#শিশিরের কহিনুর,২৮,২৯
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ২৮
উনি আমাকে বাড়ি নিয়ে আসলেন,তারপর ডাক্তার আনলেন দুতিনজন,ওরা আমাকে চেকআপ করে দেখলো আমি ঠিক আছি কি না,আমি তো অনেক দৌঁড়েছি তাতে আমার কোনো ক্ষতি হলো না কি এই ভয়ে,বলেনতো কেমনটা লাগে আমি কেমন আছি আমাকেই জিজ্ঞেস করলে পারতো ডাক্তার আনার কি ছিলো,আমার কোনো অসুবিধা করলে বা আমি অসুস্থ বোধ করলে তো আমি নিজেই বলতাম ,সত্যিই আসতো পাগল। ডাক্তারেরা চলে যাবার পর আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম।
আমি কোথায় ছিলাম তা আপনি কি করে জানলেন।
তুমি কি মনে করো ময়নাপাখি আমি শুধুই এই বাড়িতে তোমার সামনে তোমার জন্য গার্ড রেখেছি তবে তা নয়,আমি গোপনেও অনেক গার্ড রেখেছি তোমার উপর নজর রাখার জন্য,ওই যে তোমার পালানোর স্বভাব সম্পর্কে আমার ভালো করেই তো জানা আছে তাই এই ব্যবস্থা করা,তুমি লুকিয়ে রাস্তায় বের হতেই খবরটা আমার কানে পৌঁছে গেছিলো তৎক্ষনাৎ লোকগুলো তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো,তারপর আমার লোক ওই গাড়ির পিছু করে এড্রেসটা আমায় পাঠায় আর আমি পৌঁছে যাই সেখানে।
শয়তান লোকটা গোপনেও আমার পিছন লোক লাগিয়ে রেখেছে আর তা আমার জানাই ছিলো না,যাক তবে জিনিসটা কাজেই দিয়েছে,উনি সঠিক মুহুর্তে পৌঁছে না গেলে আজ আমার কতো বড় সর্বনাশই না হয়ে যেতো ভাবলেই গায়ে কাটা দিচ্ছে আমার,এখন মনে এতোটুকু বিশ্বাস তো আছেই আল্লাহর রহমতে উনি আমার সাথে থাকতে কেউ আমার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।এদিকে উনি আবার বললেন।
এই কাজটা ওই লোকদের না,ওরা কারো কথায় এমনটা করেছে তা আমি ভালোয় জানি,তোমার কি কারো সাথে কোনো শত্রুতা আছে কহিনুর,আমার তো মনে হয় না তোমার মতো লক্ষি মেয়ের কোনো শত্রু থাকতে পারে,হয়তো এই কাজটা আমারই কোনো শত্রুর কাজ তবে সে যেই হোক আমি তা খুঁজে বের করবোই,আমার কহিনুরকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সে যে কতো বড় অপরাধ করেছে তাকে তো সেটা বুঝাতেই হবে।
কথাটা শুনে আমি উনাকে কিছু বললাম না,কিন্তু মনে অনেক ভয় খেলা করতে শুরু করলো,আমি যে মরে গেলেও অভ্রের নাম নিবো না,কারন আমি চাই না ঝুমা আপির মতো ভোর আপির সাথেও লোকটা এমন করুক।মনে পড়লো চার বছর আগে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা।
আমি তখন জেএসসি এক্সাম দিয়েছিলাম,রেজাল্ট বের হবার আগে কয়েকদিনের ছুটি উপলক্ষে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমার বড় ফুফির মেয়ে প্রিতী আপির বাড়িতে,আপির স্বামী মৌলভীবাজার জেলায় চাকরি করতেন আপিও উনার সাথে সেখানেই থাকতেন,উনার পাশের বাসায় থাকতেন ঝুমা আপি,অভ্রের সাথে উনি পালিয়ে এসেছিলেন,প্রথমে উনার মা-বাবা উনাদের সম্পর্ক না মানলেও পরে নাকি ওদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছিলেন,আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন ওদের বিয়ের মাত্র ৮ মাস চলছিলো,প্রিতী আপির সাথে ঝুমা আপির অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো,ওনারা