#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ২৩,২৪
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৩
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। অসময়ের বৃষ্টিতে প্যাচ প্যচে কাদাময় বাইরে। বেশ বিরক্তিকর একটা পরিবেশ। বাইরে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। মনে হচ্ছে সারাদিন আজ বৃষ্টি থামবে না। ইভানও আজ সারাদিন বাসায়। এই বৃষ্টির দিনে ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। কোন কাজ নেই তাই সামনে টিভি চালিয়ে দিয়ে গল্পের বই পড়ছে। আর এইদিকে বউ শাশুড়ি মিলে রান্না ঘরে ব্যস্ত। আজ খিচুড়ি আর ভাজি রান্না হবে। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি ভাজি বেশ মজাদার একটা খাবার। দুজনে মিলে রান্নায় মেতে উঠেছে। এমন সময় ইভানের মায়ের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে তিনি ঈশাকে বললেন
–ভাজিটা একটু দেখ তো মা। আমি একটু কথা বলি।
ঈশা মাথা নেড়ে ভাজি নাড়তে শুরু করলো। ইভানের মা ফোনে কথা বলছেন। কার সাথে কথা বলছে ঈশা ঠিক বুঝতে পারছে না। আর বুঝতেও চাইছে না। সে তার কাজে ব্যস্ত। বেশ কিছুদিন পার হয়েছে বিয়ের। ঈশা নিজের মতো সংসারের দায়িত্ব গুছিয়ে নিয়েছে অনেকটা। আনমনে রান্না করছিল ঈশা। কিন্তু এর মাঝেই অস্পষ্ট কথা তার কানে আসলো। ইভানের মা বেশ উতফুল্যের সাথে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটাকে বলছেন
–সবে তো বিয়ে হল। কিছুদিন যাক। নিজেদেরকে একটু গুছিয়ে নিক। তারপর না হয় বাচ্চা নিয়ে ভাববে।
কথাটা কানে আসতেই ঈশার চাপা কষ্টটা আচমকাই নড়েচড়ে উঠলো। থমকে গেলো কেমন সব কিছু। চোখ ভরে এলো। ইভানের মা কথা শেষ করে রান্না ঘরে আসতেই ঈশা নিজের চোখের পানি লুকিয়ে ফেলল। ইভানের মা ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–যা মা গোসল করে নে। আমি এটা শেষ করে যাচ্ছি।
ঈশা কোন কথা বলল না। মাথা নেড়ে চলে গেলো উপরে। ছলছল চোখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ঘরের দরজার সামনে এসে নিজের চোখের পানিটা লুকিয়ে ফেলল। দ্রুত ঘরে ঢুকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের ইচ্ছা মতো কাদল। এতদিনে ইভানের কাছে থাকতে থাকতে সে এই বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলো। ইভানের মায়ের কথা শুনে আবার কষ্টটা নতুন করে গাড় হয়ে উঠলো। এলোমেলো লাগছে সব কিছু। সবাই যখন জানতে পারবে তখন কি হবে। কিভাবে নিবে এসব ভাবতেই আবারো চোখের পানি ছেড়ে দিলো ঈশা। অনেকটা সময় পর ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এলো। বের হয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতেই ইভান কে বলল
–যাও তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো।
ইভান বই থেকে চোখ তুলে তাকাল ঈশার দিকে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। পিছন ফিরে আছে। ইভান সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে?
ঈশা থেমে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল
–কি হবে?
ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বইটা বন্ধ করে বলল
–সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
ঈশা হেসে বলল
–কিছু হয়নি তো।
কাছে এসে ইভানের হাত ধরে ওয়াশ রুমের ভিতরে ঢুকে দিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি বের হবে কিন্তু। খুদা পাইছে।
ইভান কোন কথা বলল না। কিন্তু সবই বুঝল। ওয়াশ রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল।
—————
পশ্চিম আকাশে এলোমেলো ভাবে মেঘের বিচরণ। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির পরে গোধূলি বেলায় একটু ছাড় দিয়েছে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা হাওয়াটা গায়ে এসে লাগছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রকৃতি কেমন প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। ঈশা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শেষ বেলার সেই প্রকৃতির দর্শন করতে উঠেছে ছাদে। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে স্থির। কিন্তু এসব কিছুই তার মন ছুঁতে পারছে না। এতদিনে বেমালুম ভুলে যাওয়া কষ্টটা আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তার সাথেই কেন এমন হল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে যখন সবাই এসব নিয়ে কথা বলবে তখন ঠিক কি হবে? সবার মনে একটা অপ্রাপ্তি থেকে যাবে। সমাজে কতজন কত কথা বলবে। এসব ভাবতেই আবারো চোখ ভরে উঠলো।
–মন খারাপ?
