#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা,১২,১৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
১২
রাত এগারোটা বেজে তেরো মিনিট,
ফাইজা আজকে অনেক লেইট করে অফিস থেকে ফিরেছে। ফিরেই শাওয়ারে ঢুকে। এরকম প্রায়ই হয়।
আয়েশা প্রত্যেকবার অনেক বকাঝকা করে। সকালে একবার শাওয়ার নিয়ে যায় আবার রাতে এসে শাওয়ার নেয় যদি জ্বর,ঠান্ডা ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায় তখন কি হবে? এই ভেবে আয়েশা বকাঝকা করেন।
ফাইজা কোন প্রতিক্রিয়া করে না শুধু শুনে রয়।
.
মাঝ রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে তখন রামিসার পানি পিপাসা পায়।মামপট চেক করে দেখে কোন পানি নেই তাই ড্রয়িং রুমে আসে পানির জন্য।
মামপট ভর্তি করে পানি নিয়ে যাওয়ার সময় তায়েসের রুমটা চোখে পড়ে। রুমের দরজা বাহিরে থেকে লক লাগানো।
আজকে কতদিন হয়ে গেল তায়েস বাড়ির বাইরে।রামিসা যেন এতে খুশি নয়। অদ্ভুত ব্যাপার,অথচ তার খুশি হওয়ার কথা।যেন ঝগড়া করতে না পারায় পেটের ভাত হজম হচ্ছে না।
খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে রামিসা যেন কেউ বুঝতে না পারে।
ভিতরে ঢুকে দরজাটা চাপিয়ে দিল, অন্ধকারে হাতড়ে সুইচ অন করে দিল।
হঠাৎ অন্ধকারে লাইট জ্বলে উঠায় চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রামিসা। তারপর পিটপিট করে তাকালো। রুমটা খুব সুন্দর করে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা। নিশ্চয়ই আয়েশা ছেলের রুম গুছিয়ে রেখেছেন।
বিছানার এক পাশে পুলিশের ইউনিফর্ম গুলো সুন্দর করে আইরন করে রাখা।
রামিসা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সেদিনের কথা ভাবলো,
যেদিন কাঁচের শোপিস এর ভাঙ্গা অংশ গুলো রামিসার পায়ে বিঁধে গিয়েছিল। সেদিন তায়েস কোন সহায়নুভুতি না দেখলেও পরে সেই ডাক্তার ডেকে এনেছিল।
রামিসার পায়ে গভীর ভাবে ক্ষ’ত হয়েছিল।তাই প্রাথমিক চিকিৎসায় সারবে না। এই ভেবে তায়েস ডাক্তার ডাকে।
এ কথা পরে ফাইজার থেকে শুনতে পায় রামিসা। সেদিন ভিশন অবাক হয় রামিসা মিনমিন করে বলে, আসছে আবার দরদ দেখাতে..
রামিসা পুরনো কথা ঘেঁটে মুচকি হেসে পাশে থাকা কোলবালিশ টা জড়িয়ে ধরে…
.
.
দরজার কড়াঘাতে ভয়াবহ ঝংকার তুলছে।নূরআইন ঘন্টা খানেক আগে ফযর নামায পড়ে শুয়েছে। দরজার কড়াঘাত শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসে,ঘুমের দরুন চোখ জোড়া মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। অন্ধকার রুমে হাতরে ওরনাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল ভালো করে।
চোখ গুলো বার কয়েক হাত দিয়ে ডলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
কিন্তু দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছে না।যদি কোন খারাপ লোক এসে থাকে তাহলে?ডোর ক্যামেরায় তাকিয়ে দেখলো হোটেলের ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছেন।বেশ অবাক হলো নূরআইন।
এর মধ্যে আবার দরজায় কড়াঘাত হচ্ছে।
এবার দরজা খুলে দিল,খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে কেউ একজন নূরআইন কে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় বরকে গেল নূরআইন। সেকেন্ড কয়েক সময় লাগলো ঘটনা কি ঘটেছে তা বুঝতে।
সামনে করুন মুখশ্রী করে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা। বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার একমাত্র ছোট ভাই আলিফ।
মা তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে।নূরআইন এই মুহূর্তে কি করবে বা বলবে বুঝতে পারছে না। এলোমেলো ভাবে চোখ এদিক সেদিক ঘুড়াতে তায়েসের দিকে নজর স্থির হয়ে গেল। চোখ দুটো আপনা আপনি কিঞ্চিৎ ছোট হয়ে এল।
সন্দিহান দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকানো দেখে শুকনো ঢুক গিলে পাশ পরিবর্তন করে দাঁড়ালো তায়েস।
তহুরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-“এভাবে আমাদের কষ্ট দিতে পারলি নূর? তোকে ছাড়া যে আমরা বাঁচতে পারবো না এটা একবার ও ভাবলি না কেন? কেন এমন নিষ্ঠুর ভাবে আমাদের রেখে এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলি?
