শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ৫,৬

0
1028

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ৫,৬
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৫

রাত প্রায় ৯ টা। ইরা টেবিলে বসে পড়ছে। রান্না ঘর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। ঈশা সেই এসেই রান্না ঘরে ঢুকেছে। সন্ধ্যার নাস্তা রাতের রান্না সব কিছুই এক হাতে সামলাচ্ছে। ঈশার মা ক্লান্ত পায়ে রান্না ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল
–আজ সারাটা দিন রান্না ঘরেই চলে গেলো তোর। ও বাড়িতে সকাল থেকে রান্না করলি আর এখন এই বাড়িতে। ক্লান্ত লাগছে তাই না?

ঈশা ঘাড় ঘুরে তাকাল। ভ্রু কুচকে চাপা ধমকের সুরে বলল
–এখানে কেন এসেছ? তোমাকে আমি রেস্ট নিতে বলেছি না? আমি সব সামলে নিতে পারব। যাও তুমি শুয়ে পড়। রান্না শেষ করে আমি আসছি।

ঈশার মা মেয়ের ধমকের আগে টিকতে পারল না। চলে গেলো ঘরে। ঈশা মনোযোগ দিলো নিজের কাজে। ইরার ঘরের ফ্যান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সে ঈশার ঘরে বসে পড়ছে। ইভান সারা সন্ধ্যা টিভি দেখে কাটিয়েছে। কিছুক্ষন আগেই ইফতি বাইরে থেকে এসেছে। ইভানের বেশ বিরক্ত লাগছে এভাবে সময় কাটাতে। সুস্থ থাকলে এই সময় সে বাইরেই থাকে। কিন্তু এখন তো বাইরে যেতে পারছে না। ঈশাকে ভীষণ মিস করছে। মনে মনে ভীষণ রাগ হল তার। সেই গেলো মেয়েটা একবারও তার খোঁজ নিলো না। সামনে আসা তো দুরের কথা একটা ফোনও করলো না। ভীষণ হতাশ একটা শ্বাস ছাড়ল সে। এর মাঝেই ইফতি এসে বসল তার রুমে। ইভান কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল
–কি করছ ভাইয়া?

ইভান মুখ বাকিয়ে বলল
–বোর লাগছে। এভাবে বসে থাকার অভ্যাস নেই না।

ইফতি চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে বলল
–ঈশা আপু কোথায়?

ইভানের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। অভিমানে ভরে উঠলো চোখ জোড়া। ভীষণ অভিমানী কণ্ঠে বলল
–চলে গেছে।

–চলে গেছে মানে?

ইফতির আজগুবি প্রশ্নে ইভান একটু বিরক্ত হল। বলল
–চলে গেছে মানে কি? ওর কি বাসা নেই। দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলো। হয়ে গেছে। এখন চলে গেছে।

ইফতি ঠোট উল্টে বলল
–ওহ! দুপুরে তো এখানেই শুয়ে ঘুমিয়েছিল তাই আমি ভেবেছিলাম রাতেও হয়তো থাকবে।

ইভান শান্ত চোখে তাকাল। কোন কথা বলল না। কিন্তু মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। সে দুপুরে গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলো বলেই বুঝতে পারেনি। কিন্তু ঈশা তার কাছেই ছিল। অদ্ভুত ভাবে চাপা রাগটা কমে গেলো। ইফতি বলল
–চল ভাইয়া খেয়ে নেই।