রেলিঙ্গের উপরে পা তুলে বসতে বসতে বলল ইভান। গভির ভাবনায় ডুবে থাকলেও তার গলা শুনে ঈশা একটুও চমকাল না। যেন সে জানতো ইভান এখন আসবে। পিট পিট করে চোখের পানি লুকিয়ে সামনে তাকিয়েই বলল
–না তো। মন খারাপ হওয়ার কোন কারন আছে কি?
ইভান মুখে হাসির রেশ টেনে বলল
–আছে না কত কারন। হয়তো আমাকে মিস করছ।
ঈশা পাশ ফিরে সরু চোখে তাকাল। পুরোটা ঘুরে ইভানের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে বলল
–তুমি আজ সারাদিন বাসায় আছ। মিস করবো কেন? সামনে থাকলে কি কেউ মিস করে।
ইভান হাসল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–তার মানে আমি জখন থাকিনা তখন মিস করো।
ঈশা কথা বলল না। আবার ঘুরে দাঁড়ালো। সামনে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। ইভান আবারো বলল
–কই বল না তো।
ঈশা সামনে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
–বললে কি হতো?
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–বললে ছুটে চলে আসতাম তোমার কাছে।
ঈশা মৃদু হেসে কণ্ঠে হালকা অভিমান রেখে বলল
–তোমার তো কত কাজ। সেসব ফেলে কি আসতে?
রেলিঙ্গের উপরে রাখা ঈশার হাতটা ধরে সেটাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। ঈশা ফিরে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান আবেগি কণ্ঠে বলল
–কিছু অনুভব করতে পারো?
ঈশা অবুঝের মতো চেয়ে থাকলো। ইভান আবারো বলল
–আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন এই তুমিটাকে ছাড়া আমি যে অপূর্ণ। বেচে থাকার জন্য আমার এই তুমিটাকে দরকার। তোমার মাঝেই আমার সব পূর্ণতা। তুমি থাকলে আমার আর কিছুই লাগবে না। আমার জীবনে যত কিছুই থাক তোমার থেকে কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখনি মিস করবে আমাকে ডাকবে আমি চলে আসব। প্রমিস।
ঈশা হেসে ফেলল। এতো মন খারাপের মাঝেও এভাবে তৃপ্তি নিয়ে হাসার কারণটা নিজের কাছেই বোধগম্য হলনা তার। হঠাৎ করেই মনের কাল মেঘটা সরে গিয়ে এক ফালি রোদ্দুর উকি দিলো মনে হচ্ছে। হাতটা আরও গভির ভাবে ইভানের বুকে স্পর্শ করে বলল
–মিস করি কিনা জানিনা। তবে আমি খুব বেশী বিরক্ত করতে পারি। যখন তখন ফোন করে আসতে বলবো। তখন কিন্তু বিরক্ত হওয়া যাবে না।
ইভান ঠোট চেপে হেসে বলল
–আমাকে আবার যে যত কিছু দেয় আমি তাকে তার অনেক গুন ফেরত দেই। আমাকে যত বিরক্ত করবে আমি তার কয়েক গুন ফেরত দিবো।
ঈশা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। ইভান হেসে ফেলল।
—————
কয়দিন যাবত ইভান খুব ব্যস্ত। প্রতিদিন প্রায় সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয় একদম রাতের বেলা আসে। ঈশাকেও ঠিক মতো সময় দিতে পারছে না। আজও কিছু জরুরী কাজ ছিল তার। সেগুলো সম্পন্ন করে সোজা হসপিটালে গেলো ইলহামের কাছে। ইলহাম নিজের কাজে ব্যস্ত তাই ইভান বসে অপেক্ষা করছে তার রুমে। কিছুক্ষনের মধ্যে হন্তদন্ত করে রুমে ঢুকেই ইভান কে বলল
–সরি রে। কাজ শেষ করতে একটু দেরি হয়ে গেলো। অনেক্ষন অপেক্ষা করেছিস।
ইভান একটু হেসে বলল
–অজথা কেন ফর্মালিটি করছ? আমি বেশিক্ষন অপেক্ষা করিনি।
ইলহাম চেয়ারে বসতে বসতে বলল
–বস। বল কি খাবি?
