শিশিরের কহিনুর,৩১,৩২

0
702

#শিশিরের কহিনুর,৩১,৩২
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ৩১

তখন শিশির বাড়ি থেকে বেড়িয়ে তুফান বেগে গাড়ি চালাতে শুরু করেছিলো আর ওর কানে ভেসে আসছিলো ওর কহিনুরের বলা তিক্ত সে কথাগুলো, যা কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না শিশির,হাওয়ার বেগে গাড়ি ছুটাচ্ছিলো তখন,চোখের অশ্রুধারা বয়েই যাচ্ছিল,কানে বার বার ভেসে আসতো থাকা কহিনুরের কঠোর বানি কিছুতেই আটকাতে পারছিলো না,শিশিরের মা ওকে ছেড়ে গেছে কারন ওর মতো পাগলের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা নেই, আর ওর কহিনুরও ওকে এর জন্য ভালোবাসে না আর বাসবেও না,কি করে মেনে নিবে কহিনুরের বলা এই অপ্রিয় বাক্য,ওর মরে গেলে ওর কহিনুর খুশি হবে,ওর প্রাণের বদলে যে ওর কহিনুর নিজের স্বাধীনতা চায়,কথাটা যেনো মাথায় চেপে বসেছে শিশিরের, বার বার কথাটা মাথায় ঘুরছে,আজ যে আর শিশির ওকে আটকে রাখতে চায় না,স্বাধীন করে দিতে চায় নিজের প্রাণপাখিকে কিন্তু তা যে বেঁচে থাকা সত্তে পারবে না এই পাগলপ্রেমিক,তাই অসহায়ত্ব স্বরে কঠোর ভাব এনে বললো।

আমার প্রাণের বদলে যখন তোমার স্বাধীনতা চাই তবে তাই ভালো, দিলাম তোমায় স্বাধীনতা কহিনুর। ভালো থেকো।

সামনে আসছিলো একটা বড় ট্রাক,শিশির কথাটা বলে ইচ্ছে করে গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে ট্রাকটির সাথে ধাক্কা দেয়,শিশির হঠাৎ গাড়ি নিয়ে সামনে চলে আসায় ট্রাকের ড্রাইবার আর তৎক্ষনাৎ ব্রেক কষতে গিয়েও ব্যার্থ হয় আর ট্রাকটার সাথে প্রবল বেগে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় শিশিরের কার, সাথে সাথেই শিশিরের গাড়িটা উলোটপালোট হতে শুরু করে,পাঁচ থেকে ছয় বার গাড়িটা উলোটপালোট হবার পর উল্টো অবস্থাতে থেমে যায়,খনিকে গাড়িটা চূর্ণবিচূর্ন হয়ে গেছে,ট্রাকটা নিয়ে ড্রাইবার পালিয়ে যায়, যেহেতু শিশিরের গার্ডগুলো ওর গাড়ির পিছনেই ছিলো তাই মুহুর্তটা চোখ এড়ালো না ওদের,ছুঁটে এসে ওরা গাড়িটাকে সোজা করলো তারপর ভিতর থেকে শিশিরকে বার করলো,শিশিরের অবস্থা অনেক নাজেহাল ছিলো তখন,জ্ঞান ছিলো না ঠিকমতো যতোটুকু জ্ঞান ছিলো ততটুকু জ্ঞানেই মুখ দিয়ে শুধু একটা নাম বার করছিলো কহিনুর।গার্ডগুলো ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসলো আর তারপর নুরকে ফোন করে সবকিছু বললো,কথাটা শুনে নুর ছুঁটতে শুরু করলো,একটা ওটোতে বসে আছে নুর,গাড়িওলাকে বার বার বলছে জোড়ে চালাতে,এখন যেনো নুরের পাখা থাকলে উড়ে চলে যেতো ওর মি.খানের কাছে,চোখের জল থামছে না ওর,শুধু ধমে ধমে আল্লাহকে ডাকছে, হঠাৎ গাড়িটা জ্যামে আটকা পরলো,কিন্তু নুর যে অপেক্ষা করতে নারায আজ,জ্যাম দেখে বুঝতে পারলো সহজে ছাড়বে না তাই ছুঁটতে শুরু করলো,আশেপাশে কোনো রিক্সাও পাচ্ছে না,না কোনো ওটো তাই ছুঁটছে আজ যে করেই হোক ও শিশিরের কাছে পৌঁছাবেই,নুরের প্রাণ যে ছটফট করছে শিশিরকে এক নজর দেখার জন্য,বার বার কানে ভেসে আসছে গার্ডের বলা কথা ওর মি.খানের নাকি গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে অবস্থা ভালো না,মনে ওর ভয় কাজ করছে যদি ওর মি.খান ওকে ছেঁড়ে চলে যায়, না আর পারছে না নিজেকে ধরে রাখতে ছুঁটে চলেছে শুধু,এদিকে দৌঁড়াতে গিয়ে জুতো ছিঁড়ে গেলেও খালি পায়ে ছুঁটছে,এতে পায়ে রাস্তার ছোট ছোট কঙ্কর বিধছে কিন্তু এতে যেনো নুরের কোনো কিছুই আসে যায় না ও তো আপন গতিতে ছুঁটছে,আজ কোনো কিছুই ওকে ওর মি.খানের কাছে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে না।অবশেষে পৌঁছে গেলো নুর সেই হাসপাতালে, ছুঁটে গেলো ভিতরে, হঠাৎ দেখতে পেলো গার্ড মাহদীকে।পাগলপ্রায় হয়ে ওর পাশে গেলো আর জিজ্ঞেস করতে লাগলো।

