#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ২১,২২
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২১
বিদঘুটে শব্দে ফোনটা নিচে পড়ে সব কিছু আলাদা হয়ে গেলো। ঈশার এতে কোন আক্ষেপ নেই। কারন সে ইচ্ছা করে করেছে। কারন সে চায়না ইভান ফোনটা ধরুক। আর ইভান অসহায়ের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–‘এলোমেলো জীবনে গোছালো ভালবাসার উৎস’, ‘অন্ধকার সময়ের আলোর দিশারী’, ‘রংহীন জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন’!
কথা গুলো কানে আসতেই ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা হাত গুজে দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। গাড় গোলাপি রঙের একটা সুতির শাড়ি গায়ে জড়ানো। হালকা সাজ এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখে মুখে বউ বউ কোন ভাব নেই। একদম অগোছালো। মুখের ভাব দেখেই বোঝা সম্ভব যে তিক্ত মন নিয়ে বাসর রাতে অপেক্ষমাণ বউ। ইভানের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো আবারো ঈশার তিক্ত কথার সরে
–আরও শুনতে বাকি আছে নাকি তাই এতো রাতে ফোন করেছে?
ইভান কোন কথা বলল না। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা আবারো বলল
–কেন ফোন করেছে তোমাকে? কথা না বলে থাকতে পারছিল না?
ইভান দাতে দাত চেপে বলল
–একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে না?
ঈশা এগিয়ে আসলো ইভানের কাছে। দুই হাতে শার্টের কলার চেপে ধরে বলল
–কোনটা বেশী? জোর করে বিয়ে করাটা নাকি ফোনটা ভেঙ্গে ফেলাটা।
ইভান কোন কথা বলল না। কলার থেকে ঈশার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হনহন করে ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেলো। দুম করে ওয়াশ রুমের দরজা লাগাতেই ঈশা সস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। এতক্ষনের ভয়টা কেটে গেছে। ঈশা যে প্রচুর ভয় পাচ্ছিল সেটা ইভান বুঝতে পারেনি। আর ঈশাও সেটা লুকাতে চরম বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এভাবে যে ইভানের সাথে কথা বলতে পারবে সেটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যাই হোক এতোটুকু বুঝতে পারলো যে ইভান কে জব্দ করতে হলে এভাবেই আচরন করতে হবে।
ওয়াশ রুমে ঢুকে ইভান আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। নতুন করে ঈশাকে দেখছে সে। এরকম আচরন মনে হয় স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। ইভান বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। ঈশার কথা শুনে এতক্ষনের এই বিয়ে নাটকের সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো ইভানের কাছে। স্নেহার বিষয়টাকে ঈশা যে এভাবে নিবে সেটা সে ভাবেইনি। যতটুকু বললে ভুল টাকে ঠিক মনে হবে না ইভান সেটাই তাকে বলেছে। সবটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছে। ইভানের কোন দোষ নেই সেটাও তাকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাহলে কি ঈশা তার কথা বিশ্বাস করেনি? একটা শ্বাস ছেড়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। এসেই দেখে ঈশা একদম নতুন বউয়ের মতো বিছানার মাঝখানে গোল হয়ে বসে আছে। এক পলক দেখে হাত মুখ মুছে বিছানায় বসে পড়ল। ঠিক তখনই ইফতি দরজায় নক করলো। ইভান উঠতেই ঈশা গলা তুলে বলল
–খোলা আছে।
ইভান ঈশার দিকে সরু চোখে ঘুরে তাকাল। ঠিক কি কারনে সেটা ঈশা বুঝতে না পারলেও এমন ভাব করলো যে সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ইফতি এসে বলল
–ভাবি আপু মা তোমাদেরকে খেতে ডাকছে।
ইভান হালকা সরে বলল
–যা আসছি।
ইফতি চলে যেতেই ইভান ঈশার দিকে ঘুরে বলল
–চল খাবি।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি খাবো না।
ইভান বিরক্ত নিয়ে বসে পড়ল ঈশার সামনে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অসহায় কণ্ঠে বলল
–তুই ঠিক কি চাইছিস ঈশা? কেন এরকম করছিস?
