শিশিরের কহিনুর,১৮,১৯

0
650

#শিশিরের কহিনুর,১৮,১৯
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ১৮

উনার কান্নায় খারাপ লাগছে আমার খুব,আমি উনার মাথায় হাত বুলাতেই থাকলাম,উনি কেঁদে কেঁদে বেদনাদায়ক কন্ঠে বলতে লাগলেন।

আমি তোমার কাছ থেকে বেশি কিছু চাই না কহিনুর, শুধু চাই তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকো,মায়ের মতো আমায় একা করে যাতে চলে না যাও,আমার সুখ দুঃখের সাথী হও,আমার একাকিত্বের সাথী হও,হবে না তুমি আমার সব কিছুর সাথী, বলো না কহিনুর,আমার শুধুই তোমাকে চাই,তোমার একটু ভালোবাসা চাই আমার,তোমার এক মুঠো ভালোবাসার ছায়াতলে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিবো কহিনুর,তুমি কখনো ছেঁড়ে যেও না আমায়, কখনো যেয়ো না,আমি যে তা মেনে নিতে পারবো না।

কথাগুলো বলতে বলতে একসময় কান্নার বেগ থেমে গিয়ে উনি ঘুমিয়েই গেলেন।আমার ঘুম আসছে না,তাকিয়ে আছি উনার সেই মায়াবী মুখের দিকে,কতোই নিষ্পাপ লাগছে ঘুমন্ত এই চেহারাটা,মনে হচ্ছে যেনো মা হারা একটা নিষ্পাপ ছোট্ট বাচ্চা মায়ের আবদার করে ঘুমিয়ে গেছে মায়ের অপেক্ষাতেই,লোকটা যে শুধুই একটু সত্য ভালোবাসার কাঙাল,হয়তো ওর ভালোবাসা দেখানোর ধরন টা অন্যরকম এর মানে এটা তো নয় যে লোকটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়,এই হিংস্র লোকটার ভিতরও যে অনুভূতি আছে,লোকটাও যে কষ্ট পায়,এই লোকটারও যে কান্না আসে এগুলা ভাবতেও কাল্পনিক লাগছে আমার কাছে,কিন্তু এটাই সত্য,মানুষটা এমনিতেই হিংস্র হয়নি পরিস্থিতি ওকে তা বানিয়ে দিয়েছে,উনার ভিতর জমে থাকা ঘৃণা উনাকে হিংস্র হতে বাধ্য করেছে,হয়তো একটু ভালোবাসা উনাকে সবাইকে ভালোবাসতেও শিখিয়ে দিতে পারে,উনি তো অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জগতে বন্ধি আছেন, উনার তো শুধুই একটা সাহারার হাত চাই যে উনাকে টেনে আলোর জগতে নিয়ে আসতে পারে,হয়তো সেই সাহারা হিসেবে উনি আমাকেই নির্বাচন করেছেন,কিন্তু সত্যিই কি আমিই পারবো উনাকে সেই আধার থেকে বাইরে নিয়ে আসতে,আর আমি কি সত্যিই উনার সাহারা হতে চাই,কিন্তু কেনো?কেনো আমি হবো উনার সাহারা?কেনোই বা আমার উনার জন্য খারাপ লাগছে, আমি তো উনাকে সহ্যই করতে পারি না,উনার কষ্ট হলে তো আমার ভালো থাকার কথা,তবে আমার কেনো খারাপ লাগছে,তবে এটা কি শুধু মনুষ্যত্বের খাতিরে হচ্ছে না আমি উনাকে ভালোবেসে ফেললাম।আরে না না আমি উনাকে ভালোবাসি না আর বাসবোও না কখনো।তবে কেনো হচ্ছে এমন আমার সাথে?এদিকে,ঘুম আসছে না আমার,তাকিয়ে আছি একধ্যানে উনার মুখের পানে,ভালোই লাগছে উনাকে দেখতে, চোখ সরাতেই ইচ্ছে হচ্ছে না,উনার জ্বর এখনও পুরোপুরি কমে নি,এখনও উনার শরীরের উষ্ণ পরশ আমি অনুভব করতে পারছি,উনাকে বালিশে ঘুম পাড়িয়ে ভালো করে বাইরের বাতাস আসার রাস্তা আটকে দিয়েছি অনেক আগে যাতে উনার ঠান্ডা না লাগে,গায়ের কম্বলটা ভালো করে উনার গায়ে দিয়ে উনার পাশে বসে উনার মাথায় হাত বুলাচ্ছি,খনিকে আবারও মনে পড়তে লাগলো আমার অতীতের কিছু ঘটনা।

