শুভদিন (পর্ব-০১)

0
3155

-“বাবা…..কাজী অফিসে কেন নিয়ে আসলে আমায়…!?”
-“কাজী অফিসে মানুষ কেন আসে?”
-“বিয়ের কাজে আসে….কিন্তু আমরা কেন আসলাম?”
-“আজ তোর বিয়ে…. তাই এসেছি।”

বাবার কথা শুনে অরিত্রী থমকে দাড়ালো।মুহুর্তের মধ্যে অরিত্রীর পৃথিবী টাও যেন থমকে গেল! অরিত্রীর বিয়ে…!! এসবের মানে কি…!?
কার সাথে বিয়ে? কিভাবে কি…? কেন বিয়ে করবে ও…!?কাল বাবা ওর সাথে রাগ করে বুড়ো লোকের সাথে ওর বিয়ে দেখার কথা বললেন আর আজ সত্যি সত্যিই কাজী অফিসে নিয়ে চলে এলেন..! সত্যি সত্যিই কি বাবা ওকে কোনো বুড়োর সাথে বিয়ে দেবেন..!? বাবা সত্যিই কি এত নিষ্ঠুর…!?

অরিত্রীর মাথায় কাজ করতেছে না কোনো।বার বার হৃদয়ের মুখ টা সামনে ভেসে উঠছে।হৃদয়ের সেই মায়া ভরা চোখ দুটো,সেই হাসি টা ; যেটা প্রথমবার দেখে ওর হার্টবিট মিস হয়ে গিয়েছিল…!
ওর এখনো মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা…..যেদিনটায় ও হৃদয়ের ওই মায়াভরা চোখের দৃষ্টিতে নিজেকে বন্ধী করে ফেলেছিল।ওর মুখের হাসিটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। আচমকাই ও সেদিন নিজের অজান্তেই হৃদয়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে হাউমাউ করে কাদতে কাদতে বলেছিল,
-“আমি মরেই যাব হৃদ ভাইয়া….প্লিজ আমাকে বাচাও।”

হৃদয়কে সবাই সংক্ষেপে হৃদ বলে ডাকে।বাসায় কেউ ছিল না তখন।হৃদয়ের বাবা-মা দুজনেই অফিসে চলে গিয়েছিল।সকাল ১০ঃ৩০ টার দিকে ঘুম থেকে উঠে সরাসরি ওয়াশরুমে ঢুকে।শাওয়ার নিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল হৃদয়।অফ হোয়াইট কালারের গ্যাভাডি প্যান্টের সাথে কালো একটা টিশার্ট।একহাতে একটা কালো কালারের ব্যাস্লেট আরেক হাতে ঘড়ি। মাথার আধো ভেজা চুলগুলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকঠাক করছিল।ঠিক অই সময়টাতে অরিত্রীর মাথাটা কাজ করা অফ করে দিয়েছিল।হৃদয়ের রুমের দরজার খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল হৃদয়ের দিকে।একটা মানুষ এতটা সুন্দর হয় কীভাবে অরিত্রী বুঝে উঠতে পারছে না।জীবনে অনেক সুন্দর ছেলে দেখেছে।কিন্তু কারো প্রতি ওর দৃষ্টি আটকে যায় নি।কাউকে দেখামাত্রই ওর হার্টবিট মিস হয় নি।এবার কি হল ওর…!?হৃদয় কে দেখার পর ওর সব যেন উলোট পালোট হয়ে গিয়েছিল।
এতদিন এই আশায় ছিল যে,হৃদয় হয়তো ওকে প্রপোজ করবে।হৃদয়ও যে ওকে পছন্দ করে সেইটা খুব ভালো করেই জানে অরিত্রী।হৃদয় কথাবার্তার মাধ্যমেই সেইটা ওকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছি।কিন্তু সরাসরি কিছু বলে নি।তাই হৃদয় সরাসরি ওকে কবে প্রপোজ করবে সেই দিন গুনছিল এতদিন।কিন্তু আজ আর ও থাকতে পারল না….মনে হচ্ছিল এবার ওর মনের কথা টা বলে দিতে না পারলে ও নিজেই দম ফেটে মরেই যাবে।তাই আর এক মুহুর্তও দেরি করল না অরিত্রী।দরজায় দাড়িয়েই হৃদয় কে ডাক দিল,
-“হৃদ ভাইয়া?”
হৃদয় অরিত্রীর দিকে মুখ করে তাকালো।ইশ…!! আবার সেই চাহনী…!! অই চোখের দিকে তাকালে অরিত্রী সত্যিই খুন হয়ে যায়! কি আছে অই চোখে…!?
অরিত্রীর এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে হৃদয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।তাল সামলাতে না পেরে উল্টো দিকে পরতে গিয়েও কোনোভাবে বেচে গেল। অরিত্রীর এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে গেল হৃদয়। কান্না কররে করতে অরিত্রী বলল এবার,
-“আমি মরেই যাবো হৃদ ভাইয়া।প্লিজ আমাকে বাচাও।”
-“কি হয়েছে অরু? কাদছ কেন এভাবে? কি হয়েছে বল আমাকে?”
-“স্টুপিড…তুমি কি কিছুই বুঝো না?”
-“আমি যেইটা বুঝি সেইটাই কি সত্যি?”
-“কি বুঝো তুমি?”

