শুকনো_পাতার_বৃষ্টি,০২,০৩

0
592

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি,০২,০৩
#ফারজানা_আক্তার
০২

লজ্জা করছেনা তোর একটা ফ’কি’ন্নি’র জন্য নিজের মায়ের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে? তুই তো এমন ছিলিনা, কি জাদু করেছে ওই ডিভোর্সি মেয়ে তোর উপর?”
মায়ের কথা শুনে মুচকি হাসলো আহান। তারপর কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো “তবে কঠিন সত্যি টা শুনে রেখো আম্মু সিয়া আমার মেয়ে, সিয়া আমার পরিচয়ে বড় হবে আর তুমি এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা শুনাবেনা আদিবাকে বলে দিলাম। আর হ্যাঁ আরেকটা কঠিন সত্য আছে আমার জীবনের যা একমাত্র আমি ছাড়া কেউই জানেনা আর কখনো জানবেনাও কেউ।”

“আহান তুই কিন্তু ভুল করছিস বাবা। আদিবা মেয়েটা যদি এতোই ভালো হতো তবে ওর ডিভোর্স হয়ে যেতোনা বিয়ের একবছর না ঘুরতেই। তুই ওই মেয়েকে ছেড়ে দে বাবা, আমি আমার ভাইয়ের মেয়ে আফিফাকে বিয়ে করাবো তোকে। আফিফা অনেক সুন্দরী আর আমার ভাইয়ের অনেক টাকা পয়শা আছে তুই সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবি। আর সবথেকে বড় কথা হলো আফিফা তোকে ছোট থেকেই পছন্দ করে।”

“ছিঃ মা এতোটা লোভী তুমি আমি ভাবতেই পারিনি কখনো। সানিয়া ঠিক বলেছে তুমি খুব লোভী একটা মহিলা তুমি কখনো কারো ভালো চাওনা শুধু নিজের লোভটা সব তোমার কাছে। শুনো মা আমি তোমার মতো লোভী না, আমি আমার বাবার মতোই খেটে খাওয়া মানুষ।”
খালেদা খাতুন একদম চুপ হয়ে গেলেন নিজের ছেলের চোখে নিজের জন্য এতো তীক্ষ্ণ ঘৃণা দেখে। খালেদা খাতুন কে চুপ থাকতে দেখে আহান আবারও বলে “যাইহোক আমি আদিবাকে নিয়ে সিয়াকে আনতে যাচ্ছি কেউ যেনো এই ব্যাপারে আর কোনো কথা না বলে। আমার মেয়ে আমার সাথেই থাকবে। আর হ্যাঁ আজ রাতে ওখানেই থেকে যাবো। চললাম, আল্লাহ হাফেজ।”