মাহদী ভাইয়া উনি কোথায়?কি হয়েছে উনার?

মাহদী কিছু বলবে এর আগেই একজন ডাক্তার বেড়িয়ে এসে বলতে লাগলেন।

এখানে কি কোনো কহিনুর আছেন?

এই তো আমি কহিনুর,উনি কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব,উনি কোথায়?

দেখেন উনার অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল,উনি বার বার কহিনুর বলে ডাকছেন,আমরা এখনই উনাকে ওটিতে নিয়ে যাবো উনার যে অবস্থা ওখান থেকে ফিরার আর না ফিরার সম্ভাবনা সমান তাই আপনার উনার সাথে দেখা করে নেওয়া উচিত।

কতাটা শুনে আর কহিনুর সেখানে দাঁড়াতে পারলো না ছুঁটে চলে গেলো কেবিনের ভিতর মি.খান বলে চিৎকার করে।

শিশির শুয়ে আছে,খাটের সাদা চাদর লাল বর্ন ধারন করেছে ওর রক্তে,চোখজোড়া ওর বন্ধ তবে মুখ দিয়ে বার বার একটা নাম বার করছে কহিনুর,দৃশ্যটা দেখে কহিনুর আর নিজেকে সামলাতে পারলো না ছুটে গিয়ে আকঁড়ে ধরলো শিশিরকে নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে ,তারপর ওর গালে নিজের হাতে ভালোবাসাময় স্পর্শে ধরে ব্যাথার্ত কন্ঠে বলতে লাগলো।

এই তো আমি এসে গেছি আপনার কাছে,আর কোথাও যাবো না, কথা বলেন আমার সাথে,তাকান আমার দিকে।

এবার শিশির চোখজোড়া অনেক কষ্টে টেনে খুললো,ভালো করে যে তাকাতেও পারছে না,চোখ খুলেই দেখলো ওর কহিনুরকে,ব্যাথার্ত বুকটা যেনো মুহুর্তে খুশির ছোঁয়ায় চলে গেলো,জোর করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটিয়ে অনেক কষ্টে তোঁতলাতে তোঁতলাতে বলতে লাগলো।

তুমি এসে গেছো কহিনুর,আমার টানে এসেছে বুঝি?নাকি এটা দেখতে যে সত্যিই কি মরে যাচ্ছি? তুমি কান্না করছো কেনো?কান্না করো না কহিনুর,আর তোমায় কষ্ট দিবো না আমি,তোমার জীবনের সেই খুশি ফিরিয়ে দিবো আমি,ফিরিয়ে দেবো তোমার স্বাধীনতা,আর কষ্ট দিবো না আমি তোমাকে,চলে যাবো তোমার জীবন থেকে মুক্ত করে দিবো তোমায়,আর আসবোনা ফিরে শুধু শেষ চাওয়া তোমার কাছে তোমার কোলে শান্তিতে মরতে দাও,আমি যে চাই আমার শেষ নিশ্বাস টা যেনো তোমার কোলেই ত্যাগ করার সৌভাগ্য হোক আমার,জানিনা সেই সৌভাগ্য হবে কি না।দয়া করে আমায় শান্তিতে মরতে দাও তোমার কোলে।

