শিরোনামহীন,পর্বঃ১৭ +১৮
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১৭
আজ যেন সময় থেমে আছে। প্রতি সেকেন্ড মনে হচ্ছে এক শতাব্দী।ঘড়ির টিক টিক শব্দ অস্বস্তির কারণ হচ্ছে যে খুব৷
সামনে রাখা হোয়াইট অর্কিডের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাবেত।
দীর্ঘ দেড় মাস! দেড় টা মাস যাবত আনতারা তার সাথে কথা বলে না।
আনতারার ফোনে কল যায় না,ফোন বন্ধ থাকে। মায়ের ফোনেও কল দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু আনতারা রাজি হয়নি। সব কাগজপত্র ঠিক হতে সময় লাগল এত দিন।নানা ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিফল সাবেতকে আশার আলো দেখিয়েছে মারিয়া। তার কথাতেই সাবেত আনতারা, সাব্বির এবং তার মা কে এদেশে আসতে বলেছে। প্রয়োজনীয় সব মারিয়া নিজে করেছে। সাত দিন আগে যখন টিকিট কনফার্ম হয় তখন থেকে সাবেতের সময় যেন থেমে আছে৷
আনতারার জন্য সাবেত ব্যালকনির পাশের রুম গুছিয়েছে। পুরোটা রুম সাজিয়েছে নিজের মতোন করে।
বিয়ের পর থেকে যে শাড়ি ব্যতীত কিছু পরেনি আনতারা।ওয়েস্টার্ন কাপড়ের প্রতি তার টান নেই। তাই সাবেত নিজের পছন্দ সই শাড়ি আনিয়েছে ইন্ডিয়া থেকে৷
একবার আসুক, একবার৷ তারপর সব অভিযোগ, অভিমান উড়িয়ে দিবে আকাশে।
সব ভুল স্বীকার করে নিবে। প্রয়োজনে যদি মারিয়া কে ডিভোর্স দিতে হয় দিবে তবুও আনতারা কে ছাড়া সে থাকতে পারবে না।
রেস্টুরেন্টের হেড শেফকে আগে থেকেই বলা আছে, সে যেন হালকা আঁচে ঝাল ঝাল করে টমেটো মুরগির মাংস এবং শ্বেত শুভ্র বাসমতি চাল দিয়ে ভাত রান্না করে রাখে।
একটুকরো লেবু সাথে একটা আস্ত কাঁচা মরিচ।ব্যস,তৈরী হয়ে যাবে তার আনতারার প্রিয় খাবার৷
সব কাজ শেষে সাবেত নিজ হাতে থাকা রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল
ফ্লাইটের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।
বুকের মধ্যিখানে ধুকপুকানি শুরু হয়েছে ততক্ষণে ।এয়ারপোর্টের পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাবেত। এখনো ঘন্টা খানেক সময় বাকী।
আনতারাকে দেখার জন্য এমন অনুভূতি হবে কখনো ভাবেনি সে।
আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল সে যেদিন দেশে ফিরেছিল সেদিনের কথা।
পুরো বাড়ি জুড়ে মলন দেওয়া হচ্ছিল সরিষা।পরিবেশ ঝাঁজাল গন্ধে মুখরিত । অনেকবার বলার পরও সেদিন আনতারা আনতে যায়নি সাবেতকে।
সাবেত যখন বাড়িতে এলো তখন আশেপাশের অনেক মুরুব্বি মানুষ আগে থেকেই তার বাড়িতে অপেক্ষা করছিল।
সাবেতকে দেখে সবাই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে, আনতারা ভিতর বাড়ি থেকে সবাই কে মিষ্টি,পানি এবং পান দিয়ে আপ্যায়ন করছিল কিন্তু সাবেতের সামনে আসছিল না।
সাবেত ফিরেছিল বিকেলে দিকে। আনতারা সেদিন পুরো বিকেল পাকঘরেই কাটিয়ে দিল। এ কাজ তো ও কাজ করেই চলেছে। তবে কতক্ষণ?
