শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ২৯,৩০

0
1151

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ২৯,৩০
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৯

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গেই ঈশা দেখল ইভান বিছানায় নেই। উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বসে পড়ল। এদিক সেদিক তাকাল কোথাও নেই ইভান। ওয়াশ রুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। বুঝতে পারলো ইভান ওয়াশ রুমে। সামনে ঘড়িটার দিকে তাকাল। কেবল সকাল হয়েছে। এতো সকালে ইভান কখনই উঠে না। কিন্তু গত দুই দিন ধরে নিজের রুটিন বদলে ফেলেছে। সকাল হতেই ঘুম থেকে উঠে বাইরে চলে যায়। আর আসে একদম মাঝ রাতে। ঈশা বেশ বুঝতে পারছে এসব নাটক। তার সাথে যাতে কথা বলতে না হয় সেই কারনে এসব নাটক শুরু করেছে। ঈশা দুই দিন ধরে তার নাটক শুধু দেখেই যাচ্ছে কিন্তু কোন কথা বলেনি। বলতেও চায় না। আর বলেও যে খুব একটা লাভ আছে তাও না। ইভান তার সাথে কথা বলবে না সেটা সে জানে। অজথা নিজে থেকে কথা বলতে গেলেই আরও ভাব ধরে বসে থাকবে। তাই ঈশাও এবার নিজেকে এমন ভাবে ব্যস্ত রেখেছে যাতে ইভান বুঝতে পারে তার সাথে কথা বলার সময় ঈশার নেই। ঈশার ভাবনার মাঝেই ইভান বের হয়ে গেলো ওয়াশ রুম থেকে। সোজা আলমারির সামনে দাড়িয়ে নিজের কাপড় বের করতে লাগলো। এমন আচরন করছে যেন সে ছাড়া এই ঘরে আর কেউ নেই। ঈশাও সেরকম ভাব দেখিয়ে উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখল ইভান প্রায় রেডি হয়েছে। ঈশা রান্না ঘরে চলে গেলো। এখনও কেউ উঠেনি ঘুম থেকে। ইভান নিজেকে ব্যস্ত প্রমান করতেই এতো সকালে বের হয়ে যায়। যাতে তাদের এই মান অভিমানের বিষয়টা বাসায় কেউ বুঝতে না পারে। ঈশা চা বানাচ্ছে আর ভাবছে ইভান কে কিভাবে জব্দ করা যায়। ইভান এসে টেবিলে বসলো। পানি ঢেলে মুখের সামনে ধরতেই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে সে। ইভান কে এমন হেসে হেসে কথা বলতে দেখে সকাল সকাল ঈশার মেজাজটা বিগড়ে গেলো। চা কাপে ঢেলে তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। হঠাৎ করেই মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হল। বাকা হেসে ইভানের কাপে চিনির বদলে মরিচের গুড়া ঢেলে দিলো। যাতে বুঝতে না পারে তাই ভালো ভাবে মিশিয়ে দিলো। আর নিজের কাপটা আলাদা করে নিয়ে টেবিলে গেলো। ইভান ফোনেই কথা বলছে তখনও। ঈশা পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের কাপে চুমুক দিয়ে চা খাচ্ছে। এইদিকে ইভান ফোনে কথা বলতে বলতেই চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিলো। গলা পর্যন্ত যেতেই মুখ ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। ভ্রু কুচকে একটু ভাবল। স্বাদটা কেমন অদ্ভুত। এরকম চা সে জিবনেও খায়নি। আবারো চুমুক দিলো। কিন্তু এবার মনে হল তার মুখ আর গলা জলে জাচ্ছে। ঈশার দিকে একবার তাকাল। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের কাপে চুমুক দিয়ে খেয়েই যাচ্ছে। আর এক আঙ্গুলে ফোনে স্ক্রল করছে আর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ইভান আর কথা বলতে পারলো না। ফোনটা কেটে দিলো। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মুখ লাল হয়ে গেছে। নাক চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অতিরিক্ত ঝালে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। কোন কালেই ইভান এতো ঝাল খায়নি। ঈশা জানতো যে ইভান দুই এক চুমুক খাওয়ার পরে সাদের ভিন্নতার কারনে আর খাবে না। তাই সেই আন্দাজ করেই ঝাল দিয়েছিল যাতে দুই একবার খেলেই গলা জলে যায়। ঈশা মুচকি হেসে পাশ থেকে দুধের গ্লাসে কয়েক চামুচ চিনি মিশিয়ে রাখল। ইভান পানির গ্লাসটা হাতে ধরতেই ঈশা সেটা নিয়ে নিলো। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে তীক্ষ্ণ চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা এগিয়ে এসে দুই হাতে ইভানের শার্টের কলার চেপে ধরল। ইভান কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ঠোটে ঠোট মিলিয়ে দিলো। কলার ছেড়ে এক হাত মাথার পিছনে দিলো। চুল মুঠো করে ধরল। বেশ অনেকটা সময় পর ছেড়ে দিলো। দুজনেই হাপাচ্ছে। ইভান তার ঝালের কারনে হাপাচ্ছে আর ঈশা শ্বাস আটকে যাওয়ার কারনে হাপাচ্ছে। ঈশা স্বাভাবিক ভাবে চিনি মেশানো দুধের গ্লাসটা ইভানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলো। ইভান মুহূর্তটাকে ঠিক ভাবে অনুভব করতে পারলো না ঠিকই কিন্তু সকাল বেলা এরকম একটা ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা ততক্ষনে উঠে রান্না ঘরে চলে গেছে।। আর সহ্য করতে না পেরে দুধটা পুরটা খেয়ে নিলো। ঝালটা একটু কমতেই বিষয়টা অনুভব করতে পারলো সে। চোখ বন্ধ করে তৃপ্ত শ্বাস ছেড়ে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখে মুখে পানি দিয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ভাবল। সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ভাবল এই প্রথমবার ঈশা সকাল বেলা উঠেই তার মেজাজ বিগড়ে দিলেও রাগ করার মতো কোন উপায় রাখল না। প্রথম ইভানের মনে হল তার ঠিক কি ধরনের রিয়াক্ট করা উচিৎ সেটা সে বুঝতে পারছে না।। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রান্না ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। ঈশা দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

