ভাইয়া আমার গাল চেপে ধরে বলল,
“আমি কিছুই বুঝি না৷ ইহানের সাথে তোর মেলামেশা কিছুই বুঝতে পারব না৷ যুবক ছেলে কেন তোর প্রতি দুর্বল আমি বুঝতে পারিনা? সব ছেলেরাই দেহের উপর দুর্বল৷ তুই ইহানের কাছে দেহ উৎসর্গ করতে পারিস আমার কাছে কেন নয়?”
“আপনার মস্তিষ্কে খারাপ চিন্তা ভাবনা ছাড়া কিছুই নেই৷ ফুলের মতো মানুষের সাথে আমাকে জড়িয়ে তাকে খারাপ করছেন৷ আপনাকে যতটা খারাপ ভাবতাম তার থেকেও আপনি বেশি খারাপ। অযথা কাউকে কাঁদা ছিড়ালেই সে নোংরা হবে না৷”
আমার চুলের মুড়ি ধরে বলল,
“খারাপের কি দেখছিস? তোকে জোরপূর্বক ভোগ করব৷ তারপর কতটা খারাপ তার প্রমাণ তুই নিজের পাবি৷”
চোখ থেকে অশ্রু অনবরত গড়িয়ে পড়ছে৷ ভাইয়ার এমম ব্যবহারে আমি খুবই লজ্জিত। আমি কিছুতেই নিজের সম্মান ভাইয়ার কাছে বিলিয়ে দিব না৷ জীবন দিতে প্রস্তুত সম্মান নয়৷ ভাইয়া নেশা ভরা কন্ঠে বলল,
“তোর মতো শত শত ভার্জিন মেয়ে আমার পিছনে ঘুর ঘুর করে৷ আমি তাদের এড়িয়ে চলিনা৷ তাদের ভোগ করে যাস্ট ছেড়ে দেয়৷ কিন্তু তোর মতো কাউকে পাইনি৷ তোকে আমার খুব ভালো লাগে৷ তুই যে শ্যাম সুন্দরী।”
ভাইয়ার কুৎসিত কথাগুলো নিজের কাছে বিষের তীরের মতো লাগছে৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না৷ যে পরিবারে সবাই ভালো মনের মানুষ৷ সেখানে কেন এমন নি*র্ল*জ্জ বে*হা*য়া*র জন্ম হলো? চোখ থেকে রক্তের নালা বয়ে যাচ্ছে৷ আমি ভাইয়ার মুখে থু থু দিয়ে বললাম,
“তোর মতো লোকদের জন্য আজ মেয়ে জাতি ছেলেদের বিশ্বাস করতে ভয় পাই৷ তোর মতো কিছু ছেলের জন্য মেয়েদের চোখে ছেলেরা ভাগকারী৷ কখনও মেয়ে জাতিকে সম্মাম করতে পারে না৷ তুই ভুলে যেতে পারিস৷ কিন্তু আমি আমি কখনও ভুলে যাইনি। তোর জন্ম কোন মেয়ের গর্ভ থেকেই হয়েছে। তোর বুক একবারও জন্য কাঁপে না নারী জাতিকে অসম্মান করতে। তোর মতো… ”
কিছু বলার আগে আরও কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দেন৷ এখন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলছি৷ ভাইয়া গলা চেপে ধরল৷ শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে৷ আজই ভাইয়া আমাকে মে*রে ফেলবে৷ বিশাল দেহী মানুষের সাথে পেরে উঠা মুশকিল হয়ে উঠল৷ আমার গলা ছাড়তেই আমি হাফ ছেড়ে বসে পড়লাম৷ কাশির জন্য কথাও বলতে পারছি না৷ বারবার জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি৷ আর একটু এভাবে থাকলে ম*রাই যেতাম৷ ভাইয়ার আমার মুখ উঁচু করে বলল,
” আমাকে নীতি কথা বলতে আসবি না৷ তোকে এমন অবস্থায় খুব হ’ট লাগছে৷ একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে৷ ইহানের সাথে বিছানা শেয়ার করতে ভালোই পারিস৷ আজ না হয় আমার সাথে ছাঁদ শেয়ার কর।”
