শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা,০৪,০৫

0
556

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা,০৪,০৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
০৪

বোনের এমন দূর্ঘটনার কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ে ফয়জান।সে যে কলেজে অধ্যাপনা করে সেটা বাসা থেকে বেশ দূরে হওয়ায় সেখানে রামিশা কে ভর্তি করায় নি ফয়জান। এখন বাসার কাছাকাছি কলেজ হ‌ওয়া সত্তেও একি মুছিবত! আজকাল মেয়েদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড্ড অভাব রয়েছে।

কায়েস সবকিছু শুনে বললো,
-” তায়েস তো ঐ রোড দিয়ে অফিসে যাতায়াত করে রামিশা কে না হয় তায়েস নিয়ে যাবে। কিন্তু আসার সময় কি হবে?

তায়েস বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। কেননা রামিশা কে সে কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না। কেমন দর্শিপনা মেয়ে একটা। ফয়জান আর ফাইজার বোন এরকম অগোছালো এলোমেলো টাইপের বোন কি করে হয়?তা মাথায় আসে না তায়েস এর।তায়েস বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,
-“তোমরা অজ্ঞতা দুশ্চিন্তা করছো। আমার মনে হয় ছেলে গুলো এখন পর্যন্ত সুস্থ সবল আছে কিনা সন্দেহ!যদি ঠিকানা জানা থাকতো তাহলে আমি একবার ফলমূল নিয়ে দেখে আসতাম ছেলে গুলো কে।

এ কথা শুনে রামিশা তেতে উঠল। বললো,
-” বড় মা তোমার ছেলে কি বলে শুনছো? তোমার ছোট ছেলে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্য এছাড়া ঘরের শত্রু বিভীষণ!

আয়েশা ও কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললেন,
-“তোর বোন কে ছেলে গুলো ইফ’টিজিং করেছে আর তুই সেই ছেলে গুলোর হয়ে কথা বলছিস?

রামিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-” তোমার ছোট ছেলেকে আমি ভাই হিসেবে মানি না বড় মা।একটা রাজাকার কখনো আমার ভাই হতে পারে না!

তায়েস শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-” আমার যেন বয়েই গেছে তোমার ভাই হতে?
-” আমি কি বলেছি আমার ভাই হবেন?ভাই হবেন?যত্তসব ফাউল মার্কা লোক!
-“বেয়াদব মেয়ে বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না কিছু না। আচ্ছা ফাইজা আপু তোমরা একে লন্ডন থেকে কুড়িয়ে এ দেশে কেন নিয়ে এসেছো?

তায়েসের শেষার্ধ কথায় ফয়জান আর ফাইজা হাসে। এদিকে আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো রামিশা। তায়েস কে আরো কিছু কথা শুনাতে মুখ খুলবে তার আগেই ধমকে উঠে শফিক মাহমুদ বললেন,
-“চুপ!একদম চুপ। একটা বিপদের মধ্যে অহেতুক ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। কোথায় সমস্যা সমাধান করবে তা নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তায়েস প্রতিদিন তোমার বাইকে করে রামিশা কে কলেজ পৌঁছে দিবে আর আমি না হয় ছুটি হলে গিয়ে নিয়ে আসবো।

তায়েস এ কথা শুনে রেগে উঠে চলে গেল। বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তার।যদিও শফিক মাহমুদ সহ সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো কিন্তু কিছু বললো না।
ফয়জান বললো,
-“বড় বাবা আপনি কষ্ট করে কেন যাবেন?ফাইজা নিয়ে আসলেই তো হবে।

ফাইজা চিন্তিত মুখে বললো,
-“ভাইয়া আমি তো ঐ সময় আমার কর্মক্ষেত্রে থাকবো।

শফিক মাহমুদ বললেন,
-” হুম তাই তো ফাইজা তো বাসায় থাকে না তখন।আর কোন কথা না। আমার ছোট মেয়েকে আমি ই গিয়ে আনবো।

রামিসা খুশিতে আপ্লুত হয়ে শফিক মাহমুদ এর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
-“তুমি ছাড়া আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না বুঝছো? লাভ ইউ বড় বাবা।
-“লাভ ইউ টু ছোট আম্মা।

