#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর,পর্ব ৭,৮
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৭
‘হঠাৎ বৃষ্টি’ কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের পরে হঠাৎ করেই মেঘ জমে গেলো আকাশে। চারিদিকে অন্ধকার করে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজে কেপে উঠল সব কিছু। বিকেলে নেমে গেলো ঝুম বৃষ্টি। সবুজ হয়ে উঠল প্রকৃতি। গাছের পাতা গুলো সতেজ হয়ে উঠল। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়ে দুই হাতে গ্রিল চেপে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকৃতির মেজাজ আজ রুক্ষ। বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে। গভির মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে ঈশা। ইরা পিছনে এসে জামা টেনে বলল
–আপু।
ঈশা পিছনে ঘুরে বসে পড়ল। ইরাকে দুই হাতে ধরে বলল
–কি হয়েছে?
ইরা হাতে একটা খাতা আর একটা কলম নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মুখটা মলিন। ঈশা একটু হেসে বলল
–কি হয়েছে? ইরু মনির মন খারাপ কেন?
ইরা খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলল
–লিখতে পারছি না।
ঈশা খাতাটা হাতে নিতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এসাইনমেন্টের খাতায় ইরা হাবিজাবি লিখে সব নষ্ট করে ফেলেছে। ঈশার মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেলো। শক্ত করে ইরার হাত চেপে ধরে বলল
–কি করেছিস এটা? কেন ধরেছিস আমার খাতা?
শক্ত করে ধরার ফলে ইরার হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা পাচ্ছিল। কিন্তু ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ইরা কেদে ফেলল। চিৎকার করে কাদতে শুরু করতেই ঈশা তার মুখ চেপে ধরল। গম্ভির সরে বলল
–একদম চুপ। শব্দ করবি না। নাহলে মারব কিন্তু।
ইরা ভয় পেয়ে শব্দ করে কান্না করা তো বন্ধ করলো কিন্তু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগল। ঈশা তাকে ঘরে হাত ধরে টেনে আনল। বিছানায় নিজে বসে ইরাকে আবারো চাপা সরে ধমক দিলো
–আবার চোখের পানি ফেলছিস। থামতে বলছি না।
কথা শেষ করে দরজার দিকে তাকাতেই তার চোখ কপালে উঠে গেলো। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ভয় পেয়ে ইরাকে ছেড়ে দিলো। ইরা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে আর কাদছে। ইভান এসে ইরাকে কোলে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে টুনটুনি কাদছিস কেন?
ইরা এমন আবেগি কণ্ঠ শুনে আবারো কেদে দিলো। কাদতে কাদতে বলল
–আপু মেরেছে।
ঈশা ধমকে উঠল। একটু জোরেই বলল
–এখন থেকেই মিথ্যা বলা শিখে গেছিস? আমি তোকে মেরেছি? কখন মারলাম?
ইরা ধমকে ভয় পেয়ে আবার কাদতে শুরু করলো। ইভান ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ইরার দিকে ঘুরে তাকে একটা চকলেট হাতে দিয়ে বলল
–কাদিস না টুনটুনি। তোকে আরও চকলেট দিবো। এখন থাম।
ইরা থেমে গেলো। ইভান ইরাকে কোল থেকে নেমে দিলো। ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ইভানের দৃষ্টি দেখে ঈশা ভয় পেয়ে উঠে দাড়িয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো। ইভান এগিয়ে গেলো। ঈশা একদম পিছিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। ইভান বারান্দার দরজায় এসে হেলানি দিয়ে দাঁড়াল। দৃষ্টি তার ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ। ঈশা এবার বুঝতে পারল সে সব থেকে বড় বোকামিটা করে ফেলছে। বারান্দায় না এসে ঘর থেকে পালিয়ে জাওয়া উচিৎ ছিল। এখন না জানি কি শাস্তি দিবে। এই মানুষটার শাস্তিও বেশ অদ্ভুত রকমের হয়। শারীরিক আঘাতের চিহ্ন আর ব্যথা দুইটাই সাময়িক হয়। কিন্তু মানসিক আঘাত সেটা চিরকাল থেকে যায়। রীতিমত ইমোশনাল টর্চার করে। ইভান দুকদম এগিয়ে যেতেই ঈশা আবারো পিছিয়ে গেলো। গ্রিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। আর পেছানর কোন উপায় নেই। ইভান কে এগিয়ে আসতে দেখে তার মনে হচ্ছে গ্রিল ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে পারলে ভাল হত। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। এর মাঝেই ইভান এগিয়ে এসে গ্রিলের দুই পাশে হাত রেখে ঈশাকে আটকে দিয়েছে। গম্ভির গলায় বলল
–আর পেছানোর সুজগ নেই।
ঈশা মাথা ঘুরাতেই চমকে গেলো। ইভান তার অনেক কাছে। দুজনের নাক প্রায় ছুঁইছুঁই। ঈশার খুব অসস্তি হচ্ছে। মিষ্টি একটা ঘ্রান নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। মাথা ঘুরে উঠছে। ইভান গম্ভির গলায় জিজ্ঞেস করলো
–কেন মেরেছিস ওকে?
