শুকনো_পাতার_বৃষ্টি,১০,১১

0
505

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি,১০,১১
#ফারজানা_আক্তার
১০

রাতের খাবার খেতে বসলে সবাই সেখানে আফিয়া আসেনা। খালেদা খাতুন কয়েকবার ডাকলেও আসেনা আফিয়া। এতে খালেদা খাতুন আর মামুন সাহেব ছাড়া আর কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মামুন সাহেব কাজের মেয়েটাকে ওদের জন্য আফিয়ার রুমে খাবার পাঠাতে বলে চলে যায় সেখান থেকে। মামুন সাহেবের বেশ অপমানবোধ হচ্ছে। প্রথমে একটু রাগারাগি করলেও এখন মামুন সাহেব ঠান্ডা হয়েছে কিছুটা তবে আফিয়াকে ঠান্ডা করা যাচ্ছেনা।
সানিয়া খাবার মুখে দিতে যাবে তখনই আহান সাইমনের কথা জানতে চাই ওর কাছে। দুইদিন ধরে বাসায় ফিরেনি সাইমন। সাইমনের নাম নিতেই ফ্যাকাশে হয়ে যায় আদিবার মুখটা, কেউ লক্ষ না করলেও খালেদা খাতুন লক্ষ করে বিষয়টা। খালেদা খাতুন কল করে আসার জন্য বলেছিলো সাইমনও আসবে বলে কথা দিয়েছিলো। কিন্তু আসছে না কেনো বুঝতে পারছেনা খালেদা খাতুন। খালেদা খাতুন সাইমনকে বলে দিয়েছিলো আদিবা সবাইকে সবটা বলে দেওয়ার হু’ম’কি দিয়েছে সেটা যদিও সম্পূর্ণ বিষয়টা সাইমনের অজানা। সাইমন আসেনি দেখে বেশ খুশি হয় সানিয়া কিন্তু তা প্রকাশ করেনা কারো সামনে। সানিয়া আবারও নিজের মতামত চেঞ্জ করে ফেলে। কোনো এক অজানা কারণে সানিয়া সহ্য করতে পারেনা সাইমনকে। সানিয়া নিজেও বুঝতে পারেনা কেনো সে সাইমনকে সহ্য করতে পারছেনা, হয়তো মিনহাজকে পছন্দ করে বলে। সিয়া হঠাৎ করে সবার সামনেই আহানের সাথে বায়না ধরে ওকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন কেউ কিছু বলার আগেই সানিয়া বলে উঠে “তবে কাল দুপুরের খাবার আমরা বাহিরে খেয়ে আসি আর এতে সবার মাইন্ড ফ্রেশও হয়ে যাবে সিয়ারও ঘুরাঘুরি হয়ে যাবে। আমাদের বাসার পাশেই একটা নতুন রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছে। কি বলেন ভাবি?”
আদিবা জোর করে মুখে হাসির রেখা টেনে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায়।
খাবার খাওয়া শেষ করে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিলো আর সবাই মিলে একসাথে সময় কাটাচ্ছিলো তখনই সানিয়ার ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। সানিয়া প্রথমবার রিং বাজতে কল রিসিভ করেনি। পরে আবারো কল আসলে আহান বলে রিসিভ করে দেখতে কে কল দিলো। সানিয়া কল রিসিভ করতেই একটা পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো ওর কর্ণকুহরে। চোখ বন্ধ করে শুনছে সে অপরদিকের মানুষটার কথা। অপরদিকের মানুষটা হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে কিন্তু সানিয়ার কোনো সাড়াশব্দ সে পাচ্ছেনা তাই কল কেটে আবারো করলো। আনমনা হয়ে চোখে জলের কণা নিয়ে বসে রয়েছে সানিয়া। কণ্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হলো সানিয়ার। সানিয়া কল রিসিভ করছেনা দেখে ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে আহান রিসিভ করে। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা হালকা বয়সী ছেলের কন্ঠ। আহান কল করার কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই অপরপাশের ছেলেটা বলে “আপনাদের পরিবারের একজন সদস্য এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছে, আপনারা প্লিজ দ্রুত আসুন বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে। আর এই নাম্বার টা উনার মানিব্যাগে পেয়েছি। উনার ফোন লক থাকায় উনার মানিব্যাগ চেক করতে হয়েছে আমাদের। ”
এইটুকু কথা বলেই কল কেটে দেয় ছেলেটা। আহানের আর বুঝতে বাকি রইলোনা ওদের পরিবারের কে এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছে। সাইমন ছাড়া সবাই উপস্থিত আছে বর্তমানে বাসায়। আহান সানিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলোনা শুধু বললো হাসপাতালে যেতে হবে ওকে তৈরি হয়ে আসতে। সবাই অবাক হয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে আহানের দিকে। সানিয়া তৈরি হওয়ার জন্য নিজের রুমে চলে গেলো। অবাক করা বিষয় হলো সানিয়া একবারো জিজ্ঞেস করলোনা কোথায় যাবে এই রাতে আর কেনো।
সানিয়া চলে গেলে আহান সবাইকে বলে সাইমন এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছে। এটা শুনতেই যেনো ধুক করে উঠে আদিবার বুক। কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করছে আদিবার মনে কিন্তু ও সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি যদিও খালেদা খাতুন বেশ লক্ষ রেখেছিলো আদিবার দিকে। যতই হোক প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়া এতোই সহজ না। ভালোবাসার মানুষ প্রচন্ডরকম খারাপ হলেও ভালোবাসা সুন্দর, নিষ্পাপ।