দুজন প্রায় সারাদিনই একসাথে সময় পার করতেন,প্রীতি আপির স্বামী সরকারি কলেজের একজন ইংলিশ প্রফেসর আর অভ্র তখন নিজস্ব একটা ক্লিনিক চালাতো সেখানে,যেহেতু প্রীতি আপির সাথে ঝুমা আপির ভালোই সম্পর্ক ছিলো সেহেতু সেখানে থাকাকালীন আমারও উনার সাথে ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠলো,আমি প্রায়ই উনার ঘরে যেতাম,যেহেতু প্রীতি আপির ঘর আর ঝুমা আপির ঘর প্রায় পাশাপাশি ছিলো,কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম উনার স্বামী মানে অভ্র আমার দিকে খারাপ নজরে তাকায় যখনি আমায় দেখে, সেটা বুঝতে পেরে আমি ওদের ঘরে যাওয়া কম করে দেই,হঠাৎ একদিন আমি আমার রুমে বসে আয়নাতে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম,তখনি আমার রুমে অভ্র লোকটা ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো,আপু দুলাভাই আর প্রিতী আপি তখন পাশের পার্কেই হাঁটতে গেছিলেন আমার ইচ্ছে ছিলো না বলে গেলাম না,তখনি লোকটা এলো,আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনি এখানে।লোকটা বললো।
হ্যাঁ সুইটি আমি,তোমাকে দেখার পর থেকে যে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে আমার,কি সুন্দর তোমার ফিগারের সাইজ ইশ ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দিতে,কথাটা বলে লোকটা আমার পাশে আসতে নিলে আমি ঠাসিয়ে দেই লোকটার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে, তারপর যেতে নিলে লোকটা আমার হাত ধরে নেয়,আমি নিজেকে ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পরি। লোকটা হিংস্র গলায় বলতে লাগে।
তোকে আমি যেতে দেবো না,তোকে আমি পেয়েই ছাড়বো,আর তারপর তুই চুপ করে থাকবি,তোকে আমি সোনা গহনায় ভরিয়ে দেবো শুধু প্রতিদিন একবার করে আমায় তোর পাশে আসার সুযোগ দেওয়ার বদলে।
আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে আবারও ঠাসিয়ে লোকটার গালে আরেকটা দেই আর বলি।
ওসব সোনা গহনার লোভ আমার কখনোই ছিলো না আর হবেও না,ওগুলার বদলে নিজের সতিত্ব বিলি করার মেয়ে আমি নই।আমি তোমার মুখোশ সবার সামনেই খুলে দিবো।
কথাটা বলে লোকটাকে থাক্কা দিয়ে ফেলে দরজা খোলে পালাতে লাগি আমি,লোকটা আমার পিছু আসতে আসতে বললো,তুই কাউকেই কিছু বলবি না নইলে পরিনাম ভালো হবে না,আমি লোকটার কোনো কথায় কান না দিয়ে সেই পার্কটার দিকে পালাতে লাগলাম,ভাগ্যবশত সবাই ততক্ষণে চলে আসলো আর আমি সবাইকে সব খুলে বললাম,অভ্র লোকটা ততক্ষণে আমার পিছন চলে এসেছে,কথাগুলো আমি বলে ফেলেছি বলে সবার সামনে ছলনা করতে শুরু করলো এবার।
আমি কিছু করি নি,ওই মেয়েটা আমায় নিজের শরীরের লোভে ফেলার চেষ্টা করেছে আর যখন আমি ওর কথায় সায় দিলাম না তখন আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমনটা করছে।
তবে তাই,এখনই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে কথাটা বলে আমি ঘরের দিকে দৌঁড়ালাম।