————
সব কাজ শেষ করে ঈশা ঘরে চলে গেলো। আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো গোসল করতে। অনেকটা সময় নিয়ে গোসল শেষ করে বের হয়েই সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠার উপক্রম ঈশার। ইভান বিছানায় বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ভর দুপুরে ইভান যে বাসায় আসবে সেটা ঈশা কল্পনাতেও আনেনি। কারন রাত ছাড়া সে তো বাসায় আসেনা। আর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তারপর। সকালের কথাটা মনে পড়তেই ঈশা ঠোট চেপে হাসল। ঠিক সেই সময় ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। হাসিটা চোখে পড়লেও তার মুখ ভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফোনের দিকে তাকাল। ঈশা দ্রুত পায়ে বারান্দায় চলে গেলো। ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে ঘরে চলে এলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াতে যাবে ঠিক তখনই মাথায় আবার দুষ্ট বুদ্ধি চেপে বসলো। ইভানের থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে চুল গুলো ঝাড়া দিলো। সব পানি ইভানের মুখে গিয়ে পড়ল। বিরক্তি নিয়ে ইভান চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। ঈশা আয়নায় সবটা দেখল। ঠোট চেপে হেসে আবার ঝাড়া দিলো। ইভান এবার চোখ খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই বুঝতে পারলো না। ইভান বিরক্ত হয়ে উঠে আলমারির সামনে দাড়াতেই ঈশা অনিচ্ছাতেই ঘুরে গেলো। ইভানের সাথে ধাক্কা খেলো। পড়ে যেতে নিলেই ইভান ধরে ফেলল। ঈশা শক্ত করে ইভানের শার্ট চেপে ধরল। ইভান ঈশাকে সোজা করে দাড় করিয়ে ছেড়ে দিলো। ইভান আলমারি থেকে কাপড় বের করে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশা নিশব্দে হাসল। ভালো করে চুল মুছে নিচে গেলো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতেই ইফতি এসে বসলো। একটা প্লেট বেশী দেখে বলল
–একটা প্লেট আজ বেশী কেন?

ঈশা প্লেট সাজাতে সাজাতেই বলল
–তোর ভাইয়া এসেছে।

ইফতি সামনে তাকিয়েই ইভান কে দেখে বলল
–আরে ভাইয়া তুমি এই সময় বাসায়?

ইভান এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–কেন আমার কি এই সময় বাসায় আসতে নিষেধ?

ইফতি হেসে বলল
–না না তা কেন হবে? কয়দিন ধরে তোমার তো দর্শন পাওয়া যাচ্ছিলো না। আজ হঠাৎ এমন কি ঘটনা ঘটল যে তোমার দর্শন মিলল। সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছিলাম।

ঈশা স্বাভাবিক ভাবেই গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল
–খাবার টা টেস্ট করে দেখ তো ইফতি ঝালটা কেমন? আজ কাল মনে হচ্ছে আমি খাবারে খুব বেশী ঝাল দিচ্ছি। রান্না বান্না কি ভুলে গেলাম নাকি বুঝতে পারছি না।

কথাটা কানে আসতেই ইভান আড় চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা খুব স্বাভাবিক। নিজের মতো সব খাবার নিয়ে বসে পড়ল। খাবার মুখে তুলেই ইভান ইফতিকে বলল
–বাবা মা কি বাসায় নাই?