ভাইয়ার কথা আর মেনে নিতে পারছি না৷ চোখ মেলে পাশে একটা লাঠি দেখতে পেলাম৷ নিজেকে বাঁচানোর একমাত্র হাতিয়ার পেয়ে গেছি৷ চোখের পলকেই লাঠি হাতে তুলে নিলাম৷ ছয় নয় না ভেবে এলোপাতাড়ি ভাবে পি*টা*তে থাকি৷ ভাইয়া চিৎকার করতে থাকে। ঘৃণার কারণে আমার হাত থামছে না। উচ্চ স্বরে বললাম,
“তোর মতো শয়তানকে শায়েস্তা করার জন্য এক শালিকই যথেষ্ট। আজ তোর এমন অবস্থা করব তুই কোনদিন অন্য মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে ভয় পাবি৷ আমার তো ইচ্ছা করছে তোর *** কেটে দিতে৷”
দরজার কাছে আসতেই দরজা খুলে দৌড়ে ছাঁদ থেকে চলে আসলাম৷ এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলাম৷ ওয়াসরুমের ঝরনা ছেড়ে ফ্লোরে বসে অঝোরে কান্না করতে থাকলাম৷ আমি কোন নরকে এসে পড়লাম৷ কেন আল্লাহ আমার কপালে এসব লিখে রেখেছেন? প্রায় দুই ঘন্টা ঝরনার জলে ভিজলাম৷ গালে হাত দিতে পারছি না৷ ব্যথায় চিনচিন করছে। ফুপির ডাকে বাহিরে আসলাম৷ ইহান ভাইয়া বাড়িতে থাকলে আজ আমার সাথে ছাঁদে যেতেন৷ আমি কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতাম না৷ আমি ছাঁদে কখনও একা যায়না৷ আমার সাথে ভাইয়া যান নাহলে মায়া ফুপি যান৷ আজ ভাইয়া বাড়িতে নেই৷ মায়া ফুপি রান্নার কাজে বিজি৷ সেজন্য নিজে একাই ছাঁদে গেলাম৷ কখন ভাইয়া ছাঁদে চলে আসছে জানি না?”
মায়া ফুপি আবারও হাক ছাড়লেন। বিরক্ত স্বরে বলল,
“কখন থেকে ওয়াসরুমে তুই৷ এতো ভিজলে জ্বর আসবে৷”
ভেজা কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে রুমে আসলাম৷ দাঁড়ানোর শক্তি নেই৷ আমি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লাম৷ কোন দিকে খেয়াল নেই৷ বিছানায় শুয়ে পড়লাম৷ পরের দিন সকাল বেলা পিন পিন করে চোখ মেলে তাকালাম৷ ধীর পায়ে ডাইনিং রুমে গেলাম। কানে ভেসে আসছে বিয়ের কথা৷ কার বিয়ের কথা হচ্ছে? ইহান ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে নাকি৷ আমি ডাইনিং রুমে আসতেই ইমন ভাইয়ার নজরে পড়লাম৷ ইমন ভাইয়া মুচকি হেঁসে বলল,
“আমাদের বাড়ির মেয়ে চলে আসছে৷ আপনারা কথা বলতে পারেন৷ রুপে গুণে লক্ষী৷ শালিকের মতো শ্যাম সুন্দরী কেউ নেই৷”
আমি ভাইয়ার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না৷ চোখের সামনে ভেসে উঠছে ভাইয়ার বা*জে দৃষ্টি। দেহের প্রতি লোভ৷ কাউকে কাছে পাওয়ার জন্য তীব্র আকাঙ্খা। ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করছে। আমি ধীর পায়ে সামনে গিয়ে বললাম,
“আপনারা বসে গল্প করেন। আপনাদের জন্য আমি চা বিস্কুট নিয়ে আসছি৷”
চলে আসতে নিলেই এক বৃদ্ধ মহিলা আমার হাত ধরে ফেলেন৷ মধুর কন্ঠে বলল,
“তোমার নামই শালিক! আমি তোমার কথা অনেক শুনেছি৷ তোমাকে সবাই খুব ভালোবাসে।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। যার অর্থ আমার নামই শালিক৷ আমার হাত ধরে নিজের পাশে বসালেন৷ তারপর উনার মুখ থেকে যা শুননাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না৷
চলবে…..
