শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ১৩,১৪

0
1319

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ১৩,১৪
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৩

রুমের এসি চালানো। গরম খুব একটা নেই। তবুও হিম শীতল হাওয়াটা শরীরে কোন অনুভূতি তৈরি করছে না। প্রচণ্ড বাজে ভাবে ঘামছে ইভান। মুখটায় লালাভ আভা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। শ্বাসটাও জোরে জোরে পড়ছে। বুকের ঠিক মধ্যখানটায় একটা চিনচিনে ব্যথা সুচের মতো আঘাত করছে। চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। ঈশা ধিরে ধিরে চোখ মেলে তাকাল। ইভান সস্তির নিশ্বাস ফেললো। কপালে হাত রেখে ভীষণ আদুরে কণ্ঠে বলল
–খারাপ লাগছে?

ঈশা মাথা নাড়ল। উঠে বসতে চাইল। ইভান তাকে খুব জত্ন করে নিজের বুকে আগলে নিলো। ঈশার শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। সে খুব একটা নড়াচড়া করতে পারছে না। ঈশার যখন সিস্টের জন্য ট্রিটমেন্ট শুরু হয় তখনই ইলহাম বলেছিল যে অনেক হাই ডোজের ঔষধ খাওয়ার কারনে এটার এফেক্ট শরীরে অনেকদিন পর্যন্ত থাকবে। আর সেটার ফলেই একটু অনিয়ম হলেই হুট করে তার প্রেশার ফল করতে পারে। খুব নিয়মের মধ্যে থাকলে সেটা তাড়াতাড়ি রিকভার করতে পারবে। কিন্তু ঈশা একদম কেয়ারলেস। সে সেরকম ভাবে কোন নিয়ম মেনে চলে না। ইভানের উচিৎ ছিল বিষয়টা খেয়াল রাখা। কিন্তু অফিসের কাজের চাপে কয়েকদিনে ইভান নিজেই অস্থির হয়ে উঠেছে। নিজের খেয়াল রাখাই তার জন্য দুস্কর হয়ে পড়েছে। তাই ঈশারও খেয়াল রাখতে পারেনি। ইভান ঈশার মুখটা আলতো করে তুলে ধরে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো
–তুমি খেয়েছ?

ঈশা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আলতো করে মাথা নাড়ল। খায়নি সে। ইভানের খুব রাগ হল। ঈশা ভাবল রাগটা হয়তো তার উপরেই করেছে না খেয়ে থাকার জন্য। কিন্তু ইভানের নিজের উপরেই রাগ হল। ঈশা ধরেই নিলো ইভান এখন তাকে বকবে। তাই মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আমি তোমার…।

শেষ করতে পারল না কথাটা। ইভান শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ঈশা একটু অবাক হল। ইভানের শ্বাস অনেক জোরে পড়ছে। হৃদ স্পন্দনও বেড়ে গেছে। এতটাই বেড়ে গেছে যে ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ রুমের মাঝে ঈশা স্পষ্ট ইভানের হৃদ স্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললো ঈশা। ইভান আবেগি কণ্ঠে বলল
–সরি জান। আমি আসলে অনেক টেনশনের মাঝে ছিলাম। একটু বেশীই রিয়াক্ট করে ফেলেছিলাম। আমার উচিৎ ছিল তোমার কথা শোনা। আমি সত্যিই সরি।

ঈশা চোখ খুলে ফেললো। মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভানের চেহারায় অপরাধ বোধটা স্পষ্ট। ঈশার খারাপ লাগলো। তার অন্তত বোঝা উচিৎ ছিল। একটা মানুষ কত দিকে সামলাবে। এমনিতেই অফিসের কাজের চাপ থাকেই। তার উপরে ঈশাকে নিয়ে টেনশন। তার নিজের উচিৎ ছিল বিষয়টাকে সহজভাবে নেয়া। ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
–তুমিও খাওনি কেন?

