#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ১১,১২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১
কালো মেঘে ঢাকা আকাশের গায়ে একে বেঁকে আলো জ্বলে উঠছে মাঝে মাঝেই। তীব্র গর্জনে কেঁপে উঠছে ধরণী। এলোমেলো হাওয়া জানালার কাঁচে এসে বাড়ি খাচ্ছে। ঝনঝন করে কেঁপে উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগতেই অসস্তি হল ঈশার। ঘুমের মাঝেই সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারল। গায়ের কাঁথাটা ভালো করে টেনে নিলো। তারপরেও ঠাণ্ডাটা কমলো না। গুটিসুটি হয়ে ইভানের কাছাকাছি যেতেই খেয়াল করলো ইভান নেই। চোখ মেলে তাকাল। তার ধারনা ঠিক। মাঝরাতে কোথায় গেলো। উঠে চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিতেই দেখল বারান্দার দরজা খোলা। বাইরের ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় একটা ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছায়াটা কার বুঝে যেতেই বিছানা থেকে নেমে সেদিকে পা বাড়াল। ইভান এক হাত গ্রিলে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আরেক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ল সেদিকে। এমন মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে যেন পৃথিবীর সব থেকে মনোরম দৃশ্য এখন তার চোখের সামনে। ঈশা গম্ভীর গলায় বলল
–কি হচ্ছে?
আচমকা এমন গলা শুনে চমকে উঠলো ইভান। ভয় পেলো কিঞ্চিৎ। পেছন ঘুরে ঈশাকে দেখেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। এমন সময় তাকে আশা করেনি। পরিস্থিতির চাপে হাতের সিগারেটের কথাও ভুলে গেলো। ঈশা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–আমার অগোচরে আর কি কি করো?
ইভান এবার খেয়াল করলো হাতের সিগারেট। ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঈশার সামনে মাঝরাতে এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে ভাবেনি সে। ঈশা চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ইভানের মুখোমুখি। ইভান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে ঘুরে গেলো উল্টা দিকে। ঈশা গম্ভীর আওয়াজে বলল
–উত্তর দিলে না যে?
ইভান আড় চোখে তাকাল। বলল
–তোমার অগোচরে আমি এমন কিছুই করি না যা বলার মতো। মাঝে মাঝে যখন টেনশন হয় তখন শুধু সিগারেট খাই।
ঈশা হাত গুঁজে দাঁড়ালো। বলল
–এখন কিসের টেনশন?
ইভান আবার আগের জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। হতাশ শ্বাস ছাড়ল। কোন উত্তর দিল না। ঈশা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ইভানের দিকে তাকাল। মুখটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে সে। ঈশা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইভানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আদুরে কণ্ঠে বলল
–মন খারাপ?
ইভান জোর করে হাসার চেষ্টা করলো। হাত ধরে টেনে পাশের টুলটা পা দিয়ে এগিয়ে দিলো। বলল
–বসো।
ঈশা একবার ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে পড়লো। ইভান হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ঈশার সামনে। ঈশার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আবেগি কণ্ঠে বলল
–তোমাকে কিছু কথা বলি?
ঈশা বিস্ময় নিয়ে তাকাল। ইভানের চোখ ছলছল করছে। এমন কি কথা বলতে চায় সে? মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ইভান তার হাতের জোর বাড়িয়ে দিলো। শক্ত করে ধরে ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
–ঈশা! আমি চেয়েছিলাম তোমাকে জীবনের সব সুখ এনে দিতে। তোমার জীবনে কোনরকম অপূর্ণতা আমি রাখতে চাইনি। চাইলেই আমি তোমাকে আরও আগেই বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু করিনি কেন জানো?
