শুভ্রমেঘের_ভালোবাসা,পর্বঃ৪

0
1526

শুভ্রমেঘের_ভালোবাসা,পর্বঃ৪
Saiyara_Hossain_Kayanat

“কাছে আসো অনন্য।”

আচমকা শুভ্রর মুখে এমন কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম তার দিকে। এবার উনি শক্ত গলায় বললেন-

—”রিকশা থেকে পরে গেলে হাত পা ভাঙবে তাই বলছি এদিকে চেপে বসো। আমি তো আর তোমাকে খেয়ে ফেলবো না তাই না।”

ওনার কথা শুনে একটু ওনার দিকে চেপে বসলাম তবে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। শুভ্র ওনার বা হাত আমার সামনে দিয়ে এনে আমার সাইডের রিকশার হুডিটা ধরে আছে। ছোটবেলা আব্বুর সাথে রিকশায় উঠলে আমি যেন পরে না যাই তাই আব্বু এভাবে ধরে বসতো। আমি কি এখনো ছোট নাকি যে শুভ্র এভাবে হাত রেখেছে!! এই মুহূর্তে খুব অস্বস্তি লাগছে আমার। শুভ্র আমাকে এভাবে কাচুমাচু করতে দেখে বললেন-

—”কি হলো এমন কাচুমাচু করছো কেন??”

আমি কিছু বললাম না মাথা নিচু করে শুধু হাত কচলাচ্ছি। উনি এবার ধমকে বললেন-

—”কথা বলছো না কেন?? হাত না কচলিয়ে মুখে বলো অস্বস্তি লাগছে তোমার।”

আমি এবার আমতা-আমতা করে বললাম-

—”আসলে এর আগে কখনো অপরিচিত ছেলের সাথে রিকশায় উঠিনি তাই খুব অস্বস্তি লাগছে আমার।”

শুভ্র উচ্চস্বরে হাসলেন আমার কথা শুনে। পরক্ষণেই হাসিটা থামিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললেন। হঠাৎ এমন করার কারন বুঝতে পারলাম না আমি। শক্ত গলায় উনি বললেন-

—”মামা রিকশাটা এখানেই থামিয়ে দিন।”

রিকশা থামার সাথে সাথেই উনি বৃষ্টির মধ্যেই নেমে গেলেন রিকশার ভাড়া দিয়ে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে টেনে রিকশা থেকে নামিয়ে হাটা শুরু করলেন। ওনার এমন কাজে আমি থমকে গেলাম কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। বৃষ্টিতে ভেজে পুরো ভেজা কাকের মতো হয়ে যাচ্ছি। আমি কিছুটা নিম্নস্বরে বললাম-

—”কি করছেন আপনি?? আমি ভিজে যাচ্ছি তো এভাবে কলেজে যাবো কিভাবে??”

উনি কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলেন-

—”যেতে হবে না কলেজে।”

এই কথা বলে আবারও হাত শক্ত করে ধরে টেনে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে উনি। এবার আমি রেগে এক ঝটকায় হাত ছড়িয়ে বললাম-

—”ছাড়ুন আমার হাত। আর কি বলছেন এসব কলেজে যেতে হবে না মানে কি!! আমার ক্লাস টেস্ট আছে আজ।”

উনি আমার রাগ পাত্তা না দিয়ে আগের মতো রাগী কন্ঠেই বললেন-

—”ক্লাস টেস্ট না দিলেও কিছু হবে না। চল আমার সাথে।”

—”যাবো না আমি আপনার সাথে কোথাও”

এই কথা বলে পিছন ফিরে এগিয়ে যেতেই আবারও আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। হাত ছাড়ানো চেষ্টা করেও পারলাম না। বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের অবস্থা একাকার হয়ে গেছে। কিছুটা পথ যেতেই খেয়াল করলাম উনি আমার স্কুলে নিয়ে এসেছেন। স্কুলের মাঠে এসেই আমার হাত ছেড়ে দিলেন। বৃষ্টির জন্য আসেপাশে মানুষ নেই বললেই চলে। আমি রেগেমেগে বললাম-

—”এখানে নিয়ে এসেছেন কেন আমাকে?”