জেঠা-বাসতির এমন নিবিড় সম্পর্ক দেখে সবাই মুচকি হাসে।
.
তাদের সম্পর্কটা বেশ মধুর।
শফিক মাহমুদ এর ছোট ভাইয়ের সন্তান ফয়জান,ফাইজা আর রামিসা।

তবে ভবিষ্যতে এই সম্পর্কটা ভিন্ন রুপে রুপান্তরিত হবে! শফিক মাহমুদ এর বড় ছেলে কায়েস মাহমুদ এর সাথে তার ছোট ভাই রুহুল আমিন এর বড় মেয়ে ফাইজা চৌধুরীর কে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা হবে ইনশা আল্লাহ।

বর্তমানে রুহুল আমিন এবং তার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে আছেন। ফয়জান, ফাইজা আর রামিসা তাদের কর্মক্ষেত্র এবং পড়াশোনার জন্য শফিক মাহমুদ এর বাসায় থাকে। তবে তাদের এপার্টমেন্ট এর কাজ চলছে খুব শীঘ্রই কমপ্লিট হলে তারা নিজেদের বাসায় শিফ্ট হবে। তখন কায়েস আর ফাইজার বিয়ের তারিখ ধার্য করা হবে।
.
.
রাতের খাবার খেয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ফাইজা। আকাশের দিকে তাকালেই কোরআন এর আয়াতের অংশা মনে পরে, শরীর শিউরে উঠে।
“আকাশের দিকে তোমার বার বার তাকানো আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি”।
[সূরা আল বাকারাহ-১৪৪]

“সুবহান আল্লাহ” বলে ফাইজা খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা করছে। গোলাকার আকৃতির চাঁদ জ্বলজ্বল করছে ঐ দূর আকাশে।তার আশে পাশেই কয়েকটি তাঁরা মিটিমিটি জ্বলছে।
ঢাকা শহর বলে গাছপালা খুব কম। না হয় গাছের শাখা প্রশাখার ফাঁকফোকরে স্নিগ্ধ শোভন চাঁদ কে আরো মোহনীয় লাগে দেখতে। যখন গাছের পাতা হাওয়ায় দোলে তখন আরো সুন্দর লাগে সেই দৃশ্য।

এর মাঝে গুন গুন করে ফাইজা গজল গায়,
“তোমার দুনিয়াতে আমি যেদিকে তাকাই,
অথ‌ই নেয়ামতে,ডুবে আছি সবাই।
পাখপাখালির গানে যেন তাসবিহ…

এতটুকু বলতেই রুম থেকে রামিসার বিচলিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে থেমে যায় ফাইজা। রুমে চলে আসে দেখার জন্য কি হয়েছে?
.
রামিসা পড়তে বসেছে তখন তার বান্ধবী নিদ্রার নাম্বার থেকে কল আসে।রামিসা কল রিসিভ করেই বললো,
-“নিহোনিয়াম এর পাগলী হঠাৎ আমাকে স্মরণ করার কারণ কি?

কলের ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,
-“তারমানে তুমিও ঐ ছেলের কথা জানো রামিসা? আমি ঠিক ধরেছি আমার মেয়ে একদম বকে গেছে।হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে! ইয়া আল্লাহ এমন মেয়ে পেটে নিয়েছি আমি যে তোমার আদেশ অমান্য করে হারাম সম্পর্কে জড়িয়েছে!

রামিসার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো বুঝতে যে নিদ্রার মা ফোন ধরেছেন। কিন্তু রামিসা বুঝতে পারছে না তিনি এসব কি বলছেন?তাই বিচলিত হয়ে ঝটপট বললো,
-“আন্টি আপনি শান্ত হোন প্লিজ। আমাকে একটু খুলে বলুন কি হয়েছে?

কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল।ফাইজা চোখে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে?রামিসা প্রথম থেকে সবটা খুলে বললো। সবটা শুনে দুই বোনের মধ্যে নিরবতা পালন চলছে। হঠাৎ রামিসা চিৎকার করে বললো,
-“হায় আল্লাহ! এখন কি হবে?

