শুভদিন (পর্ব-০৪)

0
1539

শুভদিন (পর্ব-০৪)
লিখাঃ সুমাইয়া বিনতে আব্দুল আজিজ

বাসায় পৌঁছুতেই অরিত্রীকে আরশির সাথে না আসতে দেখে কৈফিয়ত চাওয়া শুরু করে দিলেন ওদের মা হুমাইরা জাহান।
অরিত্রী কোথায় আছে? ওদের সাথে কেন আসল না? কখন আসবে?
আহসান আলম ঠান্ডা মাথায় নরম সুরে বললেন,
-“মাত্রই তো বাইরে থেকে আসলাম।একটু রেস্ট নিতে দাও।”
-“রেস্ট নিতে নিতেই তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো তাই না?”
-“আরে বাবা….ওদের কলেজের ওদিকে গিয়েছিলাম।গিয়ে ওদের ফোন করলাম ক্লাস শেষ কিনা শুনার জন্য।আরশির ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই ওকে নিয়ে এলাম সাথে।অরিত্রীর ক্লাস এখানো শেষ হয় নি।”
-“দুজনে একই গ্রুপে অথচ একজনের ক্লাস শেষ, একজনের ক্লাস শেষ হয় নি এসবের মানে কি? বোকা পেয়েছ আমাকে হ্যা?”

আহসান আলম এবার রেগে গিয়ে বললেন,
-“সরি বাপ…ভুল বলে ফেলছি।অরিত্রী ওর জামাইর সাথে রিকশায় চড়ে ঘুরতেছে।আমি নিজে ওদের রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে এসেছি।বুঝেছ? শান্তি হয়েছে?”
-“সবসময় ত্যারাইছা কথা না বললে হয় না তোমার তাই না? এই তোমার জন্যই মেয়েগুলা এত্ত খারাপ হচ্ছে।আমি তো সৎ মা….সবসময়ই খারাপ চাই ওদের।তুমি আপন বাপ হয়ে যে খারাপ চাচ্ছ বা খারাপ বানাচ্ছ সেইটা তো ওরা বুঝতে পারতেছে না।বুঝবেও না।”

এবার আরশি পাশ থেকে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-“কথায় কথায় মায়ের আগে সৎ ওয়ার্ড টা উচ্চারণ না করলে হয় না? আমরা ২ বোন কখনো তোমাকে সৎ মায়ের চোখে দেখি?”

হুমাইরা জাহান চেচিয়ে উঠে বললেন,
-“হয়েছে হয়েছে…বাপের সামনে এখন আর সাধু সাজা লাগবে না।”

আরশি আর কোনো কথা বলল না।সে জানেই যে এখানে তর্ক করে লাভ নেই।মিছামিছি কথা বাড়বেই।চুপচাপ ওর রুমে চলে গেল।ভেতর টা খুব হালকা লাগছে ওর।অবশেষে আল্লাহর রহমতে অরিত্রীর হারাম রিলেশনটাকে হালালে পরিনত করতে সক্ষম হয়েছে ও।খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করতেছে।দরজাটা লক করে বাইরের কাপড় ছেড়ে ঘরের কাপড় পরে ফ্যান অন করে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো আরশি। হঠাৎ করে কোনো পারমিশন না নিয়েই আরশির চাচাতো ভাই মেরাজ আরশির রুমে ঢুকে পরল।আরশি চরম বিরক্তির সাথে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে পাশ থেকে উড়না টা মাথায় দিয়ে সারা শরীর ঢেকে নিল।তারপর কর্কশ কণ্ঠে ধমকের সুরে মেরাজকে বলল,
-“মেরাজ ভাই…তোকে কত শত বার বলছি আমার রুমে এভাবে হুটহাট ঢুকে পরবি না।ঢুকার আগে পারমিশন নিয়ে নিবি।এক কথা কতবার বলতে হবে?”
-“ঢং দেখাইস না তো আরশি… এমন ঢং দেখাচ্ছিস মনে হচ্ছে তোর ইজ্জত কেড়ে নিতে আসছি…!”
-“মুখ সামলে কথা বল মেজার ভাই।কোন দরকারে এসেছিস দরকার সেরে কেটে পর।আর নেক্সটে এভাবে আমার রুমে হুটহাট ঢুকে পরবি না।লাস্ট বারের মত বলে দিলাম।”

