#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ৩,৪
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩
পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়েছে। তার চারপাশের আকাশটা কমলা আর হলুদের সংমিশ্রণে কি এক অদ্ভুত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। এই মেঘের রং আর সময় দুটাই ঈশার খুব পছন্দের। প্রায় সময়ই সে এই সময় ছাদে বসে থাকে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দৃশ্য দেখতে। কিন্তু আজ রিক্সাতে বসেই সেই দৃশ্য উপভোগ করে ফেললো। উচু উচু দালানের পেছনে সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল। আর কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই সে পৌঁছে যাবে ইভানের কাছে। সে বাসায় চলে আসার পরেই ইভানের জ্ঞান ফিরেছে। ইফতি সে খবর দিতেই তাকে ফোন করেছিল। খবরটা শুনেই ঈশার খুশীর অন্ত নেই। এই দুইদিন তার কিভাবে কেটেছে কেউ জানে না। অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান হল। এখন ইভান পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেই সে সমস্ত দূরত্ব মিটিয়ে ফেলবে। সব সম্পর্ক ঠিক করে ফেলবে। ইভান কে এই জীবনে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আর কষ্ট দিতে চায়না। ইভানের সাথে ভালভাবে বাচতে চায় সে বাকি জীবনটা। প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয়টা এই দুইদিনে প্রতিটা মুহূর্তে সে অনুভব করেছে। সে চলে যাবার পর ইভানের কষ্টটা অনুভব করতে তার বিন্দু মাত্র অসুবিধা হয়নি। আর সেটা অনুভব করেই নিজের অপরাধ বোধটা বেড়ে গেছে। সেটাকে সে এবার শেষ করে ফেলবে। আর কোন বাধা বিপত্তি থাকবে না তাদের মাঝে। থাকবে শুধু ভালবাসা। রিক্সা থেমে যেতেই ঈশা ভাবনা থেকে বের হল। চোখ ফিরিয়ে একবার দেখে নিয়েই নেমে পড়লো। ইরা আর ঈশা ভেতরে চলে গেলো। ইভান কে কিছুক্ষন আগেই কেবিনে শিফট করা হয়েছে। সে সোজা গিয়ে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ালো। সবাইকে সেখানেই পাওয়া গেলো। সবার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা চিন্তা মুক্ত তারা। ঈশা ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিতেই ইলহাম বলল
–ঘুমাচ্ছে। এখন আমি কোনভাবেই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারব না। হি নিড রেস্ট। ইভানের এখন ঘুমটা খুব দরকার। ঘুম ভেঙ্গে গেলে তবেই ভেতরে যেতে পারবি।
ঈশার মনটা খারাপ হয়ে গেলো ভীষণ। মনে হল সে দেরি করে ফেলেছে। আর একটু তাড়াতাড়ি আসলে হয়তো ইভান কে দেখতে পেত। কাঙ্ক্ষিত মানুষটার মুখটা একবার দেখার জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো। মুখেও তার সেই বিষাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেলো। কিন্তু সেরকম কিছুই করলো না। চুপচাপ সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। অসহায়ের মতো বলল
–আমি অপেক্ষা করছি। যখন যেতে পারব আমাকে বল। আমি শুধু একবার দেখবো।
ঈশার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ভেতরের অবস্থাটা খুব সহজেই আন্দাজ করা গেলো। ইলহাম সবার সাথে কিছুক্ষন কথা বলে চলে গেলো। ইফতি এসে পাশে বসতেই ঈশা জিজ্ঞেস করলো
–তুই দেখেছিস তোর ভাইয়াকে?
ইফতি মাথা নাড়ল। বলল
–কেবিনে শিফট করার মুহূর্তে দেখা হয়েছে।
ঈশা আগ্রহ নিয়ে তাকাল। বলল
–কথা বলেছিস?
ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–না। শুধু চোখ খুলে একবার দেখছিল। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। আমরাও আর বিরক্ত করিনি। আরও একটু সুস্থ হয়ে নিক। তারপর কথা বলা যাবে। এখন বিপদ কেটে গেছে এটাই অনেক।
ঈশা সম্মতি জানাল। কিন্তু সে কিছুতেই ঠিক থাকতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ভেতরটা আবারো অস্থির হয়ে উঠতেই সে উঠে দাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো এপাশ ওপাশ। পুরদমে পায়চারি করছে অস্থির ভাবে। ইরা কিছুক্ষন স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু কোন কথা বলল না। অনেকটা সময় পায়চারি করে ঈশা দমে গেলো। ক্লান্ত হয়ে দাঁড়ালো কেবিনের দরজার সামনে। দ্রুত শ্বাস পড়ছে তার। কেবিনের দরজাটা কাচের হলেও ভেতরের পর্দাটা পুরোটা টেনে দেয়া। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হল না। ব্যর্থ হয়ে বসে পড়লো আবার। সে ভাবছে এতো বছরের অপেক্ষা তার উপরে কোন প্রভাব ফেলতে পারল না। কিন্তু এই অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা কেন সহ্য হচ্ছে না। আশ্চর্য! ইভানের ঘুম ভাঙ্গা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারছে না। চোখটা বন্ধ করে ফেললো। ভীষণ অস্থিরতার মাঝেই কেটে গেলো সময়টা। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে কিছুক্ষন আগে। ইলু আর সায়ান মাত্র এসেছে। ইরিনাও এসেছে কিছুক্ষন আগে। ইলহাম এখনো কেবিনের ভেতরে। বেশ কিছুক্ষন পর বের হয়ে আসলো। ঈশার সামনে দাড়িয়ে বলল
–তুই এখন ভেতরে যেতে পারবি। কিন্তু কিছু বিষয় খুব ভালভাবে মাথায় রাখবি। কোন রকম কান্নাকাটি করতে পারবি না। আর ইভান ঘুমিয়ে থাকলে তাকে ডাকতে পারবি না। ও নিজে থেকে কথা না বললে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি না। ও এখনো অনেক দুর্বল।
ঈশা মাথা নাড়িয়ে কেবিনের ভেতরে গেলো। দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখে পড়লো একজন নার্স ইভান কে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। এগিয়ে গেলো সেদিকে। ইভানের উপরে চোখ পড়তেই ভেতরটা কেঁপে উঠলো ঈশার। সাদা চাদরে মোড়ানো অচেতন দেহটা পড়ে আছে। মাথার পুরো অংশটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখের এক পাশে ছোপ ছোপ কালো দাগ। ঠোঁটের এক কোণা ফুলে উঠেছে। ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। চোখের পানি বাধ মানল না। গড়িয়ে পড়তে লাগলো অনবরত। ইলহামের কথাটা মাথায় আসতেই বের হয়ে এলো সেখান থেকে। বাইরে এসেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ইলহাম বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। সে জানত ঈশা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না।। ইলহাম তাকে আলতো করে ধরে বসিয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–ঠিক হয়ে যাবে। কাদিস না। শান্ত হ।
ঈশা কিছুতেই শান্ত হল না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অসহ্য যন্ত্রণা। নিজের সাথে এরকম কিছু হলে সে হয়তো শারিরিক যন্ত্রণাটা সহ্য করে নিতো। কিন্তু ইভান কে এই অবস্থায় দেখে মানসিক যন্ত্রণা তার কাছে এই জগতে সব থেকে বেশী মনে হচ্ছে। ভেতরে কাঁটার মতো ফুঁড়ছে। আবারো হুহু করে কেদে উঠলো। ইলহাম ইলুকে ইশারা করে সামলাতে বলেই চলে গেলো। ইলু তাকে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো। ঈশাও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নিজের সব কষ্টটুকু ছড়িয়ে দিলো। নিজেকে সামলাতে পারল না সে। ইরা মৃদু সরে বলল