কথাগুলো বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো আহান। খালেদা খাতুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আহানের যাওয়ার দিকে। হঠাৎ করে খুব কষ্ট হচ্ছে খালেদা খাতুনের আবার ভীষণ রকম রাগ হচ্ছে আদিবার উপর।
আহান রুমে যেতে যেতে আফজাল খানের সাথে কথা বলে জানিয়ে দিলো সে শ্বশুড়বাড়িতে যাচ্ছেন। ছেলের সততাই ভীষণ খুশি আফজাল খান। আফজাল খান সবসময়ই মনে মনে চেয়েছেন তার ছেলে যেনো কোনো গরিব ঘরের অসহায় মেয়েকে বিয়ে করে আর আহান তার সেই আশাটাই পূরণ করেছে অজান্তেই। আফজাল খান মনে মনে এটা চাইলেও মুখে কখনো উচ্চারণ করেনি আহানের সামনে এই বিষয়ে কোনো কথা।
আহান রুমে প্রবেশ করে আদিবাকে উদ্দেশ্য করে বলে “হয়েছে তোমার?”
খুব নরম সুরে আদিবা বলে “হু হয়েছে।”
এই মিষ্টি কন্ঠের ছোট্ট শব্দটা আহানকে মুগ্ধ করে বারংবার। যতই মন খারাপ থাকুক আদিবার কাছে আসলেই মন ভালো হয়ে যায় আহানের। আদিবা তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর খুঁটে খুঁটে দেখছে নিজেকে। আহান ধীর পায়ে আদিবার পেঁছনে গিয়ে কানে কানে বলে “এভাবে দেখোনা আমার হুরপরীকে নজর লেগে যাবে।” সাথে সাথেই লজ্জায় মাথা নুঁইয়ে নেয় আদিবা। আদিবার ঠোঁটের চিকন হাঁসি স্পষ্ট ফুটে উঠছে। আহান মৃদু হাঁসে আদিবাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে। মেয়েটা বেশ লাজুক, একটুতেই লজ্জায় লালছে হয়ে যায়। শ্যামবর্ণ চেহারার মায়াবী সুন্দরী আদিবা আহানের দৃষ্টিতে। আহান একটু কেঁশে বলে “এতোটা লজ্জা পেওনা গো মায়াবতী নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবোনা এই ভরদুপুরে।”
ফিসফিস করে কথাটি উচ্চারণ করেই ওয়াশরুমে চলে যায় আহান। আদিবা বেশ লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। মানুষটা বড্ড সরল, যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলে দিবে কোনো সংকোচ ছাড়া। এই কারণেই হয়তো আদিবার এতো দ্রুত এই মানুষটাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছে। সিয়ার কারণেই এই সৎ মানুষটাকে আদিবা নিজের করে পেয়েছে।সিয়ার প্রতি এক অদ্ভুত টান আছে আহানের। তবে এখনো একটা সত্যি আদিবার কাছে অজানা।

আহান ড্রাইভ করছে আর আদিবা ওর পাশে চুপচাপ বসে আছে। আদিবাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আহান বলে “সিয়ার কাছে যাচ্ছি আমরা তোমার তো খুব বেশি খুশি হওয়ার কথা কিন্তু তা না করে মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে আছো কেনো?”
আহানের করা প্রশ্নের উত্তরে আদিবা শুধু এইটুকুই বললো “কিছু সত্য পৃথিবী সমান খুশি দেয় আমাদের আর কিছু সত্য আছে যা ভ’য়ং’ক’র অ’গ্নি’তে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।”
আদিবার এমন কথায় হুট করেই ধুকপুক করে উঠে আহানের বুক। কেঁপে উঠে সমস্ত শরীর। গাড়ির জানালা খোলা এতো এতো বাতাসের মধ্যেও কপালে ঠোঁটের নিচে ঘেমে গেছে আহানের। কোনো ভয় প্রবেশ করলে আহানের মনে তখনই কপাল আর ঠোঁটের নিচে ঘেমে যায় ওর। হঠাৎ এই কোন সত্যির কথা বললো আদিবা বুঝতে পারছেনা আহান। কখনো কোনো কথা স্পষ্ট করে বলেনা মেয়েটা। অদ্ভুত ধরনের এক মেয়ে। মনের কথাগুলো কখনোই স্পষ্ট করে কারো সাথে শেয়ার করবেনা। শুধু গম্ভীর হয়ে একাকী চিন্তা করবে যা আহানকে কাঁপিয়ে রেখে দেয়। আহানের গোপন সত্যটা জেনে গেলো না তো আদিবা? এই ভয়েই ঘামছে সে।
আহান ঠা’স করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আদিবার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে “কিছু কিছু কথা স্পষ্ট বলতে হয়, সব কথা অস্পষ্ট রাখলে বুঝতে বড় কষ্ট হয়।”

“গাড়ি স্টার্ট করুন, সিয়ার সাথে দেখা করার অপেক্ষা আর হচ্ছে না আমার। আমি তেমনভাবে কিছুই বলিনি যে আপনার বুঝতে অসুবিধা হবে।”

