শুভ্রমেঘের ভালোবাসা ,পর্বঃ১

0
2554

শুভ্রমেঘের ভালোবাসা ,পর্বঃ১
Saiyara_Hossain_Kayanat

“তিন বছরের সম্পর্কে প্রেমিকের কাছে ধোকা খেয়ে আত্মহত্যা করলো এক তরুণী।”

“পরকীয়ায় লিপ্ত থাকার ফলে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করলেন স্বামী।”

খানিকটা উচ্চস্বরে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নিউজ গুলো পরলো অনন্যা। সাথে সাথেই অনন্যার হাত থেকে ঝড়ের গতিতে ফোনটা ছিনিয়ে নিল টেবিলের উপর পাশে বসে থাকা অনন্যার বেস্ট ফ্রেন্ড হাবিবা। অনন্যা ভ্রু কুচকে হাবিবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বললো-

—”ফোন ছিনিয়ে নিলেই কি ভালোবাসার নামে এইসব বিশ্রী পরিনতি গুলো পালটে যাবে??”

হাবিবা কিছুটা রেগে হাতের ফোনটা শব্দ করে জোরে টেবিলের উপর রেখে অনন্যার উদ্দেশ্যে বললো-

—”দিন দিন ভালোবাসা নিয়ে তোর নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা গুলো বেড়েই চলছে অনি।”

অনন্যা সোজা হয়ে বসে টেবিলের উপর দু’হাত রেখে শান্ত গলায় বললো-

—”আমার চিন্তা ভাবনা নেগেটিভ না হাবিব। ভালোবাসার নামে আশেপাশে যেসব জঘন্যতম কর্মকাণ্ড হচ্ছে আমি তো সেটাই বলছি।”

হাবিবা এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে শক্ত গলায় বললো-

—”তুই ভালোবাসা নিয়ে সব সময় খারাপ চিন্তা ভাবনা করিস বলেই এইসব নেগেটিভ নিউজ তোর চোখে বেশি পরে।”

অনন্যা কিছু বলার আগেই হাবিবার ফোন বেজে উঠলো। হাবিবা ফোন রিসিভ করে বললো-

—”তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি আসছি।”

এইটুকু বলেই ফোন কেটে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো-

—”দোস্ত সাদাফ এসে পরেছে আমাকে যেতে হবে। তুই বরং এখনে কফি খেতে খেতে বৃষ্টি কমে যাওয়ার অপেক্ষা কর। বৃষ্টি কিছুটা কমলেই চলে যাস।”

—”আচ্ছা তুই যা তোর নায়ক অপেক্ষা করছে।”

হেসে হেসে কথাটা বললো অনন্যা। হাবিবা কিছু না বলে চুপচাপ অনন্যার ফোনটা নিয়ে নিউজের সব পেইজ গুলো আনলাইক করে ফোনটা অনন্যার হাতে দিয়ে বললো-

—”সাবধানে যাবি আর বাসায় গিয়ে আমাকে কল দিয়ে জানিয়ে দিস কিন্তু অনি।”

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই হাবিবা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।

(অনন্যা হোসাইন মেঘ খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট স্বভাবের একটা মেয়ে। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে যত খারাপ চিন্তা ভাবনা আছে সব যেন অনন্যার মাথায় নিখুঁতভাবে গেঁথে আছে। হাবিবা অনন্যার বেস্ট ফ্রেন্ড পুরোই অনন্যার বিপরীত স্বভাবের মেয়ে। দুজনেই অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট।)