ঈশা মনোযোগ দিলো ইভানের কথা শোনার জন্য। ইভান এবার চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকাল। বলল
–আমি নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম যাতে তোমাকে ভালো রাখতে পারি। তোমাকে এমন একটা লাইফ গিফট করতে পারি যেখানে আফসোস বা অভাবের কোন জায়গা থাকবে না। আমি নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করেও নিয়েছিলাম। সেদিন হয়তো আমার ভাবনা দেখে উপরে বসে একজন হেসেছিলেন। কারন ওনার পরিকল্পনা তো ভিন্ন। উনি এমন একটা জায়গায় অপূর্ণতা রেখে দিলো যেখানে আমি চাইলেও কিছু করতে পারব না। সারাজীবন এই কষ্টটা আমাকে মেনে নিতে হবে। আমার জীবনের এই একটা আফসোস থাকবে। তোমার কষ্টটা আমি নিজে চোখে দেখে কিভাবে সহ্য করি তা আমি বোঝাতে পারব না। তোমাকে বিষণ্ণ হয়ে ভাবতে দেখলে আমার বুকের ভেতরটা তীব্র কষ্টে হাহাকার করে ওঠে। ভেবেছিলাম তোমাকে খুব ভালো রাখবো। কিন্তু তোমাকে ভালো রাখা হল না। আমি ব্যর্থ ঈশা। পারলাম না। আমাকে…আমাকে মাফ করে দিও।
ইভান চোখ বন্ধ করে ফেললো। গলা ভীষণ রকমের কাঁপছে। তার চোখে পানি টলমল করছে। কিন্তু ছেলেদের কাঁদতে নেই। তাই হয়তো চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে না। ঈশা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইভানের মন খারাপ সেটা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু কারণটা যে এটা তা বুঝতে পারেনি। ঈশা হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। ইভান চোখ খুলে ফেললো। ঈশার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ রেখেই বলল
–খুব ভালোবাসি তোমাকে। এতো বছর আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পেরেছি কারন আমি তোমাকে তোমার মতো করে ভালবেসেছিলাম। তুমি যেভাবে ভালো থাকতে পারো সেভাবেই রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর পারব না। আমি পুরোপুরি তোমার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তোমাকে হারানোর ভয়টা আমার মাঝে প্রতি নিয়ত ভীষণ ভাবে জেকে বসছে। আমি পারছি না ঈশা। আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাবো। পরিস্থিতির কারনে ৫ বছর তোমার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। এখন আমি ৫ দিনও থাকতে পারব না। আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ।
ঈশার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ইভানের পরিস্থিতি সে বুঝতে পারছে। তার ফুপু আসার পর থেকেই সে চিন্তায় পড়ে গেছে। ৫ বছর আগের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ভয়। কিন্তু ঈশা কি এতো বোকা? একই ভুল বারবার করবে? ঈশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–অতীত যতই ভয়ঙ্কর হোকনা কেন প্রিয় মানুষ কাছে থাকলে বর্তমান ভবিষ্যৎ সবটা সুন্দর হয়। তোমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে এই কথাটা ভালোভাবেই বুঝতে শিখেছি। আমি ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল। একটা সুযোগ দেবে? আবার নতুন করে ভালবাসতে চাই।
ইভান মাথা তুলে তাকাল। ঈশা দুই গালে আলতো করে হাত রেখে বলল
–কারো কথাই আর আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারবে না। দুজনের ভালবাসাই আমাদের ভালো থাকার জন্য যথেষ্ট হবে।
ইভান হাসল। ঈশার হাত ধরে বলল
–তোমাকে আমি খুব ভালো রাখার চেষ্টা করবো। সর্বচ্চ চেষ্টা করবো।
ঈশা ইভানের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল
–অনেক রাত হয়েছে। চলো ঘুমাবে।
বলেই উঠে দাঁড়ালো। ইভান আব্দারের সুরে বলল
–তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে।
ঈশা তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়ালো। কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল
–এতো কথার মাঝে তোমার সিগারেট খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছি সেটা ভাবলে ভুল করবে।
বলেই ভেতরে চলে গেলো। ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। কথাটা মাথায় ঢুকতেই সামনে দাড়িয়ে বলল
–সিগারেট খাওয়ার সাথে জড়িয়ে ধরার কি সম্পর্ক?