*
বাড়িতে নিয়ে আসা হয় সাইমনকে। আহান আর সানিয়া গিয়ে সেই ছেলেটাকে পেলোনা যে কল করে তাদেরকে জানিয়েছিলো। ডাক্তারের সাথে কথা বললে উনি বলেন ছেলেটা কল করেই চলে গিয়েছিলো কারণ ছেলেটার মা নাকি অসুস্থ তাই তাকে দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে হবে। ছেলেটার নাম ঠিকানা কিছুই জানা গেলোনা আর। যে নাম্বার থেকে কল করেছিলো ছেলেটা সেটাও হাসপাতালের টেলিফোন থেকে। সানিয়ার একটুও মাথাব্যাথা নেই সাইমনের অসুস্থতা নিয়ে, সানিয়া শুধু ভাবতে থাকে সেই পরিচিত কন্ঠ টার কথা। সানিয়াকে এমন উদাসীন দেখে সবাই ভেবেছে সাইমনের অসুস্থতার জন্যই হয়তো চিন্তিত ও। কিন্তু ওর মনে যে ঝ’ড় বয়ে চলেছে সেটা কেউই উপলব্ধি করতে পারছেনা। আদিবা কিছুটা লক্ষ করলেও সানিয়া বুঝতে দেয়না আদিবাকে। সাইমন বেড রেস্টে আছে। দূ’র্ঘ’ট’না’য় সাইমনের মাথায়, হাতের কনুই আর ডান পায়ে আ’ঘা’ত পেয়েছে। ডাক্তার বলেছে নিয়মিত ঔষুধ খেলে আর পর্যাপ্ত সেবা পেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে সাইমন।