কহিনুর এবার ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো শক্ত করে আর বলতে লাগলো।

এসব কি বলছেন আপনি? আপনার কিছুই হবে না,আপনি একদম ঠিক হয়ে যাবেন,আমি আপনাকে কিছুই হতে দিবো না।।

শিশির এবার খুব কষ্টে নিশ্বাস টেনে আলতো করে বলে উঠলো।

আই লাভ ইউ কহিনুর।

কথাটা বলার পরপরই শিশির নিস্তেজ হয়ে গেলো যা বুঝতে বাকি রইলো না নুরের,নুর এবার পাগলপ্রায় হয়ে শিশিরের গালে হাত দিয়ে ওকে ডাকতে শুরু করলো।

মি.খান,মি.খান চোখ খোলেন,কথা বলেন আমার সাথে,কথা বলেন না,এই তো আমি আপনার পাশেই আছি,বকেন আমাকে,রাগ করেন,মারতে ইচ্ছে হলে তাই করেন তবুও অভিমান করে থাকবেন না আমার সাথে, চোখ খুলেন না কথা বলেন আমার সাথে মি.খান কথা বলেন,মি.খান।

মি.খান বলে চিৎকার করে আবারও বুকে টেনে নিলো ওকে কহিনুর আর আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলো।

আর কখনোই আপনাকে ছেঁড়ে যাওয়ার কথা বলবো না,সারাজীবন পাশে থাকবো আপনার,আগলে রাখবো আপনাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে, প্লিজ আমায় ছেঁড়ে যাবেন না আপনি,আমি পারবোনা আপনাকে ছাড়া থাকতে,আপনার কহিনুর যে পারবে না আপনাকে ছাড়া বাঁচতে ফিরে আসেন মি.খান,চলে যাবেন না আমায় ছেঁড়ে,মনের অজান্তে কখন আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানিনা,কিন্তু আপনাকে এই হালে দেখে যে আমার নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে,ইচ্ছে করছে আপনাকে বুকের ভিতর লুকিয়ে নেই আর কোথাও যেতে না দেই,যদি এই টানটার নাম ভালোবাসা হয়ে থাকে তবে হ্যাঁ ভালোবাসি আমি আপনাকে,যদি অন্য মেয়ের সাথে আপনাকে দেখে আমার খারাপ লাগা,আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা,আপনার কষ্ট অনুভব করা ভালোবাসা হয়ে থাকে তবে হ্যাঁ হ্যাঁ ভালোবাসি আমি আপনাকে,অনেক ভালোবাসি,শুনেছেন আপনি আপনার কহিনুর আপনাকে ভালোবাসে,চোখ খুলেন না এবার,কথা বলেন আমার সাথে মি.খান কথা বলেন।

তখনি ডাক্তারেরা চলে এসে শিশিরকে নিয়ে যেতে লাগলেন।কহিনুর ওকে ছারতেই চাইছে না।

না আমার মি.খানকে আমি কোথাও যেতে দিবো না,উনার কিছুই হতে দিবো না আমি,উনি আমায় ছেঁড়ে চলে যেতে চান আমি তা কখনোই হতে দিবো না,আপনারা চলে যান এখান থেকে চলে যান বলছি।

দেখেন আপনি নিজেকে সামলান খুব শিগ্রই উনার অপারেশন শুরু না করলে উনাকে আর বাঁচানোই যাবে না,কথাটা বলে ডাক্তারেরা শিশিরকে নিয়ে যেতে লাগলেন,নুর ওদের পিছন ছুটছে ওর মি.খানকে কোথাও যেতে দিবে না এই আবদার করে,নুর পুরো পাগলের মতো বিহেব করছে তখনি ওর পরিবার চলে আসে সেখানে,নুরকে ধরে নেন ওর মা।আসলে তখন নুর ফোন ফেলে ছুটে আসলে মুহুর্তটা চোখে পরে জেবিনের,জেবিন ফোনটা তুলে দেখলো মাহদী নামে সেইভ করা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো তখন,তারপর কল ব্যাক করে সবকিছু জানতো পারলো আর সবাইকে নিয়ে চলে আসলো এখানে।