ধীরেধীরে বাড়ি ফাঁকা হলে সাবেত আনতারা কে ডাক দিল। কেননা অনেক সময় হলো সে এসেছে, অথচ আনতারা তাকে চোখের দেখা দেখার জন্যও এলো না?
এমনি তো একদিন ভিডিও কলে কথা না হলে তার মাথা খারাপ করে দেয় অথচ আজ সে সামনে আর আনতারা লুকোচুরি খেলছে?
রাতে খাবার দেওয়ার সময় এক হাত ঘোমটা টেনে খাবার পরিবেষণ করল আনতারা।
পরিবারের মানুষ বলতে সাবেত,সাব্বির আর তাদের মা। সাব্বিরের সামনে আনতারা এতবড় ঘোমটা টানে না। তবে এই ঘোমটার কারণ যে সাবেত এটা বুঝতে বাকী রইল না কারোর।
সবাই মুখ টিপে হাসছিল কিন্তু আনতারা তার কাজে মশগুল। খাওয়া শেষে সাব্বির উঠে গেলে সাবেত আনতারার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“রাতে তো ঘুমানোর জন্য রুমে আসতে হবে না কি? তখন কি করবে? তখন দেখব তোমার এই তেরো হাত কাপড়ে চৌদ্দ হাত ঘোমটায় কুলোয় কি না।”
আনতারা শুনেও না শোনার ভান করে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।কাজের সুবিধার্থে সব কিছু ঘরেই,তাই
ঘরের ভিরতেই আনতারা সব কাজ করছিল, এদিকে দুই ভাই বসেছে লাগেজ নিয়ে৷ আনতারাকে শাশুড়ি হাত ধরে টেনে এনে পাশে বসিয়ে দেয়। কারণ যা সব তো ওর৷ সাব্বিরের জন্য যা আনা হয়েছিল সাব্বির নিয়ে রুমে চলে যায়, মা ঘুমাতে চলে গেলেন আনতারার জিনিসপত্র নিয়ে সাবেত রুমে চলে এলেও আনতারার খবর নেই। আনতারা রুমে এলো প্রায় সাতচল্লিশ মিনিট পর।
শীতে রীতিমতো কাঁপছে সে৷
সাবেতের ঠোঁটে তখন জ্বলন্ত সিগারেট।
ঠোঁটে সিগারেট রেখে ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“বকুল তলায় গিয়েছিলে?”
“হুম”
“ভিতরের দিক দিয়ে? ”
“হুম”
“শীত লাগছে খুব?”
“হুম”
“কি হুম,হুম করতেছিস?”
এবার আনতারা চোখ তুলে সাবেতের দিকে তাকায়। সাবেত সাধারণত তুই তখন ডাকে যখন আনতারার জন্য তার মন প্রচন্ড খারাপ থাকে।
“আপনার কি মন খারাপ?”
আনতারার প্রশ্নে সাবেত নিরুৎসাহিত কণ্ঠে জবাব দিল,
“না মন খারাপ হবে কেন? আসার পর থেকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছিস?”
আনতারা কিছুই বলেনা৷ চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইল।
“কাল ফিরতি টিকিট কাটব। চলে যাব। এরপর আশা করি তোর সমস্যা হবে না। তুই চাইলে মায়ের কাছে ঘুমাতে পারিস।”
“আচ্ছা।”
জবাব দিয়েই আনতারা দরজা খুলে চলে যাচ্ছিল। সাবেত চিন্তাও করেনি এমন হবে। ত্রস্ত হাতে আনতারা কে টেনে রুমে এনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেধে নেয় নিজের সাথে।
আনতারার স্পর্শ যেন একটা ছোট্ট বিড়াল ছানার স্পর্শ। সুযোগ পেলেই সেধিয়ে যায় বুকের ভিতর৷
“কাছে আসছিলে না কেন?”