ইভান চোখ নামিয়ে বলল
–দুপুরে তোমার সাথে খাবো বলেই তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছিলাম। কিন্তু কয়েকদিনের চাপে এতো টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। আমি সত্যিই সরি ঈশা। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা তবুও কোন না কোন ভাবে তুমি আমার কাছ থেকে কষ্ট পাও।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান বাইরে চলে গেলো। ঈশা পেছনে হেলে আরাম করে বসে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কিছুক্ষন পরেই ইভান ঘুরে এলো খাবার হাতে নিয়ে। ঈশা চোখ খুলে ফেললো। ইভান ঈশার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
–খেয়ে নাও।

ঈশা উত্তর দিলো না। ইভান যত্ন করে ঈশার মুখে খাবার তুলে দিলো। ঈশা কয়েকবার খেয়ে বলল
–তুমি কখন খাবে?

ইভান উত্তর দিলনা। প্রসঙ্গ পালটে বলল
–জানতে চাইবে না ফোনের মেয়েটা কে ছিল?

মুহূর্তেই ঈশার আবার সব কথা মনে পড়ে গেলো। চাপা অভিমান খেলে গেলো মনের মাঝে। মুখটা থমথমে করে বলল
–নাহ!

ইভান বুঝতে পেরে স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–আমার অফিসের ক্লায়েন্ট ছিল। আমেরিকায় থাকে। তার সাথে একটা প্রজেক্টে কাজ করছিলাম। তাই অনেকবার কথা হয়েছে। আজকেই সেই প্রজেক্টের কাজ শেষ করে দিলাম। আর কথা বলতে হবে না।

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল
–কথা বলবে। তোমাকে কে নিষেধ করেছে।

ইভান মৃদু হাসল। বলল
–বিবাহিত এক বাচ্চার মায়ের সাথে কথা বলে আমার লাভ কি?

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল
–তাই? ঐ এক বাচ্চার মাই তোমাকে ভীষণ মিস করে।

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–তোমাকে কে বলল?

–ফোনে কথা বলে শান্তি হয়না তাই মেসেজ করে জানিয়ে দেয় ঠিক কতটা মিস করে।

ইভান ভ্রু কুচকে ফেললো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–মেসেজ করে মানে?

ঈশা পাশ থেকে ইভানের ফোনটা নিয়ে মেসেজ অন করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–এই যে। দেখো তোমাকে কতোটা মিস করে।

ইভান মেসেজটা দেখে হতাশ শ্বাস ছাড়ল। এটার কারনেই ঈশা ওরকম আচরন করেছে। কিন্তু ইভান তো এটা দেখেয়নি। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এরকম হাজারটা মেসেজ কোন কিছুই ইঙ্গিত করে না। আমি যতক্ষণ না এসবের প্রতি কোন ইন্টারেস্ট দেখিয়েছি। তোমার ফোনেও এমন মেসেজ আসে। সেসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। তুমি যে মেসেজটা দেখেছো সেটা আমাকে জানাওনি। তা কেন জানাবে? তোমার তো ধারনা আমি প্রেম করি। সন্দেহ ছাড়া আর কি করতে পারো তুমি? আর রাতে তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলেই আমি বারান্দায় গিয়ে কথা বলেছিলাম। যাতে তোমার ঘুম নষ্ট না হয়। যদি তুমি আমার সব কথা শুনে থাকো তাহলে এটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ যে অফিসিয়াল ছাড়া অন্যকোন কথা আমাদের মাঝে হয়নি। সেটা শুনেই বা কি লাভ। তোমার মনে তো আমাকে নিয়ে সব সময় সন্দেহ কাজ করে। আগেও এমনই ছিল। যে কাজটা আমি করিই নি সেটা নিয়েই তুমি আমাকে অপবাদ দিয়েছ। তোমার এরকম আচরন আমাকে সত্যিই খুব কষ্ট দেয়। সবাই জানে আমার সবকিছু এই ঈশাতেই আটকে আছে আর শুধু তোমাতেই সীমাবদ্ধ। ইভান শুধু তার ঈশাতেই আসক্ত। আর এটা তুমিই বোঝনা।

