শুভ্রমেঘের_ভালোবাসা,পর্বঃ২
Saiyara_Hossain_Kayanat
“ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড় দিয়ে তোমার গাল গুলো লাল করে দেই বেয়াদব মেয়ে।”
শুভ্রর এমন হুংকার দিয়ে কথা বলা শুনে অনন্যা যতটুকু সাহস জুগিয়ে ছাদে এসেছিলো তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। ভয়ে কাচুমাচু করছে অনন্যা এই লোকটাকে আগে ভয় না লাগলেও আজ প্রচন্ড রকমের ভয় লাগছে।
শুভ্র আবারও ধমকে বলে উঠলো-
—”কয়বার কল দিয়েছে তোমাকে?? রিসিভ করনি কেন?”
কিছুক্ষণ আগে অনন্যা নিজের রুমে বসে ছিল তখনই তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। অনন্যা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার তাই তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ফোন যখন পর পর তিন চার বার বেজে উঠলো তখনই অনন্যা বুঝে গিয়েছিলো এটা শুভ্রই হবে। তাই সে পরের বার ইচ্ছে করেই কেটে দিয়েছিল। ফোন কাটার সাথে সাথেই স্কিনে একটা হুমকিস্বরূপ মেসেজ ভেসে উঠলো।
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাদে না আসলে এর শাস্তি কাল অবশ্যই আপনি পাবেন।”
আজ শুভ্রর এমন রাগী ব্যবহার দেখে এমনিতেই অনন্যা কিছুটা ভয় পাচ্ছে তাই বাধ্য হয়েই ছাদে চলে গেল। কিন্তু ছদে এসে শুভ্রদের বাসার ছাদে তাকিয়ে অন্ধকারে তেমন কাউকেই দেখতে না পেয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো শুভ্র অনন্যাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার দিকে তাকাতেই বাঘের মতো গর্জে উঠেছে।
অনন্যা নিজের মনে সাহস জুগিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললো-
—”আসলে আপনি তো কখনো আমকে এর আগে কখন কল দেননি তাই অপরিচিত নাম্বার ভেবে রিসিভ করিনি।”
শুভ্র কর্কশ গলায় বললো-
—”আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি বুঝতে পেরেছিলে আমি কল করেছি।”
অনন্যা কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভেবে শান্ত গলায় বললো-
—”আপনি আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলছেন খেয়াল আছে!!”
—”কেন কোনো সমস্যা আছে তুমি করে বললে??”
অনন্যা আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে বললো-
—”আমাদের মধ্যে তো তেমন কোনো পরিচয় বা সম্পর্ক নেই যে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন তা-ই বললাম।”
অনন্যার এরকম কথায় শুভ্র ভড়কে উঠলো। রাগ যেন তরতর করে মাথায় উঠে গেল। প্রায় দশ এগারো বছর ধরে এই মেয়েকে চিনে সে। তারপরও এই কথা কিভাবে বলে এই মেয়ে!!! শুভ্র অন্য দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো-
—”এক্ষুনি নিচে যান আপনি। আর এক মিনিটেও যেন আমার সামনে এই মুহূর্তে আপনাকে না দেখি। আমি চাই না রাগের মাথায় আপনাকে কিছু একটা বলে ফেলি।”
শুভ্রর এমন কথায় অনন্যা কিছুটা অপমানিত বোধ করলো। তাই চুপচাপ নিচে চলে গেল আর শুভ্রও ছাদের রেলিং টপকে তাদের ছাদে চলে গেল। ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে অনন্যার কথা। ঠিক এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে দেখেছিল অনন্যার ভিতর লুকানো আরেকটা অনন্যাকে।
রুমে বোরিং লাগছিলো তাই শুভ্র ছাদে এসেছিল। ছাদে পা রাখতেই কারও খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনে শুভ্র কিছুটা ভ্রু কুচকে আসেপাশে তাকাতেই দেখলো। পাশের ছাদে অনন্যা তার মামানি আর মামাতো ভাই সাইফের সাথে ছুটোছুটি করে খেলছে আর খিলখিল করে হেসে উঠছে। এই মেয়েটাকে এভাবে মনপ্রাণ খুলে হাসতে দেখে যেন শুভ্রর নিজের চোখকেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে অনন্যা দিকে। প্রায় তিন বছর পর অনন্যাকে এভাবে হাসতে দেখছে। তাহলে কি এই মেয়েটা বাহিরের সবার সামনে নিজেকে গম্ভীর করে রাখে!!!