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–মা…মারিনি তো।
–তাহলে কাদল কেন?
–এ…এমনি।
–এমনি কেউ কাদে?
ঈশার অস্বস্তিটা বেড়েই গেলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান বুঝতে পেরে সরে দাঁড়াল। এক পাশে দাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল
–কি করেছে ইরা?
ইভানের গলার আওয়াজ দূর থেকে আসায় ঈশা চোখ খুলে ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ইভান পাশেই সামনে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল
–আমার এসাইনমেন্টের খাতায় হাবিজাবি লিখে নষ্ট করে ফেলেছে। তাই বকেছি।
–এটা তাহলে তোর দোষ। বাসায় বাচ্চা আছে সেটা তোর ভাবা উচিৎ ছিল। ও ছোট মানুষ। এতো কিছু বুঝলে তো কাজ হয়েই যেত। তোর উচিৎ ছিল সব কিছু গুছিয়ে রাখা যাতে ইরার হাতে না পড়ে। ওর সাথে এভাবে খারাপ ব্যাবহার করার কোন মানে নেই।
ঈশা কথা বলল না। ইভানের কথা সব ঠিক। অপরাধির মতো চোখ নামিয়েই রাখল। ইভান ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–ঈশা। কোন সমস্যা?
ঈশা মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ঘুরে দাঁড়াল। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল। সেদিন ঈশা ইভান কে কিছু বলতে চেয়েও পারেনি। প্রথমত সাহসের অভাব। দ্বিতীয়ত কথার মাঝ পথেই ইরিনা এসে পড়ায় কথা শেষ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। ইভান বুঝতে পেরেছিল ঈশা হয়ত এমন কিছু তাকে বলতে চায় যা বলার জন্য তার নিজের কিছুটা সময় সাহস দুটোই প্রয়োজন। ইভান তাকে সময় তো দিতে পারে। কিন্তু সাহস কি আদৌ দিতে পারবে? সেটা তার জানা নেই। সে কি ঈশার জিবনে সেই জায়গাটা তৈরি করে নিতে পেরেছে যেখান থেকে ঈশা চোখ বন্ধ করে তার উপরে ভরসা করতে পারে। ঈশার মনে তার জন্য অনুভুতি তো তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস আর ভরসা কি এতই সহজ? পারবে কি ইভান ঈশার জীবনের এক মাত্র ভরসা হয়ে উঠতে? ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার মনে হয় তুই ভাল নেই। কারণটা আমার জানা নেই। চাইলেই জানাতে পারিস। না চাইলেও আপত্তি নেই। কারন জানতে চাওয়ার মতো অধিকার এখনও হয়নি। যখন হবে তখন কিন্তু আমি আমার অধিকার জোর করে আদায় করে নিব। তখন কিছুই লুকাতে পারবি না আমার কাছ থেকে।
ঈশা কিছু বলল না। ইভান আবারো বলল
–জীবন মানেই ছোট খাটো একটা জুদ্ধ ক্ষেত্র। আমরা যখন ছোট থাকি তখন বাচার অবলম্বন হয়ে উঠে অবচেতন মনের রঙ বেরঙ্গের স্বপ্ন। আর যখন বড় হই তখন সেই রঙ বেরঙ্গের কিছু স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তখন শুরু হয় চরম বাস্তবতা। কাছের মানুষ গুলো হুট করেই কেমন অচেনা হয়ে উঠে। গোছানো জীবন অগোছালো হয়ে উঠে। হঠাৎ করেই এমন বাস্তবতার মাঝে পড়ে কেউ ঠিক থাকতে পারেনা। তখন প্রয়োজন হয় একটা ভরসার হাত। জার হাতে হাত রেখে কিছু সময়ের সস্তি পাওয়া যায়। জিবনে বেচে থাকার মানে খুজে পাওয়া যায়। জিবনের কষ্টের ভাগটা তার কাছে গুছিয়ে বলতে পারলে নিজেকে অনেক হালকা মনে হয়। আমি জানি তু………।
–জীবনটা কি সত্যিই এতো সুন্দর?