ইভান সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বলল
–চা খাবো।
–শুধু চা?
ইভান হেসে বলল
–আপাতত শুধুই চা।
–তারপর বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে?
ইলহামের প্রশ্ন শুনে ইভান হাসল। হাসি মুখে রেখেই বলল
–যেমন কাটার কথা ছিল। ঈশার মধ্যে এখনও বাচ্চামি ভাবটা আছেই। ম্যাচিউর হতে একটু সময় লাগবে।
ইভানের কথা শেষ হতেই ইলহাম বলল
–ইভান আমি ঈশার রিপোর্ট গুলো সবটা দেখেছি। ঈশার মেইন প্রবলেম হল ওর ইউট্রাসে অসংখ্য সিস্ট আছে। যার কারনেই ওর ইউট্রাস অনেক উইক। আর এই অবস্থায় কোন ভাবেই কন্সিভ করা পসিবল না।
ইভান মনোযোগ দিয়ে শুনল ইলহামের কথা। তারপর শান্ত গলায় বলল
–এর কি কোন ট্রিটমেন্ট নেই ভাইয়া?
ইলহাম একটু হতাশ গলায় বলল
–আছে। কিন্তু এটা বলা যায়না যে একদম সুস্থ হয়ে যাবে। সিস্ট গুলো এখনি তেমন কোন ক্ষতি না করলেও ছোট ছোট কিছু শারীরিক সমস্যা হবে। আর যত দিন যাবে ওগুলো তত বাড়তে থাকবে। তাই ট্রিটমেন্ট তো অবশ্যই শুরু করতে হবে। কিন্তু এই ট্রিটমেন্ট অনেক লম্বা সময় ধরে চলবে। সব থেকে বড় কথা হল ট্রিটমেন্ট করার পরে আমরা সিস্ট গুলো নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলেও কন্সিভ করার ক্ষমতাটা ঈশার মধ্যে তৈরি হবে কিনা সেটা বলা সম্ভব না। চান্সও খুবই কম। বলতে গেলে নেই।
ইভান শান্ত ভাবে বলল
–আমার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। আসলে প্রবলেমটা ঈশার। কে কি ভাবল। কি বলল। এসবের কারনে ইদানিং খুব বেশী মেন্টালি স্ট্রেচড থাকে। ওর মেন্টাল স্ট্রেস কমানোর জন্যই আমি আসলে খুব তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু করতে চাই। পরে কি হবে সেটা পরের কথা। কিন্তু আপাতত মনের মধ্যে একটা শান্তি থাকবে যে ট্রিটমেন্ট চলছে। কিছু একটা রেজাল্ট আসবে তো।
ইলহাম সম্মতি জানালো। ইভান একটু ভেবে বলল
–আমি এখনি ঈশাকে কিছু বলতে চাচ্ছিনা ভাইয়া। তুমি সব কিছু ব্যবস্থা করো। তারপর জানাবো। আর হ্যা তুমি শুধু একটা বিষয় খেয়াল রেখো ঈশা এই ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে যা জানবে সবটাই যেন পজিটিভ হয়। আমি ঈশাকে কোন রকম ডিপ্রেশনের মধ্যে দেখতে চাই না।
ইলহাম মাথা নাড়ল। ইভান কথা শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হল। সারা রাস্তা একটা বিষয় নিয়ে ভাবছে। নিজের কাজের কারনে মাঝে মাঝেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। ঠিক মতো সময় দিতে পারেনা ঈশাকে। আর ঈশাও একা একা শুধু এসব নিয়েই ভাবে। এরকম চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে। ঈশাকে এই ডিপ্রেশন থেকে বের করতেই হবে। ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে গেলো।
ইভান বাইরে থেকে এসে সোজা ঘরে গেলো। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। সে আজ আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। ঈশা শুয়েছে কিনা সেটা ভেবেই ঘরের দরজাটা আসতে করে খুলল। কিন্তু ঈশাকে ঘরে কোথাও দেখতে পেলো না। একটু ভিতরে ঢুকে দেখল বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ঈশার এরকম আচরন ইভানের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। ঈশার কারনে সেও ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। শব্দ শুনে ঈশা ঘরে এসে ইভান কে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–এতো দেরি করলে যে?