মা আমাকে ছাড়ো মা,আমার মি.খানকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে,উনি বলেছেন উনি আমায় ছেঁড়ে চলে যাবেন আর ফিরবেন না,আমাকে উনাকে ফিরাতে হবেল মা,আমার যে উনাকে প্রয়োজন, চাই না আমার মুক্তি,চাই না স্বাধীনতা আমার শুধু উনাকে চাই, উনাকে ফিরিয়ে আনোনা মা।

নুরের মা ওকে শান্তনা দিচ্ছেন, তখন জেবিন আপি বলে উঠলেন।

তুই এতো ড্রামাও করতে পারিস আজকে আমি প্রথম জানলাম আরু,কি পার্ফেক্ট তোর অভিনয়,এই মিছে কান্না না করে গিয়ে পার্টি কর যা,আজকে তো তোর পার্টির দিন।

তুমি এসব কি বলছো আপি,আমি পার্টি কেনো করবো?

এবার নুরের আপন বোন বলে উঠলো।

কেনো করবি না বল?তুই তো নিজের মুখেই তখন বললি যে শিশির মরে গেলে তুই পার্টি করবি,যেদিন শিশির মরবে সেদিন তোর খুশির দিন হবে,তবে তো ছেলেটা আজকে তাই করলো,মরতে গেলো,হয়তো এখন বেঁচে আছে কিন্তু যা অবস্থা বেশিক্ষণ বেঁচে থাকবে বলে মনে হয় না।মরেই যাবে।

আপু,তোমার সাহস হলো কি করে এমনটা বলার?

চিৎকার করিস না আরু,আজ তোর জন্যই ওই ছেলেটার এই অবস্থা,ভেবে দেখ আরু তুই কোনো অপসরা না, তোর থেকেও হাজার গুন সুন্দর মেয়েরা ওই শিশিরকে এক পলক দেখার জন্য উল্টে পরে মরে,এ বিষয়ে সবথেকে ভালো তুই জানিস,এছাড়াও কি আছে তোর, আছে ওর মতো অর্থ বিত্ত, আছে ওর মতো ক্লাস?না নেই আরু,কিন্তু তারপরও ওই ছেলেটা তোর পিছনই কেনো পরে থাকে বলতে পারবি?কারন একটাই ও তোকে ভালোবাসে,যাকে বলে সত্য ভালোবাসা,যে ভালোবাসা রুপ গুন অর্থ বিত্ত কিছু দেখে না দেখে শুধু মন।আজকাল এমনভাবে ভালোবাসার স্বামী কেউ বছরের পর বছর সাধনা করেও পায় না আরু,আর তুই কপাল গুনে এমন একটা স্বামী পেয়েও এভাবে অবহেলা করলি,মরার রাস্তায় ঠেলে দিলি,তুই এমনকি ওর মাকে নিয়েও কথা বলতে দুবার ভাবলি না।আজ ওর এই অবস্থা শুধু তোর কারনে আরু,আজকে শিশির মরতে যাচ্ছে শুধু তোর জন্য,তোর একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভ ওকে মরার ঘাটে টেনে নিয়ে গেলো ,আজ থেকে তো তুই স্বাধীন, আর কেউ বন্ধি রাখবে না তোকে,যা গিয়ে ফুর্তি কর, বন্ধুদের পার্টি দে।

বন্ধ করো আপি,প্লিজ বন্ধ করো,আমি আর শুনতে পারছি না,আমি তখন রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা বলে দিয়েছি কিন্তু আমি কখনো চাই না উনি আমায় ছেড়ে চলে যাক,আমি পারবো না উনাকে ছাড়া থাকতে,উনি পাশে থাকতে তা বুঝতে পারি নি আমি,কিন্তু উনার দূরে চলে যাওয়ার ভয় যে এখন আকঁড়ে ধরেছে আমায়, আমি পারবোনা উনাকে ছাঁড়া বাঁচতে,আমি কিছুই হতে দিবো না উনাকে,উনার কিছুই হবে না।