হৃদয় অরিত্রীর এই প্রশ্নের উত্তর দিল না।অরিত্রীর মাথাটা বুকের সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-“অরু,আমার তোমাকে একটা কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করে।”

অরিত্রীর হার্টবিট বেড়েই চলেছে।হৃদয়ের বুকের সাথে মিশে যেতে চাচ্ছে ও….! চোখ টা অফ করে অরিত্রী বলে উঠল,
-“ভালোবাসি।প্রচন্ড ভালোবাসি”

হৃদয় মুচকি হেসে বলল,
-“হ্যা এটাই….এই কথাটাই বলতে ইচ্ছে করে আমার….।”
এইটুকু বলে হৃদয় অরিত্রীর মুখ টা বুকের উপর থেকে উঠিয়ে দু’গাল দু’হাতে চেপে ধরে মুখ টা একটু উচু ধরল।অরিত্রী চোখ বন্ধ করে আছে।কিছুতেই তাকাতে পারছে না।হৃদয় মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
-“আমিও ভালোবাসি অরু….Will you be my hreedi?”

অরিত্রী মুখে কিছু বলতে পারল না।প্রচন্ড সুখে চোখের কোণে পানি জমে গেছে।চোখের সেই অবাধ্য পাবি এবার গাল গড়িয়ে নিচে পরল।অরিত্রী আবার জড়িয়ে ধরল হৃদয়কে।

এসব ভাবতে গিয়ে এবার কেদেই ফেলল অরিত্রী।হৃদের হৃদী কি তাহলে ও হতে পারবে না শেষ পর্যন্ত…!?
ঝাপসা ঝাপসা চোখে ও সামনের দিকে তাকাতেই দেখে এক অর্ধবয়স্ক লোক মাথায় বিয়ের পাগড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে।আল্লাহ…!! সত্যিই বাবা একটা বুড়োকে ধরে নিয়ে এসেছে…!? কিন্তু কেন? কিভাবে পারল এটা বাবা…!?
লোকটা পান চিবুতে চিবুতে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে।লোকটার পাশেই অরিত্রীর জমজ বোন আরশি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের ভিতর ডুব দিয়েছে।
এই মেয়ের এই এক সমস্যা।লেবাস তো পুরাই হুজুরনি…অথচ ফোনের কি নেশা রে বাবাহ…! ফোন টিপার সময় আর দিন দুনিয়ার খেয়াল থাকে নাহ।এই যে অরিত্রী ওর ১৫ হাত দূরে দাঁড়িয়ে নিরবে কান্না করছে সেইটা কি ওর দেখা উচিত না?

