শিরোনামহীন,পর্বঃ১৫+১৬
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১৫
ওঠ ছেড়ি তোর বিয়া।
গ্রাম্যভাষায় একটা কথা আছে। হুট করেই কোনো বড় কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।
সাবেত চলে যাওয়ার পর আনতারা আগ্রহকে বুকে নিয়ে আবার পাড়ি জমায় ঘুমের দেশে।
ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। তখন সূর্য মাথার উপর তেঁতে উঠেছে। আগ্রহ ঘুম থেকে উঠে বিড়াল ছানার মতোন শব্দ করছিল।হাত -পা নেড়ে জানান দিচ্ছে তার ঘুম শেষ।
আনতারা তাকে কোলে তুলে নিয়ে বাহিরে রোদে বসে। কুমুদ বেগম হাতে বাটা হলুদ এনে লাগিয়ে দিল আনতারার গাল,হাতে। আনতারার
কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে শ্বাশুড়ির কোলে দিয়ে দিলেন কুমুদ বেগম। তারপর অনেকটা বগলদাবা করে আনতারাকে নিয়ে কুমুদ ছুটলো গোসল খানায়।
গোসল শেষে আনতারা চুপচাপ রুমে এসে নামাজ পড়ে নিলো। এমন অনেক হয়েছে যে কুমুদ বেগম নিজ হাতে আনতারার চুল পরিষ্কার করে গোসল করিয়ে দেয়।
তাই আজকের কাজে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
নামাজ শেষে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই আনতারা খেয়াল করলো বসার ঘর থেকে ভেসে আসছে হেড স্যারের কণ্ঠস্বর।
হেড স্যার এখানে এখন? এগিয়ে যেতেই কুমুদ বেগম থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন।
নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আনতারার মা।
তারপর লাল টুকটুকে বেনারসি পরানো হলো আনতারাকে।
গয়না হিসেবে আনতারার বাবা আনতারার বিয়ের জন্য বানানো কিছু গয়না।
তারপর মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো বসার ঘরের দিকে।
এটা বুঝতে আনতারার সমস্যা হচ্ছিল না যে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। এজন্য হয়তো আজ এত আদর যত্ন।
বাবা মারা গেছেন ছয়মাস হয়নি, এর মধ্যেই এত পর? একবার বলতে পারতো তাকে।
বাবা থাকলে কেউ তাকে বিয়ের কথা বলতে পারতো না। সামনে পরীক্ষা। এত বেশি হয়ে গিয়েছি? পরীক্ষা অবধি আমাকে এ বাড়িতে সহ্য হচ্ছে না কারোর?
দুই ভাইয়ের কাছে এত বেশি?
বাবার মুখ খানা বারবার ভেসে উঠছিল আনতারার মানস্পটে।
দুচোখের কয়েকফোটা পানি টুপ টুপ করে ঝরে পড়ল। ততক্ষণে তারা ঘরে পৌঁছেছে।
মুরুব্বিদের সিদ্ধান্তে আজকেই শুভ কাজ সম্পন্ন হবে।
আনতারা চোখ তুলে তাকায়নি। ভাইদের প্রতি অভিমানে তার দৃষ্টি নুইয়ে পড়েছে।
কাজী সাহেব যখন কাবিননামায় স্বাক্ষর নিলেন, তখনো সে চুপ ছিল। কার সাথে বিয়ে না জেনেই চুপচাপ স্বাক্ষর করে দিয়েছিল।
মিনিট পাঁচেক পর আনতারার পাশে এসে চুপচাপ বসে পড়ে তার হবু বর। বিয়ে পড়ানোর সময় যখন হেড স্যার ওয়ালিয়া হয়ে সাবেতের পরিচয় দিয়ে আনতারাকে কবুল বলতে বলে,