মেরাজ আর কোনো কথা না বলে আরশির ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।আরশি চিল্লিয়ে বলল,
-“অই,আমার ওয়াশরুমে ঢুকিস ক্যান?”
-“গোসল করব।বাকি সব ওয়াশরুমই ব্লক হয়ে গেছে।”
-“৫ মিনিটের মধ্যে গোসল সারবি।আমার গোসল করা লাগবে।নামাজ পরি নাই এখনও। ”

মেরাজ আর কিছু বলল না।চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।আরশি মনে মনে ১০১ টা গালি দিল মেরাজকে।
যৌথ ফ্যামিলিতে এই এক সমস্যা…পর্দা করা ঝামেলা। অরিত্রীর এক চাচা ঢাকায় থাকেন।আর আরেক চাচা ওদের সাথে একত্রে এক বাসায়ই থাকেন।বাবা এত কিছু বুঝেন অথচ এই যৌথ ফ্যামিলির পর্দার সমস্যা কেন বুঝেন না সেইটা মাথায় আসে না আরশির।অবশ্য,বুঝেন না সেইটা বললে ভুল হবে।বুঝেন ঠিকই।কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেন না এই ব্যাপারে।

পুরো বাড়িতে ইসলামিক ব্যাপারে একমাত্র ওর বাবা-ই যা একটু সাপোর্ট দেয়।তাছাড়া বাকিদের কাছ থেকেই সাপোর্ট তো পায়ই না…উলটো বাধার সম্মুখীন হয়।নিজে নিজে সবার বিরুদ্ধে স্ট্রাগল করে কতটুকুই বা পারা যায়…!?
ভাবতে ভাবতে আবার ফোনের ভেতর ঢুকে গেল আরশি।

রিসেন্টলি ফেসবুকে একজন দ্বীনি বোনের সাথে পরিচয় হয়েছে।এত্ত ভালো লেগেছে মেয়েটাকে যা বলার বাইরে! সারাদিন কথা বলে তবুও শান্তি মেটে নাহ।মেয়েটাও ওর মত প্রেকটিসিং মুসলিমাহ।ইসলামকে আকড়ে ধরতে তারও ভীষণ কষ্ট পোহাতে হয়।মেয়েটার নাম খাদিজা।এবার অনার্সে এডমিট হয়েছে।থাকে বরিশালে।

এভাবে এরকম মেয়েদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে বোন বানিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মেসেঞ্জারে চ্যাটিং করা অরিত্রীর একদম পছন্দ না।সে বার বার আরশিকে নিষেধ করে এসব ব্যাপারে।আরশির এসব নিষেধাজ্ঞা শুনতে ইচ্ছে করে না।আরশি বলে,
-“আমি কি তোর মত ছেলেদের সাথে প্রেম করে বেড়াই? তুই যেটা করিস সেইটা হারাম।কিন্তু আমার টা হারাম না।তুই এভাবে ছেলেদের সাথে অবাধ মেলামেশা করে নিজের ইমেজ তো নষ্ট করিসই উল্টো আমার ইমেজও নষ্ট করিস।”
-“আহা….আসছে আমার ইমেজ ওয়ালি।শোন,ভার্চুয়ালে এইসবই ফেইক।বুঝলি? এই যে,তুই যে খাদিজার আপুর সাথে কথা বলিস…বোন বানিয়েছিস।যেন তোর বোন নেই।কি আদিক্ষেতা…!! সবকিছুর লিমিটেশন থাকা উচিত। এসব ব্যাপারে লিমিট ক্রস করিস তুই।এই যে হুজুরনি হয়ে সুযোগ হলেই ফোনের উপর উপুর হয়ে পরে থাকিস;এটা কি সবাই ভালো চোখে দেখে?তোর ফোনের প্রতি এমন নেশা দেখে সবাই তো ভাবে প্রেম করে বেরাস তুই।আদৌ কি তাই? এই যে আমি প্রেম করি।তাও তো তোর মত এর নেশা নাই ফোনের।”

আরশি অরিত্রীর কথার কোনো জবাব দেয় না।অরিত্রীর কথা ভুল না।ওর এই ফোনের প্রতি এত নেশা কেউ ভালো চোখে দেখে না।অথচ ও তো ফোনে খারাপ কিছু করে না।ভালো কাজই তো করে।কিন্তু সেইটা কে বুঝবে?