#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_১৩
#অধির_রায়
“শালিককে আমার ছেলের বউ করে বাড়িতে তুলতে রাজি। আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷ আমরা চাই, কালই ঘরোয়াভাবে বিয়ে শালিককে আমাদের বাড়িতে তুলতে৷”
ভদ্র মহিলার কথা শুনে মাথা ঘুর ঘুর করছে৷ আফসানা চৌধুরী সোফার এক কোণে বসে আছেন৷ জোর করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিয়ের কথা শুনে বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো৷ আমার স্বপ্ন এখানেই চাপা পড়ে যাবে৷ আমি আর লেখাপড়া করতে পারব না৷ বুকের কোণে সূক্ষ্ম ব্যথায় চোখ চিকচিক করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করলাম৷ মলিন আহত কন্ঠে বললাম,
“আমার শরীর খারাপ লাগছে৷ আপনারা কথা বলেন আমি আসছি৷ বড়দের কথার মাঝে না থাকাই ভালো৷ ম্যাডাম যা মনে করেন তাই হবে৷ আমি ম্যাডামের সিদ্ধান্ত সম্মান করি৷”
আমি মুখ মলিন করে সেখান থেকে রান্না ঘরে আসতেই কানে ভেসে উঠল টাকার কথা৷ ভদ্রমহিলা আফসানা চৌধুরীকে বলল,
“পাঁচ লক্ষ টাকার এক টাকা কম হলেও এমন কালো মেয়েকে আমার বাড়ির বউ বানাব না৷ এমন কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আমি শালিককে বাড়িতে নিচ্ছি না৷ আমি শালিক নামের টাকা বাড়িতে বরণ করে তুলছি৷”
আফসানা চৌধুরীর চোখ টলমল করছে। কোন কথা বলছেন না৷ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ইমন ভাইয়ার দিকে৷ উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আমার থেকে বেশি আঘাত পেয়েছেন। ইমন ভাইয়া ভয়ে ভয়ে বলল,
“টাকা নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমরা পাঁচ লক্ষ টাকাই দিতে রাজি৷”
মায়া ফুপি চা, বিস্কুট দিয়ে আসলেন৷ আমি মন খারাপ করে বসে আছি৷ রান্নার প্রতি কোন মনোযোগ নেই৷ চা খেয়েই ভদ্র মহিলা ও তার স্বামী চলে গেলেন৷ আফসানা চৌধুরী নিজের ছেলের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন৷ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ছি ইমন! তোমার চরিত্র এতোটা খারাপ আমি ভাবতেই পারিনি৷ তোমাকে নিজের ছেলে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে৷ তোমার মতো ছেলেকে নিজের গর্ভে ধারণ করে নিজের পৃথিবীতে ছোট মনে হচ্ছে৷ আমার চোখ খুলে গেছে৷ আমি শালিককে ছাঁদ থেকে দৌড়ে আসতে দেখে ছাঁদে আসি৷ তোমার নোংরা চরিত্র দেখতে পাই৷”
ইমন ভাইয়া আফসানা চৌধুরীর পায়ে পড়ে যান৷ কান্না জনিত ভেজা গলায় বলল,
“মা আমাকে ক্ষমা করে দাও৷ প্লিজ এসব কিছু শ্রুতিকে বলবে না৷ শ্রুতি কাল বাড়িতে ফিরে আসবে৷ শ্রুতি এসব কিছু জানতে পারলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে৷ আমি শ্রুতিকে খুব ভালোবাসি। শ্রুতিহীন আমি একা হয়ে যাব৷”