আদিবা কথাটি বলতেই লক্ষ করে আহানের মুখ ঘেমে আছে। সে দ্রুত হাত ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ঘামগুলো মুচে দিলো খুব যত্নে আর মৃদু করে একটা হাঁসি দিলো।
আহান হতাশ হলো। এই মেয়ের পেট থেকে কথা বের করা মোটেও সহজ কাজ নয়। আহান গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আদিবা আহানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবতে থাকে কিভাবে বলবো মনের লুকানো কথাগুলো? আপনার মতো একজন মানুষ পেয়েছি ভাগ্য করে। আপনাকে আর কতোই বা জ্বা’লা’বো। আমার তো শুধু নিজের উপরেই খুব ঘৃণা হচ্ছে, এতোদিন পর নিজের মেয়ের সামনে কোন মুখ নিয়ে যাবো আমি? সিয়া কি পারবে ক্ষমা করতে আমায়? আমি যে কিছুতেই সিয়ার মুখোমুখি হতে পারবোনা। আমি তো আমার মিষ্টি মেয়েটার মা হওয়ারও যোগ্য না। আমি যদি ভালো মা হতাম তবে কখনোই এইটুকুন বাচ্চা মেয়েটাকে একা রেখে নিজের সুখ খুঁজতে বেরিয়ে পরতাম না। আমি খুব খুব খারাপ মা। আমি একজন স্বার্থপর মা। আমি একবারও নিজের মেয়ের কথা ভাবিনি শুধু নিজের কথায়-ই ভেবে গিয়েছি। বিয়ের দিন বিদায়ের ঠিক আগ মুহুর্তে শ্বাশুড়ি মা বলেছিলেন যদি সিয়াকে আমি আমার সাথে করে ওই বাড়িতে নিয়ে যায় তবে উনি আমার মেয়েটাকে আমার থেকে চিরদিনের জন্য আলাদা করে দিবেন সেই ভয়ে আমি আর ওকে আমার সাথে ওই বাড়িতে নিতে চাইনি। এখন সিয়াকে ওই বাড়িতে নিলে উনি সত্যি সত্যি যদি আমার মেয়েটাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেন তবে কি নিয়ে বাঁচবো আমি? আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো আমার প্রাণটাকে ছাড়া। সব সত্যি তো আর আপনাকে বলতে পারছিনা সিয়ার বন্ধু। কিছু সত্যি খুব তিতা হয় যা সবাই সহ্য করতে পারেনা আপনিও হয়তো সহ্য করতে পাবেননা নিজের মায়ের এমন আচরণ।

গাড়ি থামতেই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে আদিবা। আহানের দিকে তাকিয়ে বলে “সিয়ার বন্ধু আমরা এতো দ্রুত কিভাবে এসে পৌঁছালাম?”
“সারা রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকলে সময়ের হিসাব কিভাবে মিলাবেন সিয়ার আম্মু। ঘড়ি দেখো বিকাল হয়ে এসেছে।”
মৃদু হেঁসে বলে আহান। আদিবা বেশ লজ্জা পেয়ে যায়।
“আর লজ্জা পেতে হবেনা নেমে আসুন এবার।”
গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে আহান।”