*
আহান বসে বসে অফিসের কিছু কাজ করছিলো আর তার পাশে বসে বসে খেলা করছে সিয়া। সিয়া খেলা করা থামিয়ে আহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে “বন্ধু তুমি তো কাজ করছো। আমার একা একা খেলতে মোটেও ভালো লাগছেনা।”
আহান হাতের কাজ রেখে সিয়াকে কোলে টেনে নিয়ে বলে “আমার বন্ধুর বুঝি বেশিই বিরক্ত লাগছে একা একা খেলতে?”
হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায় সিয়া। তারপর আহান ওকে বলে সাইমনের সাথে গিয়ে খেলতে কিন্তু সিয়া কিছুতেই রাজি হচ্ছে না সাইমনের কাছে যাওয়ার জন্য। আহান অনেকবার জিজ্ঞেস করলে সিয়া বলে দেয় আদিবা যে ওকে বলেছে সাইমনের সাথে না মিশতে। খটকা লাগলো আহানের মনে। কেনো এমনটা করলো আদিবা? আহান লক্ষ করেছে সাইমন এতো বড় এ’ক্সি’ডে’ন্ট করে বাসায় ফেরার পরেও ওকে এক নজর দেখার জন্য আদিবা যায়নি এমনকি সিয়াকেও নিয়ে যেতে দেয়নি। আহান বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছে আহান সাইমনের কথা তুলতেই আদিবা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করে বা এড়িয়ে যায় সাইমনের বিষয়। সাইমনও প্রথমদিন জিজ্ঞেস করেছিলো শুধু ভাবির কথা আহানকে এরপর আর কখনো জিজ্ঞেস করেনি। আহানের সন্দেহ হচ্ছে এরা দুজন পূর্ব পরিচিত নয় তো?

“চা খেয়ে নিন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একটু পরই মাগরিবের আজান হবে।”
আদিবার কথায় ধ্যান ভা’ঙ্গে আহানের। আহান যে সন্দেহ করছে এটা সে আদিবাকে বুঝতে দিলোনা। সম্পূর্ণ বিষয় না জেনে এভাবে কাউকে জেরা করা ঠিন নয়। ওর সন্দেহ যদি মিথ্যা প্রমাণ হয় তবে আদিবা ভীষণ কষ্ট পাবে আর আদিবার ক্ষুদ্র কষ্টের কারণও আহান হতে চাইনা। আহান নিজের সাথে নিজেই ওয়াদা করেছে যে সে কখনো আদিবাকে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট দিবেনা। আদিবার সব কষ্ট মুছে নতুন করে সুখের রাজ্য সাজাবে।

*
সাইমন ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। আফিয়া সাইমনের রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে “সানিয়া কোথায়? কথা আছে ওর সাথে আমার।”
সাইমনের কেনো জানি এই মেয়েকে মোটেও পছন্দ না তাই সাইমন মুখ গুমরা করেই বলে “জানিনা।”
“জানেননা মানে। আপনার বউ কোথায় সেটা তো আপনার জানার কথা তাইনা।”
“আমার বউ তো। আমিই বুঝে নিবো। আপনাকে এতো কথা বলতে হবেনা। সানিয়া রুমে নেই, আপনি আসতে পারেন এবার।”
এভাবে আফিয়াকে অপমান করে চলে যেতে বলায় ও বেশ রেগে যায়। রাগান্বিত কণ্ঠে ফুঁস ফুঁস করে আফিয়া বলে “রাখবেন কিভাবে বউয়ের খোঁজ? বিবাহিত হয়েও বউয়ের ভাইয়ের বউকে মিস করেন। আর সেও তো নাকি ঘৃণা করে আপনাকে।”
“অদ্ভুত তো। কি বলতেছেন এসব আপনি? আমি কেনো ভাবিকে মিস করতে যাবো আর কে ঘৃণা করে আমায়?”
“কি ভেবেছেন একই ঘরে আছি আর নজর রাখবোনা ওই স’তী’নের উপর? নজর রেখেছি বলেই তো জানতে পেরেছি আপনাদের মধ্যে কি চলতেছে সেটা।”
রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে আফিয়া আবারো বলে
“আফিয়ার কাছে কিছুই লুকানো সম্ভব না। আফিয়া হলো সি সি ক্যামরা।”
এটা বলেই হাতে থাকা ফোন নিয়ে খেলতে খেলতে চলে যায় আফিয়া। চিন্তার ভাজ সাইমনের কপালে।
সানিয়া এতক্ষণ সিয়ার সাথে বাগানে ফুল গাছের যত্ন নিচ্ছিলো। সানিয়া সব ফুল গাছ ঘুরে ঘুরে দেখতেছে আর পরিষ্কার করতেছে। সিয়া ওর সাথে সাথে গুটি গুটি পায়ে হাঁটছে আর ছোট ছোট কন্ঠে কথা বলছে। সানিয়া একমাত্র এই ছোট্ট পরীটার সাথে দিনের সেরা মুহুর্ত গুলো উপভোগ করে। সিয়া যতক্ষণ সময় ওর সাথে থাকে ততক্ষণ সময় খুব ভালো কাটে। মেয়েটার মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি আছে মানুষকে বশে করার, এটাই ধারণা করে সানিয়া আর মুচকি হাসে।
সাইমন খুব করে চাইলেও আদিবা ওর ধারে কাছেও সিয়াকে ঘেসতে দেয়না। যে পুরুষ মেয়ে জন্মের পর মেয়ের চেহারা দেখার ইচ্ছে রাখেনি কখনো সে পুরুষের কাছে তার মেয়েকে সে দিতে রাজি নয় কিছুতে। সাইমন এখন বেশ লজ্জিত ওর কর্মকান্ডে কিন্তু কিছু করার নেই এখন আর। সব ওর হাতের বাইরে চলে গেছে।