ফাইজা কিছু বলবে তার আগেই রামিসা দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। গিয়ে কায়েসের রুমের দরজায় কড়াঘাত করলো। কায়েস হাদীসের ব‌ই পড়ছে দরজায় কড়াঘাত শুনে বললো,
-“দরজা খোলা আছে ভেতরে আস।

রামিসা গিয়ে বললো,
-“ভাইয়া আমার সাথে একটু বাহিরে যেতে পারবেন?

হঠাৎ রামিসার আগমনে হকচকায় কায়েস!ব‌ই বন্ধ করে উঠে দাড়ালো। স্বাগতিক করে বললো,
-“রামিসা তুমি? আমি ভাবলাম মা এসেছে।তা এই রাতের বেলা বাহিরে বের হবে কেন?
-“যেতে যেতে বলবো ভাইয়া এখন তাড়াতাড়ি চলুন।

নরম মনের মানুষ কায়েস মাহমুদ।তাই না করতে পারলো না।রামিসা কে নিয়ে বের হলো গন্তব্য নিদ্রার বাসায়। নিদ্রার পরিবারের সদস্যরা খুবই ধার্মিক।নিদ্রার বাবা বিদেশে থাকেন আর মা ভাই বোন দাদু কে নিয়ে নিদ্রা ফ্লাট ভাড়া করে থাকে ঢাকায়। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল।
নিদ্রা পড়ার টেবিলে বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছিল তখন তার মা দেখে,
নিদ্রা খাতার মধ্যে “নিহোনিয়াম” লিখে পুরো খাতা ভরে ফেলছে। শুধু তাই নয় লিখেছে,
আই লাভ ইউ নিহোনিয়াম!
আই মিস ইউ নিহোনিয়াম!
নিহোনিয়াম তুমি জানো আমি তোমার জন্য হাজারো কথা মন’গহীনে জমিয়ে রাখছি একটু একটু করে।

তখন থেকেই শুরু হয় তুমুল ঝড়। নিদ্রা কিছুতেই বোঝাতে পারে না তার মা’কে।তাই শেষে না পেরে বললো,
-“তুমি রামিসা কে কল করে জিজ্ঞাসা করে দেখ।রামিসার কথা নিশ্চ‌ই বিশ্বাস করবে? দেখবে ও বলবে নিহোনিয়াম নামে আদৌও কেউ নেই।

কিন্তু হলো তার উল্টো।রামিসা প্রথমেই নিহোনিয়াম দিয়ে শুরু করে দিয়েছে। এখন রামিসা যাচ্ছে নিদ্রার মাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে।
.
.
বাসার কলিং বেল বাজাতে নিদ্রা দরজা খুলে রামিসা দেখে বললো,
-“আমি তোর কোন জন্মের শ’ত্রু রামিসা? তুই এভাবে মা’কে বলতে পারলি?

রামিসা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“আন্টি কোথায়?
-“আর কোথায় চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত।

রামিসা নিদ্রার মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
-“আন্টি আপনি যা ভাবছেন তা নয়।
নিহোনিয়াম হলো রসায়নের একটা মৌল।আর সেখান থেকেই নিদ্রা নিহোনিয়াম নিয়ে মজা করে। বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই।

নিদ্রার মা চোখ মুখ মুছে বললো,
-“তুমি সত্যি বলছো”?

রামিসা ভদ্রমহিলা কে আশস্ত করে বললো,
-“জ্বি আন্টি পাক্কা সত্যি”।
-“আচ্ছা মেহমান নিয়ে এসেছো বসো আমি তোমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করি”।
-“না আন্টি রাত বেড়ে যাচ্ছে এখন বাসায় যেতে হবে অন্য একদিন এসে খাবো।
-“তা কি করে হয় এভাবে খালি মুখে চলে যাবে না না একটু কিছু খেয়ে তবে যাও?