———————

বর্ষাকালের শুরুর সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। অনন্যা বসে বসে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি থামার। কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষনই অনন্যা চোখের পরছে না। বেশ খানিকটা সময় বিরক্তি নিয়ে বসে থাকার পর বেড়িয়ে আসলো রেস্টুরেন্ট থেকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে এখন। আসেপাশে একটা রিকশাও নেই। কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছাতা না থাকায় অনন্যা মাথার উপর একহাত রেখে আরেক হাতে কাধের ব্যাগটা ঠিক করেই পা বারালো সামনের দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ একজন ‘মেঘ’ বলে ডাক দিতেই থমকে দাঁড়ালো অনন্যা। ঘাড় বাকিয়ে পেছনের ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে খানিকটা চমকে গেলেও মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলিয়ে আবারও সামনের দিকে মাথা ফিরিয়ে নিল। রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে খোপ করে হাতটা খুব শক্ত করেই ধরে ফেললো শুভ্র। রেগে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো শুভ্র-

—”ভালো করে ডাক দিলে কি শুনতে ইচ্ছে করে না!!”

অনন্যা কিছু বলছে না অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রের ধরা হাতটার দিকে। শুভ্রর এমন রাগী কন্ঠ শুনে যেন আরেক দফা চমকে গেল অনন্যা। মনে মনে হিসেব মেলাতে লাগলো তিনবছর আগের শুভ্র সাথে এই শুভ্রর। নাহ…কিছুতেই মেলাতে পারছে না এই মানুষটার হিসেব। যে লোক সব সময় তার থেকে কমপক্ষে পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতো আজ সেই লোকটাই তার হাত ধরেছে!!! যে লোকটা সব সময় হাসি মুখে শান্ত গলায় কথা বলতো আজ সেই লোকটার এমন রাগী কন্ঠ শুনে যেন অনন্যার কাছে অবিশ্বাস্য কিছু মনে হচ্ছে।

শুভ্র অনন্যা কে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও গম্ভীর গলায় বললো-

—”এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমার সাথে চলুন।”

অনন্যা এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নম্রতার সাথে বললো-

—”হাতটা ছাড়ুন। আর আমি আপনার সাথে যাবো কেন?”

শুভ্র হাতটা আরও শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

—”আপনার কাছে ছাতা নেই আর আমাদের বাসাও কাছাকাছি তাই আমার সাথেই যাবেন আপনি।”

অনন্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো শুভ্র। অনন্যা আজ শুভ্রর প্রতিটা কাজে চরমভাবে অবাক হচ্ছে। একটা মানুষের হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে অনন্যা কিছুটা ভয় পাচ্ছে। তাই কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না।

(শুভ্র এহসান আঁধার বেশ নম্র ভদ্র স্বভাবের ছেলে হলেও এখন প্রচন্ড রাগী স্বভাবের মানুষে পরিণত হয়েছে তার ভালোবাসার জন্য। পড়াশোনা শেষ করে এখন খুব ভালো একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে।)

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আর কাঁদাযুক্ত রাস্তায় পড়ে যাওয়ার ভয়ে পা টিপে হাঁটছে অনন্যা। আর শুভ্র শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে অনন্যাকে। প্রায় তিনবছর পর দেশে ফিরে তার ভালোবাসার মানুষটাকে সামনা-সামনি দেখছে মুগ্ধ নয়নে। হাঁটতে হাঁটতে শুভ্র ভাবছে অতীতের কথা-

প্রায় দশ বছর আগে অনন্যাদের পুরনো বাড়ি বিক্রি করে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে। তার পাশের বাড়িটাই হলো শুভ্রদের। পাশাপাশি বাড়ি হলেও তেমন কোনো পরিচয় হয়নি কখনো। প্রতিদিন এই বাচ্চা মেয়েটা তার কোমড় অব্দি চুলে দুই বেনি করে চুল নাড়িয়ে হেলেদুলে স্কুলে আসা যাওয়া করতো এতোটুকুই দেখতো শুভ্র। এই ছোট একটা মেয়ের এতো সুন্দর আর বড় বড় চুল দেখে কিছুটা নজর কাড়ে শুভ্রর। তাই সে প্রায়শই খেয়াল করতো অনন্যাকে। কয়েক বছর এভাবেই চলে যায় অনন্যা বড় হওয়ার সাথে সাথে খুব চুপচাপ আর গম্ভীর স্বভাবের হয়ে ওঠে। অনন্যার এই স্বভাবটার জন্যই অনন্যার প্রতি সবার আগ্রহ ছিল অনেক। মায়ের সাথে চুপচাপ মাথা নিচু করে স্কুলে আসা যাওয়া করতো। তা ছাড়া আর দেখা মিলতো না এই মেয়ের। কখনো তো তার সাথে কোনো বান্ধুবিও চোখে পরেনি সব সময়ই একা।