কথাটা বলে নুর ছুঁটে গেলো নামাযের রুমে,ওযু করে নফল নামাযে বসলো,ওর অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে জায়নামাজ, মোনাজাতে হাত তুলে কান্না করতে করতে বলতে লাগলো।

আল্লাহ এমন কোনো দিন যায় নি যে দিন আমি আপনার কাছে উনার কাছ থেকে মুক্তি চাই নি,প্রতিদিনই চাইতাম উনি যাতে আমার জীবন থেকে দূরে চলে যান,কিন্তু আজকে সত্যিই যখন তা ঘটছে তবে আমি তা আর মেনে নিতে পারছি না খোদা,আমি চাই না মুক্তি,চাই না স্বাধীনতা,আমি উনার ভালোবাসার বন্ধ খাঁচায় বন্দী থাকতে চাই সারাজীবন,উনাকে আপনি কেঁড়ে নিবেন না আমার কাছ থেকে,আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি আপনার দরবারে, আমাকে ক্ষমা করে দিন মওলা,ইয়া মালিক উনাকে বাঁচিয়ে দিন, আমি রোজ আপনার দরবারে নফল নামায পরে শুকরিয়া আদায় করবো,আপনি উনাকে আমায় ভিক্ষা হিসাবে দিয়ে দেন খোদা,আর নয়তো উনার সাথে আমাকেও নিয়ে যান,যে জীবনে উনি নেই সে জীবনে আমার বাঁচারও কোনো আশা নেই খোদা, খোদা আমায় খালি হাতে ফিরিয়ো না খোদা,আমার মি.খানকে ভিক্ষা রুপে দিয়ে দেন আমায়।

কান্না করতে করতে সেখানেই জ্ঞান হারায় নুর।কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে নুর নিজেকে একটা কেবিনে আবিষ্কার করে আশেপাশে কেউ নেই,হাতের উপর একটা স্যালাইন ঝুলছে, জ্ঞান ফিরতেই মনে পরে ওর মি.খানের কথা,হাতের স্যালাইন খুলে মি.খান বলে চিৎকার করে ছুটে যায় বাইরে।
আশেপাশে ছুঁটছে কোথাও নিজের পরিবারের কাউকে দেখছে না,খুঁজছে সবাইকে তখনি কিছু লোকের কথা কানে ভেসে এলো।

ইশ শুনেছি ছেলেটা নতুন বিয়ে করেছিলো,বউকে নাকি অনেক ভালোবাসতো,কিন্তু নিয়তি দেখো একটা ট্রাক এক্সিডেন্টে মারাই গেলো ছেলেটা না জানি বউটার কি হাল।

লোকগুলো একটা সাদা চাদরে ঢাকা রোগী বহন ট্রলির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলো,লোকগুলোর কথা শুনে খক করে উঠলো নুরের মন,এক পা এক পা করে এগুতে লাগলো ট্রলিটার দিকে,এগিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে লাশটার মুখ থেকে চাঁদর সরিয়েই মি.খান বলে চিৎকার করে উঠলো।

চলবে…..

#শিশিরের কহিনুর
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ৩২

নুর চাদর সরাতে গিয়ে আর ওই চেহারাটা দেখার সাহস হয়ে উঠলো না ওর,তাই চাদর সরিয়েই ওই মুখটা না দেখে নিজের মুখটা ওপরদিকে সরিয়ে মি.খান বলে চিৎকার করে উঠলো মনের ভয়ে যদি লাশটা ওর মি.খানের হয়ে থাকে,তারপর কোনোরকম চোখ তুলে তাকালো লোকটার দিকে আর ওর প্রাণে প্রাণ এলো ল, লোকটা যে ওর মি.খান না।তারপর আবার ছুঁটতে লাগলো নুর হঠাৎ ধাক্কা খেলো ওর মায়ের সাথে,পাগলপ্রায় হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো।

মা আমার মি.খান কোথায় মা?উনার কিছু হয় নিতো?

