শিশিরের কহিনুর,পর্বঃ১

0
2674

#গল্পঃশিশিরের কহিনুর,পর্বঃ১
#লেখিকাঃআরোহী নুর

ফুলে সজ্জিত স্টেজে বসে আছি গালে হাত দিয়ে,চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অজোরের বন্যা,একটু আগেই গালে পড়েছে কড়া একটা থাপ্পড়,চোখের সামনে শেরওয়ানি পরনে আমার হবু বরটা মাটিতে পরে কাতরাচ্ছে,কাতরাবেই না কেনো হাতে পর পর দুটি গুলি পড়েছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে স্টেজের নিচ তলা , মা-বাবার আর সেখানে উপস্থিত যতো আত্নীয় স্বজন ছিলো সবার মাথায় বন্ধুক তাক করা,সবাই ভয়ে থরথর করে কাঁপছে আর সবার চোখেই কান্নার ঢল নেমেছে,কান্না করবে না কিভাবে কতো সপ্ন দেখেছিলো ওরা আমার বিয়েটা নিয়ে,কতো আয়োজন করেছিলো কখনো কেউ হয়তো ভাবেই নি এরকম কিছু ঘটবে,সবাই কতো আনন্দ করছিলো অবশ্য আমি লোক দেখানো আনন্দ করছিলাম বিয়েটা আমিও করতে চাইছিলাম না,বিয়ে করতে না চাওয়ার উপযুক্ত কারন অন্য সময় অন্যটা থাকলেও আজকের কারনটা আমার জানা ছিলো না,কেনো যেনো মনের কোনটায় কিছু খালি খালি অনুভব হচ্ছিলো,জানি না জিনিসটা কি মনের সব টান একসাইড করে বিয়ের সাজে বসে ছিলাম স্টেজে তখনই ঘটনাটা ঘটলো,সামনে বসে থাকা কাজি সাহেব কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তোতলাতে তোতলাতে বলছেন বলো মা কবুল।ইনি হয়তো প্রথম কাজি যিনি এই নাজেহাল পরিস্থিতিতেও বিয়ে পড়াচ্ছে,কাজির বাম হাতেও যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা ধারালো ছুড়ি,প্রাণের ভয়ে ডানহাতে বিয়ের সমস্ত কাজ করছেন উনি,এদিকে কবুল বলার কোনো আগ্রহ নেই আমার,কিন্তু না বলেও আমি কোনো পার পাবো না,পাশে বসে থাকা লোকটাকে আমি পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ঘৃণা করলেও আজ না চাওয়া সত্ত্বেও কবুল বলে এর বউ হতে হবে,তবে মনে বেঁধে নিয়েছি কখনো এই নরপশুকে ভালোবাসবো না আমি,কখনো বাসি নি আর বাসবোও না, এই লোকটা যে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই না আমি একে শুধু ঘৃণা করি আর সারাজীবন করবো,কখনো নিজের স্বামী মানবো না একে আমি কখনো না, টাকার জোরে হয়তো এই লোকটা পৃথিবী কিনে নিতে পারে,যা চায় তা করতে পারে তবে এই লোকটা টাকা দিয়ে কখনো আমার মন কিনে নিতে পারবে না কখনোই না।হঠাৎ আমার এসব চিন্তার ব্যাঘাত ঘটলো লোকটার ধমকে।

কি কবুল বলবে, না কি একটা লাশ ফেলবো চোখের সামনে তোমার তো আবার সোজা কথা কানে যায় না,ভাবছি তোমার প্রিয় জেবিন আপুর লাশটাই আগে ফেলি তখন হয়তো তোমার মাথায় ঢুকবে যে তুমি বিয়ে না করলে আমি কি করতে পারি।