ঈশা মৃদু হাসল। বলল
–তুমি সিগারেট খেলে আমাকে টাচ করতে পারবে না। তাই এখন জড়িয়ে ধরতে পারবে না।
–হোয়াট?
ঈশা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–বাংলা ভাষায় বলেছি। বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না।
ইভান টি শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলল
–প্রচুর সুবিধাবাদি তুমি। নিজের যখন প্রয়োজন ছিল তখন তো ঠিকই জড়িয়ে ধরেছিলে। তখন তো ভুলে গিয়েছিলে যে আমি সিগারেট খাচ্ছিলাম। আর এখন আমার ইচ্ছা হল তখন ঠিকই মনে পড়ে গেলো তাই না? সুযোগের সদ্ব্যবহার কিভাবে করে সেটা তোমার কাছ থেকে শেখা উচিৎ।
ঈশা সরু চোখে তাকাল। বলল
–সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে এই বিষয়ে আমি কোন কৈফিয়ত দিতে চাইনা। তোমার যদি মনে হয় আমি সদ্ব্যবহার করেছি তাহলে তাই।
ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–তাহলে তুমি চাইছ আমি তোমাকে জোর করি।
–জোর করবে মানে? তুমি না বলেছ আমাকে কখনো জোর করবে না।
বলেই ঈশা দুই কদম পিছিয়ে গেলো। ইভান এগিয়ে যেতে যেতে বলল
–সেটা আমার ব্যাপার। আমি কেন তোমাকে কৈফিয়ত দিতে যাবো। আর এমন কথা বলে থাকলেও ভুলে গেছি।
ইভান কাছাকাছি চলে আসতেই ঈশা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ইভান তাকে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো।। শক্ত করে ধরে বলল
–এতদিন ছেড়ে রেখেছি বলে ভেবনা যে আমি জোর করতে পারিনা। আমার যা প্রয়োজন তা না পেলে এখন থেকে জোর করবো। প্রয়োজনে জোর করেই ভালবাসবো। তুমি আমাকে চাইলেও আটকাতে পারবে না।
ঈশা লাজুক হাসল। ইভান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
–ভালোবাসি পাখি। খুব বেশী ভালোবাসি।
————
স্নিগ্ধ সকালে ঘুম ভাংতেই ঈশা উঠে হাই তুলে বসে পড়লো বিছানায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরতেই চোখে পড়লো গভীর ঘুমে আচ্ছন্নে থাকা ইভানের উপরে। বেশ মায়াবি লাগছে দেখতে। ঈশা রাতে আগে শুয়ে পড়লেও ইভান অফিসের কয়েকটা জরুরী কাজ শেষ করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। ঘড়িতে ৮ টা বাজে। এখন না উঠলে অফিসের দেরি হয়ে যাবে জেনেও ঈশার ডাকতে ইচ্ছা করলো না। মুচকি হেসে উঠে গেলো সে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই চোখে পড়লো সবাই টেবিলে বসে নাস্তা করছে। সব থেকে বেশী অবাক হল ইফতিকে দেখে। ঈশার আগেই সে উঠে পড়েছে। ইফতির পেছনে দাড়িয়ে চূলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল
–আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো? তুই আমার আগে উঠেছিস।
ইফতি অসহায়ের মতো মুখ করে বলল
–জরুরী একটা কাজ আছে বলেই উঠতে হল। নাহলে কি আমার চেহারা দেখতে পেতে?