ইভান উঠে গেলো তার সাথে। ঈশা নিজের রান্না শেষ করে এসে বিছানায় বসল। ইরা তখনও পড়ছে। ঈশা নিঃশব্দে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবল ইভান কে কল দেবে। পাশের ঘর থেকে মায়ের ডাক কানে আসতেই ফোনটা রেখে চলে গেলো। এদিকে ইভান খাওয়া শেষ করে ঘরে এলো। বারান্দায় এসে একবার দেখল ঈশার রুমের লাইট জালানো। মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলো। কি ভেবে হাতে ধরে থাকা ফোনটা তুলে কল দিলো তার নাম্বারে। কিন্তু ঈশা ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল জন্য বুঝতে পারল না। দুইবার রিং হওয়ার পর ফোনটা যখন ঈশা ধরল না তখন ইভানের মনের অভিমানটা আরও গাড় হল। ঘরে চলে গেলো সে। ঈশা মায়ের কাছ থেকে ঘরে এসে আর বসে থাকতে পারল না। এমনিতেই শরীরটা তেমন ভালো নেই তার উপর আজ সারাদিন ব্যস্ত সময় কেটেছে। শরীরটা আর সায় দিচ্ছে না। তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে পড়তেই ক্লান্ত চোখ জোড়ায় ভর করলো রাজ্যের ঘুম। কখন ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারেনি। এর মাঝে ইভান কয়েকবার বারান্দায় এসে দেখে গেছে ঘরের আলো জলছে। ইরা অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু ইভান ভাবল ঈশা জেগে আছে অথচ ইভান ফোন দিয়েছিলো সেটা তো ধরলই না উল্টা তাকে ফোনও করলো না একবারও। সে এতো অভিমান চেপে রেখে যদি ফোন করতে পারে তাহলে ঈশা কেন পারবে না কথা বলতে। তার কিসের এতো অভিমান? হতাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।

————
সকালের নাস্তা শেষ করে ইভান সোফায় বসে টিভি দেখছে। হুট করেই কলিং বেল বেজে উঠতেই মনের মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি হল। ধরেই নিলো এতো সকালে ঈশা এসেছে। ঠোঁটের কোনে ক্ষীণ হাসি নিয়ে ঘাড় বেকিয়ে সেদিকে তাকাল। কিন্তু বুয়া দরজা খুলতেই ইলহামকে ঢুকতে দেখেই আবার হতাশ হল। একটা শ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলল
–আরে ভাইয়া আসো।

ইলহাম ভেতরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বলল
–কি অবস্থা কেমন আছিস?

ইভান মৃদু হেসে বলল
–ভালই আছি। তোমার কি খবর বল? এতো সকালে তুমি?

কথা শেষ হতেই আবারো বেজে উঠলো কলিং বেল। এবারের ঘণ্টাটা একদম ইভানের বুকে গিয়ে লাগলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটার আগমন ধ্বনি যেন টের পেয়ে গেলো সে। অভিমানটা গাড় করে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। বুয়া দরজা খুলতেই ইরা এক দৌড়ে ঢুকে পড়লো। দৌড়ে এসে ইভানের পাশে বসল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল
–ভাইয়া কেমন আছো তোমরা?

ইভান আর ইলহাম দুজনই মৃদু হাসল। জানাল ভালো আছে। ইরা হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল
–আমার পরীক্ষা আছে। এখনই যেতে হবে। দেখা করতে এসেছিলাম। বড় মার সাথে দেখা করে চলে যাবো।

বলেই উঠে গেলো। তখনই ঈশা এসে দাঁড়ালো। ইলহামকে দেখে বলল
–আরে ভাইয়া তুমি কখন এলে?

ইলহাম মৃদু হাসল। বলল
–এই তো এসে বসলাম। হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম একবার ইভান কে দেখে যাই। সব ঠিকঠাক আছে তো?

ইভান বেশ শান্ত কণ্ঠে বলল
–সব ঠিক আছে। এখন বেশ ভালো আছি। ভাবছি দুই একদিনে অফিস জয়েন করবো।

ইলহাম কড়া আদেশের সুরে বলল
–একদম না। আরও কয়েকদিন সময় নে। পুরোপুরি সুস্থ হলে তারপর জয়েন করবি। ছুটি না পেলে চাকরি ছেড়ে দে। এই সময় যদি অফিস থেকে হেল্প না পাওয়া যায় তাহলে অমন চাকরির দরকার নেই।

ইভান ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–না না। অফিসে তেমন চাপ নেই। আমিই ভাবছিলাম। আসলে বাসায় বসে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছি। তাই বলছিলাম।

ইলহাম একটু ভাবল। বলল
–বেড়াতে যা। ঈশাকে নিয়ে দুজন মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আয়। ঘুরতে মানা নেই কিন্তু। শুধু চাপ নিস না এখনই। কাজের প্রেশারটা একদমই নিবি না।