গাড়ি বাসা থেকে একটু দূরে একটা সাদা মাঠে পার্ক করেছে তাই আরো কিছুটা পথ হেঁটে বাসায় যেতে হবে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দু’জনের কর্ণকুহর হলো সিয়ার চিৎকার চেঁচামেঁচির, কাঁদতে কাঁদতে যেনো হাঁপিয়ে উঠেছে ছোট্ট প্রাণটা। আদিবা সিয়ার কান্নার শব্দ শুনে আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা। দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। মা মেয়ে দু’জনেই সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে। আহান শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দৃশ্যটা। আহানের চোখের কোণেও জল জমাট বেঁধেছে। এতোদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পেলো আদিবা। মেয়ের চোখমুখ সব মুচে দিয়ে আহানের দিকে আঙুল তুলে আদিবা বলে “দেখো আম্মু কাকে নিয়ে এসেছি তোমার বন্ধুকে এনেছি।”
সিয়া একবার তাকিয়ে আহানের দিকে আবার মুখ ফিরিয়ে আদিবার বুকে মুখ গুঁজে ফেলে। আহান অবাক হয় যে মেয়ে ওর জন্য পাগল ছিলো সেই মেয়ে ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানতে পারছেনা সে। আদিবা খুব যত্ন করে সিয়াকে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে আমার মামণিটার? বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে আদর দিচ্ছে না কেনো আজ?”
সিয়া মুখ ফুলিয়ে হ্যাঁচকি তুলতে তুলতে বলে “আমি জানি আম্মু বন্ধু পঁচা খুব পঁচা, বন্ধু তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে গেছে। বন্ধু একটুও ভালোনা।”
সিয়ার কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আহানের। মেয়েটা মাকে ছাড়া খুব ভেঙ্গে পরেছে বুঝতে পারছে আহান।
আদিবা আদর মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “এসব কথা তোমায় কে বলেছে মা?”
“কেনো সবাই-ই তো বলে। আমি যখন তোমার কাছে যাওয়ার জন্য জোরে জোরে কান্না করি তখন পাড়ার মহিলারা এসে এগুলো বলে আর নানুকেও খুব কথা শুনায়।”
থেমে থেমে ধীর কণ্ঠে কথাগুলো বলে সিয়া। আদিবা সব বুঝে গেছে এসব কারা বলতে পারে তাই সে আর সিয়াকে জেরা করেনি। সমাজে এমন মানুষের অভাব নেই। মানুষকে খোঁটা দিয়ে কথা না বললে মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট না দিলে তাদের দিন চলেনা। বরাবরই এসব মানুষকে অপছন্দ করে আদিবা এবং দূরত্ব বজায় রাখে এসব মানুষের কাছ থেকে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [০৩]
#ফারজানা_আক্তার

নিস্তব্ধ বিকেলে নির্জন প্রহরে ঘুমিয়ে যায় সিয়া মায়ের বুকে। ঘুমের মধ্যেই মেয়েটা কেমন জানি বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে, এর নাম দীর্ঘশ্বাস। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আদিবার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। মেয়ের এমন অবস্থার জন্য বারংবার নিজেকেই দোষারোপ করছে আদিবা। সিয়া ঘুমিয়ে গেলে সিয়াকে খুব যত্ন সহকারে শুইয়ে দেয় ওর বিছানায়। তারপর নিজের মায়ের কাছে গিয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আদিবা। আদিবার মা ফাতেমা বেগমও শব্দ করে কেঁদে ফেলেন। মাকে কাঁদতে দেখে দ্রুত ঢুক গিলে ফেলে আদিবা তারপর নিজেকে কন্ট্রোল করে নিজের চোখের জলগুলো মুছে মায়ের দুই গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে বলে “আমার জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে মানুষের কাছে তোমাকে। ক্ষমা করে দাও শেষবারের মতো আমাকে। আর কখনো আমার জন্য কারো কাছে ছোট হতে হবেনা কথা দিলাম তোমাকে আমি।” এইটুকু কথা বলে মায়ের চোখের জল মুছে দেয় যত্ন করে আদিবা। আহান শুধু দেখছে সব আর মুগ্ধ হচ্ছে। পরিবার তো এভাবেই সুন্দর। তারপর আদিবার মা ফাতেমা বেগম বলেন “তুই জামাইকে নিয়ে সিয়ার পাশে বস। আমি কিছু নিয়ে আসি খাওয়ার জন্য অনেক দূর থেকে এসেছিস।।” তখন আহান শ্বাশুড়ির যাওয়ায় বাঁধা দিয়ে বলে “কোথাও যেতে হবেনা আপনাকে আন্টি, সব প্রয়োজনীয় জিনিস আমি সাথে করে এনেছি।” আদিবা অবাক হয় আহানের কথা শুনে কারণ ও কিছু নিতে দেখেনি আহানকে তবে কবে কিনলো আহান সব জিনিসপত্র। ফাতেমা বেগম মেয়ের জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছলছল নয়নে বলে “তোমাকে দেখলে একটা ছেলে সন্তানের যে অভাব ছিলো তা আর লাগেনা। অনেক সুখী হও বাবা।” আহান আর কিছু বলেনা শুধু মুচকি হেঁসে সব এনে শ্বাশুড়ির হাতে তুলে দেয়। ফাতেমা বেগম রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যান সব খাবার আর জিনিসপত্র নিয়ে। আর আদিবাকে বলে যান আহানকে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে।
ফাতেমা বেগম চলে গেলে আদিবা আহানের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায়। আহানের চোখে মুখে বিষন্নতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আদিবা। আদিবা আহানের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে “আমি জানি আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন সিয়ার কথায়। সিয়া পিচ্চি একটা মেয়ে, এতোকিছু বুঝেনা। মানুষের কথায় ভীষণ আ’ঘা’ত পেয়েছে মেয়েটা তাই কথাগুলো বলেছে। আর আপনিতো জানেনই সমাজে কিছু মানুষ এমন আছেন যারা অন্যের ভালো সহ্য করতে পারেনা। আপনি হয়তো জানেন না ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে আমার এই বাড়িতে থাকতে অনেক সমস্যা হয়েছে, মানুষের কটুবাক্যে প্রতিনিয়ত খু’ন হয়েছি আমি তবুও এই মেয়ের জন্য বাঁচতে হয়েছে আমাকে। আপনি কোনো চিন্তা করবেননা আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আপনাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ, দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”