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–চল আগে খাবি। খেয়ে এসে তারপর নাটক করিস। সারা রাত পড়ে আছে।
ঈশা কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–আমার ইমোশন এখন তো তোমার কাছে নাটক মনে হবে।
ইভান অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। আবার বসে পড়ল। ঈশার হাত ধরতে গেলেই সরিয়ে নিলো। ইভান অসহায়ের মতো বলল
–তুই আমাকে একটুও বিশ্বাস করিস না। কেন ঈশা? আমি এমন কি করেছি?
ঈশা ছলছল চোখে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–বিশ্বাস না করলে আজকে তোমার বউ হয়ে তোমার ঘরে থাকতাম না। বিশ্বাস করি বলেই এসব করেছি।
–তাহলে এই ব্যাবহারের মানে কি?
ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। ঈশা কেদে ফেলল। চোখের পানি মুছে বলল
–আজ পর্যন্ত কখনও আমাকে বলেছ ভালোবাসো? কেন বলনি? বিয়ে পর্যন্ত গড়াল অথচ ভালবাসি বলতে পারলে না।
ইভান অগোছালো দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা এসব কথা কেন বলছে সেটা বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করে নিলো। ঈশার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–সব সময় কি বলেই বোঝাতে হয়? আমার অনুভুতি গুলো তো তোর বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না। না বলে ভালবাসা যায়না?
ঈশা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। ভাঙ্গা মন নিয়ে বলল
–আমি জানি তুমি ঐ চিঠি গুলো স্নেহা আপুকে লিখনি। কিন্তু আমি ওগুলো দেখার পর থেকে নিজেকে কোনভাবেই বোঝাতে পারছি না। খুব এলোমেলো লাগছে নিজেকে। কেমন অস্থিরতা কাজ করছে।
ইভান ঈশার হাত ছেড়ে দিলো। ঈশার অবস্থাটা সে ভালই বুঝতে পারছে। যত কিছুই হোক। ইভান কে তো সে ভালবাসে। আর ভালবাসার মানুষকে নিয়ে অন্য কারো সাথে ভাবার বিষয়টা ভয়ংকর কষ্টের। উঠে দাড়িয়ে বলল
–পুরো হাতের লেখা আমার হলেও শুরুতেই ‘প্রিয় স্নেহা’ লেখাটা কিন্তু অন্য কারো। অবশ্য প্রথম অবস্থায় যে কেউ দেখলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য যে আমি ঐ চিঠি গুলো স্নেহাকেই লিখেছি। আমি যদি তোকেই বিষয়টা ক্লিয়ার করে না দিতাম তাহলে তুই নিজেও বুঝতে পারতিস না। ভাগ্যিস নিজে নিজে বেশী না বুঝে আমার কাছে এনেছিলি। আমি হ্যান্ড রাইটিং ম্যাচ করে না দেখালে তুই কোনদিনও বিশ্বাস করতিস না আমাকে।
ঈশার দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলল
–চিঠি গুলো তুই কই পেয়েছিলি?
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–তোমার আলমারিতে একটা খাম ছিল। ঐ খামের মধ্যে অনেক চিঠি আর আমার ছবি ছিল। আমি ওটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো দেখার জন্য। কিন্তু আমি পুরটা দেখার আগেই আম্মুর হাতে সেটা পড়ে যায়। আর আম্মুই ঐ চিঠি গুলো আমাকে দেয়।
ইভান বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। ঠোট কামড়ে কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ঈশার দিকে। তারপর ধির কণ্ঠে বলল
–না জানি আমার শাশুড়ি মা কি ভেবে বসেছে? নিশ্চয় ভেবেছে জামাই আমার মেয়েকে রেখে বাইরে আর একটা প্রেম করছে। উফ! তুই কেন ওগুলো বাসায় নিয়ে গেলি ঈশা? আমার মান সম্মান বলে কিছু থাকলো না। আমার ঘরে বসে পড়তিস সব। তাহলেই এতো কিছু হতোনা।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলো
–কার জন্য লিখেছিলে ঐ চিঠি গুলো?
ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–আমার জীবনে শুধু একজনই আছে। এটা সবাই জানে। আমার সব কিছু তাকে ঘিরেই। আমার অনুভুতি, আমার ভালবাসা, চাওয়া, পাওয়া সব কিছু তাকে নিয়েই। এটা নিয়ে এতো সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই। ঐ চিঠি গুলতে কোন নাম লেখা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের দিন তোকে পুরো খামটা দিবো। কিন্তু দূর ভাগ্য আমার। আগেই তুই পেয়ে গেলি।
ঈশা আবারো বলল
–স্নেহা আপু তোমাকে পছন্দ করতো তুমি জানতে না?
–স্নেহা আমাকে পছন্দ করে কিনা আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এমন কি এসব নিয়ে কখনও মাথাও ঘামাইনি। আমাদের মধ্যে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল। আর বন্ধুদের মাঝে ফান হয়েই থাকে। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোর সামনেও স্নেহা আর মিলা ফান করেছিলো এটা নিয়ে। আমি সেদিন রেস্টুরেন্টে ওদেরকে ডেকেছিলাম শুধু তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। যাতে সবাই এই বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যায় যে তুই আমার বউ।
এক নিশ্বাসে কঠিন গলায় কথা শেষ করে ইভান একটু চিন্তিত হয়ে গেলো। এবার নরম কণ্ঠে বলল
–আমি ভাবছি তোকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি গুলো স্নেহা কোথায় পেলো? আর ঐ চিঠির শুরুতে কেই বা ওর নামটা লিখল?
ঈশা বিচক্ষনের মতো বলল
–স্নেহা আপুই যে লিখেছে সেটা তো নাও হতে পারে। অন্য কেউ তোমার ঘরে এসে সেগুলো দেখে তার নাম চিঠির মধ্যে লিখে দিতে পারে। তোমার বন্ধুদের মধ্যেই হয়তো কেউ এমন করেছে। আর সে হয়তো জানতো যে স্নেহা আপু তোমাকে পছন্দ করে।
ঈশার কথা ইভানের কানে গেলেও তার কাছে বিষয়টা সহজ মনে হল না। কারন তার ঘরে বাইরের কেউ সেরকম আসেনা। আর বন্ধুরা তো হাতে গোনা কয়বার এসেছিলো। ঐ চিঠি গুলো ঈশাকে উদ্দেশ্য করে কবে ইভান লিখেছিল সেটাই তার ঠিক মনে পড়ছে না। আর লিখলেও সব সময় সেগুলো ইভান অনেক যত্ন করে লুকিয়ে রাখত। কারন সে কখনই চায়নি এসব অনুভুতি অন্য কেউ জানুক। এভাবে তার আলমারি থেকে চিঠি খুজে বের করে তার লেখা নামহীন চিঠির শুরুতে অন্য কারো নাম লিখে রাখাটা সহজ কথা না। একটা জিনিস খুব ভালো হয়েছে যে চিঠির মুল লেখা গুলো পুরাতন হলেও স্নেহার নামটা খুব রিসেন্ট লেখা। যেটা কলমের কালির ধরন দেখেই বোঝা সম্ভব। আর হাতের লেখাটাও একদম আলাদা। ইভানের সাথে কোন ভাবেই মিলেনা। তাই তো ঈশাকে বিষয়টা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে সে। নাহলে ঈশা বিষয়টা একদম অন্য দিকে নিয়ে যেত। এই ছোট একটা বিষয়েই জেদ করে বিয়ে করে ফেলল। তবে এটা ভেবেই ইভানের অসস্তি বোধ হচ্ছে যে ঈশার মা চিঠি গুলো আগে নিজে দেখে তারপর মেয়েকে দেখিয়েছে। এতদিন ওনার কাছে তৈরি হওয়া সমস্ত ইমেজ এক নিমেশেই মাটিতে মিশে গেলো। ইভানের ভাবনার মাঝেই তার মা আবার ডাকল। ঈশা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলো। ভাজ হওয়া শাড়ীটা ঠিক করে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান একটু দাড়িয়ে থেকে বের হয়ে গেলো। সোজা টেবিলে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ঈশা দাড়িয়ে থাকলো। ইভানের মাও দাড়িয়ে আছে। ঈশা লাজুক সরে বলল
