শিরোনামহীন,পর্বঃ ২৩+২৪

0
3131

শিরোনামহীন,পর্বঃ ২৩+২৪
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
পর্বঃ ২৩

শরৎের আকাশ গাঢ় নীলের মাঝে উড়ছে একদল মেঘ৷ শুভ্র সাদা মেঘ, ঝকঝকে আকাশ সাথে হালকা বাতাস। জানান দিচ্ছে শীত এলো বলে।
আনতারা কে নিয়ে পরদিন ছোট ভাই হাসপাতাল থেকে যখন ফিরলেন তখন বেলা বেশ খানিকটা হয়েছে।
পুরো রাস্তা আনতারা হিসেব মিলিয়েছে। পাওয়া, না পাওয়ার। কোথায় কি কমতি? নিয়তি কেন এমন প্রতিদান দিচ্ছে এসব।
সব চিন্তার যোগফল শূন্য।

বাড়ির সামনে যেখানে সবজির বাগান করা হয়েছে সেখানে একটা চেয়ার পেতে বসেছিল আনতারা৷
চোখের সামনে বিস্তৃত এক ক্ষেত। যেখানে চাষ করা হচ্ছে নানান জাতীয় সবজি। শীত এলে কানায় কানায় ভরে যায় এ মাঠ। সব প্রকার সবজি চাষ হয় এখানে।
এক পাশে লাগানো হচ্ছে টমেটোর চারা,বেগুনের চারা সহ আরো কত কিছু!

খুব মনোযোগ দিয়ে আনতারা সেসব দেখছিল।তন্দ্রাঘোরে চলে গিয়েছিল সে ঠিক এমন সময় মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব করে সে।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে খাকি রঙা চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে তার স্কুলের হেড স্যার। ভরা পেট নিয়ে উঠে বসতে অসুবিধা হচ্ছিল তাই কুমুদ বেগম সাহায্য করলেন।
পাশের চেয়ারে হেড স্যার বসতে বসতে বললেন,

“কেমন আছিস রে মা?”

“আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”

” আমি ভালো৷ খেয়েছিস কিছু?”

আনতারা মাথা দুলিয়ে না সূচক ইশারা করে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হেড স্যার বলতে লাগলেন,

“সেদিন সাবেত আমার কাছে গিয়ে হাতে ধরে তোকে চাইলে আমি না করিনি৷ জানি তোর ভাইয়েরা আমার উপরে কথা বলবেন না, তাছাড়া সাবেত এ গ্রাম নয়,পুরো দশ গ্রামের পরিচিত মুখ। তাই আমি নিজে ওয়ালিয়া হয়ে বিয়ে দিয়ে দিলাম। কিন্তু সেই সাবেত এমন করবে কে জানতো?

তোর বাবা মারা যাওয়ার পর তোকে গাছ দিয়েছিলাম৷ দেখ আজ সেই গাছগুলো কতবড় হয়েছে৷ ঠিক তেমনি আমার ভুল তোর জীবন শেষ করে দিয়েছে৷

কিন্তু মা! তুই তো মা হতে চলেছিস। মায়ের সাথে যে অন্য কোনো সম্পর্ক থেকে ভিন্ন। মা মমতাময়ী, স্নেহময়ী।সন্তান তার কাছে আগে।
একটা হাড় ভাংলে আমরা কেমন করি আর ৫৭ ইউনিট ব্যথা সহ্য করে সন্তান জন্ম দিয়েও তোরা হাসতে জানিস।

সোফোক্লেস কি বলেছিলেন জানিস?

সন্তানরা হচ্ছে মায়ের জীবনের নোঙ্গর।

মা তোকে বাঁচতে হবে, তোর সন্তানের জন্য।
তোর জন্য আজ আমি অন্য কিছু না, চা বাগানের এগারো বছর বয়সী এক মেয়ে দীপাবলির গল্প নিয়ে এসেছি৷ তুই এটা পড়বি। দীপার মাস্টার মশাইয়ের মতোন আমি সাহায্য করতে পারব না তবে দোয়া করি তুই বড় হবি। অনেক বড়।”

আনতারার হাতে হেড স্যার সমরেশ মজুমদার এর লেখা সাতকাহন উপন্যাস দিয়ে চলে গেলেন।
আনতারা চোখ তুলে তাকায় না, তাকালে হয়তো দেখতো
ভদ্রলোক চাদরের এক পাশ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে যাচ্ছেন।

যমে-মানুষে টানাটানি চলছে মারিয়ার ছেলেকে নিয়ে৷ প্রথম প্রথম ছেলে স্বাভাবিক শিশুর মতোন ছিল।স্বাভাবিক ভাবে বুকের দুধ খাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল।মুখ চোয়াল শক্ত করে বন্ধ করে রেখেছে।

পরদিন সকালবেলায় অবস্থা আরো খারাপ। বাচ্চা কাঁদছিল না। কিছুক্ষণ পর শরীরে খিঁচুনি দিয়ে বাকা হয়ে যাচ্ছিল।
বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা ধনুষ্টংকার এর লক্ষ্মণ।
নবজাতকের এমন রোগ তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার মতোন দেশে।অবাক হচ্ছিলো সাবেতের মা।
যতদূর জানে সে এটা হয় বাংলাদেশের মতোন দেশে। পশুর মলের সাথে জীবাণু ছড়ায় এ রোগের৷

মারিয়ার অবস্থা শোচনীয়। চোখ মুখ ফুলে গেছে। কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না।এই বাচ্চাই যে সাবেত আর তার বন্ধন। যদি এর কিছু হয়ে যায় তাহলে সাবেত কে আটকাবে কি বলে?