আহান সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে “সিয়ার অভিমান হয়েছে। যাইহোক আসো ফ্রেশ হয়ে আসি, ওয়াশরুম কোথায়?”
আহানের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে আদিবা। আহান লক্ষ করে আদিবা কেমন জানি হাত কচলাচ্ছে।
“কি হলো আসো, ফ্রেশ হতে হবে তো।”
আদিবা থেমে থেমে বলে “আসলে বাথরুম তো বাহিরে, আপনি এই বাথরুমে মানিয়ে নিতে পারবেননা আর হাত মুখ ধৌত করতে হলে পুকুরে যেতে হবে।”

এবার কুটকুট করে হেঁসে উঠে আহান। বোকা বনে যায় আদিবা। হাঁসতে হাঁসতে আহান বসে পরে মোড়া পেতে। হা হয়ে দাঁড়িয়ে আহানের অদ্ভুত কান্ড দেখছে আদিবা।
“কি হয়েছে, এতো হাঁসতেছেন কেনো আপনি?”
ভ্রু কুঁচকে বলে আদিবা।
“হাঁসবোনা তো কি করবো? পুকুরে কত কত সাঁতার কেটেছি বন্ধুদের সাথে একসময় তুমি জানো? জানোনা, কারণ বলা হয়নি কখনো তোমাকে। আর টয়লেট নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা তা আমি ম্যানেজ করে নিবো কোনোভাবে। চিল থাকো জনাবা চিল।”
এটা বলে আদিবার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে আসে আদিবাকে আহান। পুকুরঘাটে যেতেই কিছু মহিলা এসে আদিবাকে জড়িয়ে ধরে কৌশল বিনিময় করেন। আদিবা বারবারই চাপা স্বভাবের মেয়ে তাই সে বেশি কোনো কথা বললোনা তাদের সাথে। পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে চলে আসার সময় আহানের কর্ণধারে কিছু কথা প্রবেশ করে। কিছু মহিলা বলাবলি করছিলো “মেয়েটা এমনই লোভী, শুধু বড়লোক পরিবারের ছেলেদের পটিয়ে বিয়ে করে নেয়।” আরেকজন বলে “দেখিস তোরা আগের বার যেমন বিয়ের একবছর না হতে অন্তঃসত্ত্বা করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো এবারও তেমনই হবে।” অন্য আরেকজন বলে উঠে “হুম সেইদিন আর বেশি দূরে নেই, আবারো দেখবি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে বুড়ো মা বাবার ঘাড়ে এসে বোঁঝা হবে।”
কথাগুলো শুনে আহান তাদের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আদিবা ওকে আঁটকিয়ে দেয় আর বলে “ছাড়ুন ওদের কথা। অভ্যাস হয়ে গেছে এই কয়েকবছর ধরে এদের এমন কটুবাক্য শুনতে শুনতে। এখন আর গায়ে মাখিনা এদের কথা।”