——————

শুভ্র নামের এই মানুষটাকে অনন্যা কখনও খেয়াল করেনি। প্রথম খেয়াল করেছিল যখন অনন্যা ক্লাস এইটে পরতো তখন। স্কুলের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে সবাই সাদা লাল ড্রেস আর শাড়ী পরলেও অনন্যা পরে গিয়েছিল তার প্রিয় কালো রঙের জামা। সেদিনই খেয়াল করেছিল কালো শার্ট-প্যান্ট পরা এই লোকটা তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। এতো এতো মানুষের ভিড়ে অনন্যা আর শুভ্রই শুধু কালো রঙের ড্রেস পরেছিল। কিছুটা অদ্ভুত ছিল ব্যাপারটা।

শুভ্রর বার বার আড়চোখে তাকানোতে অনন্যা বেশ অস্বস্তিবোধ করছিল যার কারনে অনুষ্ঠানের শুরুতেই বেরিয়ে আসে অডিটোরিয়াম থেকে। সেদিন অনন্যা বুঝতেই পারেনি এই লোকটাকে এখন থেকে প্রতিদিনই তার দেখতে হবে। স্কুলে আসা যাওয়া পথে প্রতিদিন একবার হলেও অনন্যার নজরে পরতো এই লোকটা। প্রতি দিন কিছুটা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো অনন্যার দিকে। প্রথম প্রথম বিরক্ত বোধ করলেও যখন দেখল লোকটা তাকে কোনো প্রকার বিরক্ত করছে না তাই অনন্যা আর পাত্তা দেয় নি ব্যাপারটা। পাশের বাসায়ই তো থাকে তাই তাকাতেই পারে এটা স্বাভাবিক।

হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পরে যেতে নিলেই অনন্যার হাতের কব্জির দিক শক্ত করে ধরে ফেলে শুভ্র। অনন্যাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে বললো-

—”এতো বড় হয়ে গেছেন এখনো কি ঠিক মতো দেখেশুনে চলতে পারেন না!!”

অনন্যা চুপ করে আছে কিছু বলতে পারলো না। আজ শুভ্রর এমন আচরণে বার বার চমকে যাচ্ছে অনন্যা। অনন্যাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে রাগে গর্জে উঠলো শুভ্র। ধমকের স্বরে বললো-

—”কথা বলছেন না কেন?? বোবা হয়ে গেছেন না-কি!!”

অনন্যা ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলো শুভ্রর মুখে এমন ধমক শুনে। পরক্ষণেই ভয়টাকে দমিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নরম গলায় বললো-

—”আপনি রেগে যাচ্ছেন। আর এই মুহূর্তে আপনাকে খুব অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে।”

শুভ্র নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করলো। এই অদ্ভুত মেয়েটা সব সময় যা বলার মুখের উপর সরাসরি বলে দেয়। শুভ্র নিরাশ হয়ে শান্ত গলায় বললো-

—”এসে পরেছি আমরা। আপনি বাসায় যান।”

অনন্যা চুপচাপ বাসার ভিতর চলে গেল। আর শুভ্র ছাতাটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পানিতে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে। মেঘ থেকেই তো বৃষ্টির পানি গুলো উপহার হয়ে আসে তাই তো বৃষ্টি শুভ্রর এতো প্রিয়। শুভ্র এবার নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে যেভাবেই হোক এই অদ্ভুত মেয়েটাকে সে নিজের করেই ছাড়বে। শুভ্রর সাথে মেঘের ভালোবাসা হবেই…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here