মায়ের দিকে দৃষ্টি পরতেই ভিতরটা মুচড়ে উঠলো নূরআইন এর। নিশ্চয়ই তার জন্য নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বলে এই অবস্থা।
ডার্ক সার্কেল পরে গেছে চোখে। ফর্সা হাস্যউজ্জ্বল মুখশ্রী শুকিয়ে গেছে।
নূরআইন তহুরার গালে হাত রেখে বললো,
-“মামুনি তুমি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো না?এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
তহুরা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
-“তোকে ছাড়া গলা দিয়ে খাবার নামে নারে মা। কেন এমন শাস্তি দিলি আমাদের?
নূ্যআইন মুখশ্রীতে কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,
-“আমার কথা বিশ্বাস করলে না কেন তোমারা?তোমরা তাকেই সাপোর্ট করেছো! আমার কথা এক বার ও ভাবোনি কেন বলো?
ইন্সপেক্টর রাকিব হাওলাদার এগিয়ে এসে নূরআইন এর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“আর এমন ভুল হবে না মা। আমার মা যেমন চাইবে তেমনি হবে। আমার মায়ের থেকে অন্য কারো মূল্য বেশি নয়।
নূরআইন ঠোঁট উল্টে বলে,
-“কথাটা মনে থাকবে তো বাবা?
-“পাক্কা মনে থাকবে। এবার আমাদের সাথে বাসায় ফিরে চল?
নূরআইন রাজি হয়ে বললো ঠিক আছে যাবো। এখন এসো বসবে, অনেক জার্নি করে এসেছো।
তারপর আলিফের কাছে গিয়ে বললো,
-“ভাই আপ্পিকে মিস করেছিস?
আলিফ নূরআইন কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“অনেক মিস করেছি আপ্পি। কিন্তু তুমি আমাকে রেখে একা একা কেন লুকোচুরি খেলা খেললে? আমাকে তোমার সাথে নিয়ে তবেই খেলতে। তুমি কতো মজা করেছো লুকোচুরি খেলায়। আমি সব কিছু মিস করে গেলাম।
অভিমানী কন্ঠে এই কথা বললো আলিফ।
তায়েস দুষ্টুমি করে বলে,
-“তোমাকে খেলায় না নেওয়ায় ভালোই হয়েছে আলিফ না হয় ভাই বোন দু’জনেই হাওয়া হয়ে যেতে।
তখন রাকিব হাওলাদার বললেন,
-“আমি অনেক কৃতজ্ঞ আপনার কাছে তায়েস মাহমুদ। আপনি এতো নিপুণ হাতে বিষয়টি হ্যান্ডেল করেছেন যার ফলে বাহিরের মানুষ আমার উপর আঙ্গুল তুলতে পারেনি।থ্যাংক ইয়ু তায়েস মাহমুদ।
-“আমি আমার ডিউটি পালন করেছি স্যার, এতে থ্যাংক ইয়ু দেওয়ার কিছু নেই।
আর হ্যাঁ একটা গোপন কথা শুনেন আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে কে জানেন?
-“কে সে?
সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে জানার জন্য, বিশেষ করে নূরআইন।
তায়েস তখন বললো,
-“আলিফ হাওলাদার।
হুম এই পিচ্চি আলিফ আমাকে তার আপ্পির অনেক তথ্য দেওয়ার কারণেই আমি এতদূর আগাতে সক্ষম হয়েছি স্যার।
নূরআইন ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ভাই আমার ব্যাপারে কি বলেছিস তুই?
আলিফ কপালের সাইটে শাহাদাত আঙ্গুল রেখে ভাবনার ভঙ্গিতে বললো,
-“এস,আই, তোমাকে কি বলেছিলাম আমি?
তায়েস বললো,
-“ঐ যে তোমার আপ্পির সিক্রেট লুকোচুরি!