–আপু শান্ত হও। এটা হাসপাতাল। এখানে এভাবে কান্নাকাটি করা নিষেধ।
ইরার কথা শুনে নিজেকে শান্ত করে নিলেও ভেতরের যন্ত্রণাটা তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণা।
————
কয়েকদিনের টানা বর্ষণের সমাপ্তি ঘটিয়ে রোদ্রজ্জল ঝলমলে দিনের সূচনা হল। ঈশা আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই বাতাসে খোলা জানালার পর্দা সরে গিয়ে এক ফালি রোদ এসে ছুঁয়ে দিলো তাকে। সেদিকে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। বারান্দার দরজাটা খুলে দিতেই রোদ এসে সরাসরি মুখে পড়লো। চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। দৃষ্টি ঠিক করে নিয়ে আবার আলতো করে তাকাল। এক পা দুই পা করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বেশ মিষ্টি রোদটা। মৃদুমন্দ বাতাস এসে মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। আকাশের দিকে তাকাল। স্বচ্ছ নীল আকাশের বুকে শুভ্র মেঘের বিচরন। কি সুন্দর সেই দৃশ্য। হুট করেই মনে পড়লো শরত কাল শুরু হয়েছে। আর শরত মানেই শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর শুরু। নীল আকাশ তার বুকে শুভ্র মেঘকে আদরে আলিঙ্গন করবে। আর সেখানে কালো মেঘের বিচরন একেবারেই নিষিদ্ধ। মুচকি হাসল সে। এই ঋতুটা তার ভীষণ প্রিয়। দৃষ্টি ফেরাতেই চোখ পড়লো বারান্দার এক কোণায় টবে অযত্নে বেড়ে ওঠা অল্কানন্দা ফুলটার দিকে। ভীষণ অভিমানে নুইয়ে পড়েছে। ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছুঁয়ে দিলো আলতো হাতে। অভিমান করারই কথা। কয়েকদিন একেবারেই জত্ন নিতে পারেনি। বিছানা থেকেই উঠলো আজ তিনদিন পর। ইভানের এক্সিডেন্টের পর থেকে বেশ অনিয়ম হয়েছে তার। কারো কথা শুনত না। হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। যার দরুন গত তিনদিন যাবত হাসপাতালে যেতে পারেনি। পারেনি বললে ভুল হবে। সবাই তাকে ব্ল্যাক মেইল করে আটকে রেখেছে। সে কথা না শুনলে ইভান কে বলে দেবে। তাই ঈশাও মেনে নিয়েছে। তবে বিছানায় শুয়েই প্রতি ঘণ্টায় কাউকে না কাউকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেছে। ইভান এখন মোটামুটি সুস্থ। ইভানের জ্ঞান ফেরার পর থেকে ঈশার সাথে তার একবারও কথা হয়নি। মাথায় আঘাতের কারনে তার ঘুমের প্রয়োজন। তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। তাই ঈশা যখনই দেখতে যেতো প্রায় সময়ই সে ঘুমিয়ে থাকতো। ঘর থেকে ফোন বাজার আওয়াজ আসতেই দ্রুতপায়ে সেদিকে গেলো। ধরেই নিলো হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। ইফতির নাম্বার দেখেই ফোনটা ধরে বলল
–হ্যা ইফতি বল।
–কেমন আছ তুমি? এখনো বিছানায় শুয়ে আছ নাকি উঠতে পারছ?
এখনো দুর্বলতা কাটেনি। বিছানা থেকে উঠলেই মাথাটা ঘুরে উঠছে। ইফতির কাছে সেটা মোটেও প্রকাশ করা যাবে না। কারন আজ তার হাসপাতালে যাবার কথা। তাই ঈশা কণ্ঠস্বর যথেষ্ট স্বাভাবিক করে বলল
–বিছানায় শুয়ে থাকব কেন? আমি এখন একদম সুস্থ। শুনে বুঝতে পারছিস না?
ইফতি হাসল। তার হাসিতে অবিশ্বাসের আভাস। ধরা পড়ে গেলো কিনা সেটা ভেবেই ঈশা কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। ইফতি হাসি থামিয়ে বলল
–বুঝতে পারছি। তুমি সুস্থ হয়ে গেছো।
ঈশা ব্যস্ত গলায় বলল
–তুই কি এখন বাসায় আসবি? আবার কখন যাবি হাসপাতালে? আমিও যাবো তোর সাথে।
ইফতি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তারপর বলল
–আসতে হবে না আর। ভাইয়াই যাচ্ছে বাসায়। ভাইয়াকে আজ রিলিজ দেবে।
ঈশার চোখ চকচক করে উঠলো খুশীতে। ইভান আসছে। ঈশা ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–ইফতি শোন। কখন আসবি তোরা?