তখন আনতারা পাশে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকায়।
তার বিয়ে আর কারো সাথে নয়, সাবেতের সাথে হচ্ছে। তবে সাবেত একবারের জন্যও আনতারার দিকে তাকায়নি। তার দৃষ্টি সামনে রাখা টি-টেবিলের দিকে। আনতারা তিনবার কবুল বলার পর সাবেত লোকচক্ষুর আড়ালে ত্রস্ত হাতে জড়িয়ে নিলো আনতারার হাত।
আনতারার পুরো শরীরে যেন শীত কালের ঠান্ডা হিমেল হাওয়া এই মাত্র ছুঁয়ে গেল,এমন অনুভূতি হলো তার।
আনতারাকে ভিতর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। তখন সাবেতের মা বলতে লাগলেন,
“ভাবীজান আর কইয়েন না৷ কি হইছে কে জানে? সকালে বাড়িতে গিয়া কইতাছে
আম্মা আনতারার বাড়িতে আজকেই প্রস্তাব নিয়ে যান। আমি তো প্রথমে বুঝি নাই পরে বুঝলাম আমার ছেলে কি বলছে। তারপর হেড স্যাররে নিয়া আসলাম। স্যার মনে হয় এটাই চাইছিল। তবে এখন এসব গোপন থাকুক।ওরা লেখাপড়া শেষ করুক।এক সাথে বাইন্ধা দিছি একজন আরেক জনের খেয়াল ঠিক রাখবেনি।”
ছেলের বউকে মন ভরে দেখে সাবেতের মা চলে গেলেন৷ ভাইদের প্রতি আনতারার অভিমান আরো একদফা বাড়লো। এবার যোগ হলো মায়ের প্রতি অভিমান।
সেরাতে আনতারা চুপচাপ রুমে এসে লেপের নিচে বসে ত্রিকোণমিতি করছিল৷
হাতের এক গাছা চূড়ি বেশ যন্ত্রণা করছে, তবুও অভিমানে সেদিকে নজর নেই আনতারার।
কুমুদবেগম এসে রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছে।
আনতারার মনোযোগ তখনো খাতায়।
কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া উঠানো এক মগ চা নিয়ে রুমে এলো সাবেত।
আজ তাদের তথাকথিত বাসর রাত।
অথচ কে বলবে তার সামনে সদ্য বিবাহিত কনে বসে আছে?
সাবেত আনতারার পাশে বসে তার ঠান্ডা হাতে গভীর স্পর্শ করে আনতারার দুই পা৷ আনতারা বড় বড় চোখে তাকাতেই সাবেত বলল,
“আমি তোর স্বামী।হিসেব মতোন তোর আমাকে সালাম করা উচিৎ তাই না?”
“না।”
“না?”
“আল্লাহ্ ব্যাতিত অন্য কারো সামনে নত-মস্তক হতে নেই।”
“বাব্বাহ্। অনেক কিছু জানিস তো। ”
“অন্তত বাচ্চাদের বডি লোশন এবং আফটার শেভের গন্ধের পার্থক্য করতে জানি।”
“মানে?”
“আপনি আমার কাছে আসুন।”
“মানে? তুই শিউর?”
ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে সাবেত। নাক ফুলিয়ে আনতারা জবাব দেয়,
“এক দফা বেশি বুঝবেন না। নিন আমার হাতের গন্ধ নিন। দেখুন এটা আগ্রহের বডি লোশনের স্মেল।”
“আমি জানি। ”
“তাহলে সকালে ওমন করলেন কেনো?”
“না হলে তোর কাছে রাত-বিরেতে আসার সুযোগ পেতাম? ”
“আমিই কেন?যান আপনার হিমুর কাছে। ”
“মেয়ে মানুষ মানেই প্রতিহিংসা। আশ্চর্য ও শুধু আমার ছাত্রী। ”
“আমিও আপনার ছাত্রী।”
“তোকে নিয়ে তো আজ থেকে আমার নতুন গল্প লেখা উচিৎ
‘ছাত্রী যখন বউ ‘ তাই না?”