সাবেতের মা তার ছেলের সুখের জন্য, জেদের জন্য মারিয়াকে ছাড়তে দুবার ভাববে না এটা মারিয়া জানে। মারিয়ার সামনে এখন বিশাল সমুদ্রের ভয়াবহতা কারণ সে এখন অথৈজলে পড়েছে। যার একমাত্র ভাসার উপায় তার সন্তান। না হলে ডুবে মরা যে নিশ্চিত।

আজ বহুদিন পর আনতারা ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেল কল এসেছে। বাহিরের দেশ থেকে।
ত্রস্ত হাতে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কারো কান্নার স্বর ভেসে এলো।

“আনতারা! ও আনতারা আমি তোর মা বলতেছি, তুই কি অভিশাপ দিছিস আমার পোলারে? দিস না মা, তুলে নে। নইলে ওর পোলাডা যে বাঁচবো না। একরত্তির পোলা যে।
ওই পোলা আমার সাবেতের খুশি, মারিয়া -সাবেতের ভবিষ্যৎ। তুই অভিশাপ দিস না।”

আনতারার বুঝতে সমস্যা হলো না যে সাবেতের নবজাতক ছেলের কিছু হয়েছে।আনতারার আজ বলতে বড্ড ইচ্ছে করছে

“আচ্ছা মা! তাহলে আমার গর্ভের ভিতর বেড়ে উঠা শিশুর কথা আপনাদের মনে হয় না? সে কি আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ হতে পারতো না? আপনি কেনো চলে যাওয়ার পর কোনো খোঁজ খবর নিলেন না?”

কিন্তু এসব বলা হয়ে উঠেনা। কারণ যে মানুষগুলো আপন নয় তাদের জন্য কার সাথে যুদ্ধ করবে? মারিয়ার সাথে?
নাহ্! সাবেত নিজ ইচ্ছায় মারিয়াকে বেছে নিয়েছে৷ তাই যা নিজের নয় সেসব নিয়ে আনতারা কিছুই বলল না।

“আপনার ছেলে কিংবা কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
জীবনে স্বার্থের জন্য আপনারা এমন করেছেন। আমি আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা অভিশাপ রাখিনি। ভালো থাকুন আপনারা৷দোয়া করি দ্রুত আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ সুস্থ হয়ে উঠুক।”

“তুই বাচ্চাটাকে রেখেছিস?না কি…….”

“ভালো থাকবেন মা। রাখছি। আসসালামু আলাইকুম।”

আজ অনেকদিন পর আনতারা দু হাত আছড়ে ফেলে বাবার ঘরে কাঁদছে।
ঘরের বাহিরেই বসে আছে তার দুই ভাই, মামা, ভাবী, মা।
তাকে কেউ সামলাচ্ছে না। শুধু বড় ভাই হুংকার দিয়ে বললেন,

“আজ যেন তোর চোখের পানি শেষ ঝরে। এরপর তোর চোখের পানি আমি বরদাস্ত করব না। তাই আজ সব শোক কাটিয়ে মাগরিবের আজান পড়েনে।
সাবেত আজ থেকে তোর জন্য মৃত হলো।গ্রামের রীতি অনুসারে কাল থেকে আমরা তিন দিন সব পালন করব। তিন দিনের দিন মানুষ খাইয়ে দিব। তোর দুঃখের মৃত্যু আজ হলো।কথাটা মাথায় রাখিস।”

চলবে

শিরোনামহীন
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
পর্বঃ২৪

আমি মস্তিস্কের সমস্ত জানালা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছি,
কেউ আসছে না। না রোদ, না পাখির নেকলেস।
কেবল উত্তর পাহাড়ের হিম, ঠান্ডা হাত
ছুঁয়ে যাচ্ছে ব্যথিত চিবুক।
বিস্মৃতির বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে রয়েছি একা,
কেউ আসছে না। না স্বপ্ন, না ঘুম, কেউ নয়।
আঁধারপুরের বাস কতোদূর থেকে তুমি আসো?

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাহির। দৃষ্টি বাহিরের বিস্তৃত আকাশের দিকে।
হঠাৎ নিজের দুচোখ বন্ধ করে নিলো।
পর মূহুর্তে মানস্পটে ভেসে উঠলো এক মায়াদেবীর ছবি৷
ঠোঁটে নিচে ডান পাশের তিল, হাতের অনামিকায় কুইন আংটি, পনি টেইল করে বাঁধা চুল বা হাতে রিস্ট ওয়াচ।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মাহিরের। নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ মেলে তাকালো আনতারার দিকে ।বিছানায় বসে আছে আনতারা।

প্রায় দশ মাসের ভরা পেট নিয়ে বসে আছে সে।
চোখেমুখে লেপ্টে আছে একরাশ স্নিগ্ধতা।

“মাহির ভাই? তোমার মায়াদেবীর কথা ভাবছিলে?”