ঈশা একটু দমে গেলো। নরম কণ্ঠে বলল
–সরি আমার ওভাবে বলা উচিৎ হয়নি। মেসেজটা দেখেই আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। তোমার সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখনই ওভাবে কথা বলা উচিৎ হয়নি। পরেও জিজ্ঞেস করতে পারতাম।

ইভান তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–আমি আগেও বলেছি এভাবে নিজের মতো সবকিছু ভেবে না নিয়ে আমার সাথে ক্লিয়ার করে কথা বলবে। আমি এই জীবনে কখনো তোমার কাছে মিথ্যা বলিনি। এভাবে চুপ করে আমার ফোন চেক করে কোন লাভ হয়নি। উল্টা সন্দেহটা বেড়ে গেছে। বিষয়টা খারাপ। আমাকে ভালভাবে জিজ্ঞেস করলেই এমন কিছুই হতোনা।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান বিষয়টা সহজ করে নিয়ে বলল
–বাদ দাও। যা হবার হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি সকাল থেকে খাওনি কেন?

ঈশা গলা নামিয়ে বলল
–তুমি খাওনি তাই। আর ভীষণ রাগ হয়েছিলো।

–তোমাকে বারবার একটা কথা কেন বলতে হয়? নিজেকে ঠিক রাখতে গেলে নিয়ম মেনে চলতে হবে। তুমি জানো নিয়ম না মানলে তোমার জন্য ক্ষতি। তুমি কি সুস্থ থাকতে চাও না? আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তোমার তাই না?

ইভানের ধমক শুনে ঈশা দমে গেলো। ভীত কণ্ঠে বলল
–আর হবে না।

ইভান কঠিন গলায় বলল
–এবার হলে তোমাকে স্টোর রুমে বন্ধ করে রেখে আসবো। জানই তো ওখানে কত তেলাপোকা। এটা ভাববে না যে আমি করতে পারব না। আমি যতটা ভালবাসতে পারি ঠিক ততটাই শাস্তি দিতেও পারি। যে যেটা ডিজারভ করে।

চলবে……

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৪

ধোঁয়ার মতো আবছা কুয়াশা আকাশ থেকে শিরশির করে পড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়াটা জানালা দিয়ে এসে সোজা মুখে লাগছে। ঈশা একটু নড়েচড়ে উঠলো। মুখটা কম্বলে ঢেকে নিলো ভালো করে। ইভান পাশে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। পাতলা একটা টি শার্ট তার গায়ে। সেরকম ঠাণ্ডা লাগছে না। কিন্তু ঈশার এতো ঠাণ্ডা লাগছে কেন? বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শরীর কাঁটা দিয়ে লোম দাড়িয়ে গেলো। ঘরে তেমন ঠাণ্ডা না হলেও বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। ইভান এতক্ষন কাজে ব্যস্ত ছিল বলে বুঝতে পারেনি। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় শিশির পড়ার দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জানালাটা বন্ধ করে আবার বিছানায় বসে পড়লো ইভান। কিছু সময়ের ব্যবধানে কাজে নিমগ্ন হয়ে গেলো সে। তীব্র শব্দে ফোন বেজে উঠলো। নিস্তব্ধ ঘরটার মাঝে আচমকাই এমন শব্দ শুনে চমকে উঠলো ইভান। ঈশাও কিছুটা নড়ে উঠলো। ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি স্থির করেই ফোনটা ধরল। ভীষণ বিরক্ত নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে ভারী গম্ভীর কণ্ঠ কানে আসলো।
–ইভান আমি মাত্র ফ্রি হলাম। এখন আসতে পারবি?

কথাটা মাথায় ঢুকতেই ইভান সচকিত দৃষ্টি ঈশার দিকে ফেললো। স্থির চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–ভাইয়া তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি ঈশাকে নিয়ে আসছি।

ফোনটা কেটে দিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। গুটিসুটি মেরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। আজকাল মেয়েটা সব সময় ক্লান্ত থাকে। একটু কাজ করলেই হাপিয়ে ওঠে। সময় অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু ঝুঁকে আদুরে কণ্ঠে ডাকল
–ঈশা। ঘুম হয়নি? ওঠো। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।

কথাটা ঈশার কানেই গেলো না। ইভান হতাশ শ্বাস ছাড়ল। কম্বল সরিয়ে দিতেই ঈশা ঠাণ্ডায় জমে গেলো। বিরক্ত নিয়ে তাকাল। ভারী গলায় বলল
–ঘুমাচ্ছি দেখছ না? বিরক্ত করছ কেন?