ঈশা ইভান কে থামিয়ে দিয়েই মাঝপথে প্রশ্ন করে বসে। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
–কোন জীবনই সুন্দর হয়না। সুন্দর করে নিতে হয়। ভাল থাকা নিজের কাছে। সব থেকে কষ্টের মুহূর্তেও যে জীবনের সুন্দর মুহূর্ত থেকে ভাল থাকার মানে খুজে নেয় ভাল থাকার অধিকার তারই।
ঈশা আবারো প্রশ্ন করলো
–কষ্টের মাঝে ভাল থাকা যায়? কিভাবে?
ইভান মুচকি হেসে বলল
–ভাল থাকার জন্য জিবনে এমন একটা মানুষ থাকা দরকার জার কথা কষ্টের মুহূর্ত গুলতে মেডিসিনের মতো কাজ করবে। তার হাসি মুখটা দেখলেই সমস্ত কষ্ট ভুলে মনে হবে জীবনটা সত্যিই অনেক সুন্দর। দিন শেষে ক্লান্ত শরিরে আমি যখন ফিরব তখন তার মিষ্টি হাসি দেখেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখে শত শত রাত না ঘুমিয়েই পার করে দেয়া যাবে।
ঈশা হেসে ফেলল। বলল
–না ঘুমালে তো অসুস্থ হয়ে যাবে। অসুস্থ শরির নিয়ে এতো কিছু ভাবার সময় হবে তখন?
ইভান হেসে বলল
–ঐ যে ভাল থাকার মেডিসিন। ওটা কাছে থাকলে তো আর কিছুই লাগবে না।
ঈশা আবারো হাসল। ইভান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঈশার মন খারাপ ছিল সেটা ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছিল সে। কিন্তু কারণটা তার অজানা। তবুও নিজের মতো করেই চেষ্টা করছে তার মন ভাল করতে। একটু থেমে বলল
–যাহ! যেটা বলতে এসেছিলাম সেটাই ভুলে গেছি।
ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান মুচকি হেসে বলল
–বৃষ্টির দিনে আম্মু আজ নতুন রেসিপি রান্না করেছে। তোদেরকে ডাকতে এসেছিলাম।
ঈশা ইভানের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকল। অদ্ভুত মানুষটা। মুহূর্তেই কেমন পুরো পরিবেশটা পরিবর্তন করে দিলো। তার অল্প কিছু কথায় মন খারাপ গুলো ভাল লাগায় পরিনত হয়ে গেলো। ইভান সামনে তাকিয়ে বলল
–পুরাতন কষ্ট ভুলে নতুন করে ভাবার সুযোগটা সব সময় আসেনা। তাই সেটা আসলেও ফিরিয়ে দিতে নেই।
ঈশা উত্তর দিলনা। কি বোঝাতে চাইল ইভান সেটাও বুঝল কিনা কে জানে। ঈশা একটু ভেবে বলল
–চল।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান ইরাকে কোলে নিয়েছে আর তার পাশে হাঁটছে ঈশা। ঝুম বৃষ্টির ফলে রাস্তায় প্যাচ প্যাচে কাদা। ঈশা কাপড় তুলে হাঁটছে। কিছুদুর গিয়ে থেমে গেলো। সামনে অনেক কাদা। তার স্যান্ডেল গুলোও অনেক পিচ্ছিল। সাপোর্ট ছাড়া হাটা অসম্ভব। ইভান দাড়িয়ে পিছনে ঘুরে ঈশার কাণ্ড দেখছে। ঈশা ভ্রু কুচকে ভাবছে কিভাবে পার করবে। ইভান কোন কথা বলছে না। সে দেখতে চায় ঈশা কি করে। কিছুক্ষন ওভাবে দাড়িয়ে থেকে ঈশা বলল
–কিভাবে যাব? পুরো কাদা। পা দিলেই নির্ঘাত পড়ে যাব।
ইভান শান্ত কণ্ঠে বলল
–আমাকে ধরতে পারিস। আমি কিছু মনে করব না।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ঠোট চেপে হেসে দুষ্টুমির সুরে বলল
–তোর কাছে এটা ছাড়া আর কোন অপশন নেই। কারন আমি ধরলে তুই আর হাটতে পারবি না। ওখানেই দাড়িয়ে যেতে হবে।
ঈশা কটমট চোখে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে সামনে এগিয়ে গেলো। কিছুদুর যেতেই পা পিছলে পড়ে গেলো। ইভান এক হাতে কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল। ইভানের এতো কাছে আসায় ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু উপায় নাই। একটু নড়াচড়া করলে একদম কাদায় পড়ে যাবে। তাই শক্ত করে ইভানের শার্ট চেপে ধরল। সামনে ঈশান ইরিনা আর ইলু ইভান দের বাড়িতে যাচ্ছিলো। ইলু আর ইরিনা খেয়াল না করেই ভিতরে ঢুকে গেলো। কিন্তু ঈশান তাদেরকে দেখে সেদিকে এগিয়ে এলো। এভাবে দেখে বলল
–কোন সমস্যা?