“তাই বলে কি এভাবে ছেড়ে দিবো এদের। হাত ছাড়ো কিছু কথা বলে আসি ওদের আমি।”
ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে আহান। আদিবা শক্ত গলায় বলে “বলছিতো ছাড়ুন এসব কথা। এদের সাথে তর্কে গিয়ে নিজের সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। ঘরে চলুন।”
আদিবা কথাগুলো বলেই আহানের হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসে। মাথা খারাপ হয়ে আছে আহানের। নিজে নিজেই দাঁত কিড়মিড় করছে আর লাল চোখে আদিবার দিকে তাকাচ্ছে বারংবার। আদিবা ঢুক গিলে, সে বুঝতে পারে আহান রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছে। এসব কথা প্রথমবার শুনলে শরীরে এমন রাগ চড়ে বসবে স্বাভাবিক কিন্তু আদিবার যে অভ্যাস হয়ে গেছে এসব শুনতে শুনতে। আদিবা চট করে গিয়ে একটা তোয়ালে এনে এগিয়ে দেয় আহানের দিকে, আহান তোয়ালে না নিয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুছে নেয় হাত ও মুখমন্ডল। আদিবা মন খারাপ করে নিজেই নিজের মুখ মুছে নেয় তোয়ালেটা দিয়ে। আহান বসে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে, মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে যাচ্ছে আহানের কারণ গ্রামে নেটওয়ার্ক সমস্যা অনেক যা ওর কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। আদিবা আহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চোখ বড় বড় করে আদিবার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আহান। আদিবা আমতা আমতা করে বলে “না মানে জানতে চেয়েছিলাম আপনি তো গাড়ি কোথাও থামাননি তাহলে এতো নাস্তা+জিনিসপত্র কিনেছেন কখন?”
“ঘুমিয়ে থাকলে সারা রাস্তায় দেখবে কিভাবে কেউ। ”
শক্ত গলায় বলে আহান। আদিবা আর কিছু বললো না। আহানের মাথা ঠান্ডা হওয়া অব্দি আর কোনো কথা বলা যাবেনা বুঝতে পারছে আদিবা। ফাতেমা বেগম এসে বলে “আদিবা মা খেতে আয় জামাইকে নিয়ে।”
আদিবা আহানের দিকে এক নজর তাকালো। আদিবা ডাকার আগেই আহান নিজে নিজেই শ্বাশুড়ির সাথে খেতে চলে গেলো। খেতে এসে আরেক ঝামেলা নিচে পিঁড়াতে বসে খেতে হবে যা আহান পারবেনা কারণ অভ্যাস নেই। শ্বাশুড়িকে সেই কথা বললে আহান উনি একটা মাধুর এনে বিছিয়ে দেন। সেখানেও বসতে পারছেনা কোনোমতে আহান। পেন্ট পরিধান করে নিচে বসা খুব কষ্টসাধ্য তারউপর আহানের অভ্যাসও নেই তেমন একটা। আদিবা এতক্ষণ এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো চুপচাপ। ফাতেমা বেগম আদিবাকে ডেকে বলে “জামাই তো বসতে পারছেনা এখানে নিচে। তুই একটা ব্যবস্থা কর তো মা।”
আহান আদিবার দিকে আঁড়চোখে তাকায়। আদিবা তা লক্ষ করেও কোনো রিয়েক্ট না করে ওর রুমে গিয়ে দুইটা মোড়া আনে। একটা বড় আরেকটা একটু ছোট। ছোট মোড়ায় বসতে দিয়ে বড় মোড়ায় প্লেট রাখতে দিয়েছে। নিচে থেকে সব খাবার প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে আদিবা। আহান কোনোকথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করে দেয়। আদিবাও মৃদু হেঁসে খাওয়া শুরু করে।
খাবার খাওয়ার মাঝখানেই আদিবা ওর মাকে জিজ্ঞেস করে “বাবা কখন ফিরবে মা?”
“এই তো আর কিছুক্ষণ পর ফিরবেন। তুই খেয়ে নে মা। তোর বাবা দুপুরে খেয়েই বেরিয়েছেন।”