লোকটার কথা শুনে সবাই আবোলতাবোল হয়ে গেছিলো কার কথা বিশ্বাস করবে,আমি এমন মেয়ে নই ওরা তিনজন ভালোয় জানে আর লোকটাও যে এমনভাবে মুখোশ পরে থাকে কেউ এর আসল রুপ ধরতেই পারবে না,আমি তখন চুল আঁচড়ার ভান করে ভিডিও করছিলাম, আমি তখন প্রায়ই এমন ভিডিও করতাম,আসলে তখন প্রথম নতুন ফোন হাতে এসেছিলো তাই সারাদিন ছবি উঠতাম আর নিজের কার্যকলাপ ভিডিও করতাম,ফোনটা তখন আমি আমার ড্রেসিংটেবিলের এক সাইডে ভিডিও অন করে রেখেছিলাম,এর মানে সেখানে ঘটা সবকিছু রেকর্ড হয়েছে,হ্যাঁ তাই হয়েছে,আমি ছুঁটে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসলাম আর তারপর সবাইকে ভিডিও দেখাতেই সব সত্য সবার সামনে চলে আসলো,এরপর ঝুমা আপি লোকটাকে কড়া আরেকটা থাপ্পড় দিলেন,আর উনার জীবন থেকে চলে যেতে বললেন।
লোকটা চলে গেলো কিন্তু যাওয়ার আগে বলে গেলো ছাড়বেনা কাউকেই।
রাত্রে ঝুমা আপি আমাদের ঘরেই থাকলেন,উনি চার মাসের অন্তঃসত্তা ছিলেন,উনি অনেক কান্না করলেন সেদিন। উনার পরিবারের লোক আসতে অনেক দেড়ি হবে কারন উনারা চট্টগ্রাম থাকেন,তাই রাতে তিনি আমাদের ঘরে ছিলেন।সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ ঝুমা আপির রুম থেকে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম ছুটে গিয়ে যে অবস্থা দেখতে পেলাম তা দেখার পর আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো,মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো,অভ্র লোকটা আমার আপি দুলাভাইয়ের উপরও হামলা করলো কিন্তু দুলাভাই চালাকি করে লোকটার হাত থেকে ধারালো বড় ছুঁড়িটা ফেলে দিলেন আর আপু চিৎকার করে আশপাশের লোক ডাকতে শুরু করলেন অবস্থা খারাপ দেখে অভ্র লোকটা পালিয়ে গেলো,আমি সেখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লাম,ভয়ে দ্বিতীয় বার ঝুমা আপুর দিকে তাকাইনি,যথারীতি কাঁপছিলাম আমি তখন অনেক,লোকটা ঝুমা আপুকে বাঁচতে দেয় নি,ঝুমা আপির গলা বরাবর ছুঁড়ি চালিয়েছিলো শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিয়েছিলো,ঝুমা আপির নিষ্প্রাণ উন্মুক্ত আখিদ্বয় তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে সেই চাহনির কথা মনে পরলে এখনও আমার শরীর ভয়ে কেঁপে উঠে।তাই আমি এখন এই লোকটার আসল সত্য কাউকে বলতে ভয় পাচ্ছি,যদি লোকটা ভোর আপির সাথেও এমনটা করে,উনিও তো এখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আমি এখন এসব মি.খানকে বললে অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে তাই আমি ডিসাইড করলাম এসব কিছু আমি মি.খানকে বলবো না।
_________________
আকাশ একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালো।
চল।
কোথায়?
রেস্টুরেন্টের ভিতরে।
কেনো?
কেনো আবার খাবার খেতে।
কেনো আমি তোমার সাথে খাবার খেতে যাবো,বাড়িতে কি খাবার নেই,আর রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে হলে আমি একাই এসে খেয়ে নিবো কিন্তু তোমার সাথে খাবো না।
কেনো আমার গায়ে কি কাটা লেগে আছে যে আমার সাথে খাওয়া যাবে না,চুপচাপ চল নয়তো আমি আবারও আগের মতো তোকে উঠিয়ে ভিতরে নিয়ে যাবো আর পাবলিক প্লেসে জিনিসটা খুব একটা ভালো দেখাবে না বুঝতেই পারছিস।
উফ,তুমি কেনো এমনটা করছো ভাইয়া?
