শিরোনামহীন,পর্বঃ১৯+২০
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
আমি যখন এদেশে এসেছিলাম আমার দিন বেশ ভালোই চলছিল।স্টাডির পাশাপাশি জব করছিলাম। যা ইনকাম হতো বেশ ভালোভাবে চলে যেত,বাড়িও পাঠাতে পারতাম।
এমনি এক রাতে কাজ শেষে ফিরছিলাম। একটা হস্পিটালে রিসিপশনে ছিল আমার কাজ৷
রাত তখন প্রায় অনেক।আরা ছিল ফোন কলে। ব্যস্ত শহরের মানুষকে পাশ কাটিয়ে আরার সাথে কথা বলতে বলতে ফিরছি আমি, ঠিক তখন দেখতে পাই একটা ছেলে একটা মেয়ে বেধড়ক মার মারছে।
ভিন দেশ বলে কাটিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু মেয়েটার চিৎকার শুনে আরা বলল,
“অন্তত মানুষ হিসেবে সাহায্য করতে। ”
আমি তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই ছেলেটা তটস্থ হলো। ইংরেজিতে জঘন্য গালি দিল আমার উদ্দেশ্যে। তবুও শান্ত স্বরে সমস্যা কি জানতে চাইলে ছেলেটা আমাকে আঘাত করে বসল।
আমার মেজাজের বারোটা ততক্ষণে হয়েছে। কারণ মেয়েটার অবস্থা ভালো ছিল না কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। ছেলের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পুলিশ আসে।
যেহেতু আমি ভিন দেশি এবং বাঙালি তাই দোষ আমার উপরেই প্রায় চলে এসেছিল।
তখন মেয়েটা সত্যি বলায় আমাকে নয় অন্য ছেলেকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়।
মেয়েটাকে ধরে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর মেয়েটা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাত দুটোর সময় প্রাইভেট হস্পিটালে এডমিট করিয়েছিলাম।
সুস্থ হওয়ার পর সবটা জানতে পারলাম।
মেয়ের নাম মারিয়া। বাবা মুসলিম মা খ্রিস্টান।
কয়েকদিন হলো বাবা গত হয়েছেন। যে মারধর করছিল সে মারিয়ার প্রেমিক।
বাবার স্মৃতি বলতে শুধু রয়েছে তার রেস্টুরেন্ট কিন্তু জুয়ারি প্রেমিক তার মালিকানা চাইছে।
মারিয়ার অভিভাবক হিসেবে আর কেউ নেই৷ না আছে ওকে সাপোর্ট করার মতোন কেউ।
আমার সম্পর্কে সব জেনে মারিয়া তাকে তার রেস্টুরেন্টে জব অফার করে৷
মূলত সে চাইছিল একটা নিরাপত্তা, ভিনদেশীর উপর নির্ভরতা।
আমি আরাকে সব জানানোর পর আরা রাজি হয়, এবং এরপর মারিয়ার ওখানে জব সাথে আমার লেখাপড়া বেশ ভালোই চলছিল।
একদিন রাতে বিধস্ত মারিয়া এলো আমার দরজায়।উষ্কখুষ্ক চুল,রক্তিম চোখে টইটম্বুর পানি, ঠোঁটের আগায় রক্ত।
বুঝতে বাকি রইল না স্মীথ মানে মারিয়ার সাবেক প্রেমিক পুনরায় আঘাত করেছে।
সেরাতে মারিয়া আমাকে একটা প্রস্তাব দেয়। তাকে বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু আমি সাফ মানা করে দেই৷ কারণ আরাকে ঠকানোর বা দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলার মতোন সাহস আমার নেই।
পরদিন যথারীতি কাজে যাই। সেখানে হঠাৎ উদয় হয় স্মীত। বেশ হট্টগোল বেঁধে গেল।মারিয়ার কোন অভিভাবক নেই। এটা নিয়ে মারিয়া বেশ কান্নাকাটি করল।আমি কি করব? কিন্তু মারিয়ার নিরাপত্তা বেশ চিন্তায় ফেলে দিল।
শেষ বার মারিয়া যখন আমার কাছে এলো তখন আমি ফেরাতে পারিনি ওর দুচোখের পানি দেখে।
বিয়ে করে নিলাম মারিয়া কে। অথচ আনতারাকে জানানোর সাহস আমার হয়নি।
এরপর আরাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। বিয়েটা নাম মাত্র ছিল।
তবে এক ছাদের নিচে থাকতে থাকতে হয়তো মারিয়া আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে আর আমার মনে মায়া জন্মেছে।
আর সে থেকেই………
তাফসির মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সাবেতের কথাগুলো।
দৃষ্টি ছিল শূন্যে। বা হাতে অনামিকায় থাকা কুইন সাইনের আংটি বার দুয়েক দেখল।
এই আংটিটা……
চোখ বন্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা আয়ত্ত করে নিয়ে বলল,
“জানিস তো! প্রিন্স আমার সাথে বিগত দুই মাস যাবত কথা বলে না।কোন একটা মেয়ের কারণে।আমার জন্য তোর কষ্ট হয় সাবেত? এসব শুনে? ”
“হয়। তোর মতোন একটা মেয়েকে এভাবে ঠকানোর কি খুব প্রয়োজন ছিল?”
