শিরোনামহী, ২৫ শেষপর্ব

0
4919

শিরোনামহী, ২৫ শেষপর্ব
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)

একফালি রোদ এসে পড়েছে ঘরের এক কোণে।
ছোটো ছোটো নরম আদুরে হাত দুটো জড়িয়ে ধরে আছে আনতারার গলা।
এক মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে। ঠিক যেমন সাবেতের গা থেকে আসতো।
আনতারা পিট পিট চোখে তাকিয়ে ছেলেকে একবার দেখলো, কাথাটা টেনে ছেলের শরীর ঢেকে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল।
দেখতে দেখতে কেটেং গেল চার বছর।
ছোট্ট সাফওয়ান দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। আনতারার মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে আছেন তার মা।সব পাল্টেছে। অতীত এখন ধুলোপড়া স্মৃতির বৈ কিছুই নয়।

এই চার বছরে যদি কিছু পাল্টে না থাকে তা হলো আনতারার বকুল তলায় যাওয়া। সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে আনতারা সাবেতের জন্য কোনো অনুভূতিহীন তবে সবার দৃষ্টির অগোচরে আনতারা যেনো সেই সপ্তদশী আনতারাই রয়ে গেছে।
প্রতিরাতেই বকুল ডালে মালা ঝুলে, ফুল না থাকলে ঝুলে নগ্ন সুতো।

“সাবেত এখন অন্যের। তাতে কি? আনতারার মনের রাজ্যে যে সাবেতের বসবাস সে তো ঠিক আগের মতোন আছে।”

“ভালোবাসতাম বলে কোনো শব্দ হয় না। ভালোবাসা কখনো প্রাক্তন হয় না। আমি আজ যাকে ভালোবাসি কাল সে আমার রইল না বলে যে তাকে অপমান করে কথা বলব কিংবা তাকে ভুলে যাবো এমন তো নয়। সে থাকুক না তার ভালোবাসা কে নিয়ে সুখে। আমার জন্য কেউ ভালো না থাকুক অন্তত কষ্ট না পাক। এটাই তো কাম্য।”

ছেলে কে রেখে বিছানা থেকে নেমে এলো আনতারা। বাহির থেকে ছোট ভাবীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
ভদ্র মহিলা আনতারাকে এই বাড়িতে এক দন্ড সহ্য করতে পারে না।
পাকঘরে দুই জা মিলে রান্না করছে। কুমুদ বেগম বরাবর চুপচাপ থাকে৷ আজ কামিনী কে জবাব দিতে বললেন,

“কামিনী শোন,আমি যখন এবাড়ি এসেছিলাম তখন আনা বড্ড ছোট। তখন থেকে আনা কে মানুষ করেছি। আগ্রহ পরে জন্মেছে কিন্তু আনা আমার প্রথম সন্তান৷ তুই আমার সামনে আমার আনাকে কিছুই বলবি না।”

“ভাবী ভালো হইলে জামাই ছাড়তো?”

“সাবেত হীরে চিনেনি। এটা তার দোষ। আর হ্যাঁ তোকে একটা কথা বলি। আনা তোদের সংসারে না, আমরা আনার সংসারে আছি।
এ বাড়ি আনতারার নামে লিখে দেওয়া হয়েছে তোর বিয়ের আগেই। এমনকি যে পানের বহরের একটা মোটা অংক তুই নিস সেটাও আনার নামেই।”

“মানে?”

“তোর স্বামীকে জিজ্ঞেস করিস, ভালো করে বলতে পারবে।”
,
,

সাবেতের মায়ের অবস্থা ভীষণ খারাপ। পুরো শরীরে কিছু একটা ব্রণের মতোন উঠেছে। তারপর সেখান থেকে ঘা তে রুপান্তরিত হয়েছে৷ বাজে গন্ধ আসে।

সাব্বির ওদের ছেড়ে বছর দুয়েক আগেই পা বাড়িয়েছে ডেনমার্কে।
সাবেত আছে মারিয়া, সায়র এবং মা কে নিয়ে।
মায়ের দেখাশুনা মারিয়া করে না। ডক্টর দেখানো থেকে শুরু করে সবটা সাবেত নিজেই করে।
সাবেতের মায়ের মুখে ইদানীং একটা কথাই শোনা যায়,
সে ভুল করেছে, পাপ করেছে। তাই আজ এই পরিণতি। মায়ের প্রতি সাবেত কোনো ঘৃণা বা অবজ্ঞা কাজ করে না।আলতো হাতে মায়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলো সাবেত, তখন সাবেত মা বললেন,

“সাবেত বাবা!”
“বলো মা।”
“দেশে নিয়ে যাবি আমায়?”
“দেশে কে আছে মা?”
“তোর স্ত্রী আনতারা আছে, তোর সন্তান আছে।”