ইভান বলল
–না ঠিক আছে। তুই ইরাকে নিয়ে যা।
ঈশান ইরাকে কোলে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ঈশা কিছু বুঝে উঠার আগেই ইভান তাকে কোলে তুলে নিলো। কাদা পার করে একদম দরজার সামনে এনে নামিয়ে দিলো। ঈশার পুরো শরির অসাড় হয়ে গেছে। সে অসস্তিতে অস্থির হয়ে উঠেছে। ইভান কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল
–কথা না শুনলে এমনি হবে। তুই নিজেই তোর অপশন পছন্দ করেছিস। আমার কিছু করার নেই।
কথা বলেই সামনে তাকিয়ে দেখল ঈশান তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান তাকাতেই অমায়িক একটা হাসি দিলো। ঈশা আরও অসস্তিতে পড়ে গেলো। সে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ভিতরে। ইভান ঈশানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই দাত কেলিয়ে বলল
–ঈশার জায়গায় আমি হলেও কি আমাকে যত্ন করে কাদা পার করে দিতে?
ইভান বিরক্ত হল। ঈশানের সামনে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–তোর প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তাই প্রশ্নই উঠে না। তুই পড়ে গেলেও আমার কোন যায় আসেনা।
বলেই সামনে পা বাড়াতেই ঈশান আবার বলল
–সবি বুঝি। কার প্রতি তোমার এতো ইন্টারেস্ট!
ইভান পিছনে ঘুরে বলল
–আমার ইন্টারেস্ট জেখানেই থাক সেটা নিয়ে তোর এতো ইন্টারেস্ট মোটেই ভাল কথা না।
ইভান আর ঈশান হেসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই দেখল ঈশা আর ইলু দাড়িয়ে আছে। ইভান একটু অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–তোরা এখানে কি করছিস?