ঈশা হাসল। আরও কিছুক্ষন কথা বলে ঈশা বসে পড়লো। ইফতির তখন খাওয়া শেষ। সে উঠে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–আমার খাওয়া শেষ ভাবী আপু। আমি আসছি।
বলেই চলে গেলো। রহিমা বেগম এতক্ষন সবটা চুপ করে দেখছিলেন। সবাই যে যার মতো চলে যেতেই তিনি ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
–এতো হেয়ালি করে কি সংসার চলে? এতো বেলা অব্দি শুয়ে থাকলে সংসার সামলানোর জন্য সতীন লাগবে। অসুস্থ শাশুড়ি বাড়িতে। কই বউ উঠে রান্না করবে শাশুড়ির সেবা করবে তা না। কপাল করে শশুর বাড়ি পেয়েছিস। আচরন একদম রাজরানীর মতো।
ইভান আকাশী রঙের শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে এগিয়ে আসছিল। তার ফুপুর কথা কানে আসতেই থেমে গেলো। ঈশা তখনও টেবিলে বসে। সকাল বেলাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো তার। ঠিক তখনই ঈশা বলে উঠলো
–ঠিক বলেছ ফুপু। আমি কপাল করেই শশুর বাড়ি পেয়েছি। কপাল করেই স্বামীও পেয়েছি। যখন ইভানের সামনে দাড়াই তখন নিজেকে রাজরানীর থেকে কম কিছুই মনে হয়না। দোয়া করবে ফুপু সবকিছু যেন সারাজীবন এমনই থাকে।
রহিমা বেগম বেশ রেগে গেলেন এমন উত্তরে। তিনি উঠে চলে গেলেন। কিন্তু ইভান খুব খুশী হল। ঠোট চেপে হাসল। ঈশা পেছনে ঘুরতেই ইভান কে দেখে দাড়িয়ে গেলো। ইভান তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঈশা বলল
–রেডি হয়েছ? যেভাবে ঘুমাচ্ছিলে ভাবলাম আজ হয়তো অফিসে যাবেনা।
ইভান অলস ভঙ্গীতে বলল
–অফিস থেকেই ফোন করেছিল। তাই উঠলাম।
ঈশা পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–সুন্দর লাগছে।
ইভান অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা কানে আসতেই ঈশার দিকে সরু চোখে তাকাল। বলল
–আমাকে বললে?
–এখানে আর কেউ কি আছে?
ইভান হেসে ফেললো। কিছুটা অপ্রস্তুত। কিছুটা অগোছালো। ঈশা খেয়াল করেই বলল
–লজ্জা পেলে?
ইভান অপ্রস্তুত হেসে বলল
–জীবনে প্রথম শুনলাম তো তাই একটু অন্যরকম লাগছে। তো জীবনে প্রথম আমাকে তোমার সুন্দর লাগলো?
ঈশা মৃদু হেসে তাকাল। বলল
–আগেও মনে হয়েছে অনেকবার। কিন্তু বলা হয়নি।
–এতদিন না বলার কারন আর আজকে বলার কারণটা জানতে পারি?
ইভান প্রশ্ন করতেই ঈশা শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–অনেক কিছুই আগে হতোনা কিন্তু এখন হচ্ছে। ধরে নাও এটাও সেরকম কিছুই।
ঈশার কথাটা ইভানের সন্দিহান মনে হল। নরম কণ্ঠে বলল
–ঠিক বুঝলাম না।
ঈশা প্রশস্ত হাসল। ইভানের শার্টের কলার ঠিক করে দিয়ে বলল
–এতদিন তো ঘুমানোর আগে মেয়েদের ফোন আসতো না আর বারান্দায় গিয়ে কথা বলার প্রয়োজন হতো না। এখন হচ্ছে।
চলবে……
#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১২
ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠলো দেয়ালে ঝুলানো দেয়াল ঘড়িটা। ঠিক ঠিক ৯ বার বেজে থেমে গেলো। রান্না ঘর থেকে ছনছন আওয়াজ ভেসে এলো। খানিকবাদেই আবার নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিলো ঘরটাকে। মুখোমুখি দাড়িয়ে ইভান ঈশা। ইভানের চোখে একরাশ প্রশ্নে ভরা তির্যক চাহুনি। ঈশার কথার রেশ টেনেই বলল
–সিরিয়াসলি! ঘুমানোর ভান করে আমাকে পাহারা দাও রাতে?
কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়লো ঈশার কপালে। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–এতো জোরে হেসে হেসে কথা বললে জেগে থাকার দরকার নেই তো। এমনিতেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
ইভান শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ঠোট বাকিয়ে হেসে বলল
–সন্দেহ? জিজ্ঞেস করতে পারতে কার ফোন। আমি তোমাকে মিথ্যা বলিনা। আর তোমার ঘুম যাতে নষ্ট নাহয় সেজন্যই বারান্দায় গিয়েছিলাম কথা বলতে। তোমার কাছ থেকে কিছু লুকানোর মতো নাই। গট ইট?
ঈশা গম্ভীর হয়ে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–এটা সন্দেহ নয়। আমি তোমার ব্যপারে খুবই পজেসিভ। এসব বিষয় সহজ ভাবে নিতে পারি না। তুমি সেটা ভালো করেই জানো। তারপরেও বাসায় এসব না করলেই পারো।
ঈশার কথাটা বেশ অসন্তোষজনক মনে হল ইভানের কাছে। ভ্রু কুচকে বলল
–এক্সকিউজ মি? তুমি কি বলতে চাইছ? এসব বাসায় না করলেও পারি মানে কি? তোমার ধারনা আমি কি প্রেম করছি?
ইভানের কথা শুনে ঈশা যেন আকাশ থেকে পড়লো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি সেটা কখন বললাম? আমি যথেষ্ট শিক্ষিত। বাইরে চলতে গেলে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতে হয় সেটা আমি জানি। কিন্তু তুমি এভাবে লুকিয়ে ছাপিয়ে বারান্দায় গিয়ে কথা না বললেও পারতে। আমার সামনে কথা বললে কি এমন ক্ষতি হতো? তোমার আচরন গুলোই অদ্ভুত।
ইভান সরু চোখে তাকাল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–ওয়াও! আমি তোমাকে দেখে রীতিমতো অবাক হচ্ছি। আমি যার সাথেই কথা বলি সেটা মেয়ে না ছেলে তুমি কিভাবে বুঝলে? কারন সেই সময় তুমি ঘুমাচ্ছিলে? আর আমি কথা বলার সময় নাম মেনশন করিনি যে তুমি কথা শুনেই বুঝে যাবে সেটা মেয়ে। তার মানে তুমি আমার ফোন চেক করো? এটা ঠিক কি ধরনের ব্যবহার?
ইভানের আচরনে ঈশা হতভম্ব হয়ে গেলো। গলার স্বর নামিয়ে বলল
–আমি চেক করিনি। আমি তো…।
–শাট আপ! একদম মিথ্যা বলবে না। এই আচরণটা তোমার নতুন না। তুমি আমাকে সব সময় সন্দেহ করো। যদি ভুলে যাও তাহলে মনে করিয়ে দেই বিয়ের সময়টার কথা।
ইভান থেমে গেলো। এমন আচরন ঈশার খারাপ লাগলো। তীব্র অভিমানে বিষিয়ে উঠলো মন। পুরো কথা না শুনেই এমন আচরন করলো? চোখ ভরে উঠলো। ইভান প্রচণ্ড রেগে বলল
–এরপর থেকে মেয়েদের নিয়ে আমাকে ব্লেম করতে হলে আগে ভালভাবে সবটা জেনে নেবে তারপর কথা বলবে। নাহলে আমার সাথে তোমার কথা বলার কোন দরকার নেই।