তারপর,রামিসা ভদ্রমহিলা কে বুঝিয়ে কায়েস কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো বাসায় ফিরে আসার জন্য। কায়েস বললো,
-“তোমার বান্ধবী আগে থেকেই হবু বরের নিক নেম ঠিক করে রেখেছে বিষয়টি খুব ইন্টারেস্টিং।

এর উত্তরে রামিসা হাসে।
পথে ফুচকার স্টল দেখে বায়না ধরে ফুচকা খাবে। কায়েস না করে না খেতে নিয়ে যায় আর সে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে।

কায়েস রামিসা কে দেখছে আর ভাবছে,
-“এই মুহূর্তে তুমি থাকলে সময়টা ভিশন সুন্দর কাটতো ফাইজা। জানি না তুমি আমাকে কেন এভোয়েড করে চলেছো। হয়তো নিজের অজান্তে আমি কোন ভুল করেছি। তবে আমার ভুল ধরিয়ে দিতে তাহলে তো আমি নিজেকে শুধরে নিতাম..
.
.
কিছুদিন পর,
রামিসা কে ইফ’টিজিং করা ছেলে গুলোর লা’শ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়না’ত’দন্তের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানায় তাদের পুরুষাঙ্গে আঘাত করে হ’ত্যা করা হয়েছে! কি আশ্চর্য কে করলো এমন কাজ? আবারো মিডিয়ায় এ নিয়ে তোলপাড় চলছে।

বাসায় প্রতিটি মানুষ থমথমে মুখে বসে আছে টেলিভিশন এর সামনে….

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

আচ্ছা কায়েস ভাইয়া মানুষ কেন বিয়ে করে?
-“মানুষ তার একাকিত্ব দূর করতে বিয়ে করে।
-“একাকিত্ব দূর করতে তো আব্বু-আম্মু, ভাইয়া সবাই আছে তাহলে?
-“বিয়ের মাধ্যমে মানুষ তার ছায়া সঙ্গিনী কে খুঁজে পায়,যে সব সময় তার সুখে-দুঃখে ছায়া হয়ে পাশে থাকে।
-“তাহলে চলো আমরা ও বিয়ে করি? আমিও তোমার ছায়া সঙ্গিনী হতে চাই কায়েছ ভাইয়া।
-“দূর পাগলি আমাদের কি বিয়ের বয়স হ‌য়েছে নাকি?
-“তাহলে কখন হবে আমাদের বিয়ের বয়স?
-“আমি হিসাব করে বলছি তোমাকে। এখন হলো তোমার বয়স এগারো আর আমার বয়স চৌদ্দ।আর বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আইন অনুযায়ী ছেলেদের বিয়ের বয়স একুশ আর মেয়েদের আঠারো।সে অনুযায়ী আমাদের যখন এই বয়স গুলো হবে তখন আমরা বিয়ে করতে পারবো।
-“আচ্ছা তাহলে আমাদের বিয়ের বয়স হলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে!কথা দাও? কি হলো কথা দাও কায়েস ভাইয়া? কথা দাও! কথা দাও!

শোয়া থেকে ধরফরিয়ে ওঠে বসে কায়েস। সেই ছোট্ট বেলার স্মৃতি গুলো বার বার স্বপ্নে এসে হানা দেয়!যে গুলো মনে পড়লে মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে আসে! কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে, ফ্রেস হয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। আজকে করোনা পরিস্থিতি কি অবস্থা দেখার জন্য টিভি চ্যানেল পাল্টাতে থাকে,সব চ্যানেলে যেন চলচ্চিত্রের উৎসব চলছে! এতে করে খুব বিরক্ত হয় কায়েস। তখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে আয়েশা, এসে বললো,
–“কায়েস?
ফয়জান ওর বোনদের নিয়ে দেশে আসছে!

টিভির দিকে পূর্ণ মনোযোগ নিবেশ করে কায়েস বললো,
–“মা কোন ফয়জান?
–“আরে তোর রুহুল আমিন চাচার ছেলে। মনে নেই তাদের কথা? অবশ্য মনে থাকবেই বা কি করে, তাঁরা যখন দেশে ছিল তুই তো অনেক ছোট ছিলি।