মা তুই শান্ত হো,এভাবে ছুঁটছিস কেনো তুই?তুই তো অসুস্থ।

আমি একদম ঠিক আছি, তুমি আগে বলো আমার মি.খান কোথায়।

ছেলেটির অপারেশন এখনও চলছে রে মা,চিন্তা করিস না আল্লাহর উপর ভরসা রাখ সব ঠিক হয়ে যাবে।

নুর এবার আবারও ছুঁটতে লাগলো, ওটির দরজার সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো।

মি.খান,ও মি.খান আপনি আমায় ছেঁড়ে যেতে পারেন না,বলেন না সবাইকে,আপনি আপনার কহিনুরের কাছে ফিরে আসবে,বলেন না,ফিরে আসেন না আমার কাছে,মি.খান।

কথাটা বলতে বলতে ফ্লোরে লুটে পরে কান্না করতে শুরু করলো নুর।

তিন ঘন্টা ধরে শিশিরের অপারেশন চলছে, ওর পরিবার খবরটা শুনার পর আর্জেন্ট ফ্লাইটে চলে এসেছে এখানে,সবাই কাঁদছে ওর জন্য,বিশেষ করে রুশানা খান,শায়েলা খান,ভোর আর রোদেলার অবস্থা বেশি খারাপ কান্না করতে করতে।

হঠাৎ ডাক্তার বেড়িয়ে এলেন,সবাই এগিয়ে গেলেন,নুর পাগলের মতো ডাক্তারকে প্রশ্ন করতে শুরু করলো।

ডাক্তার সাহেব আমার মি.খান কেমন আছেন,উনি একদম ঠিক আছেন বলেন না।

আসলে অপারেশনটা শেষ কিন্তু এখন কিছু বলা যাচ্ছে না,তাছাড়া উনার অনেক রক্ত গেছে,উনার ব্লাড গ্রুপ O নেগেটিভ, আমাদের এখানে যা ব্লাড ছিলো আমরা উনাকে তা দিয়েছি,উনার আরও রক্তের প্রয়োজন আপনাদের জলদি করে একজন ডোনার খুঁজে নিয়ে আসতে হবে।

আমার ব্লাড গ্রুপ O নেগেটিভ আমি রক্ত দিবো ওকে,আমি থাকতে আমার ছেলের কিছুই হবে না,ডাক্তার সাহেব আপনার যা রক্ত লাগে আপনি নিয়ে নিন তবুও আমার ছেলেকে বাঁচান।

ওকে আপনি আমার সাথে আসুন।

রুশানা খানের এমন কথায় সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার দিকে,উনি যে সবসময়ই শিশিরকে নিজের ছেলের চোখেই দেখেছিলেন কিন্তু শিশির কখনো উনাকে সে অনুযায়ী কোনো মুল্যই দেয় নি বরং অপমান করেছে কিন্তু এতেও শিশিরকে নিয়ে উনার মনে কোনো ক্ষোভ জন্মে নি,আজকে উনার কান্না দেখলে যে কেউ বলবে শিশির উনার নাড়ি ছেঁড়া ধন,উনার জন্য সেখানে উপস্থিত সবার মনে সম্মান আরও অনেকগুণ বেঁড়ে গেলো আজ।