–বড় মা তুমি বস আমি বেড়ে দিচ্ছি।
ইভানের মা কঠিন গলায় বললেন
–তোমাকে এতো পাকনামি করতে হবে না। তুমি বস। আমি দিচ্ছি। সব কাজ তো তোমাকে দিয়েই করাবো। তবে আজই না। একটু সময় দেবো। সবে এসেছ। আগে একটু গুছিয়ে নাও।
ইভানের মায়ের এমন কথা ঈশার কাছে বিরক্তিকর মনে হল। শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলে ফেলল
–তুমি এভাবে কেন কথা বলছ বড় মা? আগে তো এভাবে বলতে না? আর এরকম তুমি তুমি করে কি বলছ? তোমাকে এভাবে কথা বলে মোটেও মানাচ্ছে না।
সবাই হেসে ফেলল। ইভানের মা ভ্রু কুচকে বললেন
–এখন থেকে এরকমি চলবে। ভালো না লাগলেও সহ্য করতে হবে। শাশুড়ি হওয়ার প্রাকটিস করছি।
আরেকদফা হাসির পর সবাই একসাথে খেতে বসলো। খাওয়া শেষ করে সব গোছানোর সময় ঈশা সেখানে দাড়ালেই ইভানের মা ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। তিনি নতুন বউকে আজ কোন কাজেই হাত দিতে দিবেন না। ঈশাও আর উপায় না দেখে ঘরে চলে এলো। এসে দেখে ইভান বিছানায় হেলানি দিয়ে টিভি দেখছে। ইভানের বেডের সামনের দেয়ালে বড় একটা টেলিভিশন রাখা আছে। ইভান সেদিকেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঈশা ঘরে ঢুকে দাড়িয়ে গেলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধির পায়ে ঈশার দিকে এগিয়ে গেলো। ঈশা শুকনো ঢোক গিলে পেছাতে লাগলো। দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। ইভান দু পাশে হাত রেখে একটু ঝুকে বলল
–বলেছিলাম আমি নিরুপায়, সময় প্রয়োজন। কিন্তু দাওনি। আমি এখনও নিরুপায়, কিন্তু এখন আর সময় প্রয়োজন নেই। তোমাকে প্রয়োজন।
চলবে………
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২২
কোন এক তামিল সিনেমার মারামারির দৃশ্য চলছে টেলিভিশনে। সেদিকে না তাকিয়েও শব্দ শুনে বিষয়টা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঈশা ইভানের দুই হাতের মাঝে আটকে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে তার চোখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া ইভানের উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করছে। এই উষ্ণতা সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই উষ্ণতার তেজ তার ভিতরে পর্যন্ত পৌঁছে সবকিছু জালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ইভান মাথার কাছ থেকে এক হাত সরিয়ে কোমরের কাছাকাছি আনতেই ঈশা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। ইভান আলতো করে দরজার লকটা টিপে দিলো। ঈশা শব্দ শুনে চোখ খুলে সেদিকে তাকাল। আবার হাত উঠাতেই ঈশা আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল। এবার ইভান পাশের দেয়ালের সুইচ বোর্ডে হাত দিয়ে লাইটের সুইচটা অফ করে দিলো। ঈশা আবারো চোখ খুলে ফেলল। ইভান আর একটু কাছে আসতেই ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আ…আমার ঘুম পাচ্ছে।
ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। গম্ভির সরে বলল
–পাইলেও কিছু করার নাই। ঘুমানো তো যাবে না।
ঈশা এদিক সেদিক অস্থির দৃষ্টি ফেলে অসহায় কণ্ঠে বলল
–কেন যাবেনা?