আফসানা চৌধুরী এদিকে ওদিক তাকিয়ে ইমন ভাইয়ার হাত ধরে রুমে নিয়ে যান৷ আমি রান্না ঘর থেকে কান পেতে সব শুনতে পেলাম৷ এখানেও যৌতুক প্রথা চালু আছে৷ গ্রামে যৌতুক প্রথা চালু কারণ হলো নিরক্ষরতা৷ শিক্ষিত সমাজেও যৌতুক প্রথা৷ তবে যৌতুক নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই৷ আমার মাথা ব্যথা হলো ইমন ভাইয়াকে নিয়ে৷ ম্যাডাম সব কিছু জানার পরও নিজের ছেলেকে কিছু বলল না৷ নিজের ছেলে বলে সাত খু*ন মাফ করে দিলেন৷ কি অদ্ভুত দুনিয়াতে বাস করি? আমি দৌড়ে মায়া ফুপির হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলাম৷ রাগে কাঁপতে কাঁপতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছুটা রাগী স্বরেই বললাম,
“আপনি আমার মায়ের সমতুল্য। আমি জানি আপনি আমাকে মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না৷ আমি সবকিছু জানতে চাই৷ কেন হুট করেই আমাকে বিয়ে দিতে চান?”
আমার এমন রুপ দেখে মায়া ফুপি রীতিমতো অবাক। আমাকে এমন অবস্থায় মায়া ফুপি কখনও দেখেননি৷ ফুপির হাত ধরে নিজেকে শান্ত করে আস্তে আস্তে বললাম,
“ফুপি আমার খুব জানা দরকার৷ গতকাল আমি রুমে আসার পর কি হয়েছে? ফুপি চুপচাপ থাকলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে৷ ফুপি আমাকে দয়া করে সব খুলে বলেন৷”
ফুপি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল৷ হঠাৎ করেই ফুপিয়ে কান্না করা দেখে বুকের কোণে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলাম৷ অভয় বানী দিয়ে বললাম,
” ফুপি আমি যদি আজ আপনার নিজের মেয়ে হতাম৷ আপনি চুপ থাকতে পারতেন৷ আপনার মেয়ের জন্য কি আপনি প্রতিবা করতেন না৷ মুখ বুজে সব সহ্য করতেন৷”
ফুপি চোখের অশ্রু মুছে বলল,
“গতকাল তুই যখন ছাঁদ থেকে দৌড়ে চলে আসিস৷ আমি আর ম্যাডাম ছাঁদে যায়৷ সেখানে ইমনকে পড়ে থাকতে দেখতে পাই৷ ইমনের হাতে তোর জামার টুকরো৷ দেখে বুঝার বাকী নেই ইমন তোর সাথে অস’ভ্য’তা’মী করেছে। আমাদের দেখে মাথা নিচু করে ফলে ইমন। ম্যাডামের পা ধরে অঝোরে কান্না করতে থাকে৷ ম্যাডামের কাছে সব স্বীকার করে। ম্যাডাম নিজের মান মর্যাদা বজায় রাখার জন্য তোর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এমনকি যৌতুক দিতেও পিছপা হননি৷ তাছাড়া তোর নামে একটা বাসা করে দিবে৷”
ফুপির কথা শুনে মনের অজান্তেই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ এতো ভালোবাসা সব লোভ দেখানো ছিল৷ পা ধরেছে বলে নিজের ছেলের সব দোষ ক্ষমা করে দিল৷ আমি আজ অন্য মেয়ে বলে আমার কোন দাম নেই৷ আমি আজ কোন বিচার পেলাম না৷ আমার ভালো দিক একবারও বিবেচনা করল না৷ আমার স্বপ্ন গলা টি*পে মে*রে ফেলল৷ আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিল না৷ আমি কি আর গ্রামে মাথা উঁচু করে ফিরতে পারব না? আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ফুপি মাথায় হাত ভুলিয়ে বলল,
“আমার কাছে কিছু টাকা আছে৷ তুই এই বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাহ মা৷ তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না৷ বড়লোকেরা যতই ভালোবাসা দেখাক৷ সব লোভ দেখানো। নিজের সম্মান বাঁচাতে তোকে মে*রে ফেলতেও এক মিনিট ভাববে না৷”