অনন্যার মামানি শুভ্রকে দেখে সামনে গিয়ে বললো-
—”আরে আধাঁর কেমন আছো?”
মামানির কথা শুনে অনন্যা শুভ্রকে খেয়াল করতেই মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। চুপচাপ কিছু না বলে সাইফকে কোলে তুলে নিয়েই নিচে চলে গেল।
সেদিনই অনন্যা জেনেছিল এই লোকটার নাম আধাঁর। এর আগে কখনো জানা হয়নি বা জানতে চায়নি।
————————
অনন্যা ছাদ থেকে নিজের রুমে এসে ভাবতে লাগলো শুভ্র এমন অদ্ভুত রকমের আচরণের কথা। লোকটা কি নিজের রূপ গিরগিটির মতো করে বদলায় না-কি!! ওনার নামের মতো এখন ওনাকেও খুব অদ্ভুত লাগছে অনন্যার।
অনন্যা ক্লাস নাইনে তখন থেকে তার দুইটা ফ্রেন্ডের সাথেই মাঝে মাঝে স্কুলে যেত। স্কুলে যাওয়ার মাঝ পথেই শুভ্র আর কয়েকজন ছেলেকে দেখে তার ফ্রেন্ড মিম তাদের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে আবার ফিরে আসলো। মিম সেদিন বলেছিলো শুভ্র নাকি তার ভাইয়ের বন্ধু হয়। অনন্যা মিমের কাছেই সেদিন শুনেছিল এই লোকটার পুরো নাম শুভ্র এহসান আধাঁর। নামটা শুনে অনন্যা খানিকটা অবাক হয়েছিল। শুভ্র মানে সাদা বা উজ্জ্বল আর আধাঁর মানে হলো অন্ধকার। একই মানুষের নামের অর্থ উজ্জ্বল আর অন্ধকার কি করে হয়!!! খুবই অদ্ভুত লেগেছে অনন্যার কাছে।
————————
“আকাশে তাকিয়ে দেখুন তো কতো সুন্দর শুভ্র মেঘের খেলা হচ্ছে। নাহহ… খেলা না ভালোবাসার ছড়াছড়ি। হ্যাঁ এটাই হবে শুভ্রমেঘের ভালোবাসা।”
ভার্সিটি যাওয়া পথে আচমকা পেছন থেকে এমন কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো অনন্যা। পিছন ফিরে তাকাতেই শুভ্রকে এতোটা কাছে দেখে অনন্যা চমে উঠে খানিকটা পিছিয়ে গেল। অনন্যা শুভ্রর দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো-
—”খানিকটা সময় গেলেই শুভ্র মেঘের খেলা কালো মেঘে পরিবর্তন হয়ে আধাঁর নেমে আসবে।”
অনন্যার কথায়া শুভ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটতে শুরু করে বললো-
—”আকাশে শুভ্র মেঘে ঢেকে থাকুক কিংবা কালো মেঘে আধাঁর নেমে আসুক না কেন। মেঘের সাথে কিন্তু শুভ্র আর আধাঁর-ই মানায়।”
শুভ্রর কথার মানে অনন্যা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। অনন্যা কিছু বললো না চুপ করে হেঁটে যাচ্ছে। কারও মুখেই কোনো শব্দ নেই আছে শুধু নিরবতা। বেশ কিছুটা পথ চুপচাপ হাঁটার পর শুভ্র নিরবতা ভেঙে শান্ত গলায় বললেন-
—”কি ভেবেছিলেন মেঘ!! এই শুভ্র তার মেঘের পিছু ছেড়ে দিবে!! যদি এমনটা ভেবে থাকেন তাহলে সেটা আপনার ভুল ধারণা। যত তারাতাড়ি সম্ভব নিজের ধারণাটা পালটে নিন। শুভ্র তার আকাশের এই অনন্য মেঘের পিছু কখনো ছাড়ছে না।”
অনন্যা শুভ্র দিকে না তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো-
—”কেন নিজের সময় নষ্ট করছেন আপনি?? আমি আপনাকে অনেক আগেই না করে দিয়েছি শুধু শুধু ব্যর্থ চেষ্টা করতে।”
শুভ্র দুষ্টুমি করে একটা হাসি দিয়ে বললো-
—”আচ্ছা প্রেম ভালোবাসা বা ছেলেদের নিয়ে আপনার এতো কিসের প্রব্লেম?? বাই এনি চান্স তুমি কি মেয়েদের….. ”