ইভান একটু সরে দাঁড়ালো। কিন্তু হাত সরাল না। স্বাভাবিক ভাবে বলল
–বাসর রাতে কেউ ঘুমায় না। তাই ঘুমানো যাবে না।
–মানে?
ঈশার সরল প্রশ্নের উত্তরে ইভান সোজা সাপটা বলল
–তুমি আমাকে যতটা ভদ্র ছেলে ভাব আমি আসলেই ততোটা ভদ্র না। এতদিন ভদ্রতা দেখাতে চেয়েছি তাই দেখেছ। কিন্তু এখন আর ভদ্রতা দেখায়ে কি হবে বল। নিজেরি ক্ষতি।
ঈশা ভয় পেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইভান হাত উঠিয়ে ঈশার সামনের চুলগুলো কানের পিছনের গুজে দিয়ে বলল
–ভয় পাচ্ছ?
ঈশা হ্যা বলবে কি না সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। কি একটু ভেবে অনুনয়ের সুরে বলল
–আমি কি একটু বিছানায় বসতে পারি? আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।
ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার অবস্থা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু ঈশা তার হাসি দেখতে পেলো না। সে ঈশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বিছানায়। বসিয়ে দিয়ে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। ঈশা সেটা হাতে নিয়ে সব পানি এক নিশ্বাসেই শেষ করে ফেলল। ইভান পাশে বসে আবার হেলানি দিলো বিছানায়। গম্ভির গলায় বলল
–শুয়ে পড়।
ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। আর দেরি না করে শুয়ে পড়ল। ঈশা ভালভাবে শুয়ে পড়তেই ইভান টিভির দিকে তাকিয়ে গম্ভির ভাবে বলল
–বলেছিলাম যে সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে সময় প্রয়োজন। আমার কথা তখন মাথায় না ঢুকলেও এখন মাথায় ঢুকেছে নিশ্চয়?
ঈশা পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। ইভানের কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাল না। কেমন অসস্তি হচ্ছে। মনের আবেগটা তীব্র হলেও জড়তাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর উঠবেই বা কিভাবে সেরকম সুযোগ হয়নি তো। ইভান দেয় নি বা পায়নি সে যাই হোক। তাদের সম্পর্ক কোন কালেই স্বাভাবিক কোন প্রেমিক প্রেমিকার মতো ছিল না। তারা কখনই একে অপরের সাথে আলাদা ভাবে সময় কাটায় নি। নিজেদের মধ্যে অনুভুতির আদান প্রদান করেনি। সেরকম কোন কথা তাদের মধ্যে হয়ে উঠেনি। ঈশা মনে মনে ভাবল ‘ইভান ঠিকই বলেছিল। যখন বুঝতে পারবে তখন মনে হবে সত্যিই সময় প্রয়োজন ছিল।’ ইভান আবারো বলল
–কি ম্যাডাম? আমি কিছু বললাম। আমার কথা কি মাথায় ঢুকেছে?
ঈশা পাশ না ফিরেই কাপা কাপা গলায় বলল
–বি…বিয়ের পরেও তো সময় দেয়া যায়।
ইভান হেসে ফেলল। সে ঈশার কাছ থেকে এরকমি কিছু আশা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা যে এমন কথা বলবে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। এতো কিছু তো ছিল শুধু ঈশাকে বিষয়টা বোঝাতে। ইভান মৃদু হেসে বলল
–যায় তো।
ঈশা কোন কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষন ধরেই ঈশা নড়াচড়া করছে। তার ঘুম আসছে না। নতুন বিছানা। তার উপরে আবার পাশে ইভান শুয়ে আছে। সারা শরীর অসস্তিতে কাটা দিয়ে উঠছে। ঈশা ঘুমায়নি বুঝতে পেরে ইভান বলল
–অসুবিধা হচ্ছে? টিভি অফ করে দিবো?