আলিফ কাঁদো কাঁদো মুখশ্রী করে বললো,
-“তোমাকে তো আমি বলেছিলাম কাউকে যেন না বলো তাহলে তুমি বললে কেন?
-“না বললে তো আপ্পিকে খুঁজে বের করতে পারতাম না। তখন তোমার আপ্পির লুকোচুরি খেলা ইনকমপ্লিট থেকে যেত। তখন কি হতো বলো?
আলিফ বললো,
-“আচ্ছা তাহলে লুকোচুরি খেলার মধ্যে খুঁজে বের করাও একটা নিয়ম?
-“হুম।
-“আগে বলবে তো।
সবাই হাসে পিচ্চি আলিফ এর কথায়।
.
.
চার মাস পূর্বে,
রাকিব হাওলাদার হুট করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন।তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলের সাথে।
কোটিপতি বাবার ছেলে রাফিফ দেওয়ান। আমেরিকাতে তার জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা।
এমন ছেলে জামাই করার সুযোগ কেউ ই হাতছাড়া করতে চায়না। রাকিব হাওলাদার ও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। ধুমধাম করে রিসিপশন করে রাফিফ দেওয়ান এর সাথে এংগেজমেন্ট হয় নূরআইন এর।
এই বিয়েতে নূরআইন কখনোই খুশি ছিল না।নূরআইন এর মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পছন্দ ছিল। যেখানে টাকা পয়সার অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি থাকে না। হাজার টাকার বদলে শত টাকা খরচ করে সুখী হওয়া যায় সেখানে।
নূরআইন এর মতে ধনীরা সুখি হতে পারে না। তাদের চাহিদার কখনো শেষ থাকে না। তারা লাখ টাকা থাকলে কোটি টাকার পিছনে দৌড়ায়। তাদের জীবনটা এরকম দৌড়ানোতেই কেটে যায়। সুখের সন্ধান খুঁজে না কখনোই।
ধনীদের চিন্তাভাবনা থাকে এরকম,
পরিবার নিয়ে ট্যুরে না গিয়ে, সময়টা অফিসে মিটিংয়ে কাজে লাগালে,একেকটা ডিলে কোটি টাকা ইনকাম হবে।
.
যাই হোক নূরআইন রাকিব হাওলাদার কে তার ইচ্ছার কথা বললে তিনি উল্টো রাগ দেখান। তহুরা বেগম ও মেয়েকে বুঝান যে বাবা তার ভালোর জন্যই করছেন।
তাই বাবা মায়ের কথা চিন্তা করে নূরআইন চুপ হয়ে যায়।
কিন্তু ধীরে ধীরে রাফিফ দেওয়ান এর সাথে পরিচয় হলে নূরআইন বুঝতে পারে রাফিফ মোটেও ভালো ছেলে না। মেয়েদের নিয়ে খেলা তার নে’শা।এও বুঝতে পারে একজন নারী দুদিনের বেশি ভালো লাগে না রাফিফ দেওয়ান এর।তার নৃত্য নতুন নারী চাই।যাকে বলে “প্লে বয়”!
বিদেশের সংস্কৃতিতে বড় হওয়া রাফিফ দেওয়ান বিয়ের আগেই কু-প্রস্তাব দেয়!নূরআইন কে।
নূরআইন এ কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল যেন। সাথে সাথে তহুরা বেগম কে জানালে তিনি এ কথা স্বামী কে জানান।
রাকিব হাওলাদার এ কথা শুনে বলেন নূরআইন মিথ্যে বানিয়ে বলছে,বিয়ে না করার অজুহাত দেখাচ্ছে।
বাবার এ কথায় ভিশন ভেঙে পরে নূরআইন।তার কাছে প্রমাণ এর অভাবে দেখাতে পারে না কাউকে।তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ বিষয়ে বান্ধবী শেলীর সাথে কথা বলার সময় আলিফ শুনতে পায় কিছুটা।আর তাই লুকোচুরি খেলার কথা বলে বুঝিয়ে দেয় আলিফ’কে নূরআইন।
.