কায়েস এর সবার আগে ফাইজার কথা মনে পড়ে,যাকে সেই ছোট্ট বেলা কথা দেওয়ার সুযোগ হয়নি যে তাকে বিয়ে করবে! আয়শা আবার বলতে শুরু করে,
–“আমাদের সাথে তোর চাচাদের কিছু কারণে ঝামেলা হয়।এর মাস খানেক পর তারা স্বপরিবারে লন্ডন চলে যায়, তার পর ওখানেই বাসিন্দা হয়ে যায়। শোন ঢাকায় আমরা ছাড়া ওদের আপন বলতে আর কেউ নেই। তাই আমাদের বাসায় ই উঠবে।আর তোকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে ওদের আনার জন্য।
–“কখন আসছে তারা?
–“বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এসে নামবে বললো।
–“মা এতো দিন তোমার সাথে কি ওনাদের যোগাযোগ হতো?
–“তাঁরা বিদেশে যাওয়ার পর আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। আজকে প্রায় ষোল বছর পর কল করলো তোর বাবার ফোনে।আর বললো যে ছেলে মেয়ে গুলো দেশে আসছে। রুহুল আমিন ভাই আর তার বউ বছর খানেক আগেই চলে এসেছেন এখন তারা গ্রামে থাকেন।
–“ওহ্ আচ্ছা। আমি তাহলে অফিস থেকে ফিরে তাদের রিসিভ করতে যাবো।
–“সেকি তুই আসতে আসতে তো ছয়টা বেজে যাবে!
–“মা তুমি চিন্তা করো না আমি এর আগেই চলে আসবো।
–“আচ্ছা মনে থাকে যেন। আমি যাই ওদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।আর শোন টেবিলে নাস্তা ডাকা দেওয়া আছে খেয়ে নিস।
–“আচ্ছা ঠিক আছে।

কায়েস দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে যায়।কাবার্ড খুলে একটা পুরনো এলবাম বের করে। কয়েক পেজ উল্টে একটা ছবি বের করে, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল ছোঁয়ায়।আর বলে,
–“টুনিপাখি তুমি আসতেছো? আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না! আমি তো ধরে নিয়েছি তুমি আর কখনো ফিরে আসবে না।
তোমার বন্ধু কে ছেড়ে কিভাবে পারলে এতো গুলো বছর কাটাতে? একটুও কি কষ্ট হয়নি? একবার ফিরে আসো,আর তোমাকে কোথাও যেতে দিব না, একদম মৌনি কৌটায় বন্দি করে রাখবো।

_______

বিকেল পাঁচটা বাজে, কায়েস অফিসের কাজ দ্রুত শেষ করে চলে এসেছে এয়ারপোর্ট।প্লেন ল্যান্ড করতে আরো ত্রিশ মিনিট বাকি।কায়েসের যেন এটুকু সময় বছরের মতো মনে হচ্ছে।হাশফাশ করে চলেছে কখন সে তার টুনিপাখি কে দেখবে।টুনিপাখি নিশ্চ‌ই অনেক বড় হয়ে গেছে। আচ্ছা তার কি কায়েসের কথা মনে আছে? নাকি ভুলে গেছে! না না তা কি করে হয়?সে তো বলেছিল বড় হয়ে কায়েস কে বিয়ে করবে। সেই কারনেই হয়তো এতো বছর পর দেশে ফিরে আসছে।
ভাগ্যিস কায়েস এতো গুলো দিন অপেক্ষা করে ছিল। না হয় কি জবাব দিত তার টুনিপাখি কে। হাজার বলেও আয়েশা বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি কায়েস কে, কোথাও একটা পিছুটান অনুভব করতো কায়েস! মনে হতো টুনিপাখি ঠিক ফিরে আসবে।আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন উপস্থিত।এর জন্য কায়েস ঠিক করলো কিছু এতিম শিশুদের পেট ভরে এক বেলা খাওয়াবে।