“আমাদের প্রত্যেকের এক একটা না পাওয়ার গল্প আছে। গল্প আছে ঠকে যাওয়ার বা কাউকে ঠকানোর। কখনো ভেবে দেখেছিস? স্টার’স এর হয়তো এমন কেউ আছে যে তার কষ্টে কষ্ট পাচ্ছে।
দু-হাতে আগলে রাখছে? ”
“এমন কেউ নেই। আমি ব্যতীত আরার কেউ নেই।”
“স্টার’স নিজেও হয়তো এমন ভাবতো কিন্তু তুই ওর ভরসা রেখেছিস?”
স্টার’স শব্দ শুনতেই সাবেতের বুকে রক্ত ছলকে উঠলো।তাফসির আনতারা কে স্টার’স বলে ডাকে এদিকে মাহির তো আনতারাকে তারা বলে ডাকে।
সাবেতের অনুপস্থিতিতে একমাত্র মাহির আনতারার কাছাকাছি থাকবে।
মাহিরের নাম মনে হতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল সাবেতের।
আনতারার প্রতি মাহিরের অনুভূতি সে জানে না।তবে মাহির আনতারাকে সমীহ করে এটা সে জানে।
সাবেত কি কি যেন ভাবছিল এমন সময় তাফসির বলল,
“শুনেছি কায়া দেখলে মায়া বাড়ে। সামনাসামনি সব মিটিয়ে নে। অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে। তবে এদিকে খেয়াল রাখিস, মারিয়া মেয়েটাও তোর উপর নির্ভরশীল।
মা হতে চলেছে।তবে স্টার’স বুদ্ধিমতী মেয়ে। যা সিদ্ধান্ত নিবে আশা করি এতে মারিয়া, তুই বা স্টার’স কারো কোন ক্ষতি হবে না।”
“আমি দেশে ফিরে যাব। যা হবার হবে। আরা চাইলে ফিরব না হলে না।তবুও আমি পাহাড় সমান অভিযোগ বা আত্নগ্লানী নিয়ে বাঁচতে পারব না৷ আমি খুব দ্রুত দেশে ফিরে যাব।”
চলবে
শিরোনামহীন
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
পর্বঃ২০
সাদা ধবল পায়ের আংগুলগুলো বেশ লালচে হয়ে আছে।
কিছুটা স্ফীত। পায়ের আংগুল দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন দুধে হালকা আবির মিশিয়েছে।
যার ধরুন একটা মিষ্টি মিষ্টি রঙ ফুটে উঠেছে।
আনতারার পায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হাসলো মাহির।
আবিরের রঙের কথা ভাবতেই মনের গহীনে রক্ত ছলকে উঠেছে।
এক নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ গ্রীষ্মের দুপুরের একাকীত্ব অনুভব হচ্ছে।
বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক অজানা দীর্ঘশ্বাস।
চোখ বন্ধ করে নিজেকে আয়ত্ত করতে চাইলে মানস্পটে ভেসে উঠলো
কোন এক নারীর ঠোঁটের নিচে ডান পাশের ছোট্ট তিল,
হাতে থাকা লেডিস ওয়াচ।
তবে মুখ টা বেশ অস্পষ্ট। মাহির চাইলেও মনে করতে পারে না সে মুখ।
অচিরেই শক্ত হয়ে উঠলো মাহিরের চোয়াল।আগ্রহের উপস্থিতিতে চোখ মেলে তাকায় মাহির।
পুনরায় দৃষ্টি স্থির হলো আনতারার পায়ে।
হাত দিতে যাবে ঠিক তখন আনতারা পা সরিয়ে নেয়।
মাহির শক্ত হাতে পা ধরে নিয়ে
ঈষৎ গরম পানিতে পা রাখে আনতারার।
আনতারা বেশ স্বস্তি পাচ্ছে৷ প্রচন্ড ব্যথা লাগছিল পায়ে। আংগুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘা হয়ে অবস্থা বেহাল।
“তারা, তুই খালি পায়ে আর হাটবি না।”
“হুম।”
“কাঁদা মাটিতে নামবি না৷ কাঁদা পায়ে থাকিস তাই আজ এমন হয়েছে।”
“হুম।”
“আমি সব সময় থাকব না রে। তুই কি বুঝিস না?”