****

অরিত্রীর আরশির চেয়ে ৩৫ মিনিটের বড়।আবার আরশি জন্ম নেয়ার ঠিক ৩৫ মিনিট পরই ওদের মা আকলিমা মারা যান।দুই মেয়েকে একনজর দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।প্রচন্ড ব্যাথায় কাতরাতে থাকা আকলিমা এত কিছুর পরেও মেয়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা ভুলেন নি।সেই দিন টার কথা মনে পড়লে আজও ভেতর টা হু হু করে কেদে উঠে আহসান আলম এর।
তিনি এতটাই হতভাগা ছিলেন যে,স্ত্রীর ডেলিভারির সময় পাশে থাকতে পারেন নি।শুধু কি ডেলিভারি…? প্রানপ্রিয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাকে শেষ দেখা দেখতে পর্যন্ত আসতে পারেন নি। ৬ মাসের জন্য আফ্রিকায় গিয়েছিলেন আর্মিদের একটা মিশনে।তার প্রানপ্রিয় পত্নী যখন প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে তখন তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত।প্রানপ্রিয় সহধর্মিণীনি যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে তখন তিনি নিজের মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যস্ত।এখানে এত শত ব্যস্ততার মাঝে তার গর্ভবতী স্ত্রীর কথা মনে করার সময় আছে?
তবে,হাজার ব্যস্ততার মাঝে একটুখানি ফাঁকা যখনই পেত তখনই আকলিমার দেয়া চিঠিটা চোখের সামনে এনে ধরত।আকলিমাকে ৭ মাসের গর্ভবতী রেখে এসেছিলেন তিনি।
বিদায় দেয়ার সময় জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না…!! আহসান বার বার নিষেধ করছিল কান্না করার জন্য,এমনিতেই সে অসুস্থ। তার মধ্যে এভাবে কান্নাকাটি করলে আরো অসুস্থ হয়ে পরবে।
কিন্তু কে শুনে কার কথা? আকলিমা অনবরত কান্না করেই চলেছে।
স্ত্রীর শত কান্না উপেক্ষা করে সেদিন চলে আসতে হয়েছিল তাকে সূদুর আফ্রিকায়।কে জানত? আর যে কখনো দেখা হবে না…!!
৯ মাস চলাকালীন সময়ে আকলিমা একটা চিঠি লিখেছিল আহসানকে।শেষ চিঠি ছিল অইটাই।চিঠি টা আজও সবার আড়ালে অক্ষত অবস্থায় রেখে দিয়েছেন তিনি।চিঠিটা খুব বড় ছিল না।অল্প কয়েকটা লাইন ছিল….কিন্তু সেই অল্প কয়েকটা লাইনে যেন হাজার কথা লুকিয়ে ছিল।চিঠি টা যতই পরে ততই যেন নতুন লাগে।পুরোনো হয় না কখনো।চিঠিতে কোনো ফর্মালিটি ছিল না।আকলিমা লিখেছিল,,,

জানো প্রিয়?

বাচ্চাগুলো অনবরত আমাকে আঘাত করতে থাকে।দুজন পাল্লাপাল্লি করে লাত্থি দেয় পেটের ভেতর।তবুও যে কি ভালো লাগে আমার..!!
আচ্ছা,তুমি পাশে থাকলে নিশ্চয়ই ওদের আচ্ছা করে বকুনি দিতে তাই না? আমার ভীষণ মনে পরে তোমাকে।আমাকে এই অবস্থায় রেখে যেতেই হল তোমাকে…!? না গেলে কি হতই না…!?

বাবুদের জন্য কাধা সেলাই করতে গিয়ে একটা দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় চাপলো।ওদের কাধা সেলাই স্থগিত রেখে বাবুদের কাথার সাইজেই ছোট্ট একটা নকশী কাথা সেলাই করেছি।সেই নকশি কাথায় তোমার আর আমার নাম সুই সুতায় গেথে দিয়েছি।দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে জানো?
এই কাথাটা কখনো ব্যবহার করব না।টাংকে খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি।আর এটা ছাড়াও তোমার জন্য দারুন রকটা সারপ্রাইজ গিফট রেডি করে রেখেছি।তুমি আসলেই তোমাকে দিয়ে দেব ইন-শা-আল্লাহ।

জানো তো? আমার না ভীষণ ছটফট লাগে।তোমাকে প্রচন্ড দেখতে ইচ্ছে করে।তোমার কণ্ঠ টা খুব শুনতে ইচ্ছে করে।তুমি যে বড্ড খারাপ একটা লোক সেইটা কি তুমি জানো?
তোমার উপর আমার ভীষণ অভিমান হয়…..ভীষণ…!! তুমি কি বুঝো সেইটা?