আমি তোর সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই তাই,প্লিজ চল।
রোদেলা মুখে অনেক বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে চলে গেলো।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো আকাশ রোদেলার পছন্দের সবকিছু ওর্ডার করছে,এটা ওটা বলছে কিন্তু ওকে, শুধু ওকে কেনো এখানে এনেছে সেটা বলতে চাইছে না,রোদেলার এতে অনেক বিরক্ত লাগছে,এবার রোদেলা মুখে খনিক বিরক্তি নিয়ে বললো।
তুমি কি এখানে আমায় আজাইরা কথা শুনাতে এনেছো ভাইয়া।
আমার যেকোনো কথাইতো আগে তোর কাছে ভালোই লাগতো আর এখন বিরক্ত লাগছে,তোর মনে আছে তুই আমার সাথে কথা বলার জন্য কতো উৎসুক হয়ে থাকতি সারাদিন।আর এখন আমার কথা তোর কাছে আজাইরা মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ হচ্ছে,এখন তুমি আর তোমার কোনো কথা কোনোকিছুরই কোনো গুরুত্ব নেই আমার কাছে।
কথাটা শুনে আকাশ নিজের বুকে কিন্চিৎ ব্যাথা অনুভব করলো,দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ত্যাগ করলো তারপর বললো।
তবে শুন,আমি আসলে তোকে অনেক কিছু বলতে এখানে এনেছি,কোথা থেকে শুরু করবো ভেবে পাচ্ছি না।আসলে
আকাশ কথাটা শুরু করবে তখনি সেখানে আগমন ঘটলো রিয়ার।
আরে আকাশ তুমি এখানে,কি হয়েছে তোমার? আজকাল আমার সাথে ভালো করে কথাই বলছো না,যাক এসেছিলাম এমনিতেই এখানে, কিন্তু এখানে এসে তোমাকে পাবো ভাবি নি,ভালোই হলো এখন তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারবো।
হুম আপনি একদম ঠিক বলছেন রিয়া আপু,আসলে আকাশ ভাইয়ার আড্ডাটা যে তোমার সাথেই ভালো জমে তাই না আকাশ ভাইয়া?তবে আপনারা বসে আড্ডা দিন আমি না হয় আসি।
আকাশের দিকে কেমন একটা লোকে তাকিয়ে কথাটা বলে চলে গেলো রোদেলা,আকাশ ওকে ডেকে ওর পিছু যাবে তখনি রিয়া আকাশের হাত ধরে নেয়।
কোথায় যাচ্ছো আকাশ দাঁড়াও।
আমার রোদেলার সাথে অনেক কথা আছে রিয়া আমাকে আটকিয়ো না প্লিজ।
কথাটা বলে আকাশ রিয়ার হাত ছাড়িয়ে রোদেলার পিছু চলে গেলো,রিয়া হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে।
চলবে…….
#শিশিরের কহিনুর
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ২৯
শায়েলা খান কোথাও বেরুচ্ছিলেন তখনি আশরাফ খান উনাকে পিছন থেকে ডাক দিলেন।
মা কোথায় যাচ্ছো?
আমার দাদুভাই আর নাতবউকে ফিরিয়ে আনতে।
তারমানে তুমি কহিনুরকে মেনে নিয়েছো মা।
দেখ আশরাফ ছোটবেলায় শিশির ওর মাকে হারিয়েছে,আমরা সবাই জানি তখন ওকে সামলানো কতোটা মুসকিল হয়ে পড়েছিলো, তারপর থেকে আমার দাদুভাইটা ছন্নছাড়া হয়ে গেছিলো,কিন্তু ওই মেয়েটা ওর জীবনে আসার পর আমি আমার দাদুভাইকে আবার হাসতে দেখেছি,খুশি থাকতে দেখেছি,আমার দাদুভাইটা সঠিক রাস্তায় ফিরে এসেছে,আর যখন আমার দাদুভাইয়ের আসল খুশি ওই মেয়েটাতেই সীমাবদ্ধ তখন ওকে মেনে নিতে আমারও কোনো সমস্যা নেই,একবার আমার দাদুভাই ভেঙে পড়েছিলো আর আমি ওকে ভেঙে পড়তে দিবো না,আমরা ওর কহিনুরকে মেনে নিলে ও আমাদের সাথেই থাকবে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে আমাদের জন্য আশরাফ।আমি যাই গিয়ে ওদের নিয়ে আসি।