ইভান কোন উত্তর দিলো না। নিচের দিকে তাকাল। ঈশা মৃদু হেসে বলল
–অবশ্যই ভাইয়া। অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি।

ঈশা থেমে আবার বলল
–একটু বস আমি চা বানিয়ে আনছি।

ঈশাকে থেমে দিয়ে ইলহাম উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–আজ না। আমার তাড়া আছে। আরেকদিন এসে আড্ডা দেবো।

ঈশা জোর করলো না। সে বিদায় নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দরজা পর্যন্ত গিয়েই আবার থেমে গেলো। পেছন ঘুরে বলল
–ইভান এবার সিগারেট খাওয়াটা একটু কমা। আমি আগেও বলেছি। একদম কথা শুনিস না। এবারো কিন্তু তোর রিপোর্ট ভালো আসেনি। এরকম চলতে থাকলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।

ইভান একটা শ্বাস ছাড়ল। বলল
–চেষ্টা করবো। অনেকদিনের অভ্যেস তো একটু সময় লাগবে। সময় দাও। আমি ম্যানেজ করে নেবো।

–চেষ্টা না ছাড়তেই হবে। ঈশা তুই এবার এই দায়িত্বটা নে। বিষয়টা কিন্তু খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

কথা শেষ করেই ইলহাম চলে গেলো। ঈশা ইভানের পাশে এসে বসল। গম্ভীর আওয়াজে বলল
–তুমি সিগারেট খাও?

ইভান শান্ত চোখে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–তুমি আমাকে কতদিন হল চেন?

আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে ঈশা ভড়কে গেলো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–এটা কেমন প্রশ্ন?

ইভান ভীষণ শান্ত কণ্ঠে বলল
–আজকে কি নতুন দেখছ নাকি?

ঈশা মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেললো। সে যে ইভানের এমন কথায় রেগে যাচ্ছে সেটা চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে। সে আবারও বলল
–আমি বিয়ের আগে থেকেই সিগারেট খাই। এটা তুমি জানো। এমন ভাবে প্রশ্ন করছ যেন তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে আর আজকেই আমাদের প্রথম দেখা।

ঈশা এবার সত্যি সত্যি রেগে গেলো। ভীষণ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল
–একটা সাধারন প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়ার কি আছে? সাধারন ভাবে কথা বললে কি হয়?

ইভান হতাশ শ্বাস ছাড়ল। বলল
–তুমি সাধারন কথা বলতেই পারো না। তোমার কথা কাজকর্ম সব অসাধারন। তোমার কখনো মনে হয়নি?

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। হতাশ শ্বাস ছেড়ে উঠে চলে গেলো ইভানের মায়ের ঘরে। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে সামনে টিভির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কিছুক্ষন দেখার পরেই বিরক্তি এসে গেলো। পরিবেশটাই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছে। এতো অপেক্ষার পর মানুষটার দেখা পেলো আর এরকম ব্যবহার করলো। কি দরকার ছিল। অভিমান জমে আছে থাক। তাই বলে সারাক্ষন এভাবে কথা বলার মানে হয়না। এখন নিজের উপরেই রাগ লাগছে তার। ঈশা যে শুধু রাগ করেনি তার আচরনে কষ্ট পেয়েছে। অস্থির হয়ে টিভি বন্ধ করে উঠে চলে গেলো মায়ের ঘরে। ঈশা আর তার মা গল্প করছে। ইভান দরজা থেকেই বলল
–মা আসবো?

ইভানের মা এক গাল হাসলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন
–ভেতরে আয়।

ইভান চেয়ার টেনে বসল। তার মা আজ ভীষণ খুশী। ঈশা ইভান একসাথে এই বাড়িতে ভেবেই তিনি আরও বেশী খুশী হচ্ছেন। ইভানও অনেকদিন পর তার মাকে এতো খুশী দেখছে। ইভানের মা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোর মা এখন কেমন আছে ঈশা?

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–এখন ভালো আছে। কাল বিকেলে যখন ফোন দিয়েছিলো গিয়ে দেখি যা অবস্থা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আজ বেশ সুস্থ।

ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–কি হয়েছিলো মেজ মার?