ইভান দ্রুত পায়ে চলে গেলো বের হয়ে। ঈশা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো নিজের রুমে। অনাহারে কেটে গেলো সকালটা। ঈশা ঘর থেকে বের হল না। তার মনে তীব্র অভিমান জমে গেছে। কেদে কেদে একদম চোখ ফুলে তুলেছে। ইভান তার পুরো কথাটা শুনলই না। ইভানের হাসির শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন ঠিকই বুঝতে পারেনি কার সাথে কথা বলছিল। আর ঘুমের মাঝে এতটা গুরুত্বও দেয়নি। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তীব্র শব্দে আবারো ইভানের ফোন বেজে ওঠে। ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবেই ঈশা ফোনটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করে দেয়। নাম্বারটা সেভ করা ছিল না। এতটুকু বুঝতে পেরেছিল সেটা বিদেশী নাম্বার। কিন্তু কলটা কেটে যেতেই ঐ নাম্বার থেকে মেসেজ আসে। মেসেজটা দেখেই ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সেখানে লেখা ছিল
“শুভ সকাল। ঘুম থেকে উঠেই আমাকে একটা কল দেবে। আমি তোমার কলের জন্য অপেক্ষা করবো ইভান। মিস ইউ।“
নিচে ছোট্ট করে লেখা তৃনা। এই নামটা ঈশা আগে কখনো শোনেনি। হয়তো ইভানের পরিচিত কেউ। সে হিস্ট্রি চেক করতে গিয়েই দেখে ইভান মাঝে মাঝেই ঐ নাম্বারে কথা বলে। কাল রাতেও যে নাম্বারে কথা বলেছে সেটা একই। তাই ঈশা ঠিক করে ফেলে সে এই বিষয়টা নিয়ে ইভানের সাথে কথা বলবে। কিন্তু শুরু করতেই ইভান বিষয়টাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। সব সময় এমন করে। ইভান তাকে কোনভাবেই বুঝতে চায় না।
————-
জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ডের মতো উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্যটা। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা ইভানের। মেজাজটা বেশ খারাপ। হাতের ঘড়িটায় ঘণ্টার কাঁটা ২ টায় আটকে আছে। মাত্র অফিস থেকে বের হয়েছে। জরুরী মিটিং ছিল। সেটা শেষ করেই ছুটি নিয়ে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় যাবে বলে। রাতে ঘুম হয়নি। আর এই মিটিং টার জন্য একটা সপ্তাহ বেশ পরিশ্রম করেছে সে। আজ কাজটা শেষ করে অনেক শান্তি লাগছে। এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নেবে। একটা ফাঁকা রিক্সা দেখে সেটাতে উঠে পড়লো। এতটা টায়ার্ড যে রিক্সার ঝাকুনিতেই তার ঘুম চলে আসছে। চোখ মেলে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনরকমে বাড়ি পৌঁছে গেলো। কলিং বেল বাজাতেই ইফতি এসে হাসি মুখে দরজা খুলে দিলো। অবাক হয়ে বলল
–আরে ভাইয়া তুমি এতো তাড়াতাড়ি?
ইভানের কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না। তার মনে হচ্ছে কোনরকমে শুয়ে পড়লেই বাঁচে। তাই ইফতির কথায় বেশ বিরক্ত হল সে। ধমকে উঠে বলল
–সরে যা সামনে থেকে।
ইভানের এমন গম্ভীর ধমকে সবাই সেদিকে তাকাল। ইফতি সরে দাঁড়ালো। ইভান ভেতরে ঢুকেই চোখ পড়লো সোফায়। তার সব কাজিনরা বসে আছে। সবার চেহারা থমথমে। ইভান ক্লান্ত সরে বলল
–তোরা কখন এসেছিস?
ইরিনার স্বামী রাজিব বলল
–অনেক্ষন হল এসেছি ভাইয়া। আপনার অফিস এতো তাড়াতাড়ি শেষ হল?