সাবেতের চিরুনি থেমে গেল।ত্রস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“আমার সন্তান?”
“হ্যাঁ।তুই দেশে যাওয়ার পর আনতারা গর্ভবতী হয়। আমরা যখন এখানে আসি তখন আনতারা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আর আনতারা তোকে তালাক নামায় সই করে দেয়নি। ওটা জাল ছিলো।আনতারার ফোন থেকে তোর নাম্বার ব্লক,তোর ফোন হারানো,মাহিরের সাথে সম্পর্কের কথা এসব মিথ্যা। আমি সব করেছি মারিয়ার কথায়।ও যা যা বলেছিল তোদের ভালো ভবিষ্যতের আশায় আমি এসব করেছিলাম। অথচ দেখ সাব্বির আমার সাথে কথা অবধি বলে না।আমি ওকে আমার কসম দিয়েছিলাম। আনতারা…………”

সাবেত ধীর গতিতে মায়ের ঘর থেকে চলে এলো। পুরো পৃথিবী ওলট-পালট লাগছে।চারপাশ হঠাৎ গুমোট হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে এখানে সতেজ নির্মল বাতাসের বড্ড অভাব।

,
,

বিকেল হতেই গ্রামের পরিবেশ মুখোরিত হয়ে উঠেছে৷ আনতারার কপাল বিদেশি মেয়েরা বারবার পুড়ায় বলে।
গ্রামের সবার ধারণা ছিলো মাহির আনতারাকে বিয়ে করবে কিন্তু আজ মাহিরের বাড়িতে এক মেয়ে এসে উঠেছে। শার্ট- প্যান্ট পড়া মেয়ে।

বাড়ির উঠোনে বসে আছে সে। পনি টেইল করে বেধে রাখা চুলের কিছুটা সামনের দিকে। হাতে থাকা কুইন আংটির দিকে নজর। চেয়ারম্যান বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ আনতারা প্রথমে গিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বললো
কারণ মাহির তখন বাড়িতে নেই।

“তাফসির আপু?”
আগত কন্ঠস্বরের উৎসের সন্ধানে তাফসির মুখ তুলে তাকায়। ভূত দেখার মতোন চমকে উঠে সে।
নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। তারপর জবাব দেয়।

“জ্বী? ”
“আমার সাথে আসুন। আসলে এখানে এ পোশাকে….”

তাফসির কোনো কথা বাড়ায় না।চুপচাপ চলে যায় তার সাথে। তাকে শাড়ি পড়াতে পড়াতে আনতারা অনেক কথাই বললো। সেসব কথা মাহির আনতারাকে বলেছে।
কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে তাদের বিচ্ছেদের বয়স পাঁচ বছর অথচ আজ তাফসির সব ছেড়ে চলে এসেছে এখানে। নিশ্চয়ই মাহির তাকে দেখে চমকে যাবে। আচ্ছা তাকে রাখবে তো?

শেষমেশ অনেক কথার পর মাহির -তাফসিরের বিয়ে ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। আনতারা চলে যাওয়ার আগে বললো,

“আমার এই ভবঘুরে ভাইয়ের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার ভাবী৷ খেয়াল রেখো আগলে রেখো। ”

“তোমার নাম কি? ”

তাফসিরে প্রশ্নে মুচকি হাসে আনতারা। তারপর বললো

“আফিয়া আনতারা৷”

তারপর ছেলের বায়নায় দ্রুত সেখান থেকে চলে যেতে হলো তাকে। আনতারা চলে যাওয়ার পর তাফসির পাশে থাকা অন্য এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,

“বাচ্চাটা কে?”
“সাফওয়ান ওটা তো তারাবুবুর ছেলে। ”
“ওর বাবার নাম?সাবেত সামী?”
“হুম। সে নাই বিদেশে বিয়া করছে।”

তাফসির আশেপাশের অন্য কারো কথায় আপাতত কান দিতে পারছে না।তার শুধু এটা মনে হচ্ছে। আচ্ছা স্যাম কি জানে? তার সাফওয়ান নামের এক ফুটফুটে ছেলে আছে? ”

সাবেত গ্রামে ফিরে এসেছে। একা আসেনি। সাথে এসেছে তার মা-মারিয়া-সায়র। গ্রামের সবার মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। কি হতে চলেছে এরপর ?

সাবেত যখন নিজ ঘরের তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে তখন বিছানায় ধুলো জমা এক জোড়া চুড়ি দেখতে পায়। চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না চুড়িগুলো কার। পরম যত্নে বুকে আগলে ধরলো সে। মারিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে। সাবেত তাকে ত্যাগ করেনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিন্তু আর কখনো গ্রহণ করবে না এটাও মারিয়া জানে। না রইল একূল না অকূল।

আনতারার চূড়ি হাতে সাবেত পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখছিল।যেভাবে হোক না কেনো সে আজ আনতারাকে ফিরিয়ে আনবেই। তাই ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো আনতারার বাড়ির দিকে।
যাওয়ার সময় পথে বকুলতলা দেখা যাচ্ছে। সেখানে ঝুলছে এক বকুলের মালা।বকুল গাছের পাশেই হাসনাহেনা ফুলগুলো মাটিতে পড়ে আছে। আনতারা অবশ্যই তাকে এখনো ভালোবাসে। তারজন্য অপেক্ষা করছে। না হলে কি আর বকুল তলায় মালা থাকতো?