“আপনাকে দেখে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল।”
আনতারার এমন কথায় উচ্চস্বরে হাসে সাবেত। তার বিবাহিত স্ত্রী তার কাছে আসতে লজ্জা পাচ্ছে যেখানে তাদের বিবাহিত জীবনের বয়স বছর চার ছাড়িয়েছে।
আনতারার মাঝে সাবেত আলাদা এক শান্তি খুঁজে পায়৷ সকল শান্তি,অবসাদ কর্পূরের মতোন উবে যায়৷
অথচ মারিয়ার সাথে যতবার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়েছে সব বার মনে জমেছে বিষাদের কালো মেঘ।
মারিয়ার কথা মনে হওয়ায় হুশ ফিরল সাবেতের৷
আনতারা আসছে, সে কিভাবে মারিয়াকে মেনে নিবে? বা মারিয়া কিভাবে আনতারা কে মেনে নিবে? এদিকে মারিয়ার ডেলিভারির ডেট কাছাকাছি।
সব ঠিক-ঠাক হবে তো?
চিন্তার রেখা ভেসে উঠল সাবেতের চোখেমুখে।
না, আনতারা তো আসেনি।শুধু মা,সাব্বির এসেছে।
আনতারা না কি জানিয়েছে সে সাবেতের মুখ দেখতে চায় না। কারণ সাবেত তাকে ঠকিয়েছে।
সাবেতের কাছে আসার থেকে না কি মরে যাবে এটাও ভালো।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা, এক পড়ন্ত বিকেলে অস্তমিত অর্ককে সাক্ষী রেখে সাবেত জানতে পারল,
আনতারা তালাক নামায় সই করে দিয়েছে।
চলবে।
শিরোনামহীন
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
পর্বঃ১৮
হলুদিয়া এক পাখির ন্যায় আনতারার পরণে হলুদ রঙা শাড়ি।
চারিধারে সরিষার সমারোহ। সেখানে চুল খুলে দাঁড়িয়ে আছে আনতারা৷ আটপৌরে হাসি ঝুলে আছে আনতারার ঠোঁটে।
আনতারার চোখেমুখে স্নিগ্ধতা যেন উপচে পড়ছে। শুভ্র সিথিতে রোদের আলোয় চিকচিক করছে৷
সেদিকে স্থির দৃষ্টি সাবেতের৷ ওয়ালেটে রাখা ছবি দিকে তাকিয়ে আছে সাবেত৷ কি করে সাইন করে দিল সে? আনতারা এত বদলে গেল?
রাগে গা রি রি করে উঠছে সাবেতের। এই বুঝি রাগ সামলাতে না পেরে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে সে।
ঠোঁটে সিগারেট পুরে চোখ বন্ধ রেখেছে৷ আনতারার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম আর নেই। এতদিন মায়ের ফোনে কল দিয়ে সব জেনে নিত কিন্তু আজ কি করবে৷ বিধিবাম ফোন হারিয়েছে কোথায় সে নিজেও জানে না৷ এলাকার কাউকে কল দেওয়ার ব্যবস্থা তার নেই। একমাত্র উপায় ইমন। ওর মাধ্যমেই আনতারা পেয়েছিল সাবেতের বিয়ের খবর। এরপর মারিয়া ওকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে৷ গ্রামের মানুষ বলতে একমাত্র সে আছে। এবার ইমন পারবে আনতারার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে।
“সিসা টানছিস কেন?”
চোখ বন্ধ রেখেই সাবেত উক্ত ব্যক্তিকে বসতে বলে।
কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে এক কাপ গরম পানি সাথে গ্রীণটি দিয়ে গেল।
লং এর গন্ধে চোখ মেলে তাকায় সাবেত৷
সামনে বসে আছে এক রমনী। পরণে হোয়াইট শার্ট, নেভি ব্লু জিন্স। পনিটেইল করে বেধে রাখা চুলের কিছু এসে পড়েছে সামনের দিকে৷
কাপে টি-ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল,
“সামী, তোর আরার জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছি। তবে তোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে এসব শাড়ির তোর প্রয়োজন রয়েছে৷ ”
“তাফসির, আরা আসেনি৷ ”
“বুঝেছি, তোর চোখ মুখ এটাই বলছে।”
“আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না৷ ও তালাক নামায় সই করে পাঠিয়েছে। ”
“ইউ মিন ডিভোর্স পেপার? এটা তো অস্বাভাবিক কিছুই নয়৷ ”
“মানে?তুই…… ”
“আনতারার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে৷ তুই বিয়ে করতে পারবি অথচ ও তোকে ছাড়তে পারবে না? ”
“আমি ওকে কতটা ভালোবাসি তুই জানিস?”