আনতারা জবাব দেয় না। সাবেত চুপচাপ এসে আঁচল টেনে আনতারার মাথায় দিয়ে বলল,
“বকুল তলায় যাবি? চল না। আমাদের ভালোবাসার পথ চলায় তোর বাবাকে স্বাক্ষী রেখেই হোক।”
সেরাত থেকে প্রতি রাতে সাবেত আনতারাকে নিয়ে গভীর রাতে বকুল তলায় যেতো।ফুল না থাকলে শুধু সুতো ঝুলতো গাছের ডালে।
তবুও একরাত বাদ যেত না৷
তবে তাদের সম্পর্ক ঠিক আগের মতোন। দাম্পত্য জীবন তখনো শুরু হয়নি তবে মানসিকভাবে সাবেত আনতারাকে ভেঙে গড়ে নিচ্ছিলো নিজ হাতে।
অথচ বছর চারেক পর সে সাবেত ভেঙেচুরে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে আনতারাকে৷ ঠুনকো হয়েছে আজ তাদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ।
চলবে
শিরোনামহীন
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১৬
“আমি আগেই কইছিলাম। কইছিলাম না আমি? এ সংসার টিকব না। ক্যামনে টিকব হ্যাঁ? ক্যামনে?
বাপ মরলে, মুরুব্বি মরলে এক বছর বিয়া-শাদীতে যাওন লাগে না।
আগিলা কাল থেইকা মানুষ মাইনা আইতাছে। তোমরা তো মানবা না। কিছু কইলে কও হাদীসে এসব লেখা নাই। তাই কুসংস্কার মানবো ক্যান?
আরে আগিলা মানুষ আছিল গুনীমান্যি লোক। তারা কিছু মানতে কইছে তার মানে কিছু কারণ আছে। আমাগো মানা উচিৎ। তারা কত জীবন দেখছে, কত বছর জীবিত থাকছে। তাগোরে মুখের কতা তো কতা না একেকটা অমৃত বাণী।
তোমরা হাদিস খুঁজো।
জান না? তোমার স্বামী ইন্তেকাল করছে সকালে, উজান বেলায়। তোমার পোলাগো সংসার উজাইব, উন্নতি হইব তাই বইলা মাইয়্যার বিয়া দিয়া দিবা?
টিকলো কি সংসার? এবার বোঝো,নিজ হাতে মাইয়্যার কি ক্ষতি করছ।
মাইয়্যার হাত-বুক দেইখা তো ঠেকে পোয়াতি।
আহারে কপাল লো! ও কপাল। জামাইডা বিদেশ বিয়া কইরা নিছে আর এদিকে এই হতভাগী পোয়াতি।
কি করব ও? জামাই কি নিব? সতীনের সংসার করব?
না কি সারা জীবন ভাইগো ঘাড়ে বইসা খাব?
ভাইয়েরা কয়দিন দিব? সারা জীবন? ভাবী তুমি যতদিন আছ ততদিন দিলেও মরলে ওরে এই বাড়িত থাকবার দিব না।
তুমি আমার মায়ের কপালডা এমনি কইরা পুইড়া দিলা? বাপ মরা মাইয়্যা কার কাছে যাব?”