ইভান পকেট থেকে ফোনটা বের করে সেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু সরে বলল
–কাজ ছিল।
ঈশা একটু অভিমানী সুরে বলল
–এখন তো তুমি অনেক ব্যস্ত। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাক। রাতেও দেরি করে আসো। এভাবে চলতে থাকলে দুইদিন পর তোমার সাথে কথা বলতেও এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখতে হবে।
ঈশার এমন কথা শুনে ইভানের মেজাজ আচমকাই খারাপ হয়ে গেলো। খুব কষ্টে নিজের রাগটা সংবরন করে হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল
–ব্যস্ত মানুষের বউদের ধৈর্যটা একটু বেশী থাকতে হয়। এতো অল্পতেই অধৈর্য হয়ে পড়লে চলে না।
ঈশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–বউ আছে সেটা মনে আছে তাহলে।
ইভান এবার ঘুরে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–ভুলে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। সকালে বাইরে যাওয়ার সময় দেখি। রাতে বাইরে থেকে এসে দেখি। যখন বাসায় থাকি তখনও দেখি। নিজের মতো ভাই বোনদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মত্ত। বাড়ির সবার খেয়াল রাখায় ব্যস্ত। এতো বড় একটা সংসার সামলায়। সারা বাড়ির কাজে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। কখনও নিজের জন্য ব্যস্ত। কখনও সংসারের কাজে ব্যস্ত। এই তো। এতো কিছু চোখে পড়লে কি আর ভুলে যাওয়া সম্ভব।
ঈশা মনোযোগ দিয়ে শুনল কথা গুলো। কথার ধরনটা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। ঈশার কোথাও চরম ভাবে আঘাত করলো। ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঘুরে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–এসব কথা বলার মানেটা কি জানতে পারি?
ইভান ওয়াশ রুমের দরজা ঠেলে খুলে বলল
–আমি এতো কঠিন কথা বলি জানতাম না তো। আমার তো এতদিন মনে হতো আমি খুব সহজ স্বাভাবিক একটা মানুষ। কিন্তু এখন দেখছি আমার মধ্যে অনেক জটিলতা আছে।
চলবে…………
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৪
মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইভানের। চোখ বন্ধ করে পাশে হাত রাখতেই খেয়াল করলো ঈশা বিছনায় নেই। চোখ খুলে বোঝার চেষ্টা করলো। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল ঈশা জানালার পাশে চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। উদাসিন চোখ আর সাথে খুব যত্ন করে দুই হাতে চেপে ধরা ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ইভান ঘুম কাটিয়ে উঠে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে ভাবল তখন একটু বেশিই খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেছে। এমনিতেই মেয়েটা কষ্টের মধ্যে আছে। তার উপর ইভান তাকে সময় দিতে পারছে না। নিজের মনের কথা গুলো কাউকে বলতেও পারছে না। কথাটা ভেবেই নিজের উপরে রাগ হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো ঈশার কাছে। ঈশা খেয়াল করেনি। কফিটা মুখের কাছে নিয়ে যেতেই ইভান হাত ধরে ফেলল। ঈশা ভয় পেয়ে চমকে তাকাল। ইভান কে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি? উঠলে কেন?
ইভান কোন উত্তর না দিয়ে কফির মগটা হাত থেকে নিয়ে চুমুক দিলো। ঈশা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বেকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল
–মিষ্টিটা কম মনে হচ্ছে।
ঈশা চোখ পিটপিট করে তাকাল। ঈশার কাছে তো কম মনে হল না। সে তো নিজে হাতেই কফি বানাল। হুট করেই ইভান একটু ঝুকে ঈশার গালে এক হাত রাখল। মুখটা একটু উচু করে ঠোটে গাড় চুমু খেলো। একটু সরে গিয়ে জিভ দিয়ে নিজের ঠোট ভিজিয়ে বলল
–নাহ! ঠিক আছে। কফিটাই অনেক স্ট্রং। মাঝ রাতে এতো স্ট্রং কফি খাওয়ার কি দরকার?