ঈশা না তাকিয়েই অভিমানী কণ্ঠে বলল
–প্রেসার বেড়েছিল।

ইভান এবার বুঝতে পারল ঈশার তাকে না বলেই চলে যাওয়ার কারন। না বুঝেই মেয়েটার উপর অভিমান করে বসেছে সে। নিজের উপরেই বিরক্ত এসে গেলো তার। ইভানের মা এবার বলল
–তোরও তো শরীর ভালো না। কাল সকাল থেকে এখানে রান্না করলি আবার রাতে গিয়ে বাড়িতে কাজ করলি। এখন কেমন আছিস?

ঈশা শুকনো মুখে বলল
–ভালো আছি বড় মা। দেখি নাজমা কি করছে রান্না ঘরে।

কথা বলেই ঈশা উঠে বের হয়ে গেলো। ইভান সেদিকে তাকিয়ে ভাবছিল সে ঈশার সাথে একটু বেশীই খারাপ ব্যাবহার করে ফেলছে। ঈশা ভুল করেছে সেটার জন্য ইভানের মনে যে অভিমান জমে আছে সেটা এতো সহজে দূর হবে না। তাই বলে এরকম আচরন করে মেয়েটাকে কষ্ট দেয়ার কোন মানেই হয়না। এর মাঝেই তার মা বলল
–অনেক হয়েছে বাবা। এবার আর তোরা আলাদা থাকিস না। তোদের একসাথে দেখলে অনেক শান্তি লাগে। আমার কথাটা রাখ। ঈশাকে বুঝিয়ে নিয়ে আয় এই বাড়িতে। তুই বললেই চলে আসবে।

ইভান কিছুক্ষন ভাবল গভীর ভাবে। তারপর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল
–রাখলাম তোমার কথা। আমি ঈশাকে আনব মা। তুমি রেস্ট নাও। আমি পরে আসবো।

মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে ইভান সোজা রান্না ঘরে গেলো। ঈশা সবে চুলা জ্বালিয়েছে। তার পাশেই দাড়িয়ে আছে নাজমা। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঈশা ঘাড় ফিরে তাকাল। ইভান তার দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর আওয়াজে বলল
–ঘরে আসো।

বলেই আর কোন কথা না বলে ঘুরে গেলো। ঈশা একটু অবাক হল। ইভানের চোখে মুখে ভীষণ রাগ। কয়েক মুহূর্তে কি এমন হয়ে গেলো যে ইভান এতো রেগে গেলো। অথচ রাগ করার কথা ছিল তার। এই ছেলেটাকে সে কখনই পুরোপুরি বুঝতে পারে না।

চলবে……

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬

ফ্যান চলছে শন শন শব্দে। ঘরের দরজাটা অর্ধেক খোলা। ভেতরে তেমন তীব্র আলো নেই। কোন রকমে দেখা যাচ্ছে। ঈশা ধির পায়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন আগে ইভানের চেহারা দেখে তার মনে ভয় তৈরি হয়েছে। এখন সামনে যেতেও বুক দুরুদুরু কাঁপছে। কখন রাগ করে বসে সেটা ঈশা আজও বুঝতে পারল না। একটা শ্বাস টেনে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে ভেতরে তাকাল। ইভান পকেটে হাত গুঁজে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ঈশা ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল। এগিয়ে গিয়ে ইভানের পেছনে দাঁড়ালো। নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কেন ডাকলে?

ইভান ঘুরে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–এসব করে কি প্রমান করতে চাও?

ঈশা থমকাল। চোখ তুলে তাকাল ইভানের দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো কি বলতে চায়। কিন্তু বুঝতে না পেরে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কিসের কথা বলছ? আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

ইভান মৃদু হাসল। বলল
–এই আফসোসটা আমার সারাজীবন থাকবে যে তুমি আমার কথা বোঝনা। যাই হোক এই যে তুমি বাড়ির বউয়ের মতো দায়িত্ব পালন করছ। নিজের মতো সবার খেয়াল রাখছ। এতে তোমার প্রতি সবার এক্সপেকটেশন বেড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনে এই বাড়ির সবকিছু তোমার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মা চাইছে তুমি এই বাড়িতেই থাকো।

ঈশা অস্থিরভাবে কয়েকবার পলক ফেললো। অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলো
–মা চাইছে? আর তুমি?