ইভান মৃদু হাসল। বলল
–আজ তোমার ডক্টরের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। ইলহাম ভাইয়া ফোন করেছিলো। এখনই যেতে হবে।

ঈশা চোখ খুলে ফেললো। ঘুম জড়ানো চোখ গুলো যতটা সম্ভব বড় করে তাকানোর চেষ্টা করলো। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলল
–আমার কিছু হয়নি। ডাক্তারের কাছে কেন যাবো?

ইভান সরু চোখে তাকাল। বলল
–আমি বলিনি তো কিছু হয়েছে। রুটিন চেকাপের জন্য যেতে হবে। এই যে তুমি ইদানিং খুব টায়ার্ড থাকো। সব সময় তোমার ঘুম পায়। কিছুদিন থেকে দেখছি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করছ না এইজন্যই একটু ভাইয়ার সাথে কথা বলবে। আর কিছু না।

ঈশা উঠে বসল। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল
–এরকম তো মাঝে মাঝেই হয়। আবার ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।

ইভান বুঝে গেলো ঈশা সোজা কথার মানুষ না। ভালো করে কথা বলে কোন লাভ নেই। তাই একটু দরাজ গলায় বলল
–তোমার সাথে এতো কথা বলার সময় নেই। আমার কাজ আছে। তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমরা এখনই বের হবো।

ঈশা একটু দমে গেলো। ইভান কথা বলার সুযোগ দিলো না। নিজেও রেডি হতে চলে গেলো। ঈশা উপায় না দেখে রেডি হল বেশ বিরক্ত নিয়ে। যাওয়ার সময় বারবার একই কথা বলছিল এই ঠাণ্ডায় সে নির্ঘাত মারা যাবে। ইভান শক্ত চোখে কয়েকবার তাকালে আর কথা বলেনি। পুরো রাস্তায় একদম চুপ ছিল। ইলহামের চেম্বারে পৌঁছানর পর সে ঈশাকে ভালো করে দেখে কিছু টেস্ট করতে দেয়। ঈশা একটু ঝামেলা করলেও ইভানের রাগের আগে টিকতে পারেনা। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেস্টগুলো করিয়ে নিতে হল। ভারী মুখ নিয়ে বাসায় চলে এলো। ইভানের উপরে খুব রাগ তার। সব সময় এমন জোর করাটা তার মোটেও পছন্দ নয়। ইভান এটা নিয়ে আর কোন কথাই বলেনি। কারন কথা বললেই ঈশা অযথাই নখরা করবে। ঈশাও আর ঝগড়া করার কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে ঘুমিয়ে গেলো।

————-
হেমন্তের বিকেলের শেষ রোদটুকু বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। এলোমেলো হাওয়া বইছে শহর জুড়ে। আবছা কুয়াশারাও ভিড় করেছে দূর দিগন্তে। নিজের কেবিনের চেয়ারে বসে ঈশার রিপোর্ট গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে ইলহাম। কপালে ভাঁজ তার। অনেকটা সময় ধরে দেখল। ইভান কে ফোন দিলো। কয়েকবার রিং হয়েও ধরল না। হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দিলো। কাগজগুলো আবারো তুলে ধরল চোখের সামনে। একটু ভেবে ঈশার নাম্বারে ফোন দিলো। ঈশা একবারেই ফোনটা ধরে ফেললো। ইলহাম একটু চিন্তিত সরে বলল
–কেমন আছিস ঈশা?

–ভালো আছি ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?