পরিকল্পনা করে বেশ কিছুদিন ধরেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে বান্ধবীর কাছে লুকিয়ে রাখে।নিজের জমানো টাকা এবং ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে সুযোগ বুঝে বাসায় থেকে পালিয়ে কক্সবাজার চলে আসে নূরআইন।
নূরআইন এর পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে রাফিফ এবং তার পরিবার যাতা কথা শুনাতে ছাড়ে নি রাকিব হাওলাদার কে।
রাকিব হাওলাদার সেদিন কোন উত্তর খুঁজে পাননি। তবে আজকের পর থেকে আর চুপ করে থাকবেন না।মেয়ের অভিমান বুঝতে পেরেছেন তিনি।
.
.
সকালের নাস্তা খেতে সবাই রেস্তোরাঁয় বসে আছে।ওয়েটার মেনু কার্ড দিলে যার যার পছন্দ মতো,লাজানিয়া,ক্রয়স্যান্ট,ওনিয়ন রিং,প্যানকেক সাথে পানীয় অর্ডার করলেন রাকিব হাওলাদার।
তাদের সাথে তায়েস আছে।
তায়েসের একপাশে বসেছে আলিফ অন্য পাশে বসেছে নূরআইন।
সবার আড়ালে নূরআইন বললো,
-“আমাকে খুঁজে বের করার শক্তি আপনাকে পেতে হবে সাব-ইন্সপেক্টর তায়েস মাহমুদ!
এ কথা শুনে ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে তাকায় তায়েস মাহমুদ….
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।
#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(১৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
রামিসা এক গাট্টি কাপড় হাতে করে নিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে হাতের সব গুলো কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফ্লুরে পরে গেল।
রামিসা হাঁ করে তাকিয়ে আছে ফ্লুরের দিকে। বিরক্তিতে “চ” উচ্চারণ করে।
সামনে তাকিয়ে তায়েস কে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বললো,
-“রাজা’কার,আলবদর বাহিনীর সদস্য কোথাকার! কি করলেন এটা? চোখ দুটো কি হাতে নিয়ে হাঁটেন?
তায়েস মাত্রই কক্সবাজার থেকে ফিরেছে, ভিশন ক্লান্ত সে।তাই রামিসার এসব কথা পাত্তা না দিয়ে কাপড় গুলো ডিঙ্গিয়ে সামনে পা বাড়ায়!
তখন রামিসা আরো রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো,
-“বড় মা?বড় বাবা?তোমরা কোথায়? দেখে যাও তোমার রাজা’কার আলবদর ছেলে কি করেছে।
রামিসার এহেন চিৎকারে সবার আগে আলো রুম থেকে দৌড়ে এসে বললো,
-“কি হয়েছে রামিসা?
এ কথা বলতেই পাশে থাকা ব্যাক্তির দিকে নজর পরে আলো’র। সাথে চোখে ফুটে ওঠে ভয়ের ছাপ! সাথে সাথে নিজেকে আড়াল করতে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে ওরনা দিয়ে মুখশ্রী ডেকে নেয় আলো।
কিন্তু তার উপর এখনো অবধি কারো নজর স্থির রয়েছে।
আয়েশা আর ফাহমিদা খাতুন ততক্ষণে দৌড়ে আসে।রিনু এসেই বললো,
-“ছোড ভাইজান আয়ে পরছেন?তয় আমাগো জন্যি আছার মাছার তো নিয়া আইতে পারতেন,শুনিছি ঐহানের আছাড় মেলা স্বাদ খাইতে।
ফাহমিদা খাতুন বললেন,
-“আছার মাছার আবার কি?
রামিসা রেগে গিয়ে বললো,
-“তোমরা আছার মাছার নিয়ে পরে আছো? এদিকে দেখ তোমাদের গুনধর ছোট ছেলে কি করছে। আমার আইরন করা সমস্ত কাপড় এলোমেলো করে দিয়েছে।
বড় মা তুমি যদি আজকে এর একটা বিহিত না করো তাহলে কিন্তু আমি কি করবো নিজেও জানি না কিন্তু।
রিনু হাসতে হাসতে বললো,
-“ছোড আফা আন্নে তো নিজেই জানেন না কিডা করবেন তাইলে..
রামিসা চিৎকার করে বললো,
-“রিনুর বাচ্চা রিনু তোমাকে বেশী কথা বলতে কে বলেছে এখানে?
-“আফা আমার তো কোন বাচ্চা..
এটুকু বলতে রামিসা ধমকে বললো,
-“একদম চুপ করে থাকতে বলছি আমি।
এমন ধমকে রিনু মুখে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আলো এখান থেকে চলে যেতে নিলে তায়েস আঙ্গুল তুলে আলো কে দেখিয়ে বলে উঠলো,মা উনি এখানে?