ইফতি উত্তর না দিয়ে বলল
–আপু আমি পরে কথা বলছি।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ঈশা ফোন রেখে বলল
–যাহ! কেটে দিলো।
তারপর কি একটা ভেবে এক দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বাইরে বেরিয়ে দেখে ইরা আর তার মা টেবিলে বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছে। ঈশাকে এরকম হন্তদন্ত করে বের হতে দেখেই দুজন থমকে গেলো। মনের মাঝে হালকা ভয় তৈরি হল। ইরা ভীত কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে আপু? এভাবে কোথায় যাচ্ছ?
ঈশা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল
–বাবা কোথায় রে?
–বাবা তো সকালে উঠেই হাসপাতালে গেছে। ফোন এসেছিলো। কি যেন জরুরী কাজ আছে।
ঈশা মৃদু হেসে বাইরের দরজা খুলে বের হতে যাবে তখনই তার মা বলল
–কোথায় যাচ্ছিস?
ঈশা দাঁড়ালো। পেছন ঘুরে একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলল
–ঐ বাসায় মা। ইভান আসছে।
সবার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। অবশেষে চিন্তার অবসান ঘটলো। ইভান বাসায় আসছে। ঈশা দেরি না করে চলে গেলো ইভানদের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকেই আগে ইভানের মায়ের সাথে দেখা করলো। সকালের নাস্তাটা তার সাথেই খেল। তাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে কিছুক্ষন গল্প করলো। তারপর গেলো রান্না ঘরে। সে আজ নিজের হাতে রান্না করবে। ৫ বছর পর আজ ইভান কে নিজের হাতের রান্না খাওয়াবে। তার রান্নার মাঝপথেই ইরিনা আর ইলু চলে এলো। তারা জানত না ঈশা এই বাড়িতে। তারা তো ভেবেছিল ঈশা এখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। তাই দুজন আগেই চলে এসেছে বাড়ি ঠিক করে ফেলতে আর রান্না করতে। এসেই দেখে ঈশা অর্ধেক রান্না শেষ করে ফেলছে। তাদেরকে দেখেই ঈশা জিজ্ঞেস করলো
–ওরা কখন আসবে?
ইলু মৃদু হেসে বলল
–আর কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে। কিছু ফর্মালিটি বাকি আছে। সেগুলো শেষ করেই বের হবে।
তিনজন মিলে সব কাজ শেষ করে ফেললো। কাজ শেষে হাফ ছেড়ে বসল। বেশ ক্লান্ত তারা। একটা শ্বাস ছাড়তেই সায়ানের ফোন এলো। ইলু রিসিভ করে কয়েকটা কথা বলে রেখে দিলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল
–ওরা বের হয়ে গেছে। এলো বলে।
ঈশার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো খুশীর আমেজে। উত্তেজনা বেড়ে গেলো আচমকাই। অবশেষে ঘনিয়ে এলো সেই মোহময় মুহূর্ত।
চলবে……
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৪
কলিং বেল বেজে উঠতেই ঈশা দাড়িয়ে গেলো। ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি নিয়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দুটো থমকে গেলো। চার চোখ এক হল। কিছু সময় আদান প্রদান হল নীরব অনুভূতি। অনুভুতির ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। ইভানের চোখ ঝলমল করে উঠলো। সেও যেন মনে প্রাণে অপেক্ষা করছিলো এই মুহূর্তটার। বাসায় আসবে শুনেই তার প্রথম চোখে ভেসে উঠেছিল তার পথ চেয়ে বসে থাকা ঈশার দৃশ্য। দরজা খুলে তাকে দেখেই ঈশার মাঝে খেলে যাবে এক অনাবিল প্রশান্তি। সেই প্রশান্তির ছটা প্রকাশিত হবে তার চোখে মুখে। এই মুহূর্তে সেই কল্পনাটাই সত্যি হতে দেখছে ইভান। তার চোখে মুখেও ছড়িয়ে পড়লো আনন্দ।
–ভাইয়া ভেতরে আসো।
ইলুর কথা কানে আসতেই ঘোর কাটল। ইভান চোখ সরিয়ে ইলুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ঈশা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। একে একে সবাই ভেতরে ঢুকল। ইভান সোফায় বসে পড়লো। এখন সে ভালই আছে। শারীরিক দুর্বলতাটা একটু বেশীই। এখনো কেটে উঠতে পারেনি। একটু সময় লাগবে। ঈশা ইভানের পেছনে এসে দাঁড়ালো। চাপা একটা অভিমান খেলে গেলো মনে। ভেবেছিল ইভান তাকে দেখেই অস্থির হয়ে পড়বে। জড়িয়ে ধরে রাখবে কিছু সময়। তারপর আদুরে কণ্ঠে বলবে “ভীষণ মিস করেছি। কেন যাও নি হাসপাতালে আমাকে নিতে?”। কিন্তু এসবের কিছুই হল না। এমন কি কোন কথাই বলল না। এর মাঝেই ইরা হন্তদন্ত করে ভেতরে ঢুকে ইভানের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। টলমলে চোখে জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া কেমন আছো?