উনি কোনো উত্তর দিলেন না চুপ করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি এখন কিছুটা কমে গেছে তবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে পুরো শরীর বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় হাল্কা বাতাসেই কেপে উঠছি বার বার। উনি কিছুটা সময় চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন-

—”দশ এগারো বছর পাশাপাশি বাসায় থেকেও কি আমি তোমার পরিচিত কেউ হতে পারিনি অনন্যা? আচ্ছা সেটা বাদ দিলাম এতোটা বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসার পরেও কি তোমার মনে একটু জায়গায় করতে পারিনি?? আমি কি এতোটাই খারাপ অনন্য?? এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তোমাকে প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছিলাম। আমি জানতাম তুমি রাজি হবে না তবু্ও চেয়েছি তোমার মনে কিছুটা হলেও আমার জন্য অনুভূতি সৃষ্টি করতে।”

আমি কিছু বললাম না চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। উনি আবারও বললেন-

—”যখন ছোটবেলা এতো বড় চুলে দুই বেনি করে হেলেদুলে স্কুল যেতে তখনই আমাকে তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছো তুমি। হঠাৎ করে তোমার গম্ভীর হয়ে যাওয়া, তোমার ভিতর লুকানো সেই হাসিখুশি অনন্য সব কিছুর প্রতিই আমি আকৃষ্ট হয়েছি। বার বার তোমাকে ভালোবাসা কথা বলে প্রত্যাখ্যান হয়েও হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। কখনো তোমাকে কোনো কিছুর জন্য জোর করিনি, কখনো তোমার দিকে খারাপ নজরেও তাকাইনি তবুও কেন আমি এখনো তোমার কাছে শুধু মাত্র একজন অপরিচিত ছেলে হিসেবেই রয়ে গেলাম?? আমি চলে যাওয়ার আগে খুব করে চেয়েছিলাম তুমি এসে বলবে তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছ তবে না এই তিনটি বছরের একবারও আমার সাথে যোগাযোগ করো নি। সত্যি আমি আজ ব্যর্থ হয়ে গেলাম তোমার মনে নিজের জন্য একটু জায়গায় করতে।”

শুভ্র শেষের কথা গুলো বেশ জোরে জোরেই বললেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম-

—”আপনার মনে আছে আমাদের এলাকার একটা বড় আপু একজনকে ভালোবেসে প্রতারিত হয়ে গলায় ফাসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন!! সেদিন ভুলবশত তার লাশটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। তারপর থেকে নিজের অজান্তেই কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি। আমার ছোট মামা ভালোবেসে বিয়ে করার পর যেন ওনার মুখ থেকে হাসিটা-ই গায়েব হয়ে গেছে। ভাইয়াকে একজন ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ভাইয়াকে না জানিয়েই অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে। আমার ভাইয়াটাও এখন আর আগের মতো নেই। এইসব কিছু কেন হয়েছে জানেন?? ভালোবাসা নামক অভিশাপের জন্য।”

শুভ্র চুপচাপ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার কথা শুনছে। আমি কিছুটা থেমে আবারও বললাম-

—”আমি জানি আপনি খুব ভালো একজন মানুষ। কখনো আমার দিকে বাজে নজরে তাকানি, বাজে ব্যবহার করেন নি। হয়তো আমার দেখা খুব ভালো একজন মানুষ আপনি। তবুও আমি এইসব সম্পর্কে জড়াতে চাই না। আর যাইহোক প্রেম ভালোবাসা আমাকে দিয়ে হবে না শুভ্র। প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক কখনো মানুষকে হাসিখুশি থাকতে দেয় না।”

শুভ্র কিছুটা সময় চুপ থেকে খুব শান্ত গলায় বললেন-

—”ঠিক আছে অনন্য তোমার কথাই আমি মেনে নিলাম। এইসব প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কে তোমাকে জড়াতে হবে না। ধন্যবাদ তোমাকে… নিজের মনে কথা গুলো আমাকে বলার জন্য। আমি আর কখনো বিরক্ত করবো না তোমাকে এইসব বলে। এখন বাসায় চলো পুরো ভিজে গেছো তুমি। বেশিক্ষন এভাবে থাকলে তোমার জ্বর আসবে।”

আমরা একসাথেই বাসায় এসেছি তবে কেউ কারও সাথে কোনো কথা বলিনি। ওনার এমন চুপ থাকাটা কেন যেন আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি না চাইতেও ওনাকে বার বার কষ্ট দিচ্ছি। তবে আমার তো কিছু করার নেই। পারছি না আমি মাথা থেকে এসব কিছু বের করতে। উনি ভালবাসার কথা বললেই আমার মাথায় এইসব আজে বাজে চিন্তা গুলো ঘুরপাক খায়। আমি ভাবতেই পারি না ওনার সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানোর কথা। তবে উনি ব্যর্থ হয়নি সেটা আমি জানি।

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু সকাল সকাল আম্মুর চিল্লাচিল্লিতে ঘুম থেকে কিছুটা ভয়ে আঁতকে লাফিয়ে উঠলাম। ঘুমের মধ্যে এতো জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকার কি আছে!! কারও কিছু হয়েছে নাকি!! বাহির থেকেও কেমন মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। কখনো তো সকালে এমন হয় না। আম্মু আবারও আমার নাম ধরে চেচিয়ে ডেকে উঠলো। আমি কিছুটা ভয়ে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বাহিরে গেলাম।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here