*
একটা মানুষ এতোটা সুন্দর কেমন করে হতে পারে?
হঠাৎ করে আনমনা হয়ে কথাটা বলে উঠে আহান আদিবার পানে চেয়ে। সবে মাত্র আদিবা গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে পেঁছানো চুল খুলেছে। চুলগুলো প্রায় কোমর ছুঁই ছুঁই। ইদানীং সকালে গোসল করাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। আহান কথাটা বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আদিবার সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলে উঠে “তোমাকে কাছে পেয়ে ভালোবাসার তৃষ্ণা যেনো বেড়ে গেলো বহুগুন। তুমি রোদ নাকি অগ্নি? কীভাবে এতোটা তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিলে হুট করে???”

“আমি রোদও নয় আর অগ্নিও নয়। আমি আপনার ভালোবাসার রজনীগন্ধা। এবার যান গোসল সেরে আসুন। ফজরের নামাজ পড়তে হবে। খানিক পরেই একটু একটু করে আলো ছড়িয়ে আলোকিত হয়ে উঠবে পৃথিবী।”
বেশ লজ্জাময়ী কণ্ঠে মৃদু হাসির সাথে কথাগুলো বলে আদিবা। একটা শ্যামবর্ণ মেয়ে কারো দৃষ্টিতে রূপবতী হতে পারে তা নিজের সাথে না ঘটলে বিশ্বাস-ই করতোনা আদিবা। ভাগ্য করেই স্বামী পেয়েছে বলতে হবে। সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সাইমন ওর জীবন থেকে না গেলে এই সুন্দর মুহুর্ত টা তার জীবনে কখনোই আসতোনা।
আদিবা ওজু করে এসে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলে আহান গোসল করার জন্য ওয়াশরুমের দিকে এগোই আর মনে মনে ভাবতে থাকে না বলা সত্য টা আদিবা যদি জেনে যায় কোনোমতে তাহলে কি এভাবে ওর পাশে থাকবে? মেয়েটা যে বড্ড বেশি অভিমানী, প্রথম স্বামীর দেওয়া কষ্ট গুলো এখনো মন থেকে সরাতে পরছেনা। এসব ভাবতেই মনটা তীব্র গতিতে খারাপ হয়ে যায়।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [১১]
#ফারজানা_আক্তার