ইফতি ছোট্ট করে বলল
–না। দুজনই গ্রামে গেছে। কাল আসবে।

ইভান ভ্রু কুচকে আনমনে বলল
–আমি জানিনা কেন?

ঈশা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল
–বাসার মানুষের খবর জানতে বাসায় থাকতে হয়। দিন রাত বাইরে থাকলে জানা যায়না।

ইফতি সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি কোন ভাবে রাতেও বাইরে থাক? আমি তো জানি তুমি রাতে বাসায় চলে আসো।

ইভান ধমক দিয়ে বলল
–তোকে এসব নিয়ে কেউ গবেষণা করতে বলেনি। চুপচাপ খা।

ইফতি খাবারে মনোযোগ দিলো। ইভান পানি খাওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ঈশা গ্লাসটা নিয়ে নিলো। পানিতে চুমুক দিয়ে গ্লাসটা পাশে রাখল। ঈশার গ্লাসটাতে পানি ভর্তি তবুও সে সেখান থেকে পানি খেলো না। ইভান হাত বাড়িয়ে ঈশার গ্লাসটা নিতে গেলেই ঈশা সেটাকেও সরিয়ে একটু দূরে রাখল। ইভান শান্ত ভাবে দেখছে ঈশার সব কাজ কর্ম। কিছু বলছে না। ঈশা এতো কিছু করছে শুধু যাতে ইভান তার সাথে কথা বলে। কিন্তু ইভানও ঠিক করেছে এতো সহজে কথা বলবে না। সেও দেখতে চায় ঈশা আর কি কি করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে পানি খাওয়ার জন্য জীবন বের হয়ে যাচ্ছে। তাই উপায় না পেয়ে ঐ গ্লাস থেকে পানি খেলো। ঈশা ঠোট চেপে হাসল। ইভান অতি বিরক্তি নিয়ে আড় চোখে ঈশার কাণ্ড দেখছে। খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে ঘরে গেলো সবাই। দুপুর বেলা আর কোন কাজ না থাকায় রেস্ট নিবে এখন। ইভান আগেই ঘরে চলে এসেছে। সে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছে। ঈশা এসে অপর পাশে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছা করেই খোলা চুল গুলো এমন ভাবে এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল যাতে ইভানের মুখে গিয়ে পড়ে। ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন ওভাবে থেকে আলতো করে চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে ফেলে ঈশার দিকে তাকাল। সে উলটা ঘুরে শুয়ে আছে। কিছু বলল না। মুচকি হেসে চুল টেনে দিলো। ঈশা ‘আহ’ শব্দ উচ্চারণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই টিভি দেখছে। ঈশা বুঝতে পারলো ইভান তার চুল টেনেছে। কিন্তু কোনভাবেই সে স্বীকার করবে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ইভান ঠোট চেপে হাসল।

—————-
আলো অন্ধকারের খেলা। গোধূলি বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা নামলো বলে। ইভান ঐ যে এসেছে তারপরে আর বাইরে যায়নি। দুপুরে শুয়ে থাকতে থাকতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাত্র ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে দেখল ঈশা কোথাও নেই। বুঝতে পারলো রান্না ঘরে আছে। বের হয়ে দেখে ইফতি টিভি ছেড়ে দিয়ে চা খাচ্ছে আর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইভান চোখ ফেরাতেই দেখল ঈশা রান্না ঘর থেকে বের হচ্ছে। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজার কারনে কোমরের অনেকটা দৃশ্যমান। ইফতির দিকে একবার তাকিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো ইভান। রান্না ঘরের দরজার সামনে দাড়াতেই ঈশার মুখোমুখি হল। ঈশা শান্ত চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবে তখনই ইভান নিজের পা বাড়িয়ে দিলো। পায়ের সাথে পা লেগে পড়ে যেতে নিলেই ইভান ধরে ফেলল কোমর জড়িয়ে। ঈশা থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। সামনে তাকিয়েই ঈশার কোমর থেকে আঁচলটা খুলে দিলো সে। অনেক জোরে কোমরে চিমটি কাটতেই ঈশা চিৎকার করে উঠলো। ইফতি ঘাড় বেকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে? চিৎকার করলে কেন?

ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
-কিছু না। এমনিতেই।

ইফতি আর কথা বাড়াল না। টিভির দিকে মনোযোগ দিলো। ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ঠোটে জ্বালাময়ী হাসি দেখে ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। দ্রুত পা ফেলে ইফতির কাছে এসে ছুরি আর আপেল হাতে নিয়ে কাটতে গেলো। ইভান রান্না ঘরের দরজায় দাড়িয়ে দেখছে। রাগ করেই জোরে চাপ দিতেই ঈশার হাত কেটে গেলো। ইভান দৌড়ে এসে হাত ধরে ফেলল। রক্ত বের হচ্ছে। ইফতি সেদিকে তাকিয়ে বলল
–অনেকটা কেটে গেছে। আমি ডেটল আর তুলো আনছি।

বলেই চলে গেলো। ইভান চেপে ধরে আছে তবুও রক্ত বের হচ্ছে। ইভান রক্তিম চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা চোখ তুলে তাকাতেই ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি। বুঝতে পারিনি কিভাবে কেটে গেছে।

কথাটা শেষ করতেই ইভান ঈশার গালে একটা থাপ্পড় মারল। ঈশা হা করে তাকিয়ে আছে। থাপ্পড় টা এতটাই আস্তে ছিল যে ঈশা একটুও ব্যাথা পায়নি। সেটা নিয়েই সে ভাবছে যে থাপ্পড় মারল কিন্তু এতো আস্তে কেন। এর মাঝেই ইফতি এসে পড়ল। ইভান যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ইফতির ফোন আসায় সে ঘরে চলে গেলো। ঈশা আবারো চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাতেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান মুচকি হেসে যে গালে থাপ্পড় দিয়েছিল সেই গালে আলতো করে চুমু দিলো। ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ঠোটের কোনে মৃদু হাসি। ঈশাও একটু হেসে ইভানের বুকে মাথা রাখল। ইভান দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষন ওভাবেই থাকলো তারা। কিছুক্ষন পর ইভান শান্ত কণ্ঠে বলল
–ঈশা।

ঈশা ছোট্ট করে ‘হুম’ বলতেই ইভান আবার বলল
–তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা আছে।

ঈশা মাথা তুলে তাকাল। বলল
–আবার কথা?

ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ভয় পাচ্ছ কেন? আবার কি করেছ?

চলবে………

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৩০

সময়টা রাত ১১ টা। মাথার উপরে ঘড়ঘড় শব্দে ফ্যান চলছে। জানালার পর্দা বাতাসে উড়ছে। বারান্দার দরজাটাও খোলা। সেদিক দিয়েই মৃদু আলো এসে অন্ধকার ঘরটাকে আলোকিত করেছে। ঈশা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে বিছানায়। ইভান এখনও বাইরে। তখন ইভান ঈশার কথোপকথনের এক পর্যায়ে একটা ফোন আসে। ইভান বেশ কিছুক্ষন কথা বলে জরুরী ভিত্তিতে বাইরে চলে গেছে। আর বলে গেছে কখন আসবে ঠিক জানে না। তবে এসে ঈশার সাথে জরুরী কথা বলবে। অনেক জরুরী কথা আছে। ঈশা ঠিক তখন থেকেই ভাবছে ইভান কি কথা বলবে। ঈশার কাছ থেকে আবার কোন ভুল হয়ে যায়নি তো। না বুঝেই কিছু না কিছু করেই ফেলে সে। আর যখন বুঝতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। মনটা কেমন যেন লাগছে। বুঝতে পারছে না কিছুই। ইভানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হালকা চোখ লেগে এলো তার। কতক্ষন ওভাবে শুয়ে ছিল সেটা বলতে পারেনা। ঘুম ভাঙল ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিশ্বাস পড়ায়। চোখ মেলেই বুঝতে পারলো কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। খানিকবাদেই বুঝতে পারলো মানুষটা কে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। একটু নড়তেই ইভান চোখ বন্ধ করেই বলল
–ঘুম ভেঙ্গে গেলো?

ঈশা ইভানের হাত সরিয়ে উঠে বসলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–তুমি কখন এসেছ? আমাকে ডাকো নি কেন?

ইভান সোজা হয়ে শুয়ে মাথার নিচে এক হাত রেখে বলল
–তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই ডাকি নি। তোমার ঘুম ভাঙ্গাব কেন?

ঈশা ঘুমু ঘুম চোখে ইভানের দিকে তাকাল। তখনই মনে পড়ে গেলো ইভান জরুরী কথা বলতে চেয়েছিল। মৃদু সরে বলল
–সরি। আমি ঘুমায়ে গেছিলাম। তুমি আমাকে জেগে থাকতে বলেছিলে।

ইভান উঠে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল। গালে হাত রেখে বলল
–এটা কেমন কথা। ঘুম পাইলে ঘুমাবে না? আমি জেগে থাকতে বলেছি বলে কি ঘুম পাইলেও জেগে থাকবে?