কায়েস একটা বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে,যেটাতে স্পষ্ট করে লেখা আছে”ফয়জান”। পনেরো বছর পর এসে তো আর হুট করেই কাউকে চিনতে পারবে না, তাই এই পদ্ধতি।
ইতিমধ্যে প্লেন ল্যান্ড করেছে,লোকজনের ভিড় জমে গেছে। কায়েস এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে চলেছে।এর মধ্যে প্যান্টের পকেটে ফোনটা বেজে ওঠলো, ফোন বের করতে গিয়ে কিছু দরকারি কাগজ নিচে পড়ে গেল। কায়েস পড়েছে বিপাকে! নিচ থেকে কাগজ গুলো নিতে নিতে যদি তারা এসে চলে যায়, তখন কি হবে? আবার কাগজ গুলো ও জরুরি। তাই হাতে থাকা বোর্ড টা উঁচু করে ধরে রেখে নিচ থেকে কাগজ গুলো তুলছে। তখন একজন এসে কায়েসের হাত থেকে নেইম প্লেট টা নিয়ে নিল! কায়েস কাগজ গুলো তুলে, ওঠে দাঁড়িয়ে দেখে তার সামনে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে যাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
–“ব্রাদার তোমার কাগজ পত্র সব গুলো তুলা হয়েছে?
–“জজ্বি জ্বি। আসসালামু আলাইকুম।
–“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি কায়েস তাই না?
–“জ্বি ভাই। কেমন আছো? ছোট বাবা, ছোট মা কেমন আছেন?

ফয়জান আর কায়েস প্রায় সম বয়সী তাই একে অপরকে ছোট বেলা নাম ধরেই ডাকতো।
কথা বলতে বলতে দুটো মেয়ের দিকে নজর পড়ে কায়েসের।একজন উৎসাহ ভড়া মুখশ্রী নিয়ে তাকিয়ে আছে। অন্যজন ভাবলেশহীন ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তখন ফয়জান বললো,
–“এই ফাইজা,রামিশা এদিকে আয়?

একজন আরেকজনের হাত ধরে এগিয়ে আসে। ফয়জান বললো,
–“ও আমাদের জেঠা’তো ভাই।

কায়েস দুজনকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে, তার টুনিপাখি কে ঠিক চিনে নেয়।তার টুনিপাখি বোরকা পরিহিত।আর সাথের মেয়েটার পরিহিত লেডিস সার্ট হাতা ফোল্ড করা সাথে স্কার্ট।সাথের মেয়েটা হাত বাড়িয়ে বললো,
–“হ্যালো ভাইয়া,আই এম রামিশা তুজ জোহরা।
–“আসসালামু আলাইকুম।
আমি কায়েস মাহমুদ।

কায়েসের এরকম ব্যাবহারে ভড়কে গেল রামিশা!হাত সরিয়ে নিয়ে সালামের জবাব দিল।আর ফাইজা আগের মতই ভাবলেশহীন ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কায়েস যেন হিসাব মিলাতে পারলো না।যার সবার আগে এসে কায়েসের সাথে কথা বলার কথা সে এখনো অবধি টু শব্দটিও করলো না! এই মেয়েটিই কি তার টুনিপাখি? নাকি অন্য কেউ?

–“তো চলো কায়েস যাওয়া যাক?

ফয়জান এর কথায় ধ্যান ভাঙ্গে কায়েসের। ফিচেল গলায় বললো,
–“জ্বি ভাই,আসো।

তারপর তারা, মাইক্রো গাড়ি করে র‌ওনা হয় আজিমপুরের উদ্দেশ্যে। যেখানে নিজেদের একটা তিনতলা পাকা বাড়িতে থাকে কায়েস’রা।

_______

আকাশে মেঘ জমেছে,যা বৃষ্টির পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে। আয়েশা মূহুর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিল, সবজি খিচুড়ি আর মুরগির গোশত ভুনা করবে। ছোট বেলায় ফাইজা খুব তৃপ্তি ভরে খেত, আয়েশার হাতের সবজি খিচুড়ি আর মুরগির গোশত ভুনা। তাই অন্য আরো বিভিন্ন ধরনের আইটেম রান্না করলেও এখন ফাইজার জন্য আবার এগুলা রান্না করবে। কত্ত গুলো বছর পর মেয়েটা আসছে তার উপর বৃষ্টি হলে খেয়েও খুব তৃপ্তি পাবে।