একটু একটু করে পৃথিবীকে আলোকিত করে সূর্যোদয় হচ্ছে। চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে পাখির কলকল শব্দ। সকালে কুয়াশায় ঘেরা থাকলেও পৃথিবী গরম দিনের বেলা কিন্তু ভ্যাবসা পরতেছে। জানালার কাছে বসে প্রকৃতি উপভোগ করছে সানিয়া। এতোদিন হয়ে গেলেও সেই অপরিচিত কন্ঠের মানুষটাকে খোঁজে পাওয়া গেলোনা এখনো। সবার অজান্তে সানিয়া প্রায় কয়েকবারই হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছে কিন্তু তার নামটাও জানতে পারলোনা। মনটা বড্ড ছটপট করছে। শূন্য লাগছে চারপাশ। সাইমন শুয়ে শুয়ে সব দেখতেছে সানিয়ার অবস্থা। সাইমনের আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে তার স্ত্রী প্রেমে পরেছে কিন্তু কার প্রেমে এতোটা আনমনা হচ্ছে সে দিনদিন। ভাবছে সাইমন।
চার বছর সংসার করেও দুজনের মনে দুজনের জন্য কোনো প্রেমের ফুল ফুটেনি। সাইমনের মনের সবটা জুড়ে এখনো আদিবার বসবাস। এখনো আদিবাকে অনুভব করে সাইমন যদিও পাঁচবছর আগে তা উপলব্ধি করতে পারেনি কিন্তু আজ ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কাছে থাকলে কেউই বুঝেনা কিন্তু দূরে গেলে ঠিকই গুরুত্ব বুঝে। সাইমনের সাথেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। আজ বড্ড বেশি মনে হচ্ছে সেসময় খালেদা খাতুনের কথার গুরুত্ব না দিলে হয়তো আদিবা আর সিয়া ওর বুকেই থাকতো আজ। কষ্টগুলো যেনো ঘূর্ণিঝড়ের মতো বইছে শরীরে।
সানিয়া ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সাইমনকে বলে “কিছু কি লাগবে আপনার?”
সাইমন মুখে কোনো কথা বলেনা শুধু না সূচক মাথা দুলাই। তারপর সানিয়া ছাঁদের দিকে পা বাড়ায়। সকালের ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস গায়ে না মাখলে যেনো সকালই শুরু হয়না সানিয়ার। সানিয়া ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির পাশে যেই রেস্তোরাঁ খুলেছে নতুন সেই রেস্তোরাঁ টা ছাঁদ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সানিয়া এক নজরে তাকিয়ে আছে সেই রেস্তোরাঁর ছাঁদের পানে। রেস্তোরাঁর ছাঁদ টা দারুণভাবে সাজানো হয়েছে, দেখে মন হচ্ছে যেনো বিয়ে বাড়ি। সানিয়া শুনেছিলো এই রেস্তোরাঁর ছাঁদে সবসময়ই বার্থডে, বিবাহ বার্ষিকী, আকদ্ এবং বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই রেস্তোরাঁয় যাওয়ার বড্ড স্বাদ জাগে সানিয়ার মনে প্রাণে।

*
আহান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো। সিয়া এখনো ঘুমে। আহানের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে আদিবা। দু’জনের মুখেই কোনো কথা নেই। দু’জনই সকালের নামাযের পর আর ঘুমাইনি। কিভাবে রাতের অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলো ফুটে সেই দৃশ্য একসাথে উপভোগ করবে বলে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসার মানুষের সাথে সময় কীভাবে ফুরিয়ে যায় দ্রুত তা বলা মুশকিল। সুন্দর মুহুর্ত গুলো বেশি সময় স্থায়ি থাকেনা। সকাল হয়ে এসেছে। রোদ চিক চিক করছে চারদিকে। আদিবা বলে উঠে “আপনি বসুন আমি দেখি সিয়া উঠলো কিনা।”
আহান কিছু বললো না। আহানের মনে ভয় বাসা বেঁধেছে। সে আর সত্যি টা গোপন করতে পারছেনা আদিবার কাছ থেকে। নিজেকে কেমন জানি অপরাধী মনে হচ্ছে আহানের। সত্যি টা জানার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আদিবার। কিন্তু আদিবাকে সত্য টা বলার সাহস হচ্ছে না আহানের। যদি আদিবা ওকে ছেড়ে চলে যায়। আদিবাকে আর সিয়াকে ছাড়া যে দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবে সে।