সবার নজর এখন আলোর দিকে পরে।
আয়েশা ছেলের কাছে এগিয়ে বললো,
-“তোকে বলেছিলাম না বাসায় ফিরলে সারপ্রাইজ আছে।এই সেই সারপ্রাইজ!
তায়েস সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“মানে? তোমার কথা বুঝতে পারলাম না মা।
আয়েশা তায়েসের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“আমাদের ফয়জান এর বউ আলো ইসলাম!
ফয়জান ভাইয়া বিয়ে করলেন কবে?
যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল!
তায়েসের ভিতরটা খানিকটা কেপে উঠলো। ফয়জান বিয়ে করেছে তাও আবার এই মেয়েটাকে?এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে!
কাজের প্রেশারে ভুলেই গিয়েছিলো সে যে কাউকে পছন্দ করে! তাকে বিয়ে করার কিঞ্চিৎ স্বপ্ন দেখেছিল!
মস্তিষ্ক কেমন এলোমেলো লাগছে। কাউকে কিছু না বলে তায়েস নিজের রুমে চলে গেল। খানিকটা শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল।
সবাই তাকিয়ে আছে তায়েস এর যাওয়ার পানে।তায়েসের মতিগতি কারোই মাথায় ঢুকলো না।আলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে রুমে চলে গেল।
রামিসা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফ্লুরের কাপড় গুলো তুলে নিয়ে রুমের দিকে গেল।
আয়েশা আর ফাহমিদা খাতুন কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো,
-“এই রিনু তুই কি এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়েই থাকবি?কত কাজ বাকি আছে জানোস না?
রিনু বললো,
-“মনে অইতাছে ডালমে কুচ কালা হ্যায়!
আয়েশা রেগে বললেন,
-“হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে কি সব বলিস বুঝি না আগা মাথা আয় তাড়াতাড়ি?
.
.
খাবার টেবিলে রামিসা খেয়াল করলো,তায়েস অন্যান্য সময়ের থেকে একদম চুপচাপ, মনমরা হয়ে খাবার খাচ্ছে। আয়েশা ছেলেকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে কক্সবাজার এর কাজের সম্পর্কে এটা ওটা নিয়ে প্রশ্ন করছে।তায়েস উত্তর দিচ্ছে তো আবার চুপ করে আছে।
ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগছে না রামিসার।তাই একটু ভেবে তায়েসের প্রতিক্রিয়া বুঝতে আয়েশা কে বললো,
-“বড় মা তুমি তোমার ছোট ছেলেকে সব দিয়ে দিচ্ছ, আমাদের ও একটু দাও?
সবাই হাসে এ কথা শুনে। আয়েশা বললো,
-“দিচ্ছি দাঁড়া।
ফাহমিদা খাতুন রামিসা কে ধমকে বললেন,
-“ছেলেটা কতদিন পর বাসায় ফিরেছে। ওকে দিবে না কি করবে?
রামিসা মুখে ভেংচি কেটে বললো,
-“তোমরা মায়েরা এতো দু-চোখা কেন বলোতো?তোমরা সব সময় ছেলেদের বেশি আদর করো।
তখন আয়েশা বললেন,
-“ঠিক তেমনি বাবা’রা মেয়েদের বেশি আদর করেন।
-“তোমরা এরকম করলে তো বাবা’রা মেয়েদের আদর করবেই। না হয় তারা আর কার কাছে যাবে বলো?
শফিক মাহমুদ আর রুহুল আমিন ও রামিসার পক্ষ নিয়ে বললেন,তাই তো তোমরা ছেলেদের বেশি আদর করবে আর আমরা মেয়েদের বেশি আদর করবো না? তোমাদের থেকে বেশি করবো।
সবার এতো কথার মধ্যে তায়েস একটি কথাও বললো না। অথচ অন্য সময় হলে রামিসার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতো।
সবটাই খেয়াল করলো রামিসা।
এদিকে কায়েস ও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।তারও কিছু একটা হয়েছে। না হয় রামিসার কথার প্রতিবাদ না করলেও পরিবারের সদস্যদের হাসিখুশি পরিবেশ দেখলে সেও প্রাণ ভরে হাঁসতো আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সবার জন্য দো’আ করতো।যেন তার পরিবার এমনি করেই সারাজীবন হাসি খুশি জীবন পার করে।
কিন্তু সেও চুপচাপ খেয়ে চলেছে।
আর ফাইজা নিজের রুমে বসে আছে। ছেলেদের খাওয়া শেষ হলে ফাইজা,আলো, আয়েশা এবং ফাহমিদা খাবে।
রামিসার খিদে পেয়েছে বলে বাবাদের সাথে খেতে বসে পরে।
.