লোকটার কথায় আর দেড়ি করলাম না তরফরিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পরপর তিনবারই কবুল বলে দিলাম কারন আমার জানা আছে লোকটা যা বলে তা করে দেখাতে সমর্থ্য,আমি কবুল বলার আগেই কাজি সাহেব লোকটাকে কবুল বলালেন,পরপর তিনবারই কবুল বললো না থেমে, বিয়ে করার জন্য এতো তাড়াহুড়ির বর আমি এর আগে কখনো দেখি নি,তারপর কাজি সাহেব বিয়ের কাগজ এগিয়ে দিলে ঝটফট সাইন করলো বজ্জাতটা তারপর আমার দিকে এগিয়ে দিলো পেপারসগুলো, আমারও আর কি করার আছে মনে জমে থাকা অসীম ভয়,লোকটার জন্য ঘৃণা আর অসহায়ত্ব নিয়ে সাইন করে দিলাম ব্যাস হয়ে গেলাম এই বজ্জাতটার বউ,সাথে সাথে বজ্জাতটা আমায় কোলে করে গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো আমিও আর নড়াচড়া করলাম না কারন এসব জোরজবরদস্তি আমার জন্য নতুন না, এসবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি,এখন নড়াচড়া করেও যে আমার কোনো ফায়দা নেই তা আমার ভালোই জানা আছে তাই আর তা করতে চাইছি না,এই লোকটা যে একটা উন্মাদ পাগল,যা মাথায় আসবে তাই করবে,কে কি ভাববে ওকে নিয়ে,কে কি বলছে ওর কিছু যায় আসে না,ও ওটাই করে যা ওর মন চায়,আর ওকে দমানোর ক্ষমতা এক আল্লাহ ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কারও নেই,আর আল্লাহই একদিন এর বিচার করবে অভিশাপ দিয়ে দিলাম আমি,ভালো হবে না বজ্জাতটার,আমাকে কোলে নিয়ে বজ্জাতটা বসিয়ে দিলো গাড়িতে,ওপর পাশ দিয়ে এসে নিজেও বসে গেলো আর ড্রাইবারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বললো,গাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম প্রিয় মুখগুলোকে আর না জানি কখন এদের দেখতে পাবো,লোকটা কখনো এদের কাছে আসতে দেবে কি না কে জানে,কখনো যদি মনে রহম হয় তবে হয়তো এদের একটু দেখতে দিতেও পারে কিন্তু রহম নামক জিনিসের সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না,একবার যখন আমার দখল পেয়ে গেছে সে দখল আর ছাঁড়বে না কভু আমি জানি,মুক্ত খাঁচার পাখি আমি এভাবে যে শিকারির খাঁচায় আটকা পড়বো কে জানতো,আমরা গাড়িতে উঠতেই বন্ধুক তাক করা কালো পোশাকধারী লোকগুলোও নিজেদের গাড়িতে উঠে পরলো আর আমার স্বজনেরা চোখে নোনাজল নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,ওদের যে কিছুই করার নেই,মা-বাবা ভাই বোনেরা অনেক কাঁদছেন,একপাশপে দাঁড়িয়ে কাঁদছে শিমলা সূচনা আর মু্ন্নি আমার তিন খালার তিন মেয়ে, ওই তিনটা শাঁকচুন্নি এজন্য কাঁদছে না যে আমার বিয়ে এই লোকটার সাথে হয়েছে কারন ওদের বরাবরই দুলাভাই হিসেবে একেই পছন্দ ছিলো,আমার যতোটুকু মনে হচ্ছে ওরা কাঁদছে এতো সুন্দর করে পার্লার থেকে মেকআপ করে এসেও ভালো করে কয়েকটা ছবি উঠতে পারে নি বিয়েটা এভাবে হওয়ায়,তাছাড়া আরও খালাতো মামাতো ভাইবোনরাও কাঁদছে,হঠাৎ চোখ পড়লো আমার জেবিন আপির উপর যে না কি সব নষ্টের গোঁড়া,সেদিন যদি এই শাঁকচুন্নির কথায় উসকানি পেয়ে ঢাকায় না যেতাম তবে হয়তো এসব হতোই না,আমার জীবনটা আলাদাই হতো আজকে,ওদের দিকে তাকাতে তাকাতে দেখলাম ওরা চক্ষুসীমার বাইরে চলে গেলো আসলে ওরা যায় নি আমাকেই এই গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছে ওদের থেকে অনেক অনেক দূরে,চোখ ফেঁটে বেয়ে পড়ছে জল,আমি আবার আস্তে করে কান্না করতে পারি মা,কান্না আসলে সাউন্ড করেই কাঁদি,সাথে কান্নার সাথে ফুঁফানো টা আগেই চলে আসে আমার,সবাই বলে কান্না করলে না কি আমার নাক মুখ একদম লাল হয়ে যায় তখন নাকি আমায় দেখতে অনেক মায়াবী লাগে,কান্নার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটিয়ে লোকটা আমার চোখের জল মুছে দিলো সাথে টিস্যু দিয়ে নাকটাও, কতোটা খবিশ হলে মানুষ এমনটা করে আপনারাই বলুন তো,টিস্যু আমাকে দিলেই পারতো আমিই মুছে নিতাম,এমনি কি আর মনে মনে খচ্চর ডাকি একে সামনে তো আর বলার সাহস নাই,খচ্চরটা আমার ভাবনায় আর কান্নায় দুটোতেই ছেঁদ ঘটিয়ে আমার কানের একদম কাঁছে এসে বললো।

কি কহিনুর বলেছিলাম না এভাবে কান্না না করতে তুমি কান্না করলে যে তোমায় আরও মায়াবিনী লাগে,ইচ্ছে করে তোমার টমেটোর মতো লাল গালগুলো কামড়ে খেয়ে নিই।

উদ্ভট কথাটা বলে খচ্চরটা বাঁকা হেসে আমার গালে আলতো চুমু একে দিলো আমি ঘৃণার সাথে ভয় আর শিহরণে চোখ বন্ধ করে নিলাম,চোখ খুললাম আবারও লোকটার উল্টাপাল্টা কথায়।

কহিনুর তুমি তো জানো, আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না,তোমায় আঘাত করার আগে যে আমার মনে আঘাত লাগে কিন্তু কি করবো তুমি আমায় না রাগিয়ে পারো না,আর তুমি তো জানো আমার রাগে কোনো কন্ট্রোল নেই,দেখো না কিভাবে তোমার গালে আঘাত করে বসলাম,দাঁড়াও এখনি ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি,