আচ্ছা,আরশিই বা এখানে কেন…!? তার মানে কি ও এই বিয়ের ব্যাপারে জানত..!? ওর নিজের মায়ের পেটের বোন,ওর বেস্টফ্রেন্ড ওর সাথে এভাবে প্রতারণা করল…!? আরশি কি হৃদয় আর ওর ব্যাপারে জানত না? সব জেনেও কেন ও অরিত্রীকে এই বিয়ের ব্যাপারে আগে কিছু বলে নি?আরশি একটাবার জানালে ও কিছুতেই এই কাজী অফিস অবদি আসত না। কেন হৃদয়ের কাছ থেকে ওকে আলাদা করার এমন ষড়যন্ত্র করল…!? ওওও….বুঝেছি,তলে তলে ঠিকই তুমি হৃদয়কে পছন্দ কর তাই না? এখন এই বুইড়া বেটার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করার ধান্দায় আছো তাই তো?
মনে মনে দাত কিড়মিড় করে এসব বলতে বলতেই অই মধ্যবয়সী লোকটা জয়ধ্বনি দিয়ে বলতে লাগল যে,”পাত্রী এসে গেছে।পাত্রী এসে গেছে!”

অরিত্রীর এবার ঠোঁট ভেটকিয়ে কেদেই ফেলল।বাবার হাতটা চেপে ধরে মিনমিন করে বলল,
-“বাবা,আমি কি সত্যি সত্যিই বিয়ে করব?”
-“সত্যি সত্যি করবি না তো মিথ্যা মিথ্যি করবি?”
-“বাবা,বিয়ে টা দুইদিন পরে করি?”
-“নাহ…আজই করবি…এক্ষুনি।নো কান্নাকাটি….মাস্তি কর মাস্তি।”

এই মুহুর্তে এই বাবাটাকে অরিত্রীর ভেজা কাপড়ের মত চিপড়ানি দিয়ে রোদে শুকা দিতে ইচ্ছে করতেছে।মনে মনে আচ্ছা মত বলা দিল সে বাবাকে।মাস্তি করার সময় এখন তাই না?
এই একমাত্র লোক যাকে অরিত্রী বাঘের মত হয় পায়।এমনি স্বভাবে অরিত্রী বাঘিনী হলেও বাপের সামনে এসে বিড়াল হয়ে যায়।এই বাবাটাকে সে কেন এত ভয় পায় এখনো বুঝে উঠতে পারে না অরিত্রী।আজ এই মুহুর্তেও সে বাবাকে দৃঢ় কন্ঠে কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত করতে পারছে না।এটা কি ঠিক?

হুট করে বাবা কাজী অফিসে নিয়ে এসে বলবে যে,আজ তোর বিয়ে এই বুইড়ার সাথে তাই কি হবে নাকি? বিয়ে কি মুখের কথা..!? এতই সহজ…!?

অরিত্রী কান্না থামালো।চোখ মুখ মুছে মনে মনে নিজের ভেতরে সাহস জুগালো।কান্না করলে চলবে না।বাবাকে জোর দিয়ে বলতেই হবে যে,এভাবে যে কিছুতেই বিয়ে করবে না।কিছুতেই না….

ভেতরে ভেতরে নিজেকে বাঘিনী বানিয়ে শক্ত গলায় বাবাকে ডাক দিল,
-“বাবা…!?”
বাবা হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-“কিছু বলবি?”

বাবার কন্ঠ শুনেই অরিত্রীর ভেতরের বাঘিনী টা আবার বিড়াল হয়ে গেল।মিনমিন করে আবারো বাবাকে বলল,
-“বিয়ে টা দুদিন পরে করি বাবা?”

বাবা অরিত্রীর মুখের দিকে একবার বিরক্তির সাথে তাকিয়ে ওর কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে সরাসরি ভেতরে ঢুকে গেলেন।অরিত্রী এবার ঝাপিয়ে পড়ল আরশির উপর।একটু ফাকে ডেকে নিয়ে চাপা স্বরে দাত কিড়মিড় করে বলল,
-“এসব কি আরশি?”
-“দেখতেই তো পাচ্ছিস।”
-“মজা নিচ্ছিস আমার সাথে তাই না? মানুষ যে বলে বোরকার নিচে শয়তান থাকে কথাটা 100% সত্যি।তোকে না দেখলে বুঝতামই না আমি।”
-“আপনার হিরোকে দেখে যেন আপনার সব বুঝ আবার উলোটপালোট না হয়ে যায়।”