সাবেত যখন আনতারার বাবার বাড়ি পৌঁছেছে তখন খেয়াল হলো বাহির বাড়ি এক জায়গায় খেজুরের ডাল, বড়ইয়ের ডাল রাখা। গ্রামে এসব তখন রাখা হয় যখন ওখানে কোনো মৃতব্যক্তিকে ধোয়ানো হয়।

বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই খেয়াল করলো বাড়িটা অদূর অতীতে কারো মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে।
উঠোন পেরিয়ে সামনের বারান্দায় বসে বছর চারেক এর ছেলে ডাল দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছে।
ছোটো ছোটো হাত গুলোতে ভাত খুব অল্প জায়গা করে নিচ্ছে, তবুও সে চেষ্টা করছে। তার ভাত খাওয়ার আনাড়িপনা বলে দিচ্ছে সে সচরাচর নিজ হাতে ভাত খায় না।

কোথা থেকে কুমুদ বেগম এগিয়ে এসে ছেলের দিকে ডিম এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“এ কি সাফওয়ান?খালি ডাল দিয়েই খেলি?ডিম নিলি না?”

ছেলেটা হাত ধুয়ে পরনে থাকা প্যান্টে হাত মুছতে মুছতে বলল,

“মায়ের কাছে যাই মামী?”

কুমুদ বেগমের উত্তরের অপেক্ষা না করে দৌড়ে চলে গেল সে। আঁচলে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন কুমুদ বেগম। তারপর উঠে ঘুরে দাড়াতেই দেখতে পেলেন সাবেত কে।
সাবেত কে দেখে তার কোনো উৎসাহ হচ্ছে বলে মনে হলো না।বাড়ির মেহমান হিসেবেই চেয়ার এগিয়ে দিলেন সে।
বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেমন আছো?”
“আছি ভাবী। আপনি?”

প্রতি উত্তরে কুমুদ বেগম হাসলেন।ঠিক সেসময় সেখানে এলো মাহির-তাফসির। তারা খবর পেয়েছে সাবেত এবাড়িতে এসেছে। আনতারার কথা জিজ্ঞেস করতেই কেউ কিছুই বললো না।সবাই যেন চাইছে সাবেত আনতারার থেকে দূরে থাকুক।কিন্তু তাই কি হয়?

“ভালোবাসা কখনো কমে না। দিন দিন বাড়ে। সে মানুষ থাকুক আর না থাকুক।তুই ছিলি না কিন্তু আনতারার মনে ছিলি।
তোদের পাগলামি তুই ভুলে গেলি, মেয়েটা মনে রাখলো। প্রতিদিন মালা ঝুলানো তার যেন গুরুদায়িত্ব । ফুল ফুটুক না ফুটুক,ঝড়-বৃষ্টি,শীত-বর্ষা কিছুই তো বাধা ছিলো না।
তাইতো তিন দিন আগেও একরাতে সে বেরিয়েছিল বকুল তলায় ফুল কুড়াতে,মালা ঝুলাতে। ঝুলিয়েছিলও। পাশের হাসনাহেনার সৌরভে মুখরিত ছিল চারিপাশ।
মালা ঝুলিয়ে চলে আসার সময় কোনো ভাবে তাকে সাপে কাটলো। হয়তো বাঁচতে চেয়েছিল,তাই ছুটেছিল কিন্তু পারেনি। হোচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বকুলতলায়।

আমরা পেয়েছিলাম বেলা ৯ টার দিকে। ততক্ষণে আমার তারা সত্যি আকাশের তারা হয়ে চলে গেছে। আজ তারা মারা যাওয়ার তিন দিন।”

গোরস্থানে একটা নতুন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সাবেত কে কথাগুলো বলছিল মাহির। সাবেতের দৃষ্টি তখন কবরের দিকে স্থির। ইচ্ছে হচ্ছে কবরের মাটি খুবলে তুলে ফেলতে। একবার নিজের বুকের সাথে আনতারাকে জড়িয়ে নিতে। ঠিক তখন মনে পড়ল,

আনতারা বলেছিল,
“আমি তো দূর,আমার লাশ টাও যেন দেখার ভাগ্য না হয় আপনার৷”

এসবের থেকে মৃত্যু আজ বড়ই সুখের মনে হচ্ছে সাবেতের। আনতারা তাকে এভাবে শাস্তি দিবে কখনো চিন্তা করেনি। নীরবে শুধু সহ্য করেছে।শাস্তি কি আনতারা দিলো না কি প্রকৃতি?

আনতারার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাবেতের দৃষ্টি হঠাৎ বকুল তলায় স্থির হলো। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সাবেত দেখতে পেল,

“চার কি পাঁচ বছর বয়সী এক বাচ্চা ছেলে বকুল গাছের সব থেকে নিচু ডালে সদ্য গাথা এক বকুলের মালা ঝুলাচ্ছে। ”

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here