ঈশা উত্তর দিলো না। তাকিয়েই থাকলো। ইভান মুচকি হেসে বলল
–কি ভাবছ?

ঈশা উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলো
–তুমি খাবে না?

ইভান পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে হেলে ঈশাকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
–আমি ইলহাম ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়েছ?

ঈশা মাথা নাড়ল। বাড়িতে কেউ নেই তাই ঈশা আর ইফতি একসাথে খেয়েছে। ইভান বলেই গিয়েছিলো তাকে খেয়ে নিতে। ইভান ঈশার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
–ঈশা।

ঈশা ‘হুম’ বলতেই ইভান বলল
–আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে কেমন।

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–ইলহাম ভাইয়ার সাথে আমি তোমার বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। ভাইয়া বলেছে তোমার ট্রিটমেন্ট শুরু করতে। সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততই ভালো।

ঈশা চুপচাপ শুনল। কোন উত্তর দিলো না। ইভান চুপ করে থাকা দেখে বলল
–আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

ঈশা মাথা তুলে তাকাল। একটু দূরে সরে চোখ নামিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল
–কি হবে এসব করে?

ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। স্বাভাবিক ভাবে বলল
–কিছু হওয়া না হওয়া কি আদৌ আমাদের হাতে আছে ঈশা? আমি তো তাই জানি যে এসব কিছুই আমাদের হাতে নেই। তাই বলে কি চুপ করে বসে থাকবো।

ঈশা উত্তর দিলো না। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবারো সেই পুরনো ক্ষত দগদগে হওয়ার ভয়টা এবার তীব্র হল। সবাই জানলে কি হবে? ট্রিটমেন্ট শুরু হলে সবাই জেনে যাবে বিষয়টা। তখন কে কি ভাববে। মাথার মধ্যে সব চিন্তা কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো মাথার ভেতরে। ইভান ঈশার হাত আলতো করে ধরে কোলের উপরে রেখে বলল
–এভাবে না ভেবে অন্য ভাবেও তো ভাবা যায়। সব কিছু তো আর আমাদের হাতে থাকে না জান। কিছু কিছু বিষয় ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দিতে হয়।

ঈশাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইভান উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে আকাশে তাকিয়ে বলল
–তোমাকে এভাবে দেখলে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। আমি বলেছিলাম তোমাকে কোনদিন কষ্ট পেতে দিবো না। জীবনের সব সুখ দিতে চাই। কিন্তু আমি ব্যর্থ। সব সুখ দিতে পারলেও জীবনের সব থেকে বড় সুখ থেকে তুমি বঞ্চিত থাকবে।

ইভানের কথা গুলো ঈশার কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিলো। সব থেকে বেশী কষ্ট হচ্ছে ইভানের গলার আওয়াজ শুনে। সে বুঝতে পারছে ইভান প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে কতটা অসহায়। ঈশা চোখের পানি ফেলে উঠে গেলো ইভানের কাছে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা ঠেকাল। ইভান কোন কথা বলল না। ঘুরেও দাঁড়ালো না। ঈশা কাঁদছে। ইভান বুঝতে পারছে কিন্তু সে থামাতে চেষ্টা করছে না। বেশ কিছুক্ষন পর ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি কাদছি বুঝতে পারছ না?

ইভান সামনে তাকিয়েই মৃদু সরে বলল
–পারছি।

ঈশা আবারো বলল
–তাহলে থামাচ্ছ না কেন?

ইভান অভিমানী কণ্ঠে বলল
–থামাব কেন? তোমার সব কষ্ট তো দূর করার ক্ষমতা আমার নাই। তাই এই চোখের পানিটাও মুছে দেয়ার অধিকার আমার নাই। মাঝে মাঝে সৃষ্টি কর্তার উপরে খুব অভিমান হয়। কেন আমার পাখির সব কষ্ট দূর করে দেয়ার ক্ষমতা আমার হাতে দিলো না। কেন তাকে এমন কষ্ট দিলো যেটা আমার উপস্থিতিও নিঃশেষ করে দিতে পারেনা। নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এতো ভালবাসা দিয়ে কি হবে? সারাজীবন তোমার একটা কষ্ট থেকেই যাবে। তুমি ভিতরে ভিতরে জলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। আর আমি শুধু দেখবো। আমার কিছুই করার থাকবে না। আমি কতটা অসহায়!