সেদিনের পর থেকে উনি আমার শ্বাস নেওয়াটাও মুশকিল করে দিয়েছিলেন,কোচিং গেলে তো উনার গার্ডগুলো সাথে থাকতোই,বাড়ি এলেও শান্তি হতো না,যখনি ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতাম লক্ষ্য করতাম গার্ডগুলো রাস্তায়ই আছে,ঘরেও শান্তি ছিলো না রাতে ঘুমাতে গেলে ব্যাঙটা সাথেই থাকতো,এভাবে একটা পরপুরুষের সাথে এক বিছানায় থাকতে একটা ভালো মেয়ের কখনোই ভালো লাগবে না,তাছাড়া কেউ কোনো কথাও বলতে পারতো না আমার সাথে রোজ কেউ না কেউ আহত হতো শুধু আমার জন্যই ওই ব্যাঙটার হাতে,অনেক খারাপ লাগতো আমার,আমার বন্ধুবান্ধব কাউকেই আমার সাথে কথা বলতে দিতো না আমি না কি শুধু ওর আর আমি ও ছাড়া না কি কারো সাথেই কথা বলবো না, এখন সে যেই হোক কোনো ছেলে অথবা মেয়ে,এমনকি আমার বেষ্টি কনিকাকেও কথা বলতে দিতো না আমার সাথে,আমার জীবনটা পুরো তেজপাতা করে দিয়েছিলো বজ্জাতটা,মাঝে মাঝে আমাকে উঠিয়ে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতো, রেস্টুরেন্টে আরও না জানি কোথায় কোথায় নিয়ে যেতো,আমার পাশে বসে আমাকে নিজের বিষয়ে এটা ওটা বলতো,সবসময় আমার মন জয় করার চেষ্টা করেই যেতো,কিন্তু আমি একে ভালোবাসি না,জোর করে কখনোই ভালোবাসা হয় না তাই এর প্রতি আমার কখনো কোনো ভালোলাগা সৃষ্টি হয় নি,শুধুই ঘৃণা করতাম আমি ওকে,কোনো কিছুতে যদি আমি সায় না দিতাম,যদি এর সাথে যেতে না চাইতাম তবে উল্টাপাল্টা কিছু না কিছু করে ঠিকই আমায় বাধ্য করতো এর কথা মানতে,এ লোকটা নিজের সীমা পেরিয়ে গেছিলো একদম,আমার জেবিন দুলাভাইয়ের আগের জব টা ছাড়িয়ে দিয়ে নিজের অফিসে জব দিয়েছিলো বিষয়টি জেবিন দুলাভাই আর আপি না জানলেও আমি ঠিকই জানতাম,এতো বড় কোম্পানিতে জব হওয়ায় আপি দুলাভাই অনেক খুশি ছিলেন কিন্তু আমি জানতাম লোকটার এখানেও কোনো কটুবুদ্ধি আছে,হ্যাঁ তাই,ব্যাঙটা দুলাভাইয়ের বস হিসেবে প্রায়ই আমাদের ঘরে আসতো,প্রায় সারাদিনই আমি লোকটার নজর বন্ধি থাকতাম,অনেক অসহায় মনে হচ্ছিলো নিজেকে,তারপর আর কোনো পথ না পেয়ে আমি জেবিন আপিকে সব খুলে বলি,আপি সব জানার পর আর দেড়ি না করে আমার পরিবারকে সব খুলে বলে,আমার পরিবার কখনোই অতিরিক্ত ধনীদের পরিবারে মেয়ে বিয়ে দিবে না কারন উনাদের মতে ধনীরা মনের কদর বুঝে না,মানুষকে মানুষ মনে করে না তাই,আর বিষয়টি জানার পর আমার পরিবারও অসহায় হয়ে পড়েছিলো কারন এসআরকে এর পাওয়ার সম্পর্কে সবাই অনেক ভালোভাবে জানে,ঢাকাতে নামকরা উনি,তাই আমার পরিবার সিন্ধান্ত নিলো আমাকে বাবার এক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে,ছেলেটি ইন্জিনিয়ার,মা-বাবা নেই ওর,ছেলেটি না কি খুব ভালো,উনারা এটাই ভাবছেন যদি লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন তবে হয়তো মি.