রামিশার জন্ম বিদেশের মাটিতে হয়েছে, তাই সে কি পছন্দ করে না করে তা সম্পর্কে অবগত নয় আয়েশা। ভেবে নিয়েছে রুহুল আমিন ভাইয়ের ছোট মেয়েটা আসলে তাকে জিজ্ঞেস করে নিবে।
আয়েশা আজকে ভিশন খুশি, বিশেষ করে ফাইজার জন্য‌ই। ছোট বেলা আয়েশার কাছেই বেশিরভাগ সময় থাকতো ফাইজা!মেয়ের মতো আদর করতো আয়েশা। নিজের তো মেয়ে নেই তাই ফাইজা কেই নিজের মেয়ের মতো দেখতো।ফাইজা বিদেশে চলে যাওয়ার পর,বেশ কিছুদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে আয়েশা! কিছুতেই ভুলতে পারেনি মেয়েটাকে। কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে দুই ছেলে জন্ম হ‌ওয়ার পর দ্বিতীয় বার মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারেনি আয়েশা! এখনো মাঝে মাঝে খুব অসুস্থতায় ভুগে।
তাছাড়া ঠিক করে ছিল ফাইজার সাথে কায়েস এর বিয়ে দিবে। এখন সেই আশাও পূর্ণ হতে চলেছে ইনশা আল্লাহ।
.
.
অফিসে বসে অতিত ভেবে চলেছে কায়েস।ইদানিং কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারে না সে।কারণ ফাইজা তার সাথে হু হা ছাড়া কথাই বলে না।তাই ঠিক করলো ফাইজার সাথে এ ব্যাপারে খুলাখুলি কথা বলবে।

ফাইজা একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা(এনজিও)তে কাজ করে।মূলত এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সদস্যদের একজন সে।
এনজিও টার মালিক থেকে শুরু করে কর্মী, সকলে নারী! পুরুষের কোন অস্তিত্ব নেই এই প্রতিষ্ঠানে। অসহায় নারীদের এখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজের ব্যবস্থা করা হয়। যে সকল নারী নির্যাতিত নিপাতনে সিদ্ধ, এতিম,প্রতিবন্ধী সেসব নারীদের নিয়ে কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। আশ্চর্য হলেও সত্যি এটাই যে এখানে দারোয়ান থেকে শুরু করে মালিক সদস্যও নারী। অবশ্যই সবাই পর্দা অবলম্বন করে তাদের কাজ পরিচালনা করেন।

ফাইজা তার নিজস্ব কক্ষে বসে কাজ করছে তখন দারোয়ানের দায়িত্বে থাকা মেয়েটি কল করে বলল ম্যাম আপনার সাথে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চাইছেন!এখন আমি কি করতে পারি?
ফাইজা বললো,
-“ভদ্রলোকের নাম কি?
-“ম্যাম ভদ্রলোক বললেন উনার নাম কায়েস মাহমুদ।
-“আচ্ছা ওনাকে অপেক্ষা করতে বল আমি আসছি।

অফিসে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ! তাই ফাইজা ফাইল পত্র গুছিয়ে রেখে নিচে নেমে আসে। গেইট দিয়ে বের হয়ে ডানে তাকিয়ে কায়েস কে দেখতে না পেয়ে, বামে তাকিয়ে দেখে কায়েস দাঁড়িয়ে আছে। ফাইজাকে দেখেন এগিয়ে আসে কায়েস।ফাইজা বললো,
-“আপনি এখানে?
-“তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই তোমার কি সময় হবে? প্লিজ না করবে না।

কায়েসের এমন আবদারে না করতে পারল না ফাইজা।বললো আচ্ছা চলুন?
.
.
সন্ধ্যা অফিস থেকে ফেরার পর ফাইজা আকাশ সম বিষ্ময় নিয়ে বসে আছে।গ্রাম থেকে তার বাবা মা এসেছেন। তার চেয়েও বড় কথা কিছুক্ষণ পর তার আর কায়েসের আংটি বদল হবে!আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত শুনে হতাশ হয়ে গেল ফাইজা।সে ছাড়া বাসার প্রত্যেকের মুখেই খুশির রেখা স্পষ্ট।
ফাইজার বুঝতে বাকি নেই এসব কিছু কায়েস এর প্লান। লোকটা তার কথা শুনলো না….

#চলবে ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here