ইভান ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–ছুটি নিয়ে এসেছি। তোমরা গল্প করো। আমি ভীষণ টায়ার্ড। রেস্ট নিয়ে আসছি।
কথা শেষ করে ক্লান্ত দৃষ্টি ঈশার দিকে ফেরাল। শুকনো মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ইভান এখন আর কোন কথা বলার অবস্থায় নাই। তাই নিজের ঘরে চলে গেলো। বেশ লম্বা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো ক্লান্তি কাটাতে। কিন্তু কোন লাভ হল না। শাওয়ার নেয়ার পরেই আরও বেশী করে ক্লান্তি যেন জাপটে ধরল। বিছানায় কিছুক্ষন শুয়ে রেস্ট নিতে চাইল। কিন্তু শোয়া মাত্রই রাজ্যের ঘুম এসে ভিড় করলো চোখের পাতায়। সময় নিলো না গভীর ঘুমে ডুবে যেতে। দুপুরে খাওয়ার জন্য ইভান কে ডাকতে ঈশা ঘরে এলো। কিন্তু এসেই দেখল সে গভীর ঘুমে আছে। পাশে বসে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো ঘুমন্ত মুখের দিকে। আলতো হাত বুলিয়ে দিলেও কোন হেলদোল প্রকাশ পেলো না তার। ঈশা আর ডাকল না। উঠে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। সকালেও না খেয়ে গেছে সে। দুপুরেও খেলো না। বাইরে খেয়েছে কিনা কে জানে। কথাই তো বলল না। ঈশা বাইরে আসতেই সবাই জোর করলো খেতে। কিন্তু ঈশা কারো কথা শুনল না। ইভানের সাথে খাবে বললে তেমন কেউ আর জোর করলো না। সবাই যে যার মতো খেয়ে দুপুরে রেস্ট নিতে গেলো। ঈশাও ঘরে চলে গেলো। ইভান তখনও ঘুমেই আছে। ঈশা ঘরে এসেই মনে হল শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। সেও ইভানের পাশে আলতো করে শুয়ে পড়লো। শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। অন্ধকার করে এলো দৃষ্টি।
সন্ধ্যার আগে আগে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঈশাকে গুটিসুটি হয়ে পাশে শুয়ে থাকতে দেখে তার উপরে একটু ঝুঁকে গেলো। শুকনো মুখটা চোখে পড়তেই হাহাকার করে উঠলো ভেতরটা। মেয়েটাকে আবারো কষ্ট দিয়ে ফেললো। অমন ব্যাবহার না করলেও পারতো। কাজের চাপে আসলে তারও মেজাজটা ঠিক ছিলনা। তাই খুব দ্রুত রিয়াক্ট করে ফেলেছে। খুব মন খারাপ করেছে ঈশা। এতক্ষনে একটা সরি বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে তো ভীষণ ক্লান্ত ছিল। কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল
–সরি জান।
উঠে বসে কিছুক্ষন ভাবল। কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে। অনেক কিছু ভেবে অবশেষে বের করলো ঈশা রাতে ঘুরতে পছন্দ করে। আর কাজিনরা সবাই বাসায় তাই আজ রাতে সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। তাহলে একটু হলেও রাগটা কমবে। ইভান ফ্রেশ হয়ে এসে হাতমুখ মুছে নিলো। ঘর থেকে বাইরে গেলো। নাজমা কে বলল এক কাপ চা দিতে। নাজমা চা দিয়ে গেলে ইভান বেশ সময় নিয়ে চা টা শেষ করলো। চা শেষ করে ঘরে এসে ঢুকতেই ঈশার উপরে চোখ পড়লো। কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। ইভান ঘুম থেকে উঠে যেভাবে দেখেছে সেভাবেই আছে। এতটা সময়ে এক চুলও নড়াচড়া করেনি। কিন্তু ঈশা যতই গভীর ঘুমে থাক সে অনবরত নড়াচড়া করে। মাঝে মাঝে ঈশাকে জড়িয়ে ধরলে তার নড়াচড়া করার কারনে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। কাছে গিয়ে বসল। সারামুখে হাত বুলিয়ে কোন হেলদোল পেলো না। ধির কণ্ঠে ডাকল
–ঈশা। ঈশা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
ঈশার বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হল না। ইভান আলতো করে গালে হাত রেখে বলল
–ঈশা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
ঈশা আগের মতই অনড়। ইভানের চিন্তাটা এবার ভয়ে পরিণত হল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে ঈশার মাথাটা তুলে বুকে চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল
–একবার চোখটা খোলো। আমি ডাকছি তো।
চোখ মেলে তাকাল না ঈশা। এমনকি ইভানের কথাও কানে গেলো না।
চলবে………