খান আমার পিছু ছেড়েও দিতে পারেন,আমি পরলাম আরেক ঝামেলায়,এই সলিউশনের থেকে তো আমার উনার বন্ধি খাঁচাই ভালো মনে হচ্ছিলো তখন,সেই ছেলেটার সাথে বিয়ে হলে আমি যা ইচ্ছা তা করতেও পারতাম কিন্তু তারপরও আমার তখন খারাপ লাগছিলো এটা ভেবে যে আমি অন্য কারো হয়ে যাবো,আমার মনটা যেনো মি.খানেরই হতে চাইছিলো,কিন্তু কি আর করার ছিলো মা-বাবা এক দিনের মধ্যে বিয়ে ঠিক করে নিয়েছিলেন, সিলেট গিয়েই বিয়ে,ট্রেনের টিকিটও কাটা হয়ে গেছিলো,আমরা বেরুবো তখনি সামনে উনি প্রকট হলেন উনার অজস্র গার্ড সাথে নিয়ে,জিনিসটা উনার কান অব্দি যে চলে গেছে,আমার পরিবারকে বেঁধে আমাকে জোর করে নিয়ে গেলেন উনি সাথে করে,তারপর উনার ভুতিয়া বাংলায় নিয়ে গিয়ে উনার রুমে আমায় বন্ধি করে দিলেন লাইট অফ করে,আমি অন্ধকারে চিৎকার করতে করতে সেদিনও অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম,তারপর সেখানে আমায় দুদিন উনি আটকে রাখেন,আমি পালিয়ে যাবো বলে আমার হাতে হাতকড়া দিয়ে বেডের সাথে বেঁধে রেখেছিলো,আমি অনেক চেষ্টা করতে থাকলেও পালাতে পারি নি,আমার আশেপাশে সবসময় অজস্র গার্ড, ডাক্তার, খাবার নিয়ে চাকরেরা থাকতো,অবশেষে ফন্দি আটলাম,অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইছিলাম ইচ্ছে করে,ডাক্তারের অনেক চেষ্টা করে যখন আমার জ্ঞান ফিরাতে ব্যার্থ হলো তখন ওদের স্বাভাবিকভাবে অনেক মার খেতে হলো উনার হাতে,তারপর ওদের আধমরা করে ব্যাঙটা আমায় কোলে করে হাসপাতাল নিয়ে গেলো, আর আমি সুযোগ বুঝে হাসপাতাল থেকে পালালাম,পালানোর আগে ফোন করে বাবা-মাকে বললাম ট্রেনের টিকিট কাটতে তারপর মা-বাবা তাই করলেন আর পালিয়ে গিয়ে উনাদের সাথেই সিলেট পারি জমালাম আমি,তখন পালিয়ে যাওয়ার পর কেনো যেনো আমার মাঝে খারাপ লাগা কাজ করছিলো,কিন্তু আমি যে আমিই কখনো আমার মনের উল্টাপাল্টা কথা আমি শুনতে চাই না,চলে গেলাম সিলেট,জানি না বজ্জাতটা কিছু আদোও বুঝতে পেরেছে কি না,সিলেট আমরা রাতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম,মা-বাবা রাতের মধ্যেই বিয়ের সবকিছু ঠিক করে ফেলেছিলেন আর পরদিন সন্ধ্যায় বিয়ে ছিলো আমার,আর বিয়ের দিনের কথা তো আপনারা সবাই জানেনই।লোকটার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই রাতটা কেটে গেলো ঘুম আসলো না,হঠাৎ কানে ভেসে এলো ফজরের আযান,উঠে নামায পড়ে নিলাম,যে মোনাজাতে রোজ উনার কাছ থেকে মুক্তি চাই আজকে সেই মোনাজাতে উনার মনের শান্তি আর জীবনে অসীম সুখ চাইলাম,উনার জন্য আলাদা করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লাম,জানি না এতো দরদ কেনো হচ্ছে উনাকে নিয়ে আমার মনে, হয়তো মনুষ্যত্বের টানে।