কথাটা বলে শায়েলা খান যেতে নিলে আশরাফ খান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন।
দাঁড়াও মা।শায়েলা খান পিছনে তাকালেন,উনি হয়তো ভাবছিলেন উনার ছেলে উনাকে যেতে দিতে চাইবে না কিন্তু আশরাফ রায়হান খান শায়েলা খানকে পুরো অবাক করে দিয়ে মুখে খনিকে অনেকটা হাসিয়ে ফুঁটিয়ে বললেন।
তুমি তো তোমার নাতি আর নাতবউকে আনতে চলেই যাচ্ছো আমাকে বুঝি সাথে নিবে না,আমিও যে আমার ছেলে আর ছেলেবউকে ফিরিয়ে আনতে চাই।
শায়েলা খান মুচকি হেসে বললেন।
তবে চল একসাথেই ওদের নিয়ে আসি।
_____________________
অভিমান করে বসে আছে ব্যাঙটা এদিকে আমার বেচারি মনের ভিতর উথাল পাথাল ঢেউ শুরু হয়েছে,এই লোকটাকে রাগাতে ভালোই লাগে আমার কিন্তু এর অভিমান সহ্য করতে পারি না আমি,অনেক খারাপ লাগে উনি অভিমান করলে,অভিমান করলে যে আমার সাথে কথা বলে না আমার দিকে তাকায়ও না।তখন ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আমাকে অনেক সময় জড়িয়ে ধরে থাকলো আর তারপর ছেঁড়ে দিয়ে কি বকাটাই না বকলো,বিশ্বাস করা যায় কোনো লোক এভাবে মুহুর্তের মধ্যে রুপ পাল্টে ফেলতে পারে,শুনেছি মেয়েদের নাকি মুড সুয়িং বেশি হয়ে থাকে ছেলেদের ক্ষেত্রে তেমনটা শুনি নাই কিন্তু উনার দেখছি মেয়েদের চেয়েও বেশি হয়,একটু একা ঘুরতে গেলাম বলে এভাবে বকবে,যাক মারে নি যে এটাই ভালো,হু হু।এবার মুখ ফুলিয়ে বসে লেপটপে কিছু কাজ করছে,তাকাচ্ছেই না আমার দিকে,অভিমান করলে সারাদিন আমার সামনে থেকে সরে না হয়তো এ আশায় আমি উনার অভিমান ভাঙাবো আর আমিও যে উনার অভিমান না ভাঙিয়ে পারি না।আমি নিজের হাতে স্বাদ করে কফি বানিয়ে নিয়ে গিয়ে মুখের সামনে ধরলাম।তারপর মিষ্টি কন্ঠে বললাম।
এই যে আপনার জন্য কফি বানিয়ে এনেছি খেয়ে নিন।
আমার এই মুহুর্তে কফি খাওয়ার মুড নেই।
হুম উনি আমার হাতে কফি খাচ্ছেন না হুহ, আমার কুদরতউল্লাহ হলে ঝটফট খেয়ে নিতো।
উনি ভ্রুযোগল কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন আর বললেন।
কোন কুদরতউল্লাহ?
ছিলে এক কুদরতউল্লাহ,যে আমার হাতে কফি খেতে অনেক ভালোবাসতো,কতো রসিকতাই না করতো আমার সাথে,আমি কতো ওর কোলে বসেছি।
হোয়াট,কোথায় থাকে ও নাম বলো আমার কহিনুরকো কোলে নেওয়ার স্পর্ধা করেছে ও,আমার কহিনুরের হাতে কফি খায় আজকে ওকে কোনো কিছু খাওয়ার যোগ্য রাখবো না আমি,শেষ করে দিবো আমি ওকে।
যাক ডোজটা কাজে দিয়েছে ব্যাঙটা ক্ষেপেছে বটে,এবার দেখাবো খেলা, হু হু।
ওই আসলে আপনি চাইলেও উনাকে শেষ করতে পারবেন না।
কেনো এতো পাওয়ার আছে না কি ওর যে আমার কাছ থেকে বেঁচে যাবে?
না তা নেই তবে যে বেঁচেই নেই তাকে আবার মারবেন কি করে।
মানে?