ইতি,
অভিমানিনী

চিঠি টা প্রথম বার পরে মুচকি মুচকি হেসেছিল আহসান।মনে মনে ভেবেছিল,দেশে ফিরে অভিমানিনীর সব অভিমান ঘুচিয়ে দেবে।বউ তার জন্য সারপ্রাইজ গিফট রেডি রেখেছে…! সেই সারপ্রাইজ গিফট টার জন্য অই কয়টা মাস কতটা মনটা কতটা ছটফট করেছে সেইটা শুধু সেই জানে।অবশেষে দেশে ফিরে এরকম একটা সারপ্রাইজ পাবে জানলে হয়তো আর দেশেই আসত না।আফ্রিকাতেই শহীদ হয়ে থাকত।যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না তখন।চিঠিই সাধারণ মানুষের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল।
ডেলিভারির পর আহসানের কাছে যে চিঠি গিয়েছিল সেই চিঠিতে জমজ দুই মেয়ের জন্মের কথা জানানো হলেও আকলিমার মৃত্যুর সংবাদ টা জানানো হয় নি।ইচ্ছে করেই জানায় নি কেউ।দূর দেশে গেছে….এরকম একটা খারাপ সংবাদ শুনলে না জানি তার অবস্থা কেমন হবে…!!

দেশে ফিরে আকলিমার এভাবে চলে যাওয়াটা নির্বাক করে দিয়েছিল আহসানকে।বার বার আকলিমার চিঠির সেই শেষ ২ টা লাইন টা মনে পরে,”তোমার উপর আমার ভীষণ অভিমান হয়….ভীষণ…!! তুমি কি বুঝো সেইটা?”

আহসানের চোখের সামনে আকলিমার মুখটা ভেসে উঠে।মনে হয়,আকলিমা ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেছে,”তোমার উপর আমার ভীষণ অভিমান হয়….ভীষণ…!! তুমি কি বুঝো সেইটা…!?”

আহসানের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়।টলমল করা চোখের পানি গাল গড়িয়ে নিচে পরে।চিঠিখানা বুকে জড়িয়ে ধরে আহসান ফিসফিস করে বলে,
-“তোমার অভিমান টা ভাংগানোর সুযোগও দিলে না আমায় অভিমানিনী ? এতটাই অভিমান করেছিলে যে একবারে চলেই যেতে হল…!? এতটাই অভিমান…!?”

মেয়েদের মাঝে বার বার আকলিমাকে খুজে পাওয়ার চেষ্টা করত আহসান।আর পেয়েও যেত।যেই চোখ,সেই ঠোঁট, সেই হাসি….আকলিমা হাসার সময় ঠোঁটের এক সাইড একটু বাকা করে হাসি দিত।মেয়ে ২ টাও একই ভাবে হাসে।

অরিত্রী,আরশি…
মেয়েদের নামগুলো আকলিমা’ই দিয়ে গিয়েছে।

ছোট ছোট দুইটা দুধের বাচ্চা…মা নেই তার মধ্যে।এদের সামলাতে বেশ হিমসিম খাওয়া লাগছিল সবাইকে।
এদিকে আহসানের বয়সও খুব বেশি হয় নি।সারাটা জীবন কাটানোর জন্যও একজন সংগী দরকার।

আহসানেন বাবা-মা আহসানকে আবার বিয়ে করানোর কথা তুললেন।আহসান প্রথমে বিয়ে করতে এক বাক্যে অস্বীকার করলেও সবাই বুঝানোর পর মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজি হলেন।তবে একটা শর্তও জুড়ে দিলেন সেই সাথে।
এমন কোনো মেয়েকে উনি বিয়ে করবেন যে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম।বন্ধ্যা কাউকে পেলে বিয়ে করবেন নয়তো না।অরিত্রী,আরশির জন্যই সে বিয়ে করতেছে।অরিত্রী,আরশির কোনো অযত্ন তিনি হতে দিবেন না।