ইভান হেসে ফেললো। বলল
–কি বলেছিলাম ভুলে গেছো? বলেছিলাম যেদিন তোমার মনে হবে আমার শাস্তি পাওয়া হয়ে গেছে আর এখন যা হচ্ছে পুরোটাই আমার সাথে অন্যায়। সেদিন তুমি আমার কাছে আসবে। আমি সেদিনের জন্য অপেক্ষা করবো।

ঈশা পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল। মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা। ঠিক এভাবেই বলেছিল ইভান। ঈশা সেদিন তার কাছে সময় চেয়েছিল। ঠিকঠাক নিজেকে গুছিয়ে নেয়া হয়ে গেলেই চলে আসবে। ইভান কে বলতে হবে না। কিন্তু আজও কেন সময় শেষ হচ্ছে না? কেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছে না সে? গুছিয়ে নেয়াটা কি তাহলে শুধুই বাহানা। আজ ঈশার মনে হচ্ছে সে সত্যিই ইভান কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। একটু সাহস করে নিজেকে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেই তারা একসাথে ভালো থাকতে পারতো। কিন্তু আজ এই সম্পর্কের মাঝে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ইভানের ঐ গভীর দৃষ্টিতে আগে ভালবাসা চোখে পড়ত। কিন্তু এখন শুধু অভিমান। কিছুই আগের মতো নেই। সবটার জন্য ঈশা নিজে দায়ী। ইভান সম্পূর্ণ চেষ্টা করেছিল তাকে ভালো রাখার। কিন্তু সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারেনি। ভীষণ স্বার্থপর সে। ইভানের কষ্টটা সে বুঝতে চায়নি। কথাটা ভাবতেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। ইভান বিষয়টা খেয়াল করলো। তার মনটা ভীষণ খারাপ হল। সে ঈশাকে কষ্ট দিতে চায়নি। মায়ের কথা রাখতেই ঈশাকে এসব কথা জানানো জরুরী ছিল। সে এখনই এই বাড়িতে আসতে না চাইলে এভাবে দায়িত্ব পালন করার কোন প্রয়োজন নেই তো। শুধু এই বাড়ির মানুষ কেন সে নিজেই তার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতো বছর দূরে থেকেও ইভানের এমন কষ্ট হয়নি। সে পরিস্থিতি মেনে নিয়েছিল। কাছে পাওয়ার আকুলতা দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু এখন কেন পারছে না। তার প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঈশাকে যত কাছ থেকে দেখছে ততই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ঈশাকে তার ভীষণ প্রয়োজন। নাহলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবগি কণ্ঠে বলল
–আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি ঈশা। তোমাকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কথাগুল বলা জরুরী ছিল। আর আমি তোমাকে জোর…।

ইভান কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ঈশার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। নিজের কান্নাটা আটকে রেখে থেমে থেমে বলল
–আমি বাড়ির বউয়ের মতো দায়িত্ব পালন করছি না। বড় বউ হিসেবে সবার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। এতদিন আমি সেটা করতে পারিনি আমার ব্যর্থতা। এখন আর এমন হবে না। জোর করতে হবে না। আমি নিজেই চলে আসবো।

বলে চোখের পানি মুছে ঘুরে দাঁড়ালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইভান গম্ভীর আওয়াজে বলল
–যদি জোর করি? সময় দিতে না চাই?

ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভানের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। ঈশার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কিছু বলার আগেই তার চোখ পড়লো টেবিলে পড়ে থাকা ঔষধের স্ট্রিপ গুলর উপরে। কোন কথা না বলে এগিয়ে গেলো সেদিকে। এক এক করে সমস্ত ঔষধের স্ট্রিপ চেক করে দেখল। ঈশা ভালোভাবেই বুঝে গেলো যে ইভান সকালে ঔষধ খায়নি। ইভানের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর আওয়াজে বলল
–তুমি সকালে ঔষধ খাওনি কেন?