বলেই কাপটা নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমের দিকে গেলো। দরজা খুলে বেসিনে পুরো কাপটা উল্টে দিলো। ঈশা হা করে তাকিয়ে আছে। মাঝ রাতে হুট করে এমন অপ্রত্ত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। তাই বুঝতে একটু সময় লেগে গেলো। বসেই থা্কল চেয়ারে। ইভান বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ করেই বলল
–৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বিছানায় না আসলে কিন্তু সারা রাত আর ঘুমাতে হবে না।
ঈশা আর কিছু ভাবতে পারলো না। এমন কড়া হুমকির মাঝে ভাবার সময়টাও পেলনা। উঠে বিছানায় যেতে যেতে ভাবল এটা আবার কোন সময় হল। ২ মিনিট দিতে পারত। একটু হাত মুখ ধুয়ে আসত। বিরক্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। সোজা হয়ে ভাবছে। ইভান পাশ ফিরে ঈশার কাছাকাছি এসে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরল। শীতল হাত শাড়ির ভাজ গলিয়ে স্পর্শ করতেই ঈশা কেপে উঠলো। গলায় মুখ ডুবাল ইভান। আদুরে কণ্ঠে বলল
–সরি। তখন ওভাবে বলতে চাইনি। রাগ হয়েছিলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।
ইভানের এমন আদুরে কথা শুনে ঈশার মন হালকা হয়ে গেলো। ঈশা হেসে ইভানের মাথায় হাত রাখল। ইভান মুখটা তুলে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–মন ভালো হয়েছে নাকি আরও ভালো করে দিতে হবে?
ঈশা চোখ বন্ধ করে লাজুক হাসল। ইভান অন্ধকারেও ঈশার সেই লাজুক হাসির মায়ায় হারিয়ে গেলো। কোন ভাবেই এই মায়া থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব না। আরও যেন গভির ভাবে জাপটে ধরল সেই মায়া। মনের গভিরে জমে থাকা অনুভুতি হুট করেই বাধন হারা হয়ে গেলো। সাথে হাতের স্পর্শও অবাধ্য হয়ে উঠলো নিমেষেই।
————–
ঈশা সকাল সকাল উঠে গেলেও ইভান এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। ঈশা বুঝে গেলো রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য এখনও ঘুম ভাংছে না। কিন্তু তার তো বাইরে কাজে যাওয়ার কথা। তাই ঈশা ঘরে গেলো ডাকতে। বিছানায় বসে ইভানকে দেখল কিছুক্ষন। ডাকবে কিনা বুঝতে পারছে না। একটু ভেবে আলতো হাত মাথায় রাখতেই ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা নরম সরে বলল
–এখনও উঠছ না যে? আজ কোন কাজ নেই?
ইভান পাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে ধরে বলল
–আজ কোথাও যাব না। ভালো লাগছে না।
ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–কেন শরীর খারাপ? কি হয়েছে?
ইভান চোখ বন্ধ করেই বলল
–কিছু না। এমনিতেই বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে না। বাসাতেই থাকব।
ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ঘুমাতে চাইলে খেয়ে আবার ঘুমাও। এখন উঠ।
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। মৃদু সরে বলল
–একটু পরে উঠি?
ঈশা মৃদু হেসে নাড়ল। উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দরজার কাছে যেতেই ইভান ডাকল।
–ঈশা।
থেমে গেলো। ইভান উঠে ঈশার সামনে এসে দাঁড়াল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিলো। গভির ভাবে তাকিয়ে চুলের খোপাটা খুলে দিলো আচমকা। এমন হওয়াতে ঈশা একটু বিরক্ত হল। এখন সে রান্না ঘরে কাজ করবে। আর খোলা চুল গুলো বিরক্ত করবে। কিন্তু ইভান সেটার তোয়াক্কা না করে বলল
–খোলাই থাক।
ঈশা বিরক্ত হলেও কোন কথা বলল না। মৃদু হাসল। ইভান একটু হেসে ওয়াশ রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। ঈশা রান্না ঘরে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে বাইরে চলে গেলো। গিয়েই দেখল ইলু ইরিনা আর ইফতি বসে আড্ডা দিচ্ছে। ইভান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–কি রে তোরা এতো সকাল সকাল?