তারপর তার বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজনরা মিলে বন্ধ্যা মেয়ের খোজ করতে লাগলেন।অল্প সময়ের মধ্যে পেয়েও গেলেন।মেয়ে বন্ধ্য এবং ডিভোর্সি।বন্ধ্যা হওয়ার কারনেই নাকি ডিভোর্স হয়েছে। মোটামুটি ঘরোয়া ভাবেই আসহানের সাথে হুমাইরার বিয়ে হয়ে গেল।
কিন্তু চ্যাপ্টার উলটে গেলো বিয়ের এক বছর পরই।হুমাইরা প্রেগন্যান্ট…! বাজ পরল আহসানের মাথায়..!
পরে জানা গেল যে,যখন হুমাইরার পক্ষের লোক জানতে পারল ছেলেপক্ষ বন্ধ্যা মেয়ে খুজছে তখন তারা ঘটককে দিয়ে হুমাইরাকে বন্ধ্যা হিসেবেই প্রেজেন্ট করল।প্রকৃতপক্ষে সে বন্ধ্যা না….বন্ধ্যা সেজেছে কেবল।

নিয়তির লিখন, যায় না খন্ডন….আহসান এবারো বাধ্য হয়ে মেনে নিল অপ্রত্যাশিত নিয়তিকে।তবে,শাসিয়ে দিলেন হুমাইরাকে….এই দুইমেয়ের আদর যত্নের কোনো কমতি যেন না হয়।
একবাক্যে হুমাইরা মেনে নিলেন আহসানের কথা।
-“আরে,তোমার মেয়ে তো আমারও মেয়ে তাই না? কখনো দেখেছ ওদের অযত্ন হতে?”

আসলেই সেরকম কিছু দেখেন নি আহসান।দেখবেন কি করে? হুমাইরার মত অতো পাক্কা প্লেয়ার তো আহসানন না।মেয়েদের আদর যত্ন করে করে স্বামী সহ শ্বশুর বাড়ির সবার বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছে।মেয়েদের আপন মায়ের জায়গায় বসেছে।মেয়েরা সারাদিন মা কে চোখে হারায়…ওদিকে মাও মেয়েদের চোখে হারায়।এভাবে এমন একটা সময় এসে গিয়েছিল যখন অরিত্রী,আরশিকে হুমাইরার হাতে তুলে দিয়ে সবাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারত।সবার মনে হত যে,এতদিনে অরিত্রী, আরশির আপন মা-ই যেন ফিরে এসেছে।

এভাবে সবার বিশ্বাস অর্জন করে সে উলটা চাল দিতে শুরু করে।এমনভাবে চাল চালে যাতে কেউ বুঝতে না পারে।এমনকি অরিত্রী, আরশিও না।
তবে অরিত্রী, আরশি ঠিকই বুঝতো মায়ের এই চাল।আরশি ছোট থেকেই একটু শান্ত শিষ্ট টাইপের।শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই কখনো মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে নি।মনে মনে হাজার অভিযোগ থাকলেও মনের ভেতরেই রেখেছে সে।মিছামিছি সেসব বলে বেরিয়ে ঝামেলা করতে চায় নি।
কিন্তু অরিত্রী উলটো টাইপ…..গাছের উপরে উপরে পানি ঢেলে, তল দিয়ে শিকড় কাটবে এইটা সে সহ্য করতে পারবে না।প্রতিবাদ করত,মুখে মুখে তর্ক শুরু করে দিত।