খাবার টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই। আজ আফিয়া সবার সাথে নাস্তা করতে বসেছে। আফিয়ার মুখে মিটিমিটি হাসি যা দেখে গা জ্ব’লে যাচ্ছে সানিয়ার। আদিবাও ভাবছে আফিয়ার মুখের এই হাসির রহস্যের কথা। আহানের এতোদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের মতো করে নাস্তা করছে আর সিয়াকেও খাইয়ে দিচ্ছে। খালেদা খাতুন আদিবার দিকে অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বারংবার। সুযোগ পেলে এখনই যেনো খু’ন করতেন তিনি আদিবাকে। সাইমন আজ একটু সুস্থ আছে তাই সেও আসছে সবার সাথে নাস্তা করতে। সাইমন আসলে আফজাল খান খুশি হয়ে নিজের পাশেই ওকে বসতে দেন। আদিবার সোজাসুজি হয়ে বসে সাইমন। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে আদিবার। আফিয়া সাইমনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দুষ্টু হাসে যা সাইমন দেখেও না দেখার ভান করে। খাওয়ার মাঝখানেই সানিয়া সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে আজ দুপুরের খাবার সবাই বাড়ির পাশের সেই “স্নেহময় মা” রেস্তোরাঁয় খাবে। সবাই ওর কথা মতামত দিলেও খালেদা খাতুন স্পষ্ট বলে দেন উনি যাবেননা। কেউ আর জোর করেননি উনাকে শুধু আফজাল খান একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন না যাওয়ার কারণ কিন্তু খালেদা খাতুন কোনো উত্তর করেননি।