তারপর নামায পড়ে শুতেই ঘুম দেখা দিলো আমার চোখে।

পরদিন সকালে কলিংবেলটা বাজতেই একজন চাকর দরজা খুললো,খুলতেই সবাই দেখতে পারলো সামনেই অনিল দাঁড়িয়ে, রোদেলা চট করে দৌঁড়ে গিয়ে অনীলকে ঝাপঁটে ধরলো অনিল ভাইয়া বলে।রোদেলাকে রাতেই বাড়ি আনা হয়ে গেছিলো,অনীল ওর একমাত্র চাচাতো ভাই,ছোটবেলায় ওর মা-বাবা মারা যান গাড়ি এক্সিডেন্টে,অনিল ভোরের দুমাস বড়,বলতে গেলে সমবয়সী, দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো,একসাথে বড় হয়েছে,পড়ালেখাও করেছে,এমনকি একসাথে ডাক্তারিও জয়েন করেছিলো,কিন্তু দুবছর আগে হঠাৎ কেনো যেনো কাউকে কিছু না বলেই অনিল আমেরিকা চলে গিয়েছিলো,আর আজ ফিরেছে,অনিলের বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে আরও একজন ছিলো রোদেলা,অনিলের কোনো সিক্রেট রোদেলা জানে না এটা হতেই পারে না,হয়তো ওর চলে যাওয়ার কারনও রোদেলার জানা,এদিকে অনিলকে হঠাৎ দেখে ভোরের চোখ ছলছল করে উঠলো,সবাই ওকে দেখে আনন্দে বিমোহিত হয়ে উঠেছে,কিন্তু এক জোড়া চোখ মুহুর্তটা মেনে নিতে পারছে না,আর সে চোখজোড়া হচ্ছে আকাশের,আকাশের সাথে অনিলের কোনো শত্রুতা নেই,দুজনের মধ্যে অনেক ভালো ভাই আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই অনিলের সাথে রোদেলাকে কেনো যেনো সহ্য করতে পারে না আকাশ,ছেলে বলতে রোদেলা অনিলের সাথেই বেশি মিশে আর তাই হয়তো আকাশের ওটা ভালো লাগে না,এ দুবছর অনিল ছিলো না তাই আকাশের ভালোই লাগছিলো কারন জানে না আকাশ কিন্তু আজ অনিল ফিরে এসেছে ওতে আকাশের খারাপ লাগছে তার কারনও জানে না আকাশ,এছাড়া রোদেলা বাড়ি আসছে থেকে আকাশের ধারও ঘেষছে না এই সত্যটাও মানতে পারছে না আকাশ,রোদেলাকে অনিলের পাশে দেখে রাগে গা জ্বলে উঠলো আকাশের,বেড়িয়ে যাওয়ার ভান করে অনিলকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো,সবাই আকাশের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো,তারপর অনিলের আগমনে মন দিলো সবাই।

শিশির ফ্রেস হয়ে দেখলো ওর অফিসের কাপড়চোপড় বের করা বেডের উপর,কাপড়গুলো পড়ে টাই বাঁধতে গেলে নুর এসে ওটাতে ধরলো।

দেন আমি বেঁধে দিই,তা কফি খান নি সেই কখন এনে রেখে গেছিলাম,ঠান্ডা হয়ে গেছে হয়তো,ঠিক আছে ওটা এখন আর খেতে হবে না,আমি নাস্তা বানিয়েছি সবার জন্য আর স্পেশালী আপনার জন্য আপনি না খেয়ে যাবেন না এই বলে দিলাম।

টাই বাঁধতে বাঁধতে কথাগুলো বলছিলো নুর,শিশির অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে,এটা কি সত্যিই ওর কহিনুর,তবে কি ওর অপেক্ষার প্রহর তবে শেষ হতে চললো।শিশির আলতো করে নুরের কোমড়ের পিছন দিকে হোচকা টান দিয়ে নিজের উপর নিয়ে আসলো ওকে,তারপর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিজের অধরে আলতো করে চুমু কাটলো নুরের কানের লতিতে,নুর শিহরিত হয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।শিশির আলতো করে বললো।