ঈশা মৃদু সরে ‘না’ বলল। ইভান খানিকবাদেই টিভি অফ করে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু এভাবে কি আর ঘুমানো সম্ভব? ঈশার শরীরের ঘ্রান ইভানের সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে। কাঙ্খিত মানুষটার পাশে শুয়ে এভাবে ঘুমানো একেবারেই অসম্ভব। সুপ্ত অনুভুতি গুলো ধারালো হয়ে যাচ্ছে। তার মাঝেও অসস্তি কাজ করছে। কিছুক্ষন এপাশ অপাশ করে উঠে বসলো। একবার ঘাড় ফিরে দেখল। ঈশা ঘুমাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। উঠে সোফায় গিয়ে বসলো। সেখান থেকেই খোলা জানালা দিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় ঈশাকে দেখল কিছুক্ষন। ঈশা উলটা দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। সেই দৃশ্য দেখেই ইভানের চোখ জুরিয়ে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেলো। এতো বছরের সেই অপেক্ষার অবশান হল। ঠোটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ঈশার দিকে তাকিয়েই সোফায় শুয়ে পড়ল। ঈশাকেই নিস্পলক দেখে যাচ্ছে সে। কি অদ্ভুত এক প্রশান্তি মনে। মুহূর্তেই কত কিছু বদলে গেলো। এভাবে নিজের প্রিয়তমাকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল বুঝতে পারলো না।
———–
খোলা জানালার পর্দাটা সরানো। বেশ আলো ঢুকছে ঘরে। খুব একটা বেলা গড়ায় নি। তবুও যেন মনে হচ্ছে অনেক বেলা হয়েছে। আলোর দাপটে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখ নিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে কোথায় আছে সেটা বুঝতেই কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো ঈশার। ঘাড়টা ব্যথা করছে। সারা রাত একদিকে শুয়ে ছিল তাই। হাই তুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পাশ ফিরতেই দেখল ইভান নাই। এতো সকালে তো ইভানের উঠার কথা ছিল না। কই গেলো? একটু ভেবে নিচে নামলো। কুচকান শাড়ীটা টেনে ঠিক করে নিলো। আধ খোলা চুল গুলো ভালো করে বেধে নিলো। উপরের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ইভান সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঈশা ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর সত্যি সত্যি বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই একটু এগিয়ে গেলো সোফার দিকে। একটু ঝুকে ভালো করে ইভান কে দেখে নিলো। গভির ঘুমে আছে। কিন্তু ইভান তো বিছানায় শুয়েছিল রাতে। আর সেটা ভেবেই ঈশা একদম নড়াচড়া করেনি। ঈশার ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করার অভ্যেস আছে। চুপচাপ সে কিছুতেই ঘুমাতে পারেনা। কিন্তু একি বিছানায় শুয়ে এভাবে নড়াচড়া করলে ইভানের ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবেই সে নড়ার সাহস পায়নি। কিন্তু ইভান সোফায় আসলো কিভাবে? ঘুমের মধ্যে আবার হাটার অভ্যেস নাই তো? ঈশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বেশ বিরক্ত নিয়ে বিড়বিড় করে বলল
–সোফাতেই যদি ঘুমায় তাহলে আগেই ঘুমাত। আমিও একটু শান্তিতে নড়েচড়ে ঘুমাতে পারতাম। এক পাশে শুয়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।