সন্ধ্যায় সিয়া ঘুম থেকে জেগে দেখে ওর একপাশে আদিবা আর অন্যপাশে আহান ঘুমিয়ে আছে। সিয়া এক পলক আহানের দিকে তাকিয়ে আদিবাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ দুটো বুঁজে নেয়। মেয়ের স্পর্শ পেয়ে জেগে যায় আদিবা।
সিয়ার কপালে আলতো চুমু খেয়ে আদিবা বলে “ঘুম পূর্ণ হয়েছে আমার রাজকন্যার?”
মুচকি হেঁসে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায় সিয়া। তারপর আদিবা সিয়াকে ফ্রেশ করিয়ে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে তখন খেতে খেতে সিয়া বলে “আম্মু তুমি পঁচা বন্ধুকে বলো চলে যেতে এখান থেকে, পঁচা বন্ধু এখানে থাকলে তোমাকে আবার আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে যাবে।”
“নাহ মা এমন করে বলেনা। উনি তোমার পঁচা বন্ধু কে বলেছে? উনি তো তোমার ভালো বন্ধু। তুমি জানো? তোমার বন্ধু তোমার জন্য অনেকগুলো চকলেট এনেছে আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানো?”
“কি কথা আম্মু?”
“কথাটা হলো উনি তোমাকে আর আমাকে উনার সাথে উনাদের বাসায় নিয়ে যেতে এসেছেন। আমরা সবাই মিলে ওখানে অনেক আনন্দ করবো। খুব মজা হবে।”
“তুমি সত্যি বলছো? বন্ধু ভালো? বন্ধু আর আমাকে কাঁদাবে না।”
“হ্যাঁ মামণি আমি সত্যি বলছি। তোমার বন্ধু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার বন্ধু তোমার জন্য অনেক খেলনা কিনে রেখেছে, বড় বড় পুতুল কিনেছে। ভালো না বাসলে কি কেউ এসব করে কারো জন্য বলো তো।”
“তাহলে বন্ধু আমার কাছ থেকে সেদিন তোমাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল কেনো? সবাই বলেছে বন্ধু নাকি খুব পঁচা”
“মানুষের কথায় কান দিতে নেই মা। আম্মু কি কখনো মিথ্যা বলি তোমার সাথে? বলো।”
“নাহ, আমার আম্মু সবথেকে ভালো আম্মু।”
“তাহলে এখন থেকে শুনবে তো আম্মুর সব কথা?
“হুম শুনবো। ”
“আচ্ছা তাহলে তোমার বন্ধু ঘুম থেকে উঠলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে আগের মতো আদর দিবে তো।”
মুখে মিষ্টি একটা হাঁসি এনে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায় সিয়া।
আঁড়াল থেকে মা মেয়ের সব কথা শুনে আহান। ওদের কথা শুনে আহান খুব খুশি হলেও মনের ভেতর কোথাও একটা হারানোর ভয় লুকিয়ে আছে আহানের।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here