তবে কি অবশেষে নিজেকে সত্যিই মিসেস এসআরকে ভাবতে শুরু করে দিলে,ভালোবেসে ফেলেছো বুঝি এই ব্যাঙটাকে।

উনি আমার এতোটা কাছে যে কি করবো আর বলবো ভেবে পাচ্ছি না,মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার,মুখ দিয়ে হরবরিয়ে একটা কথাই বের হলো আমার,জানিনা।

তারপর অনুভব করতে পারলাম উনার নিশ্বাসের উষ্ণ ছোঁয়া আমার মুখে পরছে,অনুভব করতে পারলাম হয়তো উনি আমার ঠোঁটের ছোঁয়া নিতে এগিয়ে আসছেন,কিন্তু এই মুহুর্তে আমিও উনাকে আটকাতে পারছি না,কেনো পারছি না?না কি আমি উনাকে আটকাতেই চাই না, কে জানে?শুধু চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি,হৃদয়স্পন্দন আমার হাজারগুন বেড়ে গেছে।

চলবে…….

#শিশিরের কহিনুর
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ১৯

কহিনুর চোখগুলো বন্ধ করে আছে,ভয়ে ওর ঠোঁটগুলো কাঁপতে শুরু করেছে,কাঁপতে থাকা নেশালো সেই অধরজোড়ার দিকে তাকাতেই শিশিরের মনে আলাদা বেশা কাজ করতে শুরু করলো,এগিয়ে গেলো ওর ঠোঁটের পানে,আর শুরু করলো কহিনুরের ঠোঁটের মধু পান করা।

উনি আলতো করে এসে আমার ঠোঁটজোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলেন,আমি বরফের মতো জমে আছি,নরছিও না,উনাকে আটকানোর কোনো প্রচেষ্টাই করছি না,বরং উনার সাথে খনিক রেসপন্সও করছি,অন্য কোনো কিছুই কাজ করছে না এখন আমার মাথায়,প্রায় ৫ মিনিট পর উনি আমায় ছেড়ে দিলেন আর আমরা দুজনই হাঁপাতে লাগলাম,আমি আর উনার দিকে তাকালাম না উনাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে ছুটে চলে গেলাম।

নুরের এভাবে লজ্জা রাঙা ভঙ্গিতে ছুটে চলে যাওয়ায় শিশির আলতো হাসি ফুঁটিয়ে তোলে ঠোঁটের কোনে।

এদিকে দৃশ্যটা এড়ায় না মাহেরার চোখে,তখন শিশিরের রুমের দরজা খনিক ফাঁক করা ছিলো,আর সেই ফাঁক দিয়ে মাহেরা শিশির নুরের ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত দেখতে পেলো,তৎক্ষনাৎ ওর চোখ জ্বলে ভরে এলো,ছুঁটে গেলো ওর রুমে আর সবকিছু ভাঙতে শুরু করলো।

ছাড়বোনা আমি তোমায় কহিনুর,তুমি আমার এসআরকে কে এভাবে কেড়ে নিতে পারো না আমার থেকে ও শুধুই আমার,শুধুই আমার।