দুপুর ১ঃ৩০। সবাই বসে আছে “স্নেহময় মা” রেস্তোরাঁয়। খাবার অর্ডার করা হয়েছে। আহান আদিবা সিয়া সাইমন আর সানিয়া এসেছে। খালেদা খাতুন আসেননি তাই আফজাল খানও আসেননি। আর আফিয়াকে কেউ সেধেও চাইনি তাই খুব রেগেমেগে সকালে নাস্তার টেবিলে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সে।
খাবার আসতেই সিয়া খুব উত্তেজিত হয়ে পরে খাবার খাওয়ার জন্য। আহান খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে সিয়াকে যা দেখে য’ন্ত্র’ণা’য় বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে সাইমনের। নিজের সন্তানকে চোখের সামনে দেখেও ছুঁয়ে দেখতে না পারার মতো য’ন্ত্র’ণা কি হতে পারে আর।
সবাই খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছে কিন্তু সানিয়া শুধু আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। পুরো রেস্তোরাঁ টা খুব গুছানো। দেখতে একদম নিদারুণ। সানিয়া চেয়ে চেয়ে দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। সানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে তুলতে যাবে তখনই সেই পরিচিত কন্ঠস্বর টা আবার শুনতে পেলো। অস্থির হয়ে চারপাশ চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলো কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলোনা। সাইমন জিজ্ঞেস করলে বলে রেস্তোরাঁর সাজগোজ দেখছিলো আর কিছুনা।
একটু দূরেই সাইমন দেখতে পেলো সেদিনের সেই ছেলেটাকে যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। সাইমন ছেলেটাকে দেখে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলো সেই ছেলেটার দিকে। ছেলেটার সাথে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার পর পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য খাবার টেবিলের সামনে নিয়ে আসলো তাকে। সানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে খাবার খাচ্ছিলো। ছেলেটা আহানকে সালাম দিতেই চট করে চোখ তুলে তাকায় সানিয়া ওর দিকে। সানিয়ার সাথে ছেলেটাও অবাক। সানিয়ার চোখে জল টলমল করছে। ছেলেটার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে কিছুটা। সানিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বলে উঠে “মিনহাজ তুমি??? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে হুট করে? কত খুঁজেছি জানো তোমায়? ১৫দিন পর কলেজে গিয়ে যখন শুনলাম তুমি সাতদিন আগে থেকেই কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছো তখন পাগলের মতো এদিক সেদিক খুঁজেছি তোমায়। জানো সেদিন প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমি যে তোমায় ভা…..।”
এইটুকু কথা বলেই ঢুক গিলে ফেলে সানিয়া। সাইমন আহান আদিবা অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামিয়ার দিকে। মিনহাজ নিজেকে কন্ট্রোল করে শান্তভাবে বলে “শুনেছিলাম বিয়ে করেছো তুমি। তারপর আর ওই কলেজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম নাহ তাই অন্য কলেজে চলে গিয়েছিলাম। এভাবে চারবছর পর হুট করে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি কখনো। যাইহোক বাদ দাও সময় গরিয়েছে, সবকিছু বদলে গেছে। তোমার স্বামী কোথায়?”
সানিয়া কিছু বলতে পারছেনা কান্নার জন্য। চারবছরের জমানো কান্না যেনো সব একসাথেই কাঁদতেছে। সানিয়ার কান্না মিনহাজের সহ্য হচ্ছে না আবার বুকেও জড়িয়ে নিতে পারছেনা পাগলীটাকে। দু’জনের মনেই অদ্ভুত রকমের কষ্ট হতে লাগলো। সানিয়া লোনা জলে সব কষ্ট প্রকাশ করতে পারলেও মিনহাজ পারছেনা। মিনহাজের বুকটা বড্ড বেশি ভার হয়ে আছে। হতভম্ব হয়ে সবকিছু দেখছে সাইমন আহান আদিবা। খানিক বাদে আদিবা শান্ত করার চেষ্টা করে সানিয়াকে। কিছুটা স্বাভাবিক হয় সানিয়া। মিনহাজ জানতে পারে সেদিন যার জীবন সে বাঁচিয়েছে সেই মানুষটাই তার ভালোবাসার মানুষটার জীবনসঙ্গী। সানিয়ার মুখে হাসি নেই আর সাইমনের মনে অশান্তির ঝ’ড় বইছে। সাইমন বেশ বুঝতে পারছে এই ছেলের জন্যই চারবছর ধরে সানিয়া তাকে স্বামীর অধিকার দিতে পারেনি। সাইমন ঠিক করে বাসায় গিয়েই এই বিষয়ে কথা বলবে সানিয়ার সাথে সে। জীবনের চারটা বছর নষ্ট হয়েই গেছে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়না। বাঁচতে হলে অক্সিজেনের সাথে মানসিক সুখ শান্তিরও প্রয়োজন হয়।
ওরা খাবার খেয়ে বিল পরিশোধ করতে গেলে মিনহাজ বলে লাগবেনা। এতে সবাই একটু অবাক হয়। তারপর মিনহাজ সবার উদ্দেশ্যে বলে এটা তার রেস্তোরাঁ। ওর মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্যই এই রেস্তোরাঁ বানিয়েছে সে। আর এটা ওর মায়ের সম্পদ। ওর মায়ের স্বপ্ন সানিয়া বেশ অবাক হয়। তার ভালোবাসার মানুষটি তার এতো কাছে ছিলো তবুও সে এতদিন তাকে খুঁজে পেলোনা। এই কারণেই হয়তো এই রেস্তোরাঁর প্রতি তার এতো অনুভূতির সৃষ্টি। আহান মিনহাজকে বলে কোনো একদিন সময় করে তাদের বাসায় গিয়ে ঘুরে আসার জন্য। তারপর তারা বেরিয়ে পরে সেখান থেকে কিন্তু সানিয়া আর মিনহাজ চোখ সরাতে পারছিলোনা একে অপরের দিক থেকে। সানিয়ার মনে হচ্ছিলো সে তার আত্মাটা রেখে আসছে বুঝি ওখানে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here