ইলু বলল
–আমরা সকাল সকাল না। তুমি উঠতে লেইট করেছ।
ইভান বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল। ইভান কে খাবার দিয়ে ঈশা রান্না ঘরে চলে গেলো চা বানাতে। সবার জন্য চা বানাচ্ছে। ছেড়ে রাখা চুল গুলো প্রচণ্ড বিরক্ত করছিল। কাজের ফাকে ইভানের কথা ভুলে গিয়ে আনমনেই খোপা বেধে নিলো। চা বানানো শেষে কাপে ঢেলে এনে টেবিলে বসল। সবার হাতে কাপ দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে বসে পড়ল। ইভান নিজের মতো খেয়েই যাচ্ছে। ঈশা চায়ের কাপটা মুখের সামনে ধরতেই ইরিনা প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে বলল
–ঈশা তোর গলায় ওটা কিসের দাগ?
কথাটা কানে আসতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশার দিকে না তাকিয়েও বুঝে গেলো সে আবার খোপা বেধেছে। চোখ খুলে স্বাভাবিক ভাবে খাবার মুখে দিলো ইভান। প্রচণ্ড অসস্তির মধ্যে পড়ে গেলো সে। এই অবস্থায় ঠিক কি করা বা বলা উচিৎ বুঝতে পারলো না। মাথা নামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে খেয়ে যাচ্ছে। ঈশা কিছু না বুঝেই ভ্রু কুচকে সবার দিকে তাকাল। ইফতি মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল
–ভাবি আপু তুমি কি কোনভাবে ব্যথা পেয়েছ গলায়?
কথাটা বোধগম্য হতেই ঈশাকে প্রচণ্ড অসস্তি ঘিরে ধরল। আড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান খুব স্বাভাবিক। এখানে কোন কথা হচ্ছে সেটাও সে শুনতে পাচ্ছে না এমন ভাব। ঈশা প্রচণ্ড লজ্জায় পড়ে গেলো। ইভানের উপরে খুব রাগ হল তার। ইরিনা এবার পুরো বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজের করা বোকামির জন্য লজ্জা পেলো। মুখ ফিরিয়ে ইলুর দিকে তাকাতেই দেখল ঠোট চেপে হাসছে। ইরিনাও নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলো না। ঈশা তাদেরকে এভাবে হাসতে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে ইভানের ফোন বেজে উঠলে সে সস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোনটা নিয়ে উঠে গেলো। কারন বুঝতেই পারছে এখানে এখন কি হবে। থাকা মানেই তার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ পর কথা শেষ করে ইভান টেবিলে এসে বসলো। ঈশা একা বসে আছে। আশে পাশে এখন কেউ নেই। ইভান চেয়ারে বসে দেখল ঈশা প্রচণ্ড অসস্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে বলল
–সবাই কই গেলো?
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান চোখ ফিরিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। নিজের মুখে খাবার দিয়ে আবার খাবার তুলে ঈশার মুখের সামনে ধরল। ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান হেসে বলল
–মান সম্মানের যা ফালুদা বানানোর ছিল বানানো শেষ। এখন খাবারের উপরে রাগ দেখিয়ে কি লাভ। খাবারের আর কি দোষ।
বলেই ঈশার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল
–আমাকে রাগ দেখানোর কি আছে? আমার কি দোষ? আমি কি ইচ্ছা করে করেছি নাকি?
ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তার ঠোটের কোনে লেগে থাকা খাবার মুছে দিতে দিতে বলল
–আমার কি দোষ বল। চুল বাধতে নিষেধ করেছিলাম। আমার কথা না শুনলে এমনি হবে।
ঈশা ঝাঝাল গলায় বলল
–স্পষ্ট করে কথা বলতে পারনা? অর্ধেক কথা বল কেন সব সময়? ভালো করে বললে কি আমি চুল বাধতাম?