আমি ছুঁটে চলে আসলাম রোদেলার রুমে ওয়াসরুমে,এসে বার বার মুখে জল দিচ্ছি,ঠোঁটগুলো ঘষে ঘষে লাল করে দিয়েছি,এটা আমি কি করলাম,একটা ছেলেকে কিস করে বসলাম,তাও যাকে আমি ভালোই বাসি না,কোনো ছেলে আমার পাশে আসা তো কি কখনো আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও হয় নি,কাউকেই কখনো নিজের পাশে আসতে দেই নি,তবে আজকে কি করে উনাকে এভাবে কিস করতে দিলাম,পারতাম তো উনাকে আটকানোর চেষ্টা করতে,কতো গভীরভাবে উনি আমার ঠোঁট **** ছি ছি,এটা কি করে হয়ে গেলো,আমিও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কি করে রেসপন্স করতে পারলাম,কেনো করলাম,এ্যা হে হে,এটা কেনো হলো,ও খোদা এসব কি হচ্ছে আমার সাথে,কেনো হচ্ছে,এ মুখ আমি কি করে কাউকে দেখাই এবার,মুখ টুক আচ্ছা মতে ধুয়ে বাইরে এলাম,আসতেই সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় পেলাম আমার সতীন হওয়ার তীব্র ইচ্ছা মনে পোষন করা নারীকে,মানে মিস মাহেরা আপু। আমি ভালো মেয়ের মতোই জিজ্ঞেস করলাম আপু তুমি এখানে।বজ্জাতনিটা বিনা বাক্যে আমার দিকে তেঁড়ে এসেই আমার গালে থাপ্পড় মেরে বসলো।

তুই কি মনে করিস ডাইনি তোর শরীরের মায়া দেখিয়ে এসআরকে কে নিজের করে নিবি,তবে তুই ভুল ভাবছিস,এসআরকে শুধুই তোর শরীরের মায়ায় আছে যা মিটে গেলে তোকে ছুঁড়ে ফেলবে,সামান্য কিস করে আকাশে উড়িস না এসব কিস ও হয়তো কয়টা মেয়েকে করেছে ও তা নিজেও জানে না।

জানিনা কেনো কিন্তু কথাটা শুনে আমার শরীর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো,গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিলাম শয়তান্নিটাকে,আমার থাপ্পড়ের বেগ সহ্য করতে না পেরে পড়ে গেলো ফ্লোরে,তারপর রাগে গিয়ে ওর চুল মুঠো করে ধরলাম।

তুই আমাকে হিন্দি সিরিয়ালের অবলা,বোকা নাইকা ভেবেছিস না কি শুনি,আরে ভুলিস না আমি মিসেস এসআরকে,জানিনা কিন্তু হয়তো অনেক মেয়েকেই উনি কিস করেছিলেন,হয়তো রাত যাপনও করেছিলেন বাট কাউকেই উনি স্ত্রী বানান নি,কারন কাউকেই উনি ভালোবাসতেন না,উনি আমাকে বিয়ে করেছেন কারন উনি আমাকে ভালোবাসেন,সবাই মিসেস খান হন নি হয়েছি আমি কারন উনি ভালোবাসেন আমায়,শুনেছিস ভালোবাসে,আর হয়তো আমি আসার আগে উনার জীবনে অনেক মেয়ে এসেছিলো, কিন্তু আমার পরে কেউ আসে নি আর আসবেও না,আর আসতে চাইলেও আমি আসতেও দিবো না,কথাটা মনে রাখিস ডায়নি,আবার যদি উনার আশেপাশেও দেখি তবে হাড়গুঁড়া করে পাওডার বানিয়ে দিবো কথাটা যেনো মনে থাকে।

নাইকদের মতো ডায়লগ মেরে সেখান থেকে চলে আসলাম,এসব আমি কি করলাম,কিসব বললাম,কেনো বললাম,আমি কখনোই কারো সাথে এমন ব্যবহার করি মি কিন্তু আজকে কেনো করলাম?কেনো আমি উনার নামে এতো পাওয়ার দেখালাম?কেনো উনার স্ত্রী হবার ক্ষমতা দেখালাম,তবে কি আমি সত্যিই নিজেকে মিসেস এসআরকে মানতে শুরু করলাম,আরে ধূর কিসব হচ্ছে যে আমার সাথে,শুধু হিন্দি সিরিয়ালেই দেখতাম নায়কনায়িকা নিজেদের অনুভুতি বুঝতে অক্ষম হয় তখন ওদের কতো গালি দিতাম আমিই জানি,কিন্তু আজ নিজের অবস্থাই এমন,আর আমি উনার সামনেও যাই নি,উনি অফিস যাওয়ার আগে খেতে টেবিলে আসলেন শুধুই আমার হাতের ব্রেকফাস্ট খাবেন বলে,আমি ছাড়া খাবেই না উল্লুক,গার্ডদের দিয়ে সার্চ করিয়ে আমাকে ধরিয়ে আনলো লুকিয়ে ছিলাম যে, আমি না পারতে এলাম,ওড়না দিয়ে বড়সড় ঘোমটা দিয়েছি মুখে অনেক লজ্জা করছে যে আমার,ব্যাঙটার দিকে তাকাতেই পারছি না,কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে কি কটুদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুখে ডেবিলমার্কা হাসি,সবই আমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য শালা বজ্জাত।আমি ঘোমটা ঘামটা দিয়ে কোনোমতে খাবার সার্ভ করে দিলাম ভূ দৌড়।জানিনা বজ্জাতটা আমার কান্ড দেখে হয়তো হাসছে।