আহসান আলম আর্মির কর্নেল। বাসায় সবসময় থাকেন না।দেখা যায়,বছরে দুই-একবার দীর্ঘ দুই-এক মাস ছুটি পান।একবার উনি ছুটিতে আসলে অরিত্রী ওর বাবার সামনেই মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে দেয়।
অরিত্রী,আরশি তখন ক্লাস টু তে পড়ে।বাসার সাথেই স্কুল ছিল।একাই যেতে পারত ওরা।ওদের দুজনের ব্যাগ গুছিয়ে দেয়া,টিফিন রেডি করে দেয়ার কাজ হুমাইরা নিজেই করত।তো,প্রতিদিন কিছু না কিছু মিসিং থাকতই।একদিন পেন্সিল দিত না,একদিন ইরেজার দিত না কিংবা দরকারী কোনো বই বা খাতা দিত না।আবার টিফিনে ভাত দিলে তরকারি দিতে ভুলে যেত।এরকম চলতেই ছিল।
অরিত্রী,আরশি মাকে প্রতিদিনই মনে করিয়ে দিত যাতে কিছু মিসিং না হয়।তবুও মিসিং থাকতই।অরিত্রী বুঝে যায় ইচ্ছে করেই এমন করে।কয়েকদিন এরকম দেখে সেদিন বাবার সামনে ঝামেলা করল।অইদিন অরিত্রীর টিফিন বক্সে ভাত দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তরকারি দেয় নি।রাতেও অরিত্রী না খেয়ে ঘুমিতেছিল পেট ব্যাথার জন্য।সকালে ৮ টা থেকে ক্লাস।শীতের সকাল তাই একটা সিদ্ধ ডিম খেয়েই স্কুলে আসছে।ভাত খায় নি।টিফিনের সময় টিফিন খেতে গিয়ে দেখে তরকারি নেই।মেজাজ টা তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অরিত্রীর।আরশিকে স্কুলে রেখে টিফিন টাইমেই বাসায় এসে পরে সে।তারপর টিফিন ক্যারিয়ারের ভাত গুলো জেদের চোটে হুমাইরার মুখের দিকে ছুড়ে মারে আহসানের সামনে।তারপর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে যে,
-“শয়তানী কর আমাদের সাথে তাই না? শয়তানী ছুটাবো তোমার।তুমি প্রতিদিন এক ঢং ধর? শয়তানী বুদ্ধি মাথা থেকে সরে না তাই না?”

এই টাইপ আরো অনেক কথা…হুমাইরা তো আহসানের সামনে কান্না করতে করতে অস্থির।যে মেয়েদের সে এত আদর করে সেই মেয়েরা আহসানের সামনে তার সাথে এমন ব্যবহার করবে আর আহসান চুপ থাকবে।বিচার করতেই হবে।বাসার অন্য সবাই চিল্লাচিল্লি তে এক জাগায় হল।অরিত্রী দাদা,দাদু বলছে মেয়েটা ছোট…ভুল করে ফেলছে ছেড়ে দে।কিন্তু না….হুমাইরার বিচার লাগবেই।আহসান অরিত্রীকে বলল,
-“মাকে সরি বল।”
-“আমি ভুল না করে সরি বলব কেন? বরং মাকেই বল সরি বলতে।”

আহসান কয়েকবার ভালোভাবে বলল মাকে সরি বলার জন্য।অরিত্রী জেদ ধরে বসে আছে।সে সরি কিছুতেই বলবে না।একপর্যায়ে আহসানের মাথায় রক্ত উঠে যায়।বাচ্চা মেয়েটাকে ঘরের ভিতর দরজা আটকিয়ে জেদের বশে জীবনের প্রথম বারের মত গায়ে হাত তুলে।শুধু গায়ে হাত তুলেছে বললে ভুল হবে।স্টিলের স্কেল দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটায়….ফর্সা শরীরে এক একটা আঘাতের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠে।কি হয়েছিল তার কে জানে…! পিটাতে পিটাতে সেদিন আধমরা বানিয়ে ফেলছিল অরিত্রীকে।দরজার বাইরে থেকে অরিত্রীর দাদা-দাদি,চাচা গলা ফাটিয়ে ডাকছিল।এভাবে মারতে নিষেধ করছিল।কাজ হয় নি।বাচ্চা মেয়েটার গলা ফাটানো আর্তনাদও সেদিন তার মনে এতটুকুও করুনা সৃষ্টি করে নি।এতটাই পাষাণ হয়ে গিয়েছিল সে।

তারপর একটানা ৫ দিন অরিত্রী বিছানায় শোয়া….ভয়ে,ব্যাথায় গা কাপুনি দিয়ে জ্বর আসল।এই ঘটনার পর থেকে বাবাকে সে জমের মত ভয় পায়।যতটা সম্ভব বাবাক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।খুব দরকার না হলে বাবার সাথে কথা পর্যন্ত বলে না।বাবা অনেক চেষ্টা করেছে আদরের মেয়েটার সাথে স্বাভাবিক হতে।কিন্তু পারে নি।অরিত্রী কোনোভাবেই বাবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারে না।চেষ্টা করে না তা না….চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ।বিনা কারনেই বাবাকে জমের মত ভয় লাগে তার….জমের মত…!!

চলবে ইন-শা-আল্লাহ

বি.দ্র. বাসায় মেহমান ভর্তি।নেক্সট পার্ট দিতে একটু লেট হতে পারে।কাল দিতে না পারলে পরশুদিন দেব ইন-শা-আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here