বাহিরে ঘরের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে আনতারার ছোট ফুপুর আহাজারি। আজ সকালেই এসেছেন উনি। ভাইঝির এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু তার আর্তনাদ মোটেও খারাপ লাগছে না আনতারার। সে বিলাপ করতেছে।এক প্রকার সুর করে কান্নারত অবস্থায় কথা গুলো বলতেছে।বাবার বিছানায় বসে সেসব খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিল আনতারা।
বাবার ঘরেই শেষ ঠাঁই হয়েছে তার।
বিগত চার বছরে এ বাড়িতে এক রাত থাকেনি সে। যত ঝড় ঝামেলা হোক না কেন।সাবেত আনতারা কে বাড়ি থেকে অন্য কোথাও রাত থাকতে দেয়নি। বিয়ের পর বছর দেড়েক আনতারা তার বাবার বাড়ি ছিল। তখনো তাদের বিয়ের কথা কাউকে জানানো হয়নি। এক রাতে কোনো একটা কথার রেশ ধরে তার মা তাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন,
“ভাইবৌগো মুখের উপর কথা কইতে শরম করে না?বিয়ের পর বাপের বাড়িত পইড়া আছস কিছু তো লজ্জা করিস।”
ভাতের থালা রেখে সেরাতে আনতারা চলে আসে সাবেতের বাড়ি। এক কাপড়ে চলে এসেছিল,এমনকি তার দুপা ছিল নগ্ন।
যখন সাবেতদের বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন চুপচাপ এসে দাঁড়ায় বকুল তলায়। ঘন কুটকুটে অন্ধকারের মাঝে তার দৃষ্টি ছিল সামনের বাবার কবরের দিকে।
যখন সাবেতের বাড়ি পৌঁছাল তখন সাবেতের মা সাদরে ঘরে তুলে নিয়েছিলেন তাকে। কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করেনি, না আনতারা বলেছিল।
সাবেতকেও আনতারা কিছুই বলেনি তবুও সাবেতের বুঝতে বাকী রইল না কি হয়েছিল।
এরপর চার বছর হয়েছে, আনতারা তার বাবার বাড়ি দিনের বেলা এলেও রাত থাকেনি।
অথচ ভাগ্যের উত্থান পতনের কারণে আজ সেই আনতারার তার বাবার বাড়িতেই ঠাঁই হয়েছে। গত পরশু সাবেতের মা, ভাই পাড়ি জমিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পথে। শ্বাশুড়ি যাওয়ার আগ মূহুর্তে বার বার আনতারাকে বলে গিয়েছেন সে যেভাবে পারবে সাবেত কে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। তার সাথে যোগাযোগ কেন করছে না এজন্য বকবে। আনতারা যেন চিন্তা না করে।
প্রতি উত্তরে আনতারা কিছুই বলেনি। ইদানীং শরীর খুব একটা সায় দেয় না।
প্রায় দেড় মাস হতে চলল সাবেতের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই৷
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে চুপচাপ মরে যেতে। পরক্ষণেই মনে হয় তার ভিতরে এক ছোট্ট প্রাণ।
এই ছোট্ট প্রাণের কি দোষ?
শ্বাশুড়ি চলে যাওয়ার আগে আনতারার দায়িত্ব তার মায়ের কাছে দিয়ে গেছেন। আনতারা শ্বশুর বাড়ি থাকতে চেয়েছিল।বিয়ের পর মেয়েদের আর যাই হোক বাবার বাড়ি একদিনের জায়গায় দুদিন থাকতে নেই। সেখানে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাবার বাড়ি থাকতে যাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু সে বাড়িতে একা থাকবে এমন চিন্তা করাও সম্ভব নয়। কেননা এত বড় বাড়িতে একা একটা মেয়ে থাকা বড়ই বিপদজনক হতে পারে৷
সাবেতের বাড়ি থেকে চলে আসার আগে পুরো সময় আনতারা তার রুমেই ছিল।চার বছরের অনেক স্মৃতি মিশে আছে এই রুমের চারিধারে।
তাদের একসাথে কাটানো কিছু মূহুর্ত, ভবিষ্যৎ চিন্তা, মান-অভিমান, একটা সুন্দর ভবিষ্যৎের আশায় সাবেতের প্রবাসে পাড়ি জমানোর চেষ্টা, সাবেতের চলে যাওয়া, তার ফোনকলের জন্য অপেক্ষা, সাবেতের ছুটিতে আসা সব স্মৃতি।
আনতারা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে, হাতের চুড়ি বিছানার উপর রেখে নগ্ন পায়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে, যেমনটা এসেছিল চার বছর আগে তার বাবার বাড়ি থেকে । পার্থক্য শুধু এটাই
তখন আনতারার চোখেমুখে, মনে- মস্তিষ্কে ছিল একটা সুন্দর ভবিষ্যৎের আশা। ভরসার হাত হিসেবে সাবেতের হাত।
তবে এবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছিল এক অস্তমিত সূর্য এবং তার গর্ভে সাবেতের অনাগত সন্তান।যার ভবিষ্যৎ কি হবে এটা তার গর্ভধারিনী নিজেও জানে না।
চলবে