ঈশা ইভান কে ছেড়ে দিলো। জোরে কেদে ফেলল। কাদতে কাদতে বলল
–এরকম বল না প্লিজ। তোমার তো কোন দোষ নেই। তাহলে তুমি কেন ব্যর্থ হবে? আর তোমার যদি সত্যিই কিছু করার থাকত তাহলে কি তুমি আমাকে এভাবে কষ্ট পাইতে দিতে?

ইভান ঘুরে দাঁড়ালো। পিছনে হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো হাত গুজে। শান্ত কণ্ঠে বলল
–বোঝ? মানো না কেন?

ঈশা চোখ তুলে তাকাল। ইভান হাত বাড়িয়ে ঈশাকে বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
–কাদিও না প্লিজ। ট্রিটমেন্ট করার পর সব ঠিক হয়েও যেতে পারে। যদিও বা এখনই কিছু বলা সম্ভব না। তবুও আমরা তো আশা ছাড়তে পারিনা তাই না?

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান ঈশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–সব সময় মনের মধ্যে আশা রাখবে। দেখবে জীবনটা অনেক সুন্দর। অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছা করবে।

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভান একটু হেসে বলল
–সারা রাত কি আমাকে দেখেই পার করে দিবে? ঘুমাতে হবে না?

ঈশা হাসল। ইভান বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো। জানালা বন্ধ করে ঈশাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ঈশা কিছু একটা ভেবে বলল
–ট্রিটমেন্টের কথা তো সবাইকে জানাতে হবে।

ইভান সময় না নিয়েই সহজ স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–জানাবো। প্রবলেম কোথায়?

ঈশা ভীত কণ্ঠে বলল
–যদি অন্যভাবে নেয় সবাই?

ইভান একটু বিরক্ত হল। বলল
–অন্য ভাবে নেয়ার কি আছে? এটা কি তোমার দোষ? তুমি কোন অপরাধ করেছ? নাকি আমি করেছি?

ঈশা একটু ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–কারো দোষ না। এখন ঘুমাও।

ইভান ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। সে ভাবছে কাল তার বাবা মা চলে আসলেই তাদেরকে সবটা খুলে বলবে। তারপর ট্রিটমেন্টের কথাও বলবে। তারা নিশ্চয় বুঝবে বিষয়টা।

—————
সবাই বেশ চিন্তিত মুখে বসে আছে। ঈশার কান্নার আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। প্রচণ্ড পেট ব্যথায় কাতর সে। কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। ব্যাথার বেগ বেড়েই চলেছে। ইভান হাত ধরে বসে আছে পাশে। সেও বিচলিত হয়ে পড়েছে। কি করবে মাথায় ঢুকছে না। এভাবে সহ্যও করতে পারছে না। নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে। সারাদিন ভালোই ছিল ঈশা। ইভানের বাবা মা সকালেই চলে এসেছে। একদম যোগ্য বউয়ের মতো সব দায়িত্ব পালন করে সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাউকে কিছু না জানালেও ব্যথা ধিরে ধিরে বেড়ে যায়। আর তখন সহ্য করতে না পারায় চিৎকার শুরু করে। তখনই সবাই ছুটে যায় তার ঘরে। ব্যথা কমছে না বলে ইভান ইলহাম কে ফোন করে আসতে বলে।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ইভানের মা দরজা খুলে দিলো। ইলহাম কে দেখে বিচলিত কণ্ঠে বলল
–তুই এসেছিস বাবা। দেখ না মেয়েটার সন্ধ্যা থেকে কি হয়েছে। কেমন অস্থির হয়ে গেছে।

ইলহাম ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
–এটা খুব স্বাভাবিক বড় মামি। এরকম হবেই। এর জন্যই ট্রিটমেন্ট টা তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে।

ইভানের মা কিছু না বুঝেই জিজ্ঞেস করলো
–কিসের ট্রিটমেন্ট আর এরকমই বা কেন হবে?

ইলহাম উত্তর না দিয়েই ঈশার কাছে গেলো। ঈশাকে ভালো করে দেখে নিয়ে ইনজেকশন দিলো। ইভান কে উদেশ্য করে বলল
–কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে। আর ও ঘুমিয়ে পড়বে। সারা রাত ঘুমাক। ডাকার প্রয়োজন নেই।

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইলহাম ইভান কে বাইরে আসতে বলল। দুজন বাইরে এসে সোফায় বসে পড়ল। ইলহাম বলল
–খুব তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার। এটা এখন প্রায় সময়ই হতে থাকবে। আর জতদিন যাবে ব্যথা আরও তীব্র হবে।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তুমি সব ব্যবস্থা করো ভাইয়া।

ইলহাম মাথা নাড়তেই ইভানের মা আবার প্রশ্ন করলো
–তোরা কি নিয়ে কথা বলছিস আমাকে বলবি?