নিজের সাথে যুদ্ধ করে বললাম,
“না ফুপি। আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব না৷ যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়ার লোক শালিক নয়৷ আমি এ বিয়ে কিছুতেই হতে দিব না৷ আমার স্বপ্ন পূরণে যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে আমার সাথে মোকাবেলা করতে হবে৷”
মায়া ফুপি চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“তুই কি করতে চাস? তোর মনে কি চলছে? আমি তোর মনের কিছুই বুঝতে পারছি না৷ এমন কিছুই করিস না যেন এই বাড়ির মান সম্মান তলানিতে চলে আসে৷”
চোখের জল মুছে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
“সা’পও ম*রবে লাঠিও মজবুত থাকবে৷ কোন সম্মান হানী হবে না৷”
ফুপি কান্না করতে করতে রান্না ঘরে চলে গেলেন৷ আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মালী কাকার কাছে গেলাম। কিভাবে মালী কাকাকে সবকিছু বলব ভেবে পাচ্ছি না? নিস্তব্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে শুধু হাত কাচুমাচু করছি৷ কাকা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শালিক তোমাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন? বাড়ির কথা মনে পড়ছে৷ তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে৷”
আহত কন্ঠে আস্তে আস্তে বললাম,
“না কাকা৷ আমি বাড়িতে কারোর সাথে কথা বলতে চাইনা৷ আমার শুধু শাকিলার জন্য একটু খারাপ লাগে৷ কবে থেকে শাকিলাকে দেখি না৷ শাকিলার মায়াভরা মুখটা খুব মিস করি৷”
মুখ থেকে আর কথা বের হচ্ছে না৷ সব কথা তালগোল পাকিয়ে ফেলছি৷ মনের ভিতর সাহস জুগিয়ে বললাম,
“কাকা ইহান ভাইয়ার ফোন নাম্বার আছে আপনার কাছে৷ আপনি সব সময় আমার বিপদে দাঁড়িয়েছেন৷ আজ আমার সম্মুখে সব থেকে বড় বিপদ৷ আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন৷ আমি একা এই বিপদ মোকাবেলা করতে পারব না৷”
মালী কাকা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“তোমার কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো। ইহানকে কি দরকার? আমাকে বলো! আমি তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি৷ তোমার কিছু হলে তোমার বাবাকে কি জবাব দিব?
“তেমন কিছু করতে হবে না৷ আপনার ফোনটা শুধু দরকার৷ ইহান ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলব৷”
মালী কাকা ফোনটা আমার হাতে দিলেন৷ আমি ফোন নিয়ে কিছুটা সদূরে চলে গেলাম৷ আমাদের কথোপকথন কেউ যেন শুনতে না পারে৷ ইহান ভাইয়া ফোন রিসিভ করতেই কান্না জনিত ভেজা গলায় বললাম,
“ভাইয়া আমাকে বাঁচান৷ আমার সম্মুখে অনেক বড় বিপদ। আমি তিলে তিলে মা*রা যাচ্ছি৷ নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে৷ আমি কারোর সাথে নিজের অনুভূতি শেয়ার করতে পারছি না৷”
ইহান ভাইয়া উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“তোমার কি হয়েছে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো৷ কিসের অনুভূতির কথা বলছো?”