শুভ্র এমন কথা শুনে অনন্যা বিস্ফোরিত নয়নে মাথা তুলে চোখ বড় একটা করে শুভ্রর দিকে তাকালো। ক্ষিপ্ত হয়ে রাগী কন্ঠে বললে উঠলো অনন্যা-
—”ছিঃ ছিঃ কি সব অসভ্যের মতো আজে বাজে বকছেন আপনি!! আপনি তো আগে এমন ছিলেন না। অনন্যা এই মুহূর্তে আপনার উপর প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে আছে। আপনার সাথে কথা বলার একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি আসছি।”
এই বলেই অনন্যা চলে গেল। আর শুভ্র হাসতে হাসতে তাকিয়ে আছে অনন্যার যাওয়ার পথের দিকে। অনন্যার মুখের উপর বিরক্তি প্রকাশের স্বভাবটা বরাবরই শুভ্রর খুব পছন্দের। এই মেয়েটা সবার থেকে একদমই আলাদা অদ্ভুত। এক অদ্ভুত রকমের অনন্য মেঘ… শুভ্রর অনন্য মেঘ।
—————————
ভার্সিটি আসতেই হাবিবা আর সানিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনন্যা তাদের কাছে এগিয়ে গেল। তাদের সামনে যেতেই সানিয়া অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
—”কেমন আছিস জানু?? কতদিন পর তোদেরকে দেখলাম। অনেক মিস করেছি তোদের।”
অনন্যার মাথায় এখনও শুভ্রর কথা ঘুরছে তাই সানিয়া কে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো-
—”দূরে যা সর। আর আমাকে এইসব জানুটানু বলবি না অসহ্যকর লাগে।”
সানিয়া আর হাবিবা একে অপরকে দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে একসাথেই জিজ্ঞেস করলো-
—”কেন?? তোর আবার কি হলো হঠাৎ করে??”
অনন্যা কিছু বলতে না চাইলেও এদের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে শুভ্রর কথা বলে দেয়। আর এইসব শুনে ওরা দু’জনই প্রচন্ডভাবে চমকে আছে। হাবিবা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকয়ে বললো-
—”তুই নিশ্চয়ই সপ্নে শুভ্র ভাইয়াকে দেখেছিস। তা না হলে উনি তো এমন ব্যবহার করার মতো মানুষ না। যতটা আমরা চিনি উনি খুবই শান্তশিষ্ট ভদ্র স্বভাবের একটা ছেলে।”
সানিয়াও হাবিবার কথায় সায় দিয়ে বললো-
—”হাবিবা একদম ঠিক বলছে অনি।”
অনন্যা জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো-
—”তোদের কথায় রাগে আমার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে। কথা বলবি না আমার সাথে যা এখান থেকে।”
অনন্যার কথায় পাত্তা না দিয়ে সানিয়া হাবিবাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
—”অনন্যার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এবার আর অনন্যার রেহাই নেই হাবিবা। আর কোথায় পালিয়ে যাবি অনি!!”
কথাটা বলেই দুইজন একসাথে হেসে উঠলো। আর অনন্যা বিরক্তি নিয়ে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
———————
প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসে আছে অনন্যা মাথা নিচু করে। আর কিছুটা দূরেই শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে অনন্যার দিকে আর মিটমিট করে ঠোঁট চেপে হাসছে। অনন্যাকে এভাবে অস্বস্তিতে কাচুমাচু করতে দেখেই তার এমন হাসি পাচ্ছে। মজা পাচ্ছে খুব আজ তার আনন্দ হচ্ছে অনন্যা এভাবে দেখে।
চলবে….