ইলু হেসে বলল
–কিছু না। তোমরা উপরে যাও। আমরা আসছি।
ইভান আর ঈশান উপরে চলে যেতেই ইলু ঈশার ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–পড়ে জাওয়ার অভিনয়টা তাহলে সার্থক।
ঈশা হতাশ হয়ে বলল
–রাজ্যের কথা বলে কিন্তু যা শুনতে চাই সেটাই বলেনা। অসহ্য একটা। এভাবে কি প্রেম করা যায় বল? আমিও কম না। আমার কাছে তো মুখে বলতেই হবে। আমিও দেখতে চাই কতদিন সময় নেয়।
চলবে……
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৮
টানা দুইদিন বর্ষণের পরে আজ আকাশ একদম পরিষ্কার। রোদ উঠেছে। ১ ঘণ্টা হল ইলেক্ট্রিসিটি নেই। গরমটাও বেশ অসহনীয়। গরমে গা চিটচিট করছে। ঈশা অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত পাতলা একটা খাতা দিয়ে অনবরত বাতাস করেই চলেছে। জামাটা ঘেমে গায়ের সাথে লেপটে গেছে। বেশ অসস্তিতে পড়ে গেছে ঈশা। কি করবে সেটা ভাবতে গিয়েই মাথায় আসলো গোসল করে ফেললে অস্বস্তিটা হয়ত একটু কমবে। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। ট্যাঙ্কি খালি হয়ে গেছে। যা পানি ছিল সবটা নানান কাজে ব্যবহার করে শেষ। এখন মহা যন্ত্রণা। ঈশা চেঁচাতে চেঁচাতে বাইরে গেলো। তার মা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। ঘাড় বাকিয়ে একবার ঈশার দিকে তাকাল। এলোমেলো চুল। বারবার ঘাম মুছে ফেলায় মুখ লাল হয়ে গেছে। ঈশার মা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–আমি গোসল করব। পানি নেই।
–তো আমি কি করব? অপেক্ষা করতে হবে। ইলেক্ট্রিসিটি না আসা পর্যন্ত।
ঈশা বেশ বিরক্ত হল। ধপধপ শব্দে রুমের ভিতরে চলে গেলো। কিন্তু ভিতরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সেই পাতলা খাতাটা নিয়ে বাতাস করতে করতে বারান্দায় গিয়ে বসলো। হালকা বাতাস আসছে। ঘরের থেকে এখানে একটু হলেও শান্তি আছে। মাথাটা সামনের দিকে বাড়াতেই দেখল তার একদম সামনের দোতলা ছাদ থেকে একটা ছেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটি অমায়িক হেসে উঠল। ঈশা বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই নিচে শুয়ে পড়ল। বারান্দার মেঝেতে শুয়ে থাকার ফলে তাকে আর বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে শুয়েই বিড়বিড় করে বলল
–আজকাল কার ছেলেরাও হয়। সামনে একটা মেয়ে দেখলেই হল। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন মেয়ে জিবনেও দেখেনি। এদের জন্য নিজের বাড়িতেও ঘোরাফেরা করার আগে ১০ বার ভাবতে হয়। অসহ্য!
উপরের দিকে তাকিয়েই অনবরত হাত নাড়িয়ে বাতাস করছে। ঘামে ভেজা শরীরে মেঝের ঠাণ্ডা ভাবটা লাগতেই শরির ঝিমিয়ে আসলো। চোখের পাতা ভারি হয়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো ঈশা বুঝতেই পারল না। ইভান বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। সামনে গ্রিলে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আশে পাশে তাকাল। পাশের বারান্দায় একবার তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। ঈশা এরকম বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? তারপর মনে হল অনেক্ষন যাবত ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই হয়ত গরমে এখানে এসে বসে ছিল। একটা শ্বাস ছেড়ে ভিতরে চলে গেলো।
ঈশা ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছে বুঝতে পারল না। বাইরে থেকে বেশ আওয়াজ কানে আসায় ঘুমটা হালকা হয়ে গেলো। উঠে বসে এদিক সেদিক তাকাল। এখন কেউ নেই। ছেলেটা তাকে দেখতে না পেয়ে চলে গেছে মনে হয়। ঘুমু ঘুমু চোখে এলোমেলো পা ফেলে বাইরে বের হয়ে দেখল তার মা আর বড় চাচি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। ঈশা হাই তুলে ঘুম জড়ান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কোথাও গিয়েছিলে তোমরা?
ইভানের মা বলল
–আমরা আচার শুকাতে দিতে গিয়েছিলাম ছাদে। তুই কি করছিলি?
ঈশা অসহায় সরে বলল
–পানি নেই বড় মা। গোসল করতে পারছি না।
ইভানের মা ভ্রু কুচকে বলল
–আমাদের বাসায় চল। ওখানে গোসল করবি।
ঈশা কিছু বলতে চেয়েও পারল না। তাকে কোন কথা বলতে না দিয়েই ইভানের মা বলল
–কাপড় নিয়ে আমার সাথে চল।
ঈশা সম্মতি দিয়ে ঘরে চলে গেলো কাপড় নিতে। কাপড় হাতে নিয়েই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। সামনের এলোমেলো চুলগুলো একটু ঠিক করে ওড়নাটা মাথায় টেনে দিলো। তখনই চোখ পড়ল ডান হাতে। বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকাল। হাতের চুরিটা কিছুদিন আগে মার্কেটে দেখে এসেছিল সে। বেশ ভাল লেগেছিল তার। কিন্তু ইভানের তাড়াহুড়োতে কেনা হয়নি সেদিন। তাই একটু মন খারাপ হয়েছিল। পরে আবার ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু সেই চুরি আবার তার হাতে আসলো কিভাবে। চুরিটা খুলে হাতে নিলো। অদ্ভুত ব্যাপার তো। সকালেও এটা ছিল না। তার মানে সে যখন বারান্দায় ঘুমাচ্ছিল কেউ এটা পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কে? আর কেনই বা তার হাতে না দিয়ে এভাবে চুপি চুপি পরিয়ে দিলো? কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল ঈশা। সব ঠিক করে কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেলো।
————–
অনেকটা সময় নিয়ে ঈশা গোসল করে বের হয়ে দেখে ঘরে ফ্যান চলছে। বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে চুল গুলো মুছে বিছানায় বসলো। তখনের ঘুমটা পুরন না হওয়ায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু ঠেকিয়ে আরাম করে বসলো সে।
–তুই আমার ঘরে?