যাক শিশিরকে এবার আইসিইউতে ঢুকানো হলো,গত ১৫ ঘন্টা ধরে ও আইসিইউতে,এদিকে আইসিইউ এর দরজার কাচ দিয়ে একজোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ তাকিয়ে আছে ওর পানে,চোখগুলোর যে পলকই পরছে না,যে চোখজোড়া একসময় শিশিরকে সহ্যই করতে পারতো না সে চোখজোড়া আজ ওকে একপলক দেখার জন্য ছটফট করছে,সে চোখগুলো যে আর কারও নয় শিশিরের কহিনুরের,কহিনুরের চোখ দিয়ে জল পরা এখনও কমে নি,দমে দমে এখনও আল্লাহ আল্লাহ জপছে ওর মি.খানের জ্ঞান যাতে উনি জলদি ফিরিয়ে দেন,কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে ওকে চেক-আপ করলেন,তারপর উনারা নিশ্চিত করলেন শিশির এখন আউট অফ ডেঞ্জার, তবে ওর পুরোপুরিভাবে সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে,ওকে কোনোপ্রকার টেনশন দেওয়া যাবে না,সবসময় ওকে চিন্তামুক্ত রাখতে হবে ওর খেয়াল রাখতে হবে,কথাগুলো বলে উনারা ওকে কেবিনে শিফ্ট করলেন,কখন জ্ঞান ফিরবে তা বলা যাচ্ছে না।শিশির শুয়ে আছে বেডে পাশেই বসে আছে নুর,অপলকে তাকিয়ে আছে ওর মি.খানের দিকে,আলতো হাতে বার বার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর ওপর হাতে নিজের আঁখিদ্বয় মুছতে ব্যস্ত হয়ে আছে,আজকে যদি শিশিরের কিছু হয়ে যেতো তবে যে নুরেরও বাঁচা দায় হয়ে পরতো,কখন যে নিজের অজান্তে এই পাগল লোকটার প্রেমে নিজে পাগল হয়ে গেছে তা জানে না নুর,তবে আজকে নিজের বুকের ভেতর জমানো ভালোবাসাগুলো এভাবে উপলব্ধি করতে পারবে কখনো ভাবে নি,কিন্তু এখন যখন তা উপলব্ধি করতে পেরেছে তবে আর কখনোই শিশিরের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করবে না ভেবে নিয়েছে,নিজের সর্বস্ব উজার করে ভালোবাসবে শিশিরকে ভেবে নিয়েছে,জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পাশে থাকবে কখনো ছেড়ে যাবে না।নুরের এসব ভাবনাতে ছেঁদ ঘটিয়ে হঠাৎ শিশির একটু নড়াচড়া দিয়ে উঠে,চোখ খোলার আগেই মুখে কহিনুর বলে বিড়বিড় করতে শুরু করে,মানুষ কতোটা ভালোবাসলে এমনটা করতে পারে।

এই তো মি.খান,এই তো আমি, আপনার কহিনুর আপনার পাশেই আছে চোখ খুলেন।
এবার শিশির আলতো করে চোখ খুললো।চোখ খুলে ওর কহিনুরকে দেখে মনে আবার প্রশান্তি খেলা করলো ওর।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পরলো কহিনুর তো ওর থেকে মুক্তি চায় ওর প্রাণের বদলে হলেও,তাই এবার পাগলের মতো বলতে শুরু করলো।

কহিনুর, আমি কি বেঁচে গেছি?আমায় কে বাঁচালো?না আমি বাঁচতে পারি না?আমি বেঁচে থাকতে যে তোমাকে স্বাধীনতা দিতে পারবো না,না কহিনুর আমি নিজেকে শেষ করে দিবো,তুমি চিন্তা করো না আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।তোমাকে স্বাধীন করে দিবো আমি।

কথাটা বলে শিশির উঠে যেতে শুরু করলো, নুর ওকে উঠতে দিলো না বরং শুয়া অবস্থায় আকঁড়ে ধরে কান্না করতে লাগলো সজোরে আর বলতে লাগলো।

আর চাই না আমার স্বাধীনতা,চাই না মুক্তি আমার শুধু আপনাকে চাই,শুনেছেন আপনি আমার শুধু আপনাকে চাই,শুধু আপনাকে,আমার আর কিছু চাই না,শুধু আপনাকেই চাই,আর কখনও মরার কথা বলবেন না আপনি,আপনার কিছু হয়ে গেলে যে আমিও বাঁচবো না,আমিও মরে যাবো মি.খান,মরে যাবো আপনাকে ছাঁড়া,ভালোবাসি মি.খান,অনেক ভালোবাসি আমি আপনাকে,আই লাভ ইউ।

কথাগুলো কর্ণপাত হতেই শিশির অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলো,ওর কহিনুরের মুখে যে ভালোবাসি কথাটা এই মাত্র শুনতে পেলো ,যে কথাটা শুনার জন্য না জানি কতো দিন ধরে অপেক্ষায় আছে ও,তবে কি ওর অপেক্ষা আজ আদোও শেষ হয়ে গেলো নাকি এসব কিছুই ওর কল্পনা।শিশির কথাটা শুনে এতোটাই হতবাক হয়ে গেছে যে কিছুই বলছে না,নুর এবার ওকে ছেঁড়ে উঠে ওর কপালে অধর ছুঁইয়ে দিলো আর ওর গালে ভালোবাসাময় স্পর্শে ধরে বললো।