এদিকে নুরের এমন কান্ড দেখে শিশির হাসতে হাসতে নেই।

এদিকে দাদিজানের রুমে অনিলকে ধরে দাদিজান কি না কান্না জুড়ে আছেন।

কি দাদিজান আমার জন্যও নিজের দাদুভায়েই সমতুল ভালোবাসা দেখালে কেমন হবে বলো তো।

খবরদার অনিল আর কখনো এমন কথা বলবি না,আমি যেমন তোর বাবা আর আমার ছেলের মধ্যে কখনো বেধাবেধ করিনি তেমন তোর আর শিশিরের মধ্যেও করিনা,আর কখনো করবোও না।আর কখনো এমন বলবি না,আমার এখনও মনে আছে আমি যখন নতুন বিয়ে করে এ বাড়ি আসি তখন তোর বাবা মাত্র ২ বছরের ছিলো,সেই দুইবছরের বাচ্চাটা যে মা ছাড়া কতোটা অসহায় ছিলো তা একমাত্র সেই জানতো,একটি মা কি করে পারে নিজের নাড়ী ছেড়া ধনকে এভাবে ফেলে পরপুরুষের সাথে চলে যেতে,বড় ভাইয়া উনাকে অনেক ভালোবাসতেন, উনার এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেন নি তাই হয়তো আত্নহত্যা করলেন,যাক তারপর ওকে আমি নিজের ছেলের মতো লালনপালন করতে লাগলাম, তোর দাদুকে বলে আমরা ওকে দত্তক নিলাম,আমি আমার ছেলে আর ওর মধ্যে কখনো বেধাবেধ করার কথা ভাবিও নি আর তুই আজ এটা বলতে পারলি।

আরে দাদিজান তুমিও না আমি তো মজা করছিলাম।

আর কখনো এমনটা করবি না এই বলে দিলাম,আর আরেকটা কথা এবার যখন এসেছিস তবে আর তোকে কোথাও যেতে দিবো না আমি,আমি তোর বাবাকে হারিয়েছি কিন্তু তোর দূরত্ব মেনে নিবো না,তুই আজ থেকে আমাদের হাসপাতাল জয়েন করছিস,আর হ্যাঁ এবার তোর বিয়ের বাদ্যটাও তো বাজাতে হবে।

কথাটা শুনে রোদেলা বললো।

হ্যাঁ অনিল ভাইয়া আর কতো এবার বিয়েটা করে নাও,কতো মজা করবো আমি তোমার বিয়েতে, তখন রুমে রোদেলা আর সাথে ভোরও ছিলো।কথাটা শুনে অনিল ব্যাথার্ত একটা দৃষ্টিতে ভোরের দিকে তাকালো,ভোরও অনিলের দিকে তাকালো,দুজনের চোখে চোখ পড়লো,তারপর অস্বাভাবিক হয়ে দুজনই চোখগুলো সরিয়ে নিলো একে অপরের দিক থেকে,রোদেলা লক্ষ করলো বিষয়টা,অনেক কিছুই বুঝতে পারলো,অনিল মুখটা ঘুমড়ো করে বললো।

বিয়ে শাদি নিয়ে বলো না দাদিমা,ওসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার,এসেছি যখন তবে আমাদের হাসপাতালের সেবা করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো,ক্ষতি কিসে তাতে?