আবারও ভ্রযোগল কুঁচকে বললেন উনি জবাবে আমি বললাম।
আসলে কুদরতউল্লাহ আমার দাদুর দাদু ছিলেন,আপনি বিশ্বাস করবেন না উনি পুরো ১২০ বছর বেঁচেছিলেন,আমার বয়স যখন ১২ তখন উনি মারা যান, উনাকে আমার অনেক ভালো লাগতো আমি কতো উনাকে নিজের হাতে চা কফি বানিয়ে খাইয়েছি,উনি অনেক পুরাতন হলেও কফি খেতে শিখে গিয়েছিলেন শেষ সময়ে,ঠিক আপনার মতোই কফিখোর ছিলেন উনি,হা হা হুহু।
আমি কথাটা বলে হাসতে হাসতে নেই,এদিকে খেয়াল করলাম উনি আমার দিকে মুখটা জালিম বাঘের মতো করে তাকিয়ে আছেন,বুঝতে পারলাম অবস্থা খারাপ, আজকে বেটা ধরতে পারলে আমার ঠোঁটগুলো চিবিয়ে খাবে,যখনি এমন অভিমান করে তখনি আমি এমন দুষ্টামি করে আর তারপর আমাকে দৌঁড়ানো শুরু করে আর ধরতে পারলে ৫-৭ মিনিটের জন্য আমার অধরজোড়া জব্দ করে নেয়,ছি ছি লজ্জা শরম কিছুই নেই উল্লুকের,উনার লুক দেখে আমি বুঝতে পারলাম উনার মনোভাব তাই আর কিছু না বলে ভুদৌঁড় দিলাম।
আজ তোমাকে ছাড়বোনা মিসেস এস আর কে।
আগে ধরে দেখান তারপর নইলে ছাড়বেন।
কথাটা বলে আমি সামনে সামনে দৌঁড়াচ্ছি আর উনি পিছন পিছন, আমিও হাসছি আর উনিও।উনার সাথে এমনটা করতে আমার ভালোই লাগে,ছুঁটতে ছুঁটতে হঠাৎ আমি কারো সাথে ধাক্কা খেলাম,পড়ে যেতে নিলে উনি পিছন থেকে আমাকে ধরে নিলেন,আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমার দাদি শ্বাশুড়ি আর শ্বশুর মশাই এসেছেন,উনাদের দেখতেই উনি আমার সামনে এসে আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পরলেন আর উনাদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন।
আপনারা এখানে, কি চাই আপনাদের?
আমরা তোদের নিয়ে যেতে এসেছি শিশির।
আমরা আপনাদের সাথে যাবো না,আপনাদের আমি ওই কাগজগুলো দিয়েছিলাম সেগুলোর কি হলো,সেগুলো সাইন করে দিয়ে চলে যান এখান থেকে।
এই নাও কাগজগুলো।উনি কাগজগুলো হাতে নিয়ে একটু দেখলেন তারপর বললেন।
এগুলা তো সেই কাগজ না,এগুলা আবার কিসের কাগজ।
ভালো করে পড়ে নাও।ওগুলাতে স্পষ্ট লিখা আজ থেকে যদি তোমার কহিনুরের সাথে কোনোকিছুই খারাপ হয় তার দায় ভার আমি আর আশরাফ নিবো তারমানে এটা যে তোমার কহিনুরের সাথে আমরা কিছু করলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই তুমি আইনত আমাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারবে,এমনকি অন্য কেউও ওর সাথে কিছু করলে দায়ী তো আমরাই হবো তাই এটা স্বাভাবিক আমরা কখনো নিজে থেকে ওর ক্ষতি করতে চাইবো না দেখো কাগজগুলোতে আমরা দুজন সাইন করে দিয়েছি প্লিজ এবার বউকে নিয়ে ঘরে চলো দাদুভাই।
আমার কহিনুর কোথাও যাবে না আর আমিও না,আপনাদের এই ফালতু পেপারস গুলোর বদলে আমি আমার কহিনুরকে নিয়ে কোনো চান্স নিবো না, আপনারা এবার আসতে পারেন।