গম্ভির আওয়াজে চোখ খুলে ফেলল। ইভান কে সামনে দেখে মোটেই অবাক হল না। কারন সে ইভানের ঘরে বসে আছে। সে জখন এসেছে তখন ইভান বাসায় ছিল না। তাই তার ওয়াশ রুমে ঢুকেছিল। ইভান বেশ কিছুক্ষন ভ্রু কুচকে দাড়িয়ে থেকে আবার বলল
–কি করছিস এখানে?
ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
–বাসায় পানি ছিলনা তাই এসেছিলাম গোসল করতে।
ইভান আর কিছু বলল না। বিছানার উপরে পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল। ফোনে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। ঈশা আবারো মাথা ঠেকিয়ে দিলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করলো না। এবার দৃষ্টি স্থির করলো ইভানের উপরে। দুজনেই চুপচাপ। অনেকটা সময় পর ইভান ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি কতটা সুন্দর সেটা জানি তো। তাই বলে এভাবে দেখার কিছু নেই।
কথা শেষ করে ফোনটা বুকের উপরে রেখে ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। একটু ঘুরে বসলো। ইভান এবার মনোযোগ দিয়েই ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা বুঝতে পেরেই ঈশার আরও বেশী অসস্তি হচ্ছে। ওভাবে শুয়েই বলল
–চুল ঠিক মতো মুছিস নি কেন? ঠাণ্ডা লাগবে না?
ঈশা উলটা দিকে ঘুরেই মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–লাগুক।
ইভান কঠিন সরে বলল
–কিছু বললি?
ইভান যে তার কথা শুনতে পেয়েছে সেটা গলার সর শুনেই ঈশা বুঝতে পারছে। তাই একটু ভয় পেয়ে বলল
–কিছু না।
বলেই উঠে গেলো। ঈশা দরজা পর্যন্ত যেয়েও আবার থেমে গেলো। ইভান ততক্ষনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ঈশা দরজার সাথে হেলানি দিয়ে হাত গুজে গম্ভির সরে বলল
–ইভান ভাইয়া।
ইভান চোখ খুলে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল
–কিছু বলবি?
ঈশা মুচকি হেসে বলল
–তুমি আমার ঘরে গিয়েছিলে?
ইভান চোখ খুলে ফেলল। কঠিন দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল
–তুই কি সেটাই এক্সপেক্ট করিস?
ইভানের এমন প্রশ্নে ঈশার মেজাজ বিগড়ে গেলো। উত্তর তো দিলই না উলটা এমন একটা প্রশ্ন করে বসলো ঈশা এখন কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। ঈশাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে ইভান ধমক দিয়ে বলল
–কিছু বলতে চাইলে বল। নাহলে এখান থেকে চলে যা। মেজাজটা এমনিতেই খারাপ আছে। আরও খারাপ হয়ে গেলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখ আছে।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–মেজাজ কেন খারাপ?
ইভান এবার এমন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশা খুব ভালভাবেই বুঝে গেলো যে মেজাজ খারাপের কারন সে। কিন্তু সে কি এমন করলো যে ইভান এরকম রেগে গেলো। এরকম রেগে জাওয়ার তো কোন কারন নেই। তার ওয়াশ রুমে গোসল করার জন্য রাগ নাকি চুল না মুছার জন্য রাগ। আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই ইভান উঠে বসে বলল
–আমার মেজাজ খারাপের কারনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় তুই জানতে চাস। তাই কারণটা নিয়ে এতো গবেষণা না করে যা জানতে চাস সেটা জিজ্ঞেস করেই চলে যা।
ঈশা একটা শুকন ঢোক গিলে বলল
–তুমি কি আমার ঘরে এসেছিলে?