ইভান ক্লান্ত হাসল। মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ভালো আছি টুনটুনি। তুই কেমন আছিস?
ইরা কথা বলতে পারল না। গলা ধরে আসছে তার। যে কোন সময় চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সে এটাও জানে যে ইভানের সামনে কান্নাকাটি করা যাবে না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোট কামড়ে মাথা নাড়ল। খুব দ্রুত উঠে গেলো সেখান থেকে। ইভান পুরো ব্যাপারটাই ধরতে পারল। কিন্তু কিছুই বলল না। সায়ান বলল
–তুই ফ্রেশ হবি নাকি?
ইভান মাথা নাড়ল। সায়ান বলল
–তাহলে তুই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। দুপুরে ঔষধ খেতে হবে। আমি ঈশাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ইভান উঠে দাঁড়ালো। মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল
–মার সাথে দেখা করে আসি।
বলেই সেদিকে চলে গেলো দ্রুত পায়ে। সায়ান ঈশাকে অনেকটা সময় নিয়ে তার প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দিলো। আর বলল ইলহামের সাথে ফোনে কথা বলে নিতে। কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটা জানাতে বলেছে। ঈশা সবটা বুঝে মাথা নাড়ল। ঈশা সবার উদ্দেশ্যে বলল
–তোমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে এসো। একসাথে খাব। আমি এগুলো ঘরে রেখে আসি।
সবাই যে যার মতো চলে গেলো। ঈশা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো। লক করা নেই বোধহয়। কারন ঈশা যখন সায়ানের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখন ইভানের মা ঘুমাচ্ছিল বলে সে একবার দেখেই চলে এসেছে ঘরে। ঈশা দরজার হাতলটা ধরতেই খেয়াল করলো তার বুকের ভেতরটা দুরদুর করে কাঁপছে। ভেতরে ঢুকে কি হবে সেই দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারছে না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে দরজা খুলে ফেললো। ভেতরটা অন্ধকার। দরজা জানালা কিছুই খোলা নেই। এমনকি লাইটও জালানো নেই। ঈশা সুইচ চেপে আলো জ্বালাতেই কানে আসলো ওয়াশ রুম থেকে পানির আওয়াজ। ইভান ওয়াশ রুমে। সম্ভবত শাওয়ার নিচ্ছে। ঈশা ঔষধ গুলো টেবিলে রেখে বারান্দার দরজাটা খুলল। একটু পা বাড়াতেই চোখে পড়লো তার বারান্দার সেই অল্কানন্দা। হলুদ রঙের ফুলটা এখনো অভিমান করেই আছে। তাড়াহুড়োতে তার জত্ন নিতেই বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে। হতাশ শ্বাস ছেড়ে পেছনে তাকাতেই চমকে গেলো। দুটো চোখ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভীষণ তৃষ্ণা ঐ চোখ জোড়াতে। তাকে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ। ঈশা কয়েকবার পলক ফেলে ইভানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল
–তুমি ভেতরে বস। আমি তোয়ালেটা মেলে দিচ্ছি।
ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে তোয়ালে মেলে দিতে দিতে ভীষণ অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি পারব।
ঈশা ক্ষণিক সময়ের জন্য থমকাল। অভিমানটা বুঝতে পারলেও কারণটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো। এইসব কিছু এখনই ধরা যাবে না। ইভান এখনো সুস্থ নয়। ইলহাম বলে দিয়েছে কিছুদিন অনেক ধরনের সাইড এফেক্ট হতে পারে। তাই ওর সব ব্যাবহার সহজ ভাবে নিতে হবে। ঈশা ঘরের ভেতরে ঢুকল। আবার পেছন ফিরে তাকাল। ইভান তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ঈশা নরম গলায় বলল
–কেমন আছো?