ইভান হতাশ শ্বাস ছাড়ল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–আমার ওসবের প্রয়োজন নেই ঈশা। আমার প্রয়োজন অন্যকিছু। আমি অন্য কিছুতে আসক্ত। যেটা ছাড়া আমার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। ভীষণ কঠিন।

বলেই থামল। ঈশা ঔষধ আর পানি নিয়ে ইভানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল
–দরকার আছে কিনা সেটা আমি বুঝে নেবো। এখন এগুলা খেয়ে নাও।

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–ঔষধ খেলে আমার অসস্তি হয়। ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুম আসেনা। মাথা যন্ত্রণা করে। কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি।

করুন চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবার বলল
–তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে বড্ড প্রিয়। কিন্তু আফসোস সেই প্রিয় মুহূর্ত আমৃত্যু কাটানোর মতো দুঃসাহস আমার নেই। আমি তোমাকে জোর করতে চাইছি না। আবার না করেও থাকতে পারছি না। ভীষণ এলোমেলো আমি।

বলেই চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ঈশার ভীষণ কষ্ট হল। এমন কেন মানুষটা? নিজের কষ্টের কথা কোনদিন মুখ ফুটে বলে না। ভেতরে এমন এলোমেলো বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ে একা একা। ঈশা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। তাদের মাঝে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব মাত্র। ইভানের হাত ধরে ঔষধ গুলো হাতে দিয়ে চাপা ধমক দিয়ে বলল
–একদম অজুহাত দেখাবে না। আমার সাথে এভাবে জেদ করে কোন লাভ নেই। ঔষধ খেতেই হবে। আমার জন্য।

শেষের কথাটা শুনে ইভান আর কোন কথা বলতে পারল না। ঈশার জন্য সে সব কিছু করতে পারে। ঔষধ নিয়ে বলল
–তোমার জন্য প্রয়োজনে বিষ খেতে পারব। আর এটা তো সামান্য ঔষধ।

ঈশা তার কথা শুনে শব্দ করে হাসল। ইভান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কতদিন পর ঈশাকে এতো কাছ থেকে হাসতে দেখেছে। ঠিক সেই সময় ইফতির গলা শোনা গেলো
–ভাইয়া তোমরা বাইরে আসো। দেখো কে এসেছে।

ঈশা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। বের হয়ে আসলো। বাইরে আসতেই কানে আসলো হাসির আওয়াজ। সোফায় চোখ পড়তেই দেখল তার কাজিন সম্প্রদায়ের সবাই কি একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছে। ঈশা বেশ অবাক হল। সবাইকে একসাথে দেখবে সেটা সে আশাই করেনি। কিছুই না জানিয়ে হুট করেই তারা চলে এসেছে। ইভান পেছনে এসে দাঁড়ালো। বলল
–তোরা সবাই?

সবাই থেমে গেলো তার কথা শুনে। ইশান বলল
–কেন এসে ভুল করে ফেলেছি নাকি? ভুল করলে চলে যাই।

ইভান সরু চোখে তাকাল। এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসল। কান ধরে বলল
–তোমার পাকনামি বন্ধ করো। বেশী বুঝতে হবে না। ফাজিল ছেলে।

সায়ান বলল
–এখন কেমন আছিস তুই?

ইভান মৃদু হেসে বলল
–ভালো আছি।

সায়ান হেসে ঈশার দিকে তাকাল। বলল
–যাক তাহলে ঈশা ভালই সেবা করছে। তাই তো এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলি।

ইভান আড় চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–একদম। রাত জেগে সেবা করে। এতো বেশী সেবা করে যে আমার নিজেরই মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার তো আবার এতো সেবা নেয়ার অভ্যাস নাই।

ঈশা সরু চোখে তাকাল। কথার অর্থ ঠিকঠাক ধরতে পারল। ইরিনা সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ভাইয়া কি ঈশার প্রশংসা করলো নাকি বদনাম। ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ঈশা রাগী সরে বলল
–তোমরা বস আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি।

ঈশা ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যাওয়ার আগে। ঈশা চলে যেতেই ইভান মুচকি হাসল।