জিজ্ঞেস করতেই ইভান আবারো কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। তার দৃষ্টির মানে এমন যেন একি কথা আর একবার জিজ্ঞেস করলেই কথা বলাই বন্ধ করে দিবে। ঈশা নরম সরে আবার বলল
–না মানে আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি। আমার মনে হল আমার ঘরে কেউ গিয়েছিল তাই জিজ্ঞেস করলাম। অন্য কোন কারন নেই।
ইভান শান্ত সরে বলল
–আমিও সেরকম কিছু বলতে চাইনি। তোর কেন এরকম মনে হল যে আমিই গিয়েছিলাম? বাড়িতে এতো মানুষ থাকতেও আমার এই বাড়ি থেকে তোর ঘরে যাওয়ার কারণটা তোর কাছে স্পষ্ট হলেও আমার কাছে নয়। বিষয়টা কি একটু অদ্ভুত মনে হয়না?
ঈশা কোন কথা বলল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো। কারন সে ভাল করেই জানে ইভান তার ঘরে গিয়েছিলো। আর সেই তাকে এই চুরিটা পরে দিয়েছে। সে তখন ঘুমাচ্ছিল বলেই বুঝতে পারেনি। আর এখন তার কাছে কোন প্রমান নেই। এই চুরির কথা জিজ্ঞেস করলেও ইভান এখন কোন ভাবেই সিকার করবে না। কিন্তু কেন? এরকম করার তো কোন দরকার নেই। বলে দিলেই হয়। বললে তো আর ঈশা তাকে খেয়ে ফেলবে না। মানুষটা কেমন আজব। কিন্তু কিভাবে তার মুখ থেকে বের করবে। কেন যে এরকম একটা জটিল মনের মানুষের প্রেমে পড়েছিল। দুনিয়াতে কি সরল মনের মানুষের অভাব ছিল। জতসব! ভেবেই দরজার মধ্যে একটা লাথি দিলো। নিজের পায়ে নিজেই ব্যাথা পেল। কিন্তু প্রকাশ করলো না। ব্যাথার থেকে রাগটাই তার বেশী এখন। ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশা। ইভান তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–এভাবে লাথি দিলে রাগ তো কম্বেই না বরং পা ভাংবে। তখন বরের কোলে চরে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে। আমার অবশ্য কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তুই পারবি তো?
ঈশা আরও রেগে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার বর আর আমার ব্যাপার সেটা। আমরাই বুঝে নিব।
–বুঝলেই ভালো।
একটা জ্বালাময়ী হাসি দিয়ে ইভান ওয়াশ রুমের দরজা পর্যন্ত চলে গেলো। ঈশা রেগে বিড়বিড় করে বলল
–রুমে একটা সিসি ক্যামেরা লাগাব যাতে কে আসে কে যায় সবটা রেকর্ড হয়ে থাকে। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কাউকে আর প্রশ্ন করতে হবে না।
–খুব ভালো চিন্তা। আমিও ভাবছি জানিস এরকম কিছু করলে খারাপ হয়না। সারাদিন রুমে বসে সামনে মনিটরে দেখব।
ঈশা ভ্রু কুচকে ইভানের দিকে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–সারাদিন ঘরে থাকলে আবার সিসি ক্যামেরা লাগানোর কি দরকার?
ইভান হাসল। দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
–আমি কখন বললাম আমার ঘরে লাগাবো। আমি তো তোর ঘরের কথা বলছিলাম।
ইভানের কথা শুনে ঈশার মুখ পুরাই হা হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকাল। ইভান চোখ টিপ দিয়ে মুচকি হেসে ওয়াশ রুমের সামনে গেলো। দরজা ঠেলতেই ঈশা এপাশ থেকে গলা তুলে বলল
–এই বিশেষ উপহারের জন্য অজানা মানুষটাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। এভাবে চুপিচুপি না দিলেও পারত। তবুও অনেক ধন্যবাদ।
ইভান সামনে তাকিয়েই মুচকি হেসে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশাও হেসে বাইরে চলে গেলো।
চলবে………