ইভানের অভিমান গাড় হল। ক্ষণিকের জন্য ৫ বছর আগের সেই দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। এতো বছরে ঈশার মনে হয়নি সে কেমন আছে? কখনো জানতে চায়নি। সে নাহয় বাদ দিলো। গত ছয় মাস হল দেশে ফিরেছে। এই ছয় মাসে কয়দিন দেখা হয়েছে সেটা আঙ্গুলের ডগায় গুনে বলতে পারবে ইভান। সেও আবার অপ্রত্যশিত ভাবে। আর কথা তো হয়ই না। সামনা সামনি আসলে ঈশা এমন আচরন করে যেন তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সামনে আসলেই পাপ হয়ে জাবে। মন থেকেই কেমন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি বেরিয়ে এলো আপনা আপনি। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে উত্তরের। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি কি কখনো খারাপ থাকি? দেখেছো কখনো আমাকে খারাপ থাকতে? বরং আমার আশে পাশে থাকলেই মানুষ খারাপ থাকে। তাই পালিয়ে বেড়ায়।
কথাটা ঠিকঠাক ধরতে পারল ঈশা। আহত চোখে তাকাল। ইভান ঠোট ফুলিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ল। অসম্ভব কষ্ট জমে আছে তার ভেতরে। দ্রুত পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। ঈশা বুঝতে পারল ইভান এতো বছরের দূরত্বটা বাইরে থেকে সহজ ভাবে মেনে নিয়েছে বোঝালেও ভেতরে ঠিকই একটা অভিমান পুষে রেখেছে। আজ যখন ঈশা সমস্ত দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে চায় তখন ইভানের সেই জমানো অভিমান ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ইভানের এখানে কোন দোষ নেই। সব দোষ ঈশার। তার ভুলের মাশুল তাকেই দিতে হবে। সেও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এসে দেখে সবাই টেবিলে বসে গেছে। মোটামুটি খাবার মুখেও তুলেছে কিন্তু ইভান এখনো খায়নি। সে মনে মনে ঈশার জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশার আসতে দেরি হচ্ছে জন্য বিরক্ত মুখে বসে আছে। ইরিনা দেখেই বলল
–ঈশা তুইও বস।
ঈশা মাথা নেড়ে এগিয়ে আসলো। ইভানের পাশের চেয়ারটা ফাঁকা আছে। সেখানেই বসে পড়লো। ইভান মনে মনে খুশী হল। সেও চেয়েছিল ঈশা তার পাশেই বসুক। এতো বছর পর আবার একসাথে বসে খাওয়ার অনুভূতিটা দারুন। খেতে শুরু করলো ইভান। খাওয়ার মাঝে আড় চোখে কয়েকবার ঈশাকে দেখে নিলো। সেটা ঈশার চোখে পড়লো না। সে মন খারাপ করে বসে খাওয়া শেষ করলো। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারল না। ইভান সেটাও খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বলল না। খাওয়া শেষ করে ইভান বলল
–আমার ক্লান্ত লাগছে। রেস্ট নেবো কিছুক্ষন। বিকেলে দেখা হবে।
বলেই চলে গেলো ঘরে। ঈশা পানিটা খেয়ে গ্লাসটা রেখে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–আমি ঔষধ খাইয়ে দিয়ে আসি।
বলেই ইভানের পেছনে পেছনে সেও দৌড় দিলো। ইভান ঘরে ঢুকেই আবারো পুরো ঘর অন্ধকার করে দিয়েছে। ঈশা ভেতরে ঢুকেই আলো জ্বালিয়ে দিলো। ইভান পেছনে ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–ঔষধ খেতে হবে। তাই আলো জ্বালালাম।
ইভান মৃদু ধমক দিয়ে বলল
–আমি কি অশিক্ষিত? কি ঔষধ খেতে হবে সেটা তো প্রেসক্রিপশনেই লেখা আছে। নিজে পড়ে খেয়ে নিতে পারতাম না?