“বাড়িতে কিছুই ঠিক নেই। সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে৷ বাড়ি থেকে জোর করে আমাকে বিয়ে দিচ্ছে৷ আমি এই বিয়ে কিছুতেই করব না৷ বিয়ের দিন নিজের জীবন উৎসর্গ করতে রাজি৷ কিন্তু বিয়ের পিরিতে বসতে রাজি নয়৷ আমার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে৷ ভাইয়া কিছু একটা করেন৷ শালিক সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়।”
আমার কথা শুনে ভাইয়া স্তব্ধ হয়ে গেলে৷ ভাইয়ার কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না৷ ভাইয়া যেন মূর্তি হয়ে গেছেন৷ ভাইয়া মলিন কন্ঠে বলল,
“আমি আগামীকাল ১২ টার মাঝেই আসতেছি৷ আর কেউ জেনে জানতে না পারে আমি বাড়ি আসছি৷ কেউ বাড়িতে যাওয়ার কথা জানতে পারলে অন্য কিছু করতে পারে৷ তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করব। স্বপ্ন পূরণে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না৷”
ভাইয়া ফোন কেটে দিল৷ আমার আর কষ্ট করে বলতে হলো না কথাটা কাউকে না জানাতে। ভাইয়া নিজ থেকেই বললেন৷ ফোন রেখে ৯৯৯ এ ফোন দিলাম৷ ফোন রিসিভ করতেই বললাম,
“কাল চৌধুরী ভিলাতে বাল্যবিবাহ হচ্ছে৷ তার উপর যৌতুক দিয়ে শালিক নামে একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে৷ শালিকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করেন৷”
ব্যাস আমার কথা হয়ে গেছে৷ মুচকি হেঁসে মনে মনে বললাম,
“ইমন ভাইয়া আপনার অপরাধের ক্ষমা নেই৷ আমি আপনার অপরাধ কখনও ক্ষমা করব না৷ আমার সাথে এমন হলে ক্ষমা করে দিতাম৷ আপনি শুধু আমার সাথে নয় আমার মতো অনেক অসহায় মেয়ের সাথে অন্যায় করেছেন৷ আমি বেঁচে থাকতে আপনার পা*পের কোন ক্ষমা হবে না৷”
রাতে বসে খাবার খাচ্ছি৷ ইমন ভাইয়া আমার সামনে এসে বসলেন৷ মুচকি হেঁসে বলল,
“শালিক পাখি তোমার স্বপ্ন এখানেই শেষ৷ আমার কথা মেনে নিলে তোমার ভাগ্য খুলে যেত। তোমাকে এমন জায়গায় পাঠাবো তুমি চাইলেও বেরিয়ে আসতে পারবে না৷”
ইমন ভাইয়ার কথার মাঝে রহস্যের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি৷ বিয়ের কথাটা ইমন ভাইয়ার মাথায় প্রথম আসছে৷ ভাইয়ার ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছি৷ এখানেও ভাইয়ার কোন স্বার্থ আছে৷ ভাইয়া কখনও স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেন না৷ আমি ভ’য়া’র্ত কন্ঠে বললাম,
“ভাইয়া প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না৷ আমি আপনার বোনের মতো৷ কোন আমাকে আপনি দাবার গুটি বানাচ্ছেন। শ্রুতি ভাবী আপনি বলতে পা*গল৷ আপনি শ্রুতি ভাবীকে ঠকাতে পারেন না৷”
পিশাচের মতো মুচকি হেঁসে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
“আমার কিছুই করার নেই৷ অনেক দেরি হয়ে গেছে শালিক পাখি৷ তোমার ভাগ্য তুমি নিজে ঠিক করেছো৷ নিজের ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখো৷”
ভাইয়া চোখ টিপল দিয়ে চলে যান। ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করছে৷ ইচ্ছা করতে ইমন ভাইয়াকে খু*ন করতে৷ আমিও মুচকি হেঁসে মনে মনে বললাম,
“ভাইয়া দাবার গুটি এবার ভুল চালছেন৷ আমি আপনার য*ম হয়ে ফিরছি৷ আমাকে দাবার গুটি বানানো এতো সহজ নয়৷ দাবার চাল আমিও কম দিতে পারিনা৷ আমার রাজা, মুন্ত্রী, নৌকা সব জীবিত আছে৷ এবার খেলা উল্টে গেছে৷”
চলবে….