অরিত্রী ভ্রু কুচকে তাকালো আরশির দিকে।হিরোকে দেখে সব বুঝ উলোটপালোট হবে মানে? আরশি ওর ভ্রু কুচকানোকে কোনো পাত্তা দিল না। মুচকি হেসে অরিত্রীকে এক প্রকার উপেক্ষা করে সেখান থেকে চলে গেল।মুচকি হাসিটা অবশ্য ওর নিকাবের কারনে দেখা গেল না।অরিত্রীর গা জ্বলে যাচ্ছে।এই আরশি মেয়েটার চুল একটা একটা করে টানতে ইচ্ছে করছে।
অই মধ্যবয়সী লোকটার সাথে ওর বিয়ে দিচ্ছে বাবা..!! এর চেয়ে তো মরা ভালো।ও কি একবার ছাদে গিয়ে লাফ দেবে?
ছাদে গিয়ে লাফ দেয়ার সময় নিশ্চয়ই বাংলা সিনেমার মত ওর হিরো মিস্টার হৃদয় এসে উপস্থিত হবে।হ্যা,এইটাই করবে ও।ছাদে গিয়ে চোখ অফ করে লাভ দিবে। আর চোখ খুলে দেখবে যে ওর হৃদয়ের কোলে! আহ….!!

এক পা, দু পা সিড়ির দিকে এগুতে লাগল অরিত্রী।ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।আচ্ছা,লাফ দেয়ার আগে একবার হৃদয়ের সাথে শেষ বারের মত কথা বলা তো উচিত তাই না? একটাবার ফোন করতে হবে হৃদয়কে।ও ওর পার্স থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করলে গেল হৃদয়ের নাম্বারে।

“How am I looking mrs hreedi?”

হৃদী…!!
সেই চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর…!! ও কি ঠিক শুনতে পারছে? নাকি মনের কল্পনা..!? পেছনে তাকাতেই চোখ ইয়া বড় বড় হয়ে গেল।শেরোয়ানি আর পাগড়ি পরিহিত ওর দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন যুবক…!! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।চোখ কপালে তুলে বলল,

-“হৃদ…!! তু তু তুমি…!?এই অবস্থায়..!? ”
-“হ্যা আমি।কেন…? এই জায়গায় অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করেছিলে নাকি?”
-“হ্যা মানে না,তা না।কিন্তু অই বুড়ো টা কই?”
-“কোন বুড়ো?”
-“অই যে,যে বুড়োকে ভেতরে ঢুকার সময় এরকম পাগড়ি পরা দেখলাম।”
হৃদয় এবার হাহা করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতে বলল,
-“উনি মামার পরিচিত। আমাদের বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে এসেছেন।”

অরিত্রীর সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।সত্যিই ওর বিয়ে…!? তাও আবার হৃদয়ের সাথেই…!? আবারো মুহুর্তের জন্য একটা ঘোরের ভিতর চলে গেল অরিত্রী। ঘোর ভাংলো ওর বাবার কথায়।বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে হৃদয়কে বলছে,
-“মিস্টার হালুম….অরু আজ বিয়েটা করতে চাচ্ছে না।তাহলে তুমি বরং চলেই যাও আজকে।”

অরিত্রী এবার অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো।বাবা কি ওর সাথে মজা করছে..!? কি হচ্ছে এসব..!? অরিত্রী বাবার দিকে তাকিয়ে করুন কণ্ঠে বলল,
-“বাবা….বেচারা এত কষ্ট করে এত আশা নিয়ে সেই ময়মনসিংহ থেকে টাংগাইল আসছে বিয়ে করার জন্য….তাকে ফিরিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে? বিয়েটা বরং আজই করেই ফেলি?”

শুভদিন (পর্ব-০১)
লিখাঃ সুমাইয়া বিনতে আব্দুল আজিজ

Will be continue in-sha-allah….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here