ইলহাম ইভানের দিকে তাকাল। তার তাকানোর মানে ইভান বুঝতে পেরে বলল
–মা জানে না কিছু।

ইলহাম আর সময় নষ্ট না করে উঠে বলল
–আমার কাজ আছে। যেতে হবে। আর তুই কাল ঈশাকে নিয়ে আমার ক্লিনিকে আয়। সব টেস্ট আবার করাতে হবে।

ইভান মাথা নাড়ল। ইলহাম চলে গেলো। ঈশার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। ইভানের বাবা এসে সোফায় বসে বলল
–মেয়েটার এখন কি অবস্থা?

ইভান মৃদু সরে বলল
–ঠিক আছে এখন।

ইভানের মা চিন্তিত হয়ে বলল
–ইভান কি হয়েছে ঈশার? কোন বড় সমস্যা?

ইভান একটু সময় নিয়ে সবটা তার বাবা মাকে খুলে বলল। সবাই মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনল। ঘরটাতে পিন পতন নিরবতা চলল বেশ খানিকটা সময়। এর মাঝেই ইভানের মা বলে উঠলো
–এই কথাটা লুকানো উচিৎ হয়নি। ট্রিটমেন্ট করেও যদি কিছু না হয় তাহলে তখন কি করবি?

ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–বাচ্চার বিষয়টা স্বামী স্ত্রীর একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার মা। এটা নিয়ে অন্য কারো কথা বলা শোভা পায় না।

ইভানের মা হতাশ গলায় বললেন
–অন্য কেউ? কাকে অন্য কেউ বলছিস তুই? আমি তোর মা ইভান। ভালো মন্দ এসব নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার আছে। সন্তানের ভালো মন্দ ভাবার দায়িত্ব প্রতিটা বাবা মায়ের।

–অবশ্যই আছে। আর আমি কোন অধিকার নিয়ে কথাও বলিনি। তুমি এসব নিয়ে ভাবতেই পারো। আমি তোমার ভাবনা আটকাতে পারবো না। কিন্তু আমার মনে হয় বিয়ের পরে কিছু বিষয় সন্তানদের উপরেই ছেড়ে দিতে হয়। তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে একটা কথা আছে। সেটার সিদ্ধান্ত একান্ত তাদের হওয়া উচিৎ মা।

ইভানের মা গম্ভির গলায় বললেন
–এটা কোন সিদ্ধান্ত নয় ইভান। তোরা বাচ্চা নিয়ে ভাবতে যদি সময় নিস তাহলে সেটা হতো সিদ্ধান্ত। তোদের যদি চিন্তা ভাবনা অন্য কিছু থাকতো তাহলে আমি ব্যাক্তিগত ভেবে সেটা নিয়ে কথা বলতাম না। কিন্তু এখানে পুরো বিষয়টা উলটা। ভাবার কোন অবকাশ নাই। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কিছুই নেই। আর যেটা একেবারেই নেই সেটা এখন আর কোন স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ থাকবে না। বাইরে বেরিয়ে আসবে।

কথাটা শুনে ইভান হাত গুটিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল
–আমি কারো কেয়ার করিনা। আমি আমার জীবনে সুখী থাকলে কার এতে কি যায় আসে সেটা দেখা আমার কাজ নয়।

ইভানের মা ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন। থম্থমে গলায় বললেন
–স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সুতো হল বাচ্চা। সারাজীবন এই সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে রাখে এই বাচ্চা। বাচ্চা ছাড়া সম্পর্ক আর সুতো ছাড়া ঘুড়ির মধ্যে কোন তফাত নেই। সুখ এতো সহজ নয়। মুখে হাজার বার সুখী শব্দটা উচ্চারণ করলেই আর নিজেকে সুখী দেখাবার চেষ্টা করলেই সুখী হওয়া যায়না। সেভাবে তুমি বাইরের মানুষকে দেখাতে পারবে সুখী। কিন্তু নিজে কি আসলেই সুখী হতে পারবে? বাচ্চা ছাড়া যে অপূর্ণতা তোমাদের জীবনে নেমে আসবে সেটা কিভাবে সামলাবে? তাছাড়াও বছরের পর বছর সংসার করার পর যখন বাচ্চার মুখ দেখতে পাবে না তখন সমাজ প্রশ্ন করবে। সেসবের উত্তর তোমরা দিতে পারবে? আজ আমার সাথে যুক্তি তর্কে টিকে গেলেও সমাজের যুক্তি তর্কে কিভাবে টিকবে সেটা কি ভেবেছ?