ইভান খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল
–পারি। কিন্তু বলতে ইচ্ছা করেনা।
ইভানের এমন হেয়ালিপূর্ণ কথা শুনে ঈশা রাগে গজগজ করতে করতে উঠে ঘরে চলে গেলো। ইভান হেসে ফেলল।
—————
সন্ধ্যার পরে ইভান একটু বাইরে গেছে। ছোট কি যেন কাজ আছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তাড়াতাড়ি আসবে। ঈশা শুয়েছিল একটু। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলো। কেমন এলোমেলো লাগছে। কাজল গুলো চোখের নিচে লেপটে গেছে। ওয়াশ রুমের দরজা খোলা রেখেই আঁচলের কোনা দিয়ে চোখের নিচে লেপটে থাকা কাজল ডলে ডলে মুছার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিক মতো উঠছে না। চোখের নিচেটা কালো হয়ে যাচ্ছে। ঘষে ঘষে চামড়া তুলে ফেলার মতো অবস্থা করে ফেলেছে। ইভান অনেক আগেই এসেছে বাসায়। চুপচাপ ঈশার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি করতে চাইছে। এক সময় এগিয়ে গিয়ে ঈশাকে নিজের দিকে ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা চমকে উঠে বলল
–কি করছ?
ইভান নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিলো। ঈশার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই ঈশা পিছিয়ে বেসিনের উপরে ঝুকে গেলো। ইভান কোমর জড়িয়ে ঈশাকে নিজের কাছে এনে টিস্যু ভিজিয়ে নিয়ে আলতো করে মুছে দিলো। ঈশা চুপচাপ তাকিয়ে আছে। ভেজা টিস্যু দিয়ে পুরো মুখটা মুছে দিয়ে বলল
–হয়েছে।
ঈশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে গেলো। আয়নায় ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–কিভাবে হল?
ইভান হেসে ফেলল। ঈশা আয়নায় ইভানের দিকে তাকাল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–হাসার কি হল? আমি কখন থেকে চেষ্টা করছিলাম মুছে ফেলতে। কিছুতেই পারছিলাম না।
ইভান বেসিনের উপরে দুই হাত রেখে ঈশাকে আটকে দিলো। ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল
–সব কিছু কি সবাইকে দিয়ে হয় ঈশা পাখি। কিছু কিছু বিষয়ে স্পেশাল কাউকে লাগে। তোমার সেই স্পেশাল মানুষটা আমি।
ঈশা হাসল। মৃদু সরে বলল
–সত্যিই তাই।
চোখ নামাতেই ইভানের ডান হাতে চোখ পড়ল। কেটে গেছে কোন ভাবে। রক্ত জমাট বেধে আছে। ঈশা হাত ধরে বিচলিত হয়ে বলল
–কিভাবে কাটল?
ইভান সেদিকে তাকাল। কিভাবে কাটল আসলে সেও খেয়াল করেনি। কোন ভাবে হয়তো কেটে গেছে। বলল
–জানিনা।
ঈশা ইভানের দিকে ঘুরে বলল
–জাননা মানে কি? কিভাবে কেটেছে সেটাও জাননা?
ইভান নিশ্বাস ছেড়ে বলল
–কেটেছে কোন ভাবে খেয়াল করিনি। তেমন কিছুই না।
ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–তেমন কিছু না তাই না? কিভাবে কেটেছে সেটাও জাননা। কোথায় থাকে মন?
ইভান মুচকি হেসে ঈশাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
–এখানে থাকে।। বাকি কিছুর তো খেয়াল থাকে না।
ঈশা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে ডেটল নিয়ে ইভানের হাতে আলতো করে লাগিয়ে দিলো। ইভান ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভান কে ঠিক করে দিয়ে বলল
–ফ্রেশ হয়ে এস। খাবো।
বলেই পা বাড়াতেই ইভান হাত ধরে আটকে দিলো। যত্ন করে কপালে চুমু দিয়ে বলল
–আসছি। যাও।
ঈশা সোজা রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই রান্না ঘর থেকে ঈশার চিৎকার কানে এলো। শুন্য মস্তিষ্কে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে সেদিকে দৌড় দিলো।
চলবে………