ঈশার উত্তরে ইলহাম নরম সরে বলল
–ভালই আছি। আচ্ছা ইভান কোথায়? ওকে ফোন দিয়েছিলাম ধরল না।

–অফিসে। মনে হয় মিটিং এ আছে তাই ধরতে পারেনি। কোন দরকার ছিল? কিছু বলতে হলে আমাকে বল। আসলে আমি বলে দেবো।

ইলহাম একটু ভেবে বলল
–তুই বাসায় আছিস?

ঈশা একটু ভেবে বলল
–হ্যা। কেন?

–আমি আসছি।

বলেই ইলহাম ফোনটা কেটে দিলো। ঈশা ভাবনায় পড়ে গেলো। তার রিপোর্ট নিয়ে কোন কমপ্লিকেশন হয়নি তো? সাত পাঁচ ভেবে ভেতর থেকে একটা তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি বেরিয়ে এলো। নতুন করে আর কি কমপ্লিকেশন হবে। মাথা থেকে ভাবনাটা বের করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ইফতি সোফায় বসে ছিল। তার পাশে গিয়ে বসতেই ইফতি বলল
–ভাবী আপু কাল ভাইয়ার জন্মদিন মনে আছে?

ঈশা মৃদু হেসে বলল
–হ্যা আছে।

চিপসের প্যাকেট ঈশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
–কালকের প্ল্যান কি?

ঈশা প্যাকেট থেকে একটা চিপস তুলে নিলো। মুখে পুরে বলল
–ইলু আপু ফোন করেছিলো। সারপ্রাইজ দিতে চায়। তাই আমাদেরকে নরমাল আচরন করতে বলেছে।

ইফতি ভ্রু উঁচিয়ে হেসে বলল
–তার মানে আমরা ভুলে গেছি তাই তো?

ঈশা হেসে ফেললো। একটা ফোন আসায় ইফতি উঠে চলে গেলো। ঈশাও উঠে রান্না ঘরে গেলো। রাতের খাবারের আয়োজন হচ্ছে। ইভান খুব কড়া নির্দেশ দিয়েছে যে ঈশা যেন রান্না ঘরে না আসে। তাই ঈশাকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখেই নাজমা দরজাতেই আটকে দিলো। অস্থিরভাবে বলল
–না ভাবী আপনে এখানে আসবেন না। ভাইয়া শুনলে রাগ করবে।

ঈশা ভ্রু কুচকে ফেললো। ধমক দিয়ে বলল
–আমি এভাবে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছি নাজমা। আর এখন কেউ নেই যে তোমার ভাইয়াকে বলবে। তুমি না বললেই হল।

নাজমা তবুও প্রতিবাদ করলো। কিন্তু ঈশার জেদের আগে টিকতে পারল না। কাজের মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। নাজমা ভীত কণ্ঠে বলল
–ভাইয়া এসেছে মনে হয়। আপনে এখান থেকে যান।

ঈশা মৃদু হেসে বলল
–মনে হয় ইলহাম ভাইয়া এসেছে। আমি দেখছি।

বলেই বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো। ইলহাম মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকল। সোফায় বসে বলল
–এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবি।

ঈশা পানি এনে দিলো। তার ঠিক সামনেই বসে বলল
–কি হয়েছে ভাইয়া? জরুরী কোন কথা?

ইলহাম পানির গ্লাসটা সামনে রাখল। বলল
–ইভান কখন আসবে?

ঈশা ঘড়ির দিকে তাকাল। মাত্র ৮ টা বাজে। ইভান বলেছে আসতে প্রায় ১১ টা বাজবে। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–দেরি হবে ভাইয়া। আজ নাকি জরুরী কাজ আছে।

ইলহাম ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলতেই ঈশা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–ভাইয়া কোন সমস্যা হলে তুমি আমাকে বলতে পারো। আমি এখন সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি। পরিস্থিতি সব কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। তুমি আমার রিপোর্ট নিয়েই কথা বলতে এসেছ তাই না?

ইলহাম মাথা নাড়ল। ঈশা মৃদু হেসে বলল
–আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারো ভাইয়া। কোন সমস্যা নেই।

ইলহাম রিপোর্টটা