ইভানের মুখে কাঠিন্য ভাব চলে এলো। গম্ভির গলায় বলল
–আমি কোন সমাজের তোয়াক্কা করিনা। কে কি বলল সেসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। আর সব থেকে বড় কথা হল এই বিষয়টাতে আমাদের কোন হাত নেই। ঈশারও কোন দোষ নেই। তার যদি কিছু করার থাকত তাহলে কি ঈশা চুপ করে থাকত? কোন মেয়েই এই বিষয়টা সহজে মানতে পারেনা মা। ঈশাও পারেনি। ওকে মানাতে আমার কম কষ্ট করতে হয়নি। এখন আমি কোন ভাবেই চাইনা পুরনো ক্ষতটা আবার দগদগে হয়ে উঠুক।

–এসব আবেগের কথা ইভান। আমি বলছিনা ঈশার দোষ আছে। এটা তার দুর্ভাগ্য। তাকে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু বিয়ের আগে তোমার এই বিষয়টা আমাদের জানানো উচিৎ ছিল। এতো বড় একটা বিষয় এভাবে চেপে গিয়ে তোমরা ঠিক করনি।

ইভান মায়ের দিকে গভির দৃষ্টিতে তাকাল। আজ তার মাকেই তার কাছে অচেনা লাগছে। কি অদ্ভুত! সমাজের ভয়ে আজ একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে এভাবে তার দুর্বলতা নিয়ে আঘাত করতেও ভাবছে না। ইভান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–শুধু ঈশার দুর্ভাগ্য না মা। ঈশার ভাগ্য আমার সাথে জড়িয়ে আছে। তাই আমার ঠিক ততটাই দুর্ভাগ্য। আর যদি একান্তই বাচ্চা দরকার হয় তাহলে আমরা এডপ করবো। এতে তো কোন সমস্যা নেই।

ইভানের মা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন
–নিজের বাচ্চা আর অন্যের বাচ্চার মধ্যে পার্থক্য আছে ইভান। তোমার আগেই এই বিষয়টা ভাবা উচিৎ ছিল।

ইভানের মায়ের শেষের কথাটা ইভানকে পুরই ভেঙ্গে দিলো। তার মা যে আজ এমন কথা বলবে সেটা তার মাথাতেই আসেনি। ইভান উঠে দাঁড়ালো। কঠিন গলায় বলল
–ঈশা তোমার কাছে কোন অভাগি মেয়ে হতে পারে। তোমার কাছে তোমার ছেলের বউ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে আমার সব কিছু। ঈশা আমার জীবন। ঈশাকে কিছু বলা মানে আমাকে বলা। ঈশাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলা মানে আমাকে কষ্ট দেয়া। আর আজ তুমি আমাকে অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছ মা। এখন তুমি বুঝবে না। কিন্তু যখন বুঝবে তখন আক্ষেপ ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।

ঈশার মা অসহায় কণ্ঠে বলল
–আমি কোন খারাপ কথা বলিনি ইভান। আমার কথাটা বুঝতে চেষ্টা করো। আমি তোমাদের ভালো চাই।

ইভান উঠে দাড়িয়ে বলল
–আমি জানি মা। কিন্তু সব ভালো সব সময় সবার জন্য ভালো হয়না। তোমার কাছে যেটা ভালো সেটা আমার কাছে ভালো হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তুমি এটা ভেবে থাকলে ভুল করবে। আর হ্যা যদি এতে ঈশার কোন দোষ থাকত তাহলে হয়তো আমি তোমার ভালো মন্দ বিচার করার কথা গুলো শুনতাম। কিন্তু যেখানে আমার ঈশা অসহায় সেখানে কারো ভালো মন্দ বিচার করার অধিকার নেই। শোনা তো দুরের কথা।

ইভান পা বাড়াতেই ইভানের বাবা বলল
–এখন এসব কথা থাক। আমরা এসব নিয়ে পরে কথা বলবো। এখন মেয়েটা কেমন আছে আপাতত সেটাই জানা জরুরী।

ইভান ধরা গলায় বলল
–এসব নিয়ে আর কোন কথা হবে না। এখানেই শেষ। আর যদি কোন কথা হয়েই থাকে তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে যেই বাড়িতে ঈশার এই অক্ষমতাকে নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে সেই বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না। কারন এটা নিয়ে কথা বলা মানে ঈশাকে অপমান করা। আর ঈশাকে অপমান করা মানে আমাকে অপমান করা।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here