তারপর ওরা উনাকে মানানের জন্য কি না কি করতে লাগলেন,উনি উনার কথা থেকে একচুলও নড়ছেন না বরং ধীরে ধীরে উনার রাগ উঠতে শুরু করছে যা আমি অনুমান করতে পারছি আর রাগটা উঠে গেলে যে ক্যালেঙ্কারী হবে, এতোসময় আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলাম, এবার আমি উনাকে সেখান থেকে টেনেটুনে আমাদের রুমে নিয়ে গেলাম আর যেতে যেতে ইশারা করে দাদিজান আর বাবাকে বুঝালাম যে আমি উনাকে মানাবোই।আমি জানি উনাকে যদি কেউ নিজের কথা মানাতে পারে তবে সেটা শুধু আমি,রুমে এনে উনাকে কতো কাকুতিমিনতি করলাম,উনাকে এটা বুঝাতে সক্ষম হলাম যে আল্লাহর রহমতে উনি আমার পাশে থাকলে কেউ আমার কিছুই করতে পারবে না,তাছাড়া উনারা যখন একটা চান্স চাইছেন তাই উনাদের সেই সুযোগ দিয়ে দেওয়া দরকার,এরপরও যদি উনারা কিছু করেন তবে উনার তাদের সাথে যা করার উনি করে নিতে পারেন আমি আটকাবো না উনাকে,এসব কথা বুঝিয়ে উনাকে মানালাম নয়তো উনি কখনোই মানতেন না আমি জানি,যাক অবশেষে অনেক করে উনাদের সাথে যাওয়ার জন্য মানলেন উনি,কিন্তু আমাকে উনাদের আশেপাশে যেতে মানা করলেন,আসার সময়ও আমাকে উনাদের পাশে যেতেই দিলেন না,এমনভাবেও কেউ কাউকে আগলে রাখতে পারে আজকে আমি প্রথম দেখলাম,সত্যিই লোকটা আমার জন্য পাগল।
___________________
রোদেলা ওর বেডে বসে ফোন গাটছিলো তখনি আকাশ এসে ওর ফোনটা নিয়ে পাশে রেখে ওকে চট করে কোলে তুলে নিলো।
এসব কি করছো আকাশ ভাইয়া ছাড়ো আমায়,এমন লুচ্চামি করছো কেনো তুমি?
লুচ্চামির কি দেখেছিস তুই সবে তো মাত্র শুরু।
ছাড়ো ভাইয়া বলছি?
আকাশ ওর কোনো কথা না শুনে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর রুমের বারান্দার দোলনাতে বসালো।
কি হলো এখানে বসালে কেনো।
তোকে কিছু কথা বলবো বলে।
আমি তোমার কোনো কথাই শুনবো না ভাইয়া,রিয়া আছে তো ও সারাদিন তোমার সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য উঠে পরে থাকে ওর সাথেই কথা বললে পারো।
কথায় কথায় কেনো রিয়াকে টেনে আনিস রোদেলা,তখনও রিয়াকে দেখে আমার সাথে কথা বললি না বরং চলে আসলি সেখান থেকে।
তো আর কি করার ছিলো আমার, তুমিতো তোমার রিয়ার সাথেই বেশি হেপি থাকো আর আমি তোমাদের কাবাবে হাড্ডি হতে চাই না।
কিসের কাবাবের কথা বলছিস রোদেলা,রিয়ার সাথে আমার এমন কিছুই না।
কেমনে কিছু না ভাইয়া,তুমিই তো বলেছিলে রিয়া কতো পার্ফেক্ট, ওর মতো মেচোয়ার, ভালো আরও কি কি যা আমি কখনোই হতে পারবো না,তবে এখন ওকে ছেঁড়ে আমার পিছন পরার মানেটা কি তা একটু খুলে বলবে ভাইয়া,আমি তো একটা নষ্টা মেয়ে তবে আমার মতো নষ্টার পিছনে পরার কারন কি আমি জানতে পারি।
একদম চুপ রোদেলা,নিজেকে নষ্টা বলতে মুখ কাঁপলো না তোর।
চিৎকার করো না ভাইয়া এই উপাধিটা তুমিই আমাকে দিয়েছিলে আর আজ কথাটা আমার মুখে শুনে খারাপ লাগছে তোমার,দেস্ট’স নট ফেয়ার ভাইয়া।
আমি তখন জিনিসটা বুঝতে পারি নি রোদেলা,নিজের মনের সত্য অনুভুতির সাথে আমি অবগত ছিলাম না,কিন্তু যখন তুই আমার থেকে দূর হতে শুরু করলি তখন বুঝতে পারলাম তোকে নিয়ে আমার মনের আসল অনুভুতিটা আসলে কি,কথায় আছে না পাশে থাকলে কখনোই কারো মর্ম বোঝা যায় না দূরে গেলেই মর্মটা অনুভবে ধরা দেয়,আমি যে নিজের মনের কথা বুঝতে দেরি করে ফেলেছি রে রোদেলা, ক্ষমা করা যায় না আমাকে?প্লিজ ক্ষমা করে দে আমায়।
