শুভ্রমেঘের_ভালোবাসা,পর্বঃ৩
Saiyara_Hossain_Kayanat
“আমি আপনাকে ভালোবাসি মেঘ। আমি জানি আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না তবুও বলছি আমি আপনাকে ভালোবাসি মেঘ। তাড়াহুড়ো নেই ভেবে চিন্তেই উত্তর দিয়েন।”
এই কথা বলেই শুভ্র আমার হাতে লাল গোলাপ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি একই জায়গায়। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি মেয়েকে এতো গুলো মানুষের মাঝে কিভাবে ভালোবাসার কথা বললো শুভ্র!! মনে মনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই স্কুলের অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত। শুধু মাত্র আমার কয়টা ফ্রেন্ডই খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। আমি চুপচাপ বাসায় এসে পরলাম তেমন কোনো পাত্তা দেইনি এই বিষয়টাকে।
সেদিনের পর থেকেই শুরু হয়েছে শুভ্রর ভালোবাসা প্রকাশ করা। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা হুটহাট করে ফুল দিয়ে ভালোবাসি বলা। আর প্রতিবারই আমার করা প্রত্যাখ্যান হাসি মুখে মেনে নেয়া এটাই তার নিয়মিত রুটিন। আচ্ছা এই লোকটা কি কখনো হার মানবে না!!!
হঠাৎ করেই হাসাহাসির শব্দে আমার ধ্যান ফিরলো। পাশে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়া, আম্মু, আব্বু, শুভ্র আর ওনার বাবা-মা সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ওনাদের এই বাসায় আসার মূল কারণ হলো শুভ্র। উনি এতো দিন পর দেশে ফিরেছে এই কারনেই সবাই মিলে ছোটখাটো একটা আড্ডার আসর বসিয়েছে।
এদের মাঝে বসে থাকা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর আর অস্বস্তি লাগছে তাই আমি ছাদে চলে আসলাম। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বসে পরলাম দোলনায়া। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে হয়তো বৃষ্টি নামবে। চোখ বন্ধ করে এই শীতল পরিবেশটা অনুভব করছি খানিকটা সময় যেতেই পাশ থেকে একটা শান্ত গলার স্বর ভেসে আসলো-
—”আমি মেঘ ভালোবাসি আর তার সাথে এই অন্ধকার গুমোট পরিবেশটাও।”
আমি কিছু বললাম না চুপ করেই সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। শুভ্র আমার সামনে এসে দাড়িয়ে আমার দিক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। ওনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম-
—”এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
উনি কিছুটা ভাবুক হয়ে বললেন-
—”দেখছি তোমার মুখের কোথাও তালা লাগানো আছে কি না। সব সময় তো তোমার মুখ আটকানোই থাকে তাই একটু চেক করছিলাম।”
—”এখানে কি এসব বলতে এসেছেন?”
—”নাহ.. একটা কথা জানতে এসেছি।”
—”কি কথা তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।”
—”না মানে আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। আচ্ছা তুমি কি করলা খেতে খুব বেশি পছন্দ কর অনন্য??”
আমি এবার বিরক্ত হয়ে কর্কশ গলায় বললাম-
—”কি সব কথা বলছেন!! এখানে করলার কথা আসলো কেন??”
—”আসলে তোমার কথা গুলো না অনেক তিতা তিতা তাই আরকি জিজ্ঞেস করলাম।”
ওনার কথা শুনে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। দৃষ্টি অন্য দিকে দিয়ে নরম গলায় বললাম-
—”আপনি যে দিন দিন খুব অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন জানেন?? খুব অদ্ভুত রকমের কথা বলেন এখন। বিদেশ থেকেই কি এমন হয়ে হয়েছেন নাকি??”
শুভ্র মনে মনে হাসলো অনন্যার কথায়। কিন্তু উপরে গম্ভীর মুখ করে বলল-
—”কিছু কিছু ঘাড়ত্যাড়া মানুষের সাথে সব সময় নম্রতার সাথে ব্যবহার করা যায় না।”
অনন্যা কিছু বললো না সব সময়ের মতো এবারও চুপচাপ কথা গুলো এড়িয়ে চলে গেল। শুভ্র মনে মনে বললো-
—”এই মেয়ের কি ছোট থেকেই কি ঘাড়ত্যাড়া না-কি আজব!! কোনো কথার পাত্তা না দিয়ে চলে গেল বেয়াদব। উফফফ…এই মেয়েটার মাথায় যে কেন প্রেম ভালোবাসা নিয়ে এতো নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা!!”
————————
“ভাইয়া এই সন্ধ্যায় ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন??”
অনন্যার ভাই শাকিল পিছন ফিরে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো-
—”এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি। তুই এখানে কি করছিস!!”