“এ গল্পে না হয় আমার মায়াদেবীর প্রেম কাহিনী অজানাই থাকুক।”

“কেনো?”

“এ গল্পটা তোর হোক তারা। গল্পটা তোর হোক।অন্য কোনো এক গল্পে না হয় থাকবে আমার গল্পকথা।”

“খুব ভালোবাসো তাই না?”

“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

“না হলে তোমার কন্ঠে রুদ্র বাবুর কথায় এত আবেগ ঝরে পড়তো না।”

“তাই বুঝি? আমরা বড্ড ভুল

সময়ে, ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলি। তারপর সেই ভাঙাচোরা মন নিয়ে ঘুরে বেড়াই।”

প্রতি উত্তরে আনতারা কিছুই বলল না। হলুদের ডালি নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলল উঠোনের দিকে।
বাড়িতে মানুষ গিজ গিজ করছে এখনি। বাচ্চা-বুড়ো সবাই আনন্দে মেতে উঠেছে বিয়েতে।

মাঝে সময় কেটেছে দুই মাস। দুই মাসে সাবেত নানা ভাবে চেষ্টা করেছে আনতারার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারেনি। তাই আজ বাধ্য হয়ে এলো ইমনের কাছে। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা রেখেই ইমন তখন রান্নায় ব্যস্ত।

ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসছে তার স্ত্রীর কন্ঠস্বর।
তাদের কথোপকথন শুনে থমকে দাঁড়ায় সাবেত৷

“আনতারাকে মেনে নিছে তাইলে?”

“হুম। বুবু রে মানছে৷ আর না মানার কিছুই নাই, বুবুর নামে তার বাপে মেলা কিছু দিয়া গেছে।”

“তুমি কি বিয়া বাড়িত?”

“হুম কুমুদ ভাবী একা কত সামলাবে? তাই আসতে হইল।”

“মাস্টার চাচা আসছে না কি?”

“হু আসছে। হলুদ বাটা শেষ। একটু পরেই মাহির ভাই নিয়া যাবো।”

“আনু কেমন আছে? ”

“আল্লায় ভালোই রাখছে। মাহির ভাই তার হাল ধরছে সে খারাপ থাকব কেন?”

কথোপকথন শুনে সাবেত নিশ্চিত হলো আজ আনতারা-মাহিরের হলুদ হচ্ছে কাল বিয়ে।
সে তো সাইন করেনি তালাক নামায়, তাহলে আনতারা বিয়ে করে কিভাবে?

পরক্ষণেই মনে হলো, মা তো আগেই বলেছিল তাদের পরকীয়ার কথা। আর যাই হোক আজ থেকে সাবেত আর কখনো আনতারাকে মনে করে কষ্ট পাবে না। মারিয়া কে কষ্ট দিবে না।

লাল কালো মিশেলে শাড়ি পরনে আনতারার। হাসি মুখে হলুদ বাটি এনে দাঁড়ালো ভাইয়ের সামনে।
তারপর ডান হাত দিয়ে আচঁলে কোণায় হলুদ নিয়ে লাগিয়ে দিলো ভাইয়ের কপালে।
আজ তার ছোট ভাইয়ের হলুদ হচ্ছে কাল বিয়ে।দেখে মনে হচ্ছে এই আনতারার কোনো দুঃখ নেই যে দুঃখের গল্প শুনিয়ে কারো মন খারাপ করবে কেউ।

কিন্তু খুব একটা সময় এই সুখ স্থায়ী হলো না। দুহাতে পেট ধরে ধীরেধীরে হেটে সরে এলো সে।
এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো ।বুঝতে সমস্যা হলো না যে সময় আর নেই। দ্রুত নিতে হবে হাসপাতালে।

আজ অনেক রাত পর সাবেত নিজের শরীরে আমন্ত্রণ জানালো মারিয়াকে।
নেশায় বুদ সাবেত যখন মারিয়াতে মত্ত তখন মনের কোনো এক রাজ্যের অন্ধকার কুটিরে বন্দী আনতারার অনুভূতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কেনো যেন আনতারার কথা বড্ড বেশি পোড়াতে লাগলো তাকে।
মারিয়া কে ছেড়ে ত্রস্ত হাতে সিগারেট ধরায় সাবেত৷ বার বার মনে হচ্ছে আনতারা তাকে ডাকছে।
বার বার ডাকছে।

ডেলিভারি রুমের চারিপাশ আনতারার চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে৷ ঠিক পয়তাল্লিশ মিনিট পর আনতারা জন্ম দিলো এক শিশু৷
এক পুত্র সন্তান। তবে তাকে কোলে নেওয়ার আগেই স্থির হয়ে গেলো আনতারার দু হাত।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here