রামিসা খাবার খেয়ে এসে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে পড়তে বসে।
আজকে বাংলা বিষয় নিয়েছে। গ্রুপের সাবজেক্ট এর প্যারায় বাংলা বিষয় পড়া হয়ে উঠে না।তাই আজকে নেওয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প অপরিচিতা পড়ছে সে। গল্পটা খুবই সুন্দর।পড়ার ফাঁকে তায়েসের কথা মনে পড়ে।ভাবছে তায়েস কে জিজ্ঞেস করবে কিনা,যে তার কি হয়েছে? অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে কিনা।
আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে রামিসা তায়েসের রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। এতে একটু অবাক হলো। ভিতরে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজেও তায়েস কে দেখতে পেল না। তারপর বেড়িয়ে এসে ড্রয়িং রুমে দেখলো তাও নেই।
তাছাড়া সবাই সবার রুমে অবস্থান করছে।অন্য রুমেও যাওয়ার কথা নয়।তাই সিদ্ধান্ত নিল ছাদে যাবে। ওখানে থাকলেও থাকতে পারে।
যেই ভাবা সেই কাজ।
ছাদে চলে এলো রামিসা।পুরো ছাদে চোখ বুলিয়ে দক্ষিন দিকে দেখলো, রেলিং এ বসে আছে তায়েস। জোছনার আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।রামিসা এগিয়ে যেতে খেয়াল করলো তায়েস মুখে কিছু একটা ধরে রেখেছে।লাল রঙা দেখা যাচ্ছে।
যখন পুরোপুরি কাছে এগিয়ে গেল তখন বুঝতে পারলো তায়েস সিগা’রেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে!
এতে একটু আধটু নয় পুরো আকাশ সম বিষ্ময় ভাব ফুটে উঠেছে রামিসার মুখশ্রী জুরে।এই কয়েকমাসে একদিন ও এরকম সিন দেখেনি রামিসা। তাছাড়া আয়েশা কথায় কথায় বলেছিলেন তার দুই ছেলে কখনও সিগা’রেট খায় না মা শা আল্লাহ।
তাহলে এখন?
রামিসা পা টিপে টিপে গিয়ে হঠাৎ টান দিয়ে ফেলে দিল সিগারেট এর বাকি অংশটুকু।
তায়েস কিছুটা অবাক হল।
কিন্তু কিছু বললো না, পকেট থেকে সিগা’রেট এর পুরো বক্স বের করে ফের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে মুখে দিল।
রামিসার ভিশন রাগ হলো বললো,
-“এসব বাজে জিনিস কেন খাচ্ছেন আপনি? ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আপনি জানেন না?
তায়েস বললো,
-“তাতে তোমার কি? কেন এসেছো এখানে?
রামিসা কথা পাল্টে বললো,
-“এগুলো খাওয়া কিন্তু এক ধরনের অপচয় করা।আর ইসলামে কিন্তু অপচয় করা নিষিদ্ধ। তাছাড়া আমি বড় মা কে বলে দিব আপনি ধুমপান করেন।
রামিসা ফিরে আসতে নিলে তায়েস বললো,
-“আমার বন্ধুরা বলতো সিগারেট খেলে ডিপ্রেশন কমে তাই আজকে ট্রাই করছি।
রামিসা ফের ঘুড়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-“কিসের এতো ডিপ্রেশন আপনার?
তায়েস বললো,
-“কাউকে কখনো পছন্দ করেছো?
-“না।
-“তাহলে তুমি বুঝবে না। অজথা বলে লাভ নেই।
-“আপনি বলেই দেখেন না? তারপর লাভ/ক্ষতির হিসাব নিকাশ করা যাবে।
-“একটা মেয়েকে ভালো লাগতো, মেয়েটাকে তার কলেজে প্রথম দেখেছিলাম।
-“তারপর? তারপর কি হয়েছিল?…
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।