রোদেলা খেয়াল করলো কথাটা বলতে গিয়ে আকাশের চোখজোড়া খনিক ছলছল করে উঠলো,ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওর বলা কোনো কথা মিথ্যে বলে মনে হলো না রোদেলার,তাও নিজেকে শক্ত করে নিলো,নিজেকে যে আর দূর্বল পরতে দিতে চায় না রোদেলা,চায় না ওর মনটা আবারও ভাঙুক,মন ভাঙার ব্যাথা যে সহ্য করার ক্ষমতা দ্বিতীয়বার আর হয়ে উঠবে না রোদেলার,তাই আর আকাশের বলা কোনো কথাই আর আলাদা করে অনুভব করতে চাইলো না রোদেলা বরং বললো।
ওহ তবে তোমার ক্ষমা চাই, হ্যাঁ তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো তাই তোমার খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক, তবে শুনে নাও ভাইয়া আমি তোমাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি,এবার তুমি শান্তিতে থাকতে পারো।
কথাটা বলে রোদেলা চলে যেতে নিলে আকাশ এমন একটা কথা বলে উঠলো যা শুনে রোদেলা থমকে দাঁড়ালো।
আমি শুধু ক্ষমা চাই না রোদেলা আমি তোকেও চাই।
কথাটা শুনে এবার রোদেলা অবাক দৃষ্টিতে পিছন ফিরে তাকালো,আকাশ আবারও বলতে শুরু করলো।
হ্যাঁ রে রোদেলা আমি যে তোকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, আমার থাকা দায় হয়ে পড়েছে তোকে ছাঁড়া,প্লিজ ফিরে আয় আমার জীবনে কথা দিচ্ছি আর কখনো তোকে কষ্ট দিবো না,বুকের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিবো তোকে,আগলে রাখবো নিজের জীবন দিয়ে হলেও।
না জানি কতো বছর ধরে এই কথাটা শুনার অপেক্ষায় ছিলো রোদেলা কিন্তু আজ এভাবে শুনতে পাবে তা হয়তো কখনো রোদেলার ভাবনাতেও আসে নি,কিন্তু এই সুপ্রিয় বাক্যটা শুনারও পরও যে তা বিশ্বাস করার সাহস নেই রোদেলার বুকে,তাই আর তা বিশ্বাস করার চেষ্টাও করতে চাইলো না।রোদেলা এবার কন্ঠে কাঠিন্য এনে বললো।
তুমি বাসলেও আমি তোমায় ভালোবাসি না ভাইয়া আর কখনো বাসবোও না।আর আমার মনে হয় তুমিও আমায় ভালোবাসো না ওই যে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলে হয়তো তা নিয়ে আমার জন্য তোমার মনে খারাপ লাগা কাজ করছে যাকে তুমি ভালোবাসা ভাবছো,কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয় ভাইয়া,তোমার তা বুঝা উচিৎ।
কথাটা বলে রোদেলা ছুটে চলে গেলো রুমের বাইরের দিকে আকাশ ওর যাওয়ার পানে ছলছল চোখে তাকাতে তাকাতে বললো।
না রোদেলা তা যে খারাপ লাগা না আমার মনে লুকিয়ে থাকা তোর জন্য অসীম ভালোবাসা তা আর বুঝতে বাকি রয়ে যায় নি আমার, জানি আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে আর সে কষ্টের পাহাড় ভাঙাও যে আমার পক্ষে সহজ হবে না তাও আমার জানা আছে রোদেলা,তবে এটা জেনে রাখিস এই পাহাড় আমি ভাঙবোই,তুই শুধু আমার রোদেলা,তোর মনে যে নতুন করে নিজের জায়গা করে নেওয়ার কোনো পথই ছাড়বো না আমি,এন্ড ইট’স মাই প্রমিজ টু ইউ মাই লাভ।
চলবে………..