————
শরতের আকাশ ঝকঝকে। বেশ ঝলমলে রোদ। দুপুর হলেও বাতাসের কারনে রোদের তেজটা তেমন গায়ে লাগছে না। দুপুরে খাওয়া শেষ করে সবাই ইভান দের ছাদে আড্ডা দিচ্ছে গরম চায়ের সাথে। ইভান চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ইরা এসে দাঁড়ালো। প্রশস্ত এক হাসি দিয়ে বলল
–তোমরা সবাই এখানে? আমি তোমাদের সবাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

ইলু হাত বাড়িয়ে বলল
–আরে তুই এতক্ষন কোথায় ছিলিস? আয় এদিকে।

ইরা এসে বসল ইলুর পাশে। তার পাশেই একদম অপরিচিত একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি অস্থির ভাবে এদিক সেদিক ফেলছে। বোঝাই যাচ্ছে সবার মাঝে ভীষণ অসস্তি হচ্ছে তার। ইশান তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কেমন আছো সিয়া?

ইভান তার পাশেই বসে ছিল। ইশানের কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকাল কৌতূহলী চোখে। মেয়েটাকে ইভান আজকেই প্রথম দেখছে। কিন্তু ইশানের মনে হয় পরিচিত। মেয়েটা ভীষণ অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল
–ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?

ইশান হেসে বলল
–ভালো আছি। অনেকদিন পর দেখা হল তোমার সাথে।

সিয়া মৃদু হেসে বলল
–আসলে পরীক্ষা চলছিলো তো তাই একটু ব্যস্ত ছিলাম।

–ওহ! পরীক্ষা শেষ? কেমন হল?

সিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–মোটামুটি হয়েছে।

সিয়া কথা শেষ করতেই ইরা বলল
–আসলে ও ইভান ভাইয়াকে দেখতে এসেছিলো। ভাইয়ার কথা শুনে বলছিল আসবে বাসায়। তাই নিয়ে আসলাম।

ইভান চমৎকার হেসে বলল
–সো সুইট অফ ইউ। তুমি এসেছ আমি খুব খুশী হয়েছি।

সিয়া ভীষণ অসস্তি নিয়ে ভদ্রতার সাথে বলল
–ধন্যবাদ ভাইয়া। এখন আপনি কেমন আছেন?

ইভান একটু দুষ্টুমি করে বলল
–ভালো আছি। তোমাকে দেখে আরও ভালো হয়ে গেলাম।

সিয়া হাসল। ইরা হেসে বলল
–তোমরা গল্প করো। আমি আসছি। সিয়া বাসায় চলে যাবে তো।

ইরা আর সিয়া বাসায় যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে যেতেই ইভান গলা তুলে বলল
–এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে সিয়া? আর একটু থাকতে।

সিয়া ঘুরে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
–আজ না ভাইয়া। আরেকদিন আসবো।

ইভান প্রশস্ত হেসে বলল
–অবশ্যই। মাঝে মাঝেই আসবে আমার সাথে দেখা করতে। খুব খুশী হবো।

সিয়া হেসে চলে গেলো। ওরা চলে যেতেই ইভান ঠোট কামড়ে সামনে তাকিয়ে বলল
–মেয়েটা ভীষণ কিউট।

ইশান সরু চোখে তাকাল। বলল
–তুমি বিবাহিত ভাইয়া। বিবাহিত হয়ে একটা মেয়েকে দেখে এমন কথা বলতে লজ্জা করে না।

সবার মুখে দুষ্টু হাসি। ইভান ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল
–বিবাহিত বলে কি আমার চোখ নেই? সুন্দর কিছু দেখলেই তার প্রশংসা করতে হয়। এটাতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া ভাবছি বিয়ে না করলে একটা চান্স নেয়া যেতো। মেয়েটা আমাকে দেখতে এসেছিলো শুনলি না?

ইশান সরু চোখে তাকাল। সবার মুখে দুষ্টু হাসি। ইভান ইশানের রাগের কারন বুঝতে পেরেই ঠোট চেপে হাসল। তারপর ঈশার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখল সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here