—”আমার কাছে কথা লুকাচ্ছিস কেন ভাইয়া!! আমি জানি তোর মন খারাপ হলেই তুই এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকিস।”
ভাইয়া আমার মাথায় টোকা দিয়ে বললো-
—”এতো বেশি বুঝতে হবে না তোকে পাকনি।”
আমি ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে রেলিং হেলান দিয়ে শান্ত গলায় বললাম-
—”এখনো ওই মেয়েটার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিস কেন বল তো!! যে মেয়ে তোকে ধোকা দিয়ে না জানিয়েই অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেললো তবুও কেন তুই তার জন্য মন খারাপ করে থাকিস??”
ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
—”কারন আমি তো ভালোবাসার নাটক করিনি। আমি মন থেকেই ওকে চেয়েছিলাম তাই এখনো ভুলতে পারছি না।”
—”আসলে এখানে তোর দোষ নেই সব দোষ হলো ভালোবাসার। ভালোবাসলেই মানুষ কষ্ট পায়।”
—”ভুল বললি অনি.. মানুষ ভালোবেসে কষ্ট পায় না বরং ভুল মানুষকে ভালোবাসলেই কষ্ট পায়।”
—”আমি ঠিকই বলেছি ছোট মামাকে দেখ ভালোবেসেই তো বিয়ে করছিলো। তাহলে তার সংসারে কেন সব সময় ঝামেলা লেগে থাকে!! কেন ছোট মামা সব সময় মন খারাপ করে থাকে?”
শাকিল ভ্রু কুচকে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো-
—”চুপ থাক তো অনি। এতো পাকনামি করিস না মাথা থেকে এসব আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেল।”
—”তুইও শুধু শুধু ওই মেয়ের জন্য মন খারাপ করে না থেকে আমাদের সাথে সময় কাটাতে পারিস। আমাদের ভালোবাসা কি তোর জন্য যথেষ্ট না!!! এখন বুঝবি না যখন থাকবো না তখন ঠিকই বুঝবি।”
শান্ত গলায় অনন্যার মুখের এতো কঠিন একটা কথা শুনে শাকিলের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো –
” আসলেই তো আমার জন্য কি আমার ফ্যামিলির সবার এতো ভালোবাসার চেয়ে ওই কালো অতীতটাই গুরুত্বপূর্ণ!! কেন আমি এতো দিন এতো গুলো মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করে এই অতীত নিয়ে পরে আছি। সত্যিই যদি এই মানুষ গুলো আমার সাথে না থাকে তখন কিভাবে থাকবো!! নাহহহ এই মানুষ গুলো ছাড়া তো আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। আর এই পাকনিটাকে ছাড়া তো একদিনও থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে।”
শাকিল নিজেকে সামলিয়ে অনন্যার কাধে হাত রেখে বললো-
—”হয়েছে হয়েছে দাদিমা আর জ্ঞান দিতে হবে না। চল বাহির থেকে আইসক্রিম খেয়ে আসি।”
অনন্যা আইসক্রিমের কথা শুনে খুশি হয়ে শাকিলের সাথে চলে গেল।
———————
বর্ষাকালের এই একটাই সমস্যা প্রয়োজনের সময়ই একদম আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসে। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বের হতেই হঠাৎ করে এমন ভারি বৃষ্টি শুরু হলো। একটা খালি রিকশাও দেখছি না। বাসার নিচে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছি রিকশার জন্য। আজ যদি ক্লাস টেস্ট না হতো তাহলে বারান্দায় বসে বসেই ভালো একটা মুডে নিয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে পারতাম। বৃষ্টির মধ্যে বাহিরে যাওয়া খুবই বিরক্তিকর মনে হয় আমার।
বেশ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা খালি রিকশা দেখতে পেলাম। দূর্ভাগ্যবশত আমি ডাক দেওয়ার আগেই শুভ্র ভাই ওনার বাসার সামনে রিকশা থামিয়ে সাথে সাথেই উঠে পরলেন। উনি হয়তো অফিসে যাচ্ছেন। রিকশাটা আমার সামনে আসতেই শুভ্র থামাতে বললেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
—”অনন্য রিকশা উঠে পরো আমি অফিসে যাওয়ার পথে তোমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিব।”
—”নাহ.. আপনি চলে যান আমি আরেকটা রিকশা নিয়ে যেতে পারবো।”
—”চুপচাপ কোনো কথা না পেচিয়ে রিকশায় উঠে পরো। আমার অফিসের দেরি হচ্ছে এখন তোমার সাথে তর্ক করতে পারবো না।”
শুভ্র কিছুটা ধমকের স্বরেই বললো কথাটা। আমারও দেরি হয়ে যাচ্ছে আর কোনো রিকশাও দেখছি না তাই বাধ্য হয়ে ওনার সাথেই রিকশায় উঠে পরলাম।
চলবে….