“এই পৃথিবীতে কেউ দীর্ঘস্থায়ী থাকে না। স্বার্থ উদ্ধার হলে সবাই চলে যায়।”
আনতারার কথায় আহামরি কিছু ছিল না তবে যা ছিল তা হলো একরাশ অভিমান।
এক ফালি রোদ এসে পড়েছে আনতারার কোলে। পেট ইদানীং বেশ বড় হয়েছে৷
চোখ-মুখে শুকনো ভাব।
মাহির কিছুই বলল না, চলে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেল,
“বকুল তলায় যাসনে তুই এই অবস্থায়। পড়ে গেলে উপায় থাকবে না। বাচ্চাটার কোন দোষ নেই। ওকে বাঁচতে দে। আসতে দে এই পৃথিবীতে।”
আমরা পৃথিবীতে বড়ই একা। আমাদের কেউ নেই। আমরা কেউ কারোর নই।
দিন শেষে আমরা প্রতিটি মানুষ বড্ড নিঃস্ব। কেউ হেরে যাই নিজ গল্পে কেউ বা পরের স্বপ্নে।
তবুও আমরা বাঁচি, একটি নতুন ভোরের আশায়।
একবুক স্বপ্ন এবং একটু শান্তির ইচ্ছে নিয়ে ঘুমাতে যাই। একটু শান্তির আশায় নির্ঘুম কাটানোর রাতের হিসেব কখনো করি না, না করি দীর্ঘ শ্বাসের হিসেব। তবুও আমরা বাঁচি, হয়তো পরের জন্য,
অথবা হয়তো নিজের জন্য।
ঠিক তেমনি হেরে যাওয়ার গল্পে ফিরে এলো না সাবেত।
আনতারা প্রতিদিন গাছের গোড়ায় পানি দেয়, বকুল তলায় যায়,নিয়মিত ফোনে মেগাবাইট লোড দেয়, ফোন চার্জ দেয় অথচ আসে না কোন কল বা ছোট্ট একটা ম্যাসেজ।
একাকীত্ব আনতারা চুপসে গেছে সাবেতের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তার গর্ভের সন্তান।
আজ সকালে মারিয়া ছেলে জন্ম দিয়েছে। সাবেতের মায়ের খুশি যেন ধরছে না।
ভাগ্যিস সেদিন ওই তাফসিরের সাথে কথা গুলো শুনেছিল।
তাইতো বুঝ দিয়ে আটকে রেখেছে ছেলেকে৷ কারণ এমন রাজত্ব সহ রাজকন্যা ছাড়া আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা সমান কথা।
সাত মাসের ভরা পেট নিয়ে আনতারা এগিয়ে যাচ্ছিলো ইমনদের বাড়ি। সেখান থেকে যদি সাবেতের সাথে যোগাযোগ করা যায় এই আশায়।
এই একটু পথ হেটে এসে ঘেমে-নেয়ে অস্থির আনতারা৷
ঘরের বাহিরে বসে পড়লো সে।
তারপর ইমনের মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“চাচী, ইমন ভাইরে একটু…..
কথা শেষ করার আগেই ইমনের স্ত্রী এসে বলল,
” আম্মা, আম্মা দেখেন, সাবেত ভাইয়ের সেই বিদেশি বউয়ের ছেলে হইছে। সব্বাই কি খুশি।”
শাশুড়ীর ধমকে চুপ হলে খেয়াল করলো,আনতারা বসে আছে।
আনতারা হাত বাড়িয়ে ফোন চাইলো।
ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল,
হাসি হাসি মুখে সাবেত বসে আছে ছেলেকে কোলে নিয়ে,পাশেই বেডে শুয়ে সাবেতের বাম হাত আঁকড়ে ধরে আছে মারিয়া।”
চলবে।