এমন ধমক খেয়ে ঈশার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বড় সড় একটা ধমক দিয়ে বলল
–অন্ধকার করে তো ঘুমিয়ে পড়ছিলে। কখন ঔষধ খেতে? বিকেলে না সন্ধ্যায়?
ইভান ভড়কে গেলো। সে আশা করেনি ঈশা তাকে এভাবে ধমক দেবে। একটু দমে গিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। ঈশা ঔষধ আর পানি এনে ইভানের হাতে ধরিয়ে দিলো। ইভান নিশব্দে খেয়ে ফেললো। তারপর শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বলল
–লাইট অফ করে দাও। আমি ঘুমাব।
ঈশা লাইট অফ করে দিলো ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারল না সে কি করবে। থাকবে নাকি বাইরে যাবে। কিছুক্ষন ভেবে ধির পায়ে ইভানের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভারী সমস্যায় পড়ে গেলো সে থেকে তো গেলো কিন্তু এখন কি ইভানের পাশে শুয়ে পড়বে? ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষন কেটে গেলো। চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছে তার। সময় নষ্ট না করে শুয়ে পড়লো ইভানের পাশে। ইভান তখন ঘুমে বিভোর। সে বুঝতেও পারল না ঈশা তার পাশেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
————-
শেষ বিকেলে ফোনটা কয়েকবার কেঁপে উঠতেই ঈশা ধড়ফড় করে উঠে বসল। ফোনটা ধরে ফেললো তড়িঘড়ি করে। ঈশার মা ফোন করেছে। ফোন ধরতেই তার মা বলল
–ঈশা কি করছিস?
মায়ের গলা বেশ ক্লান্ত শোনাল। ঈশা উঠে বাইরে গিয়ে বলল
–কিছু না মা। কেন? কি হয়েছে?
ঈশার মা জড়ানো গলায় বলল
–আমার প্রেশারটা বেড়েছে। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। একবার আসবি বাসায়? কাল ইরার পরীক্ষা তো। ও পড়ছে।
ঈশা ছোট্ট করে বলল
–আসছি মা।
বলেই দরজা খুলে ইভানের কাছে গেলো। সে গভীর ঘুমে। একবার মুখটাতে হাত ছুঁয়ে দিতেই ইভান নড়েচড়ে উঠলো কিন্তু চোখ খুলল না। আবার উল্টা ঘুরে ঘুমিয়ে গেলো। ঈশা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির বুয়াকে সবটা বুঝিয়ে বলে দিলো। ইভানের মায়ের সাথে একবার দেখা করে চলে গেলো নিজের বাড়িতে।
ইভানের ঘুম যখন ভাংল তখন বাজে ৭ টা। এতক্ষন সে ঘুমাল অথচ কেউ তাকে ডাকল না। ঈশা তো একবার এসে ডাকতে পারতো। ফ্রেশ হয়ে বের হল ঘর থেকে। টেবিলে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে খেতে চারিদিকে অস্থির দৃষ্টি ফেললো কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। তখনই বুয়া রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ইভান তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা কোথায়?
–আপু তো বাড়ি চলে গেছে বিকেলেই।
ইভানের মনটা আবার বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। তাকে না বলেই চলে গেলো মেয়েটা। এতো কিসের তাড়া ছিল বাড়ি যাওয়ার। তার ঘুম ভাঙ্গা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কি এমন ক্ষতি হতো? অযথাই নাটক করতে এসেছিলো। ক্ষণিকের জন্য আশা তৈরি করে আবার চলে গেলো। এই মেয়েটা এমনই। ইভানের অনুভুতির কোন দাম নেই তার কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল
–অভিমান তার উপরেই করা উচিৎ যার উপরে করলে শুধু অভিমান টুকুর সম্মান বাঁচে। কিন্তু যেখানে অনুভুতির কোন মুল্য নাই সেখানে অভিমানটা নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। তুমি আমার অভিমানেরও যোগ্য নয়। আর কোন প্রত্যাশা থাকলো না তোমার কাছে।
চলবে……