বিরক্ত নিয়ে আলমারির সামনে দাঁড়ালো। ইরিনা আর ইলু মিলে কাল অল্প কিছু কাপড় এনে আলমারি গুছিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে দেখল। কিন্তু কোনটা পরবে বুঝতে পারছে না। অনেক সময় নিয়ে ভেবে বের করলো সে এখন থেকে শুধু শাড়ি পরবে। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। তার কাছে তেমন শাড়ি নেই। মায়ের সব শাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু অন্য কিছু পরবে না। অল্প কয়টা শাড়ির মধ্যে থেকে একটা সবুজ সুতির শাড়ি খুজে বের করলো। সেটা নিয়েই ওয়াশ রুমে গেলো। বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছে। খুটখাট আওয়াজে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রচণ্ড রকমের বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে ফেলল। খুব একটা গাড় ঘুম হয়নি তার। কাল রাতের সব কথাই মনে আছে। তাই এই শব্দের পিছনে যে ঈশাই দায়ী সেটা মাথায় রেখেই ভয়ংকর এক ধমক দিতে প্রস্তুত হল। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই তার দুনিয়া অন্ধকার হওয়ার বদলে সবুজে ছেয়ে গেলো। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা জড়ানো চোখ গুলোও বড় বড় হয়ে গেলো। ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ভেজা চুল গুলো ইচ্ছা মতো আছড়ে জাচ্ছে সে। সবুজে জড়ানো মায়াবতীকে কি স্নিগ্ধটাই না লাগছে। চোখ ফেরান দায় হয়ে গেছে। একটু ছুয়ে দিতে মন চাইছে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে নিজেকে সংযত করে নিলো। চুল ঠিক করে ঈশা পুরো ঘরে এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে কি যেন কাজ করছে। ইভানের এবার ঈশার উপরে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ লাগছে। অযথাই রাগটা ক্ষণে ক্ষণে চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু এমন কোন কারন নাই। তবুও ইভান নিজেকে কিছুতেই রাগ করা থেকে আটকাতে পারছে না। এর মাঝেই দরজায় জোরে জোরে ধাক্কানর আওয়াজে ঈশা পিছন ঘুরে একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান কে চোখ খুলে থাকতে দেখে নিরভয়ে দরজা খুলে দিলো। ইরা দৌড়ে এসে ঈশার পায়ের কাছে ধরে বলল
–আপু তুমি এখানে কেন ছিলে? বাসায় যাবে না।
সকাল সকাল ইরার এমন কথা শুনে ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান উঠে বসে পড়ল। ইফতি ঘরে ঢুকে বলল
–রাতে তোমাকে বাসায় দেখতে না পেয়ে প্রচণ্ড কান্না কাটি করেছে। সকাল থেকে জেদ আপুর কাছে যাবে। তাই নিয়ে এলাম সকাল সকাল।
ইভান মৃদু সরে বলল
–ভালো করেছিস।
ইরা আবারো ঈশার শাড়ি টেনে বলল
–ও আপু। বাসায় কখন যাবে?
ঈশা মৃদু হেসে বসে পড়ল। ইরার গাল টেনে বলল
–আমি এখন থেকে এখানেই থাকব ইরু মনি।
–কেন থাকবে? তোমার কি বাড়ি নেই?
ইরা ভ্রু কুকে বলতেই ঈশা হাসল। ইরা ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে ইভানের কাছে গিয়ে বলল
–ও ভাইয়া আপু কেন তোমার ঘরে থাকবে?
ইভান ইরার কথার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। চুপচাপ বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো। ইরা আবারো বলল
–আপু থাকলে কিন্তু আমিও তোমার ঘরে থাকব।
ঈশা ইরার কথা শুনে তার দিকে তাকাল। ইভান শান্ত ভাবে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল
–একদম। আমি তো ভাবছি তোর বাপের বাড়িতে যত মেয়ে হবে আমি সবাইকে নিয়ে এসে আমার ঘরে রাখবো। আর আমি আমার ঘর বিছানা সব ছেড়ে বারান্দায় থাকব।
ঈশা বড় বড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ইরার দিকে আছে। ঈশা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–তুমি সোফায় শুয়েছিলে কেন?
ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু আবারো রাগটা চেড়ে উঠলো। কোন রকমে সেটাকে গিলে উঠে দাড়িয়ে বলল
–তোর মাথায় কখন কি চলে কে জানে। ঘুমানোর আগে মনে হয়েছে সময় দরকার আবার ঘুমানোর পরে যদি মনে হয় আর সময় দরকার নেই। যদি কোনভাবে আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিস। তাই নিজেকে সেফ রাখতেই দূরত্ব বজায় রেখেছি।
চলবে……।