কথাটা বলে লোকটা ওষুধ লাগাতে শুরু করলো আমার গালে আমি তো মমের পুতুল কি আর করার আছে ডিজাইনার সাহেব যে ডিজাইন করছেন সে জিজাইন অনুযায়ী বসে আছি,আঁড়চোখে ড্রাইবারের দিকে তাকাচ্ছি কারন ব্যাটা এসব রোমান্টিক সিন দেখে মুচকি মুচকি হাসছে আমি আর বেশি তাকালাম না ওদিকে প্রথমত লজ্জায় আর দ্বিতীয়ত বজ্জাতটা দেখতে পেলে ড্রাইবারের ড ও থাকবে না,বজ্জাতটার আর কি লজ্জা শরম বলতে তো কিছু নেই যেখানে সেখানে যা তা করে,নিজে ইচ্ছে করে মারলো আর এখন নিজেই আবার ওষুধ লাগাচ্ছে একে পাগল বলবো না তো কি বলবো হুহ,ইচ্ছে তো করছে কিছু একটা দিয়ে ওর কল্লাটা ফাটাইয়া দিই কিন্তু কি আর করার আছে আমার মতো এই ছোট্ট প্রাণের।

ওষুধ লাগানো শেষ হলে বজ্জাতটা টান দিয়ে আমাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে সিটে হেলান দিলো আর বললো।

নড়াচড়া করো না কহিনুর তোমায় বুকে নিয়ে যে আরামের একটা ঘুম দিবো, রাস্তা যে এখনও অনেক বাকি আরামছে একটা ঘুম দেওয়া যাবে,তোমার জন্য যে কাল সারারাত ঘুমোই নি আমি তাই এখন ঘুমাবো আর যদি আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছো তবে কিন্তু তোমার জানাই আছে আমি কি করবো,আশা করি আমার লক্ষি বউটা এই মুহুর্তে আর আমায় রাগাবে না,ওকে তবে ঘুমাই সুইটহার্ট।

কথাটা বলে লোকটা আমায় নিজের বুকের সাথে চেঁপে ধরে ঘুমানোতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো,একটা মানুষ এক মুহুর্তের মাঝে এতো রুপ কি করে পাল্টাতে পারে, এর মতো আমি এই পৃথিবীতে আর একটাকেও দেখি নি,হয়তো পিস একটাই যা খোদা আমার কপালেই রাখলেন,এর ধমকি ভরা ভালো কথায় নড়াচড়া করার সাহস পাচ্ছি না,তবে আমি যে নড়াচড়া না করেও থাকতে পারি না,এদিকে পড়ে আছি ভারী কাপড়চোপর ভারী গহনাগাটি,সব থেকে বেশি রাগ হচ্ছে আমার ওই পার্লারের মহিলার উপর ওয়াটার প্রুভ মেকআপ বলে এমন মেকআপ করেছে যে কান্নার ক আসতেই হয়তো লেপ্টে পড়েছে সব,না দেখলেও ঠিকই আন্দাজ করতে পারছি,আমিও কম না বিয়েটা ঠিকই করতে চাইছিলাম না তবে সাজগোজের কোনো কমতিও রাখতে চাই নি,রাখবোই বা কেনো জীবনে একবার মাত্র বিয়ে করবো তবে সুন্দর করে সেজেই করবো তাই না,দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে হলে তো ওগুলাকে শুনেছি বিয়ে বলে না নিকাহ বলে আর নিকাহগুলো কারই বা এতো ধুমধামে হয় তাই এতো সাজা আরকি,কিন্তু কার জানা ছিলো বিয়েটা এভাবে হবে,একটা ছবিও উঠাতে পারি নি ভালো করে,এদিকে এসব ভাবনা আমার শেষ হতে হতে হঠাৎ দেখলাম রাত হয়ে এসেছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে গাড়ি ছুঁটছে আমাদের,উল্লুকটা ঘুমিয়ে গেলেও ঠায় শক্ত করে ধরে রেখেছে আমাকে মহাভারী পেশিবহুল ওর হাতের চিপা থেকে নিজে নিজে বের হবার ক্ষমতা আমার নেই তাই পরে রইলাম এভাবেই জানালার দিকে তাকিয়ে, বাইরে রাতের অন্ধকারে রাস্তার পাশের গাঁছগুলো যেনো দৌঁড়াচ্ছে,এই রাস্তাটা অনেক ভালো লাগছে আমার, ইচ্ছে করছে না এই মানুষটার সাথে কোথায়ও যেতে,এই রাস্তাতেই মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আজ,রাস্তাটার দিকে তাকাতে তাকাতে ঝাঁপ দিলাম অতীতে।আজ থেকে প্রায় ১ মাস আগে আমার এই লোকটার সাথে পরিচয়,এক মাস থেকে ৩-৪ দিন কমই হবে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here