আমি আর কখনোই আপনাকে ছেঁড়ে যাবো না,পাশে থাকবো জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত, আগলে রাখবো আপনাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে সারাজীবন।
কথাগুলো শুনতেই শিশিরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে শুরু হলো, কথাগুলো যে বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর,তাই কন্ঠে অবাকত্ব নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো।

তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো কহিনুর, নাকি আমি মরে যাবো বলে আমার মন রাখছে।

খবরদার যদি আর মরার কথা বলেছেন তো,নয়তো আমি নিজেকে শেষ করে দিবো,আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি,কতোটা বাসি তা জানি না,তবে এটা জানি আপনার কিছু হয়ে গেলে আমিও বাঁচবো না,মরে যাবো আমিও। হয়েছে আর কান্না করতে হবে না আপনাকে,আপনার কান্নার দিন শেষ,এখন আপনার জীবনে শুধু সুখ বিরাজ করবে,আমি আপনাকে আর কষ্ট পেতে দিবো না কখনোই না।

কথাটা বলে কহিনুর শিশিরের চোখের জল মুছে দিলো,তারপর আবারও ওর কপালে অধর ছুঁয়ালো,তারপর ওর উভয় গালে চুমু কাটলো।

তুমি আমাকে কখনো ছেঁড়ে যাবে না তো কহিনুর?এভাবে ভালোবাসবে আমাকে সবসময়?

আজীবন বাসবো যতোদিন বেঁচে আছি ভালো বেসেই যাবো।আপনি এবার একটু শান্ত হন আপনার এখন এতো কথা বলা ঠিক না আমি ডাক্তার ডেকে আনি।

না তুমি যেও না আমায় ছেঁড়ে,আমার পাশে থাকো।

আমি ডাক্তার ডেকেই চলে আসবো।

না তুমি যেও না।

আচ্ছা আচ্ছা আমি কোথাও যাচ্ছি না,আমি ফোন করে ডাক্তার ডাকছি,আপনি শান্ত হয়ে শুয়ে থাকেন আমি পাশেই আছি।

__________________

হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে রোদেলা আকাশের চাঁদের পানে তাকিয়ে, তখনি পাশে এসে বসলো আকাশ,হাতে একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। এবার খাবারগুলো ওর সামনে ধরলো।

এই নে খেয়ে নে,সকাল থেকেই তো কিছুই খাস নি,শুধুই কেঁদেই চলেছিস,এতো কান্না করা ঠিক না,শরীর খারাপ করবে তো, এদিকে আবার না খেয়েও আছিস।নে খেয়ে নে।

আমার খিদে নেই ভাইয়া,তুমি খেয়ে নাও।

শিশির তো এখন ভালো আছে এখন অন্ততো কিছু খেয়ে নে।

খেয়ে নিবো যখন আমার ইচ্ছে হবে,তুমি আলাদা করে আমার খেয়াল করতে হবে না,নিজে গিয়ে খেয়ে নাও।

বার বার এমন জেদ করিস কেনো বল তো,আজ তোকে খেতেই হবে।

কথাটা বলে আকাশ ওকে জোর করে খাওয়াতে নিলে রোদেলা ওর হাত থেকে খাবার প্লেটটা উপরে ফেলে দেয়,তারপর দাঁড়িয়ে গিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে লাগলো।

তুমি কেনো আমার পিছন পরে থাকো ভাইয়া?আমি বলি নি আমার তোমাকে কোনো প্রয়োজন নেই,আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে জানি আমাকে নিয়ে তোমার এতো মাথা ঘামাতে হবে না,সারাদিন কেনো আমার পিছু পিছু ঘুরঘুর করো আমার এসব আর সহ্য হচ্ছে না,প্লিজ আমাকে আমার হালে ছেঁড়ে দাও,প্লিজ।

কথাটা বলে হনহনিয়ে চলে যায় রোদেলা,আকাশের চোখ ছলছল করে উঠে খনিকে।

আর কতো অভিমান করে থাকবি রে রোদলা,আর কভে সারা দিবি আমার মনের ডাকে,আর কখন ক্ষমা করবি তুই আমায়,তোর অবহেলা যে আর আমি মেনে নিতে পারছি না রে,ভিতরটা যে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমার।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here