কথাটা বলে অনিল বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে,ভোরের চোখ ভরে এলো জ্বলে, ভোরও আর দাঁড়ালো না সেখানে চলে গেলো সেখান থেকে।

শিশির অফিসে বসে বসে ফাইল্স দেখছিলো,তখনি মনে পড়লো ওর দুষ্টু পরীর কথা,সাথে সাথেই ঠোঁটের কোনে ফুঁটে উঠলো ওর বাঁকা হাসি,তখনি কেবিনে প্রবেশ করলো মাহেরা।

নিশ্চয়ই নিজের বউয়ের কথা মনে করছিস এসআরকে।কি আছে ওই কহিনুরের মাঝে যা আমার মাঝে নেই?

মাহেরা তেড়ে গিয়েই শিশিরের হাতে থাকা একটা ফাইল ছুঁড়ে ফেললো মাটিতে আর কথাগুলো বললো।

শিশির তখনি ঠাস করে মাহেরার গালে একটা কড়া থাপ্পড় বসিয়ে দিলো,মাহেরা মুখ থুবড়ে পড়লো ফ্লোরে।শিশির চিৎকার করে বলে উঠলো।

তোর সাহস হলো কি করে নিজেকে আমার কহিনুরের সাথে তুলনা করার,কহিনুরের সাথে তোর কি কারোই কোনো তুলনা হয় না আর হবেও না,কহিনুর অতুলনীয় কথাটা মনে রাখিস, ওকে আমি কেনো ভালোবাসি জানি না শুধু এটা জানি আমি ওকে ভালোবাসি,অনেক ভালোবাসি,জানি না এই ভালোবাসার সীমা আছে কি নেই কিন্তু শুধু এটা জানি আমি শুধুই কহিনুরের আর কহিনুর শুধুই আমার আর আমার আর কহিনুরের মধ্যে যেই আসবে তাকেই আমি শেষ করে দিবো।

মাহেরা গালে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালো,আর অগ্নিদৃষ্টিতে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো।

অনেক ভালোবাসিস না এসআরকে ওই কহিনুরকে,দেখিস তুই, একদিন ওই তোর কহিনুর তোকে ছেঁড়ে চলে যাবে,তুই ওকে বেঁধে ধরেও নিজের কাছে রাখতে পারবি না,কখনোই না,ও তোকে ছেঁড়ে চলে যাবে এসআরকে,দেখে নিস তুই কখনোই ওকে পাবি না তুই,কখনোই না।

কথাটা বলে মাহেরা সেখান থেকে ছুটে চলে গেলো,শিশির টেবিলের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিলো তারপর গর্জে বলে উঠলো।

কহিনুর শুধুই আমার,আর ও সবসময় আমারই থাকবে,ও থাকতে না চাইলেও আমি ওকে জোর করে নিজের কাছে ধরে রাখবো,কোথাও যেতে দিবো না ওকে আমি, কোথাও না।

এদিকে অনিল হাসপাতালে চলে আসলো,আজকে আসতেই একটা এমারজেন্সি পড়লো ওর তাই এখানেই থাকবে ও আজ,আকাশও থাকবে আজ এখানে,অবশ্য রিয়ার আজ কোনো এমারজেন্সি নেই তাই ও আজ থাকে নি,তবে আজ আকাশ রিয়াকে মোটেও মিস করছে না বরং ওকে অন্য টান আঁকড়ে ধরেছে,এরকম যখনি আকাশের কোনো এমারজেন্সি পড়ে তখনি রোদেলা ওর জন্য খাবার বানিয়ে আনতো কিন্তু আজ আর আসছে না,এমনকি সারাদিন ফোন করে করে মাথাও খেতো কিন্তু আজ ভুলেও একটা ফোন করলো না ওকে রোদেলা,জানে না কেনো যেনো ওর অনেক খারাপ লাগছে আজ,অবশেষে মনে হঠাৎ একটা ভালোলাগা কাজ করলো যখন দেখলো রোদেলা টিফিন হাতে হাসপাতালে প্রবেশ করছে,ঠোঁটের কোনে একটা আলতো হাসি ফুঁটে উঠলো,কিন্তু খনিকে আকাশের মনের আশা নিরাশায় পরিণত করে দিলো রোদেলা আকাশের ধার ঘেষে ওকে দেখেও না দেখার ভান করে অনিলের কেবিনের দিকে অগ্রসর হয়ে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here