“তুই ওকে কতটা ভালোবাসিস তুই জানিস। ভালোবেসে কতটা দিয়েছিস, কি কেড়ে নিয়েছিস ভেবে দেখিস নি।”
“আমি মারিয়াকে বিয়ে করতে বাধ্য ছিলাম।”
“ফিজিক্যাল হতেও বাধ্য হয়েছিলি?”
“আফটার অল আ’ম আ ম্যান টু, আই হেভ সাম ফিজিক্যাল নিডস।
“ব্রাভো মাই বয়৷ ব্যাভো, ইউ হ্যাভ সাম ফিজিক্যাল নিডস
সো ইজ দেয়ার নো ফিজিক্যাল ডিমান্ড ফর আনতারা?”
“তাফসির তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“আমি রাগ করছি না, তুই জানিস আমার কাজ শব্দ নিয়ে খেলা করে মানুষের মনের অসুখ সারানো।”
“তুই কি পারিস না আমার আনতারা কে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে? ”
“যে নিজের সাহায্য না করে তার সাহায্য সৃষ্টিকর্তাও করেন না।তুই তো মারিয়ার লিগ্যাল অভিভাবক তাই না? রাজকন্যা সমেত রাজত্ব পেয়েছিস, তাহলে তাই নিয়ে থাক। আনতারার মতোন বোকা মেয়ের মরে যাওয়াই ভালো। ”
তাফসিরের এমন কথায় শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইল সাবেত। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাফসির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সামনের দিকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকচিরে।
তারপর ধীর গলায় চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“শালা প্রেমিক পুরুষদের জাতটাই হারামির জাত৷”
সাবেতের মায়ের চোখ-মুখের খুশির ঝিলিক যেন কমছেই না৷ ফোনে মারিয়া যা দেখিয়েছিল এতো তার চারগুণ সম্পত্তি। এসব দেখাশোনা করে ভালোভাবে জীবন কেটে যাবে তার দুই ছেলের।
আর কি চাই? তার দুই ছেলে দুধে ভাতে থাকবে, এর জন্য হাজার আনতারাকে বলি দেওয়া যায়।
তাছাড়া সাবেত মারিয়ার সাথে সুখেই আছে না হলে মারিয়া পোয়াতি হয় না কি?
পোয়াতি মনে হতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল সাবেতের মায়ের। আনতারাও যে প্রায় মাস পাঁচেকের অন্তঃসত্ত্বা।
মেয়েটা কিছুই খেতে পারে না৷ কে জানে কেমন আছে? এতগুলো বছর একসাথে থাকায় আলাদা মায়া জন্মেছে মনে।
ঠিক তখন মারিয়া সাবেতের মায়ের জন্য গরম এক মগ কফি এনে দিয়ে আধো আধো বাংলায় বলল,
“আমি চা বানাইতে পারি না৷ কফি খেয়ে দেখুন,ভালো লাগবে।”
মাহির বসে আছে আনতারার পায়ের কাছে৷ পা দুটো অসম্ভব ফুলেছে। এতদ্রুত শরীরে পানি আসার কথা নয়৷ পা প্রচন্ড ব্যথা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আগ্রহ ছোট্ট ছোট্ট হাতে পা মালিশ করছে আনতারার।
“আগ্রহ, যাও তো বাবা তোমার মা কে বলো হালকা কুসুম গরম পানি নিয়ে আসতে। ”
মাহিরের কথায় আগ্রহ ছুট লাগায় মায়ের কাছে। এদিকে আনতারার পায়ে স্পর্শ করতেই আনতারা পা সরিয়ে নেয়। মাহির মুচকি হেসে পায়ে হাত দিতে দিতে বলল,
“শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নয়, তোর স্বামীর বন্ধু হিসেবেই তোর খেয়াল রাখতে দে৷ কারণ খুব দ্রুত তুই যার আমানত সে এসে তোকে নিয়ে যাবে।”
চলবে