শিরোনামহীন,পর্বঃ১+২

0
4959

শিরোনামহীন,পর্বঃ১+২
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১

কিছুক্ষণ পূর্বে পাশের বাড়ির কাকী আম্মা এসে আমার শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে বলে গেলেন আমার স্বামী না কি প্রবাসে আবার বিয়ে করেছে।
প্রথমে কথাটা নিছক মজার ছলেও নিলেও, এ যে মোটেও কোন তামাশা নয় তা বেশ বুঝতে পারছি।

কারণ কাকীর ছেলে মাস দুয়েক হলো আমার স্বামীর সাথে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে।সে অবশ্যই তামাশা বা টিপ্পনী কাটতে করে এমন বলবে না।

বাড়ির উঠোনে ফোন হাতে চুপচাপ বসে আছে আনতারা। পুরো নাম আফিয়া আনতারা। স্বামীর নাম সাবেত সামী। বছর তিনেক হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী।দীর্ঘ ছয় বছরের সম্পর্ক। প্রথমে দুই বছর প্রেমের এবং চার বছর বিবাহিত জীবন। এই তো চার মাস আগে এসে দুই মাস ছুটি কাটিয়ে আবার দু মাস যাবত চলে গেছেন।আজ সকাল অবধি তো সব ঠিক ছিলো।অথচ কাকী এসে কি সব বলে গেলো?

মাথার উপর কয়েকটা দাঁড় কাক উচ্চস্বরে ডেকেই চলেছে। মেঘের ছিটেফোঁটা নেই আকাশে। তপ্ত রোদে ফোন হাতে নিয়া আনতারা বসে আছে গোয়াল ঘরের পাশটায়।
শরীর কয়েকবার ঘাম দিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ রোদে পুড়ে লাল হয়েছে গাল দুটো।অথচ সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। দৃষ্টি ফোনের দিকে।
বর্তমানে বাহিরের দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো ইমো নামক অ্যাপস।স্পষ্ট দেখাচ্ছে তার স্বামী সাবেত অনলাইনে অথচ সে আনতারার কোন কল বা ম্যাসেজের রিপ্লাই করছে না।
এর আগেও এমন হয়েছে,সে ব্যস্ত থাকলেও আনতারা কিছুই বলেনি তবে আজ মেনে নিতে পারছে না। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে এ নিয়ে। অনলাইন তাহলে রিপ্লাই কেনো করবে না?কি এমন ব্যস্ততা? অশান্ত মন সচরাচর কারো যুক্তি মানে না।তাইতো আনতারার মন আজ কোন যুক্তি মানছে না।খোলা
আকাশের তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে উঠোনের একপাশে মোবাইল হাতে বসে থাকা আনতারার মনে ধীরেধীরে মেঘ জমতে শুরু করেছে।
এক সময় মেঘ নোনাজলের স্রোত হয়ে নেমে এলো দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে।

গ্রামে কোন কথা চাপা থাকে না, এক কান দু কান হয়ে পুরো গ্রামে কথা ছড়িয়ে পড়েছে। যা হবার তাই হলো।দলে দলে দাদী-চাচীরা এসে ঘটনা কি জানতে চাইছিলো। দুই একজন তো আরো এক ধাপ এগিয়ে। তারা বললো, সে ঘরে না কি বাচ্চাও আছে।
আনতারাকে নানা প্রকার প্রশ্ন করছিলো অনেকেই। প্রতিউত্তরে ছিলো আনতারার নিরুত্তাপ উদাসীনতাময় চাহনি।

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে।তবুও সাবেতের কল এলো না।যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেনো,এদেশের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় ঠিক কল দিতো সে।আনতারার নামাজ নিয়ে আগে থেকেই বেশ কঠোর সাবেত ।

“আনু, মা উঠ।কে কি কইলো এতে তো আর সংসার চলে না মা! আমার বেটায় তোরে ঠকাবো? এইটা কেউ মানবো? তুই জানিস না?কামে ব্যস্ত থাকলে কি করবো? একটু সবুর কর মা! একটু সবুর কর।”

শ্বাশুড়ির কথায় মুখ তুলে তাকায় আনতারা। চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে৷ শ্বাশুড়ির কোমর জড়িয়ে ধরে হুহু করে চাপা কান্না কাঁদতে থাকে আনতারা।
সে নিজেও জানে সাবেত তাকে কোন দিন ঠকাবে না। তবুও মন কেনো এত কু গাইছে?

সাবেত-আনতারা পাশাপাশি গ্রামের ছিলো। যে বছর সাবেত অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হলো সে বছর আনতারা মাধ্যমিক দেবে৷
ভালো ছাত্র হিসেবে সাবেতের নাম পুরো দশগ্রামে। তাইতো আনতারা সহ আরো কয়েকজন ছেলে-মেয়েকে হেড মাষ্টার পড়তে পাঠায় সাবেতের কাছে।
আনতারা স্বভাব বশত কারণে বেশ চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। পড়তে যাওয়া শুধু মাত্রই তার কাজ ছিলো।
এবাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছিলো সেদিন তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। বিধাতার আরশে যত পানি আছে সব যেনো গ্রীষ্মের সে দুপুরে ঝড়ে পড়ছিলো।
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই একদল ছাত্রছাত্রী এলো সাবেতের বাড়ি। তাদের মাঝে আনতারাও একজন৷ওদের ঘরে বসতে দিয়ে সাবেত যখন বেরিয়ে যায়, আচমকা বাতাসের সাথে ভেসে আসে মেঘে মেঘে সংঘর্ষের শব্দ। শব্দের সাথে সাথেই বিদুৎ চলে যায়। পুরো রুম ডুবে যায় ঘুটঘুটে আঁধারে। ভর দুপুরে যেনো রাতের আঁধার নেমে এসেছে।
ঘুটঘুটে আঁধারের মাঝেই এক রত্তি মোমের আলো নিয়ে রুমে এলো সাবেত।
সেদিন প্রথম আনতারা সাবেত কে প্রথম দেখে। দেখার পর কোন বিশেষ অনুভূতি হয়নি। চুপচাপ মন বসায় পদার্থ বিজ্ঞানের ভরবেগের সূত্রে।

আজ ছয় বছর পর হঠাৎ প্রথম দিনের স্মৃতি আধোঘুম আধো-জাগোরণে মনে পড়ছিলো আনতারার।মাথা ব্যথায় কাতর হয়েও ফোন ছাড়েনি হাত থেকে। এই বুঝি কল এলো।

আনতারার ঘুম যখন একটু হালকা হলো তখন একচোট বৃষ্টি হয়ে সবে মাত্র থেমেছে৷ বিদুৎ নেই তাই ঘর অন্ধকার। বাহিরে হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কান খাড়া করে আনতারা কিছু শোনার চেষ্টা করলো।
তার শ্বাশুড়ি মা কারো সাথে কথা বলছে ফোনে।
ভদ্রমহিলা লাউড স্পিকার অন ছাড়া ফোনে কথা বলতে পারেন না। তাই কার সাথে কি বলে সব শোনাই যায়।
অপর পক্ষের কথা স্পষ্ট না হলেও এ পাশ থেকে শ্বাশুড়ি বারবার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করছে।

“বাবা আমার কাছে কিছু লুকাইয়ো না। সত্যি কইরা কও। আমার কাছে স্বীকার করো।”

অপর পাশে থেকে কোন কথার স্বর ভেসে এলো না।আনতারা এবার উঠে এসে দরজার পাশে দাঁড়ায়।
শ্বাশুড়ি তখন ফোনে কথায় ব্যস্ত।

“বাবা! মায়ের কাছে সন্তানের কোন গোপন কথা লুকাইতে নাই। মা যদি সাহায্য না করে, বিপদে আপদে না দেখে তাইলে কে দেখবো? আমার কাছে কিছু লুকাইয়ো না।তুমি কি সত্যি আবার বিয়া করছো?”

অপর পাশে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো। কিছুটা কাঁপা কন্ঠে জবাব এলো

“হুম মা। তোমরা যা শুনেছো সব সত্যি। আমি আজ নয়, আরো দুই বছর আগে এখানে বিয়ে করেছি।”

আনতারার যেনো মাথার ভেতর সবটা হঠাৎ করেই ফাকা হয়ে গেলো। অনুভূতিগুলো তখন কেমন তালবাহানা শুরু করেছে। পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো সে।
দ্রুত পায়ে হেটে প্রায় এক প্রকার ছিনিয়ে শ্বাশুড়ির হাত থেকে ফোন নিয়ে চিৎকার করে বললো,

“আমি মানি না আপনার এই বিয়ে। আমি মানি না।আপনি আমার কাছে থেকে অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করার সাহস পেলেন কোথায়? আমি কখনো আপনাকে অনুমতি দেয় নি এই বিয়ের। আপনার এই বিয়ে আমি মানি না। ”

চলবে

শিরোনামহীন
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ২

প্রায় পনেরো ঘন্টা সময় হয়েছে আনতারা নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে। গত রাতে সাবেতের সাথে একদফা কথা কাটাকাটি হয়।
আনতারা যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলো নিজেকে সামলে, শান্ত রেখে সব কথা জানার কিন্তু পারেনি সে।
গতকালের কথোপকথন কিছুটা এমন ছিল,

“আরা! আরা আমার কথা শুনো তারপর তোমার যা ইচ্ছা হয় আমাকে বলো। তবে আগে… ”

“আপনি কি কথা শোনাবেন আমাকে? কিভাবে আমার সতীন আনলেন এটা?”

অপর পাশে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। দীর্ঘশ্বাসের কারণ আনতারার অজানা নয়। ফুপিয়ে কেঁদে উঠে আনতারা। কান্নার শব্দে সাবেত বলল,

“একটি পয়সার কিন্তু দুটো পাশ থাকে। এক পাশ জানলে তোমাকে অপর পাশ জানতে হবে। ”

“দয়া করুন আমার উপর। আপনি ফিরে আসেন আমার কাছে। আমার কিছুই লাগবে না।আমি আপনার অল্প আয়ের সন্তুষ্ট ছিলাম, ভবিষ্যতে থাকবো।”

“পাগলামো করে না।আমার কথা শোন।”

“মেয়েটা কি মারিয়া? ”

পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবেত জবাব দিলো,

“হ্যাঁ।”
“কেনো করলেন আমার সাথে এমন অভিনয়? অভিনয় করতে গিয়ে কখনো ক্লান্ত লাগেনি?”

“আমি কখনো অভিনয় করিনি।তুমি প্লিজ আমার কথা শোন।”

“আজ আপনার ঘরের নিচে বসে পশ্চিম দিকে আঁচল ফালিয়ে আল্লাহ্ এর কাছে চাইলাম। আমার লাশ যেনো আপনার দেখার ভাগ্য না হয়।”

“এই মেয়ে এই। তোমার এত কিসের কথা? কতক্ষণ যাবত কিছু বলার চেষ্টা করছি শুনবি না তো?
তোকে কিসের কমতিতে রেখেছি? তোর কোন কম আছে কিছুতে? তাহলে তোর এত কিসের রাগ?
আমি বিয়ে করেছি আমার ইচ্ছায়। কি করবি যা কর। আমাকে আর কোনদিন কল দিবি না।
যা তো যা।”

আনতারা জবাব দেওয়ার আগেই সাবেত কল কেটে দেয়। তারপর নাম্বার ব্লকড। আনতারা চেয়েও পুনরায় কল দিতে পারছিলো না।
রাগে শ্বাশুড়ির ফোন সজোরে ছুড়ে মারে ফ্লোরে। স্ক্রীন ফেটে চৌচির হয়ে গেলো মুহূর্তেই।

ভোরবেলায় নামাজ শেষ হতে না হতেই জমে উঠেছে মজী শেখের চায়ের দোকানে আড্ডা। শীত, বর্ষা বা গ্রীষ্ম। যাই হোক না কেনো, মজী শেখের দোকানে চায়ের সাথে আড্ডা জমে উঠে।
আজকের বিষয় সাবেতের বিয়ে। গ্রামের বাচ্চা-বুড়ো সবার কাছেই এখন সব জানা।

চা হাতে মকবুল চৌধুরী প্রথম মুখ খুললেন এ বিষয়ে। বৃদ্ধ কৃষক মকবুল চৌধুরী। একসময় যুদ্ধ করেছেন ভাষার জন্য,দেশের জন্য,জাতির জন্য।জীবনে অনেক মানুষ দেখেছেন,জীবন মূহুর্তে মূহুর্তে শিখিয়েছে। আজ তার মন খারাপ।ভীষণ খারাপ, শুধুমাত্র কন্যাসম আনতারার জন্য।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মকবুল চৌধুরী বললেন,

“বুঝলা রাসু,মেয়েটা বড্ড শান্ত স্বভাবের। দেখলেই সালাম দিয়ে কথা কইবে,সবার বিপদে আপদে সাহায্য করে। বাপের মতন বৈশিষ্ট্য পাইছে। মেয়েটার সাথে সাবেত এমন না করলেও পারতো।”

প্রতি উত্তরে রাসু ওরফে রাশেদ মিয়া বললেন,

” বুঝি মিয়া ভাই। কিন্তু কি কমু কন? সাবেতের মতন পোলায় এমন কাজ করবার পারে এটা কি আমরা কেউ ভাবছিলাম? ওর মতন ভদ্র পোলা কি আমাগো দশ গ্রামে আছে?”

“মাইয়্যাডা এখন কি করবো কে জানে? ওর ভাইয়েরা কিছু জানে না না কি? এহনো তো ফজলে দোকান খোলে নাই।খবর কি পায় নাই? ”

কথা শেষ করেই মকবুল চৌধুরী আশেপাশে চোখ মেলে দেখতে লাগলো।

এ বাজারে খুব ভোরেই শুরু হয় কেনা-বেচা। এখান থেকে পাইকারী দরে বিক্রি হয় জিনিসপত্র, সবজি।বেলা একটু হতে না হতেই বাজারের পরিবেশ হয়ে উঠে মুখরিত। শহর থেকে আসে ছোট ছোট মিনি ট্রাক।এক দফা দরদাম চলে তারপর বোঝাই করা মিনিট্রাকগুলো লাইন বেধে যেমন আসে তেমন চলে যায়। পরিবেশ আবার শান্ত হয়ে যায়।

রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় বেশ কাঁদা জমেছে। সাইকেল নিয়ে আজ আসতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে ফজলের।
ফজলে ওরফে ফজলে করিম। আনতারার বড় ভাই৷ এই বাজারে তাদের বড় বড় তিনটে দোকান।তিন ভাই-বোনের নামে। আরেক ভাই আনিসুল করিম। দুই ভাই মিলে ব্যবসা দেখে। ফজলে করিমের বয়স চল্লিস ছাড়িয়েছে।শরীরে ধীরে ধীরে বার্ধক্য জায়গা করে নিচ্ছে।
দোকানের কাছাকাছি এসে ঘটলো বিপত্তি। ফ্যাচফ্যাচে কাঁদায় পা ফসকে গেলো।
দোকানের কাছে আম গাছটায় সাইকেল ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফজলে সাহেব গেলেন মজী শেখের দোকানের পাশে টিবওয়েলে পা পরিষ্কার করতে। ততোক্ষণে কর্মচারী এসে দোকান খুলে ঝাড়ু দেওয়া শুরু করেছে।

ফজলে কে দেখেই মকবুল চৌধুরী হাত ইশারায় ডাকলেন।বাবার বয়সী চাচার ডাকে হাসি মুখে এগিয়ে গেলেন ফজলে রাব্বী।

তবে হাসি মুখে কি আদৌও হাসি থাকবে? না কি ক্ষণিকের মাঝে হাসি কর্পূরের মতন উবে দেখা দিবে একরাশ ঘন কালো মেঘ।

আনতারাকে যখন শ্বাশুড়ি বার বার ডেকেও কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছিলো না তখন বেশ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন ভদ্র মহিলা।একে তো এলাকার সবাই বেশ মজাদার মসলাদার বিষয় পেয়েছে আলোচনার জন্য অপর দিকে যখন সকাল সকাল সে বাড়ি থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসে তাহলে শূন্য বাড়ি পূর্ণ হতে সময় লাগে না।
আনতারার দেবর যখন ঘরের পিছনের জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দরজা খুললো তখন প্রথমে রুমে এলো সাবেতের মা।
খাটের বা পাশে জানালার পাশে তখন আনতারা উবু হয়ে পড়ে আছে। চোখ মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছে।
তবে কি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই হার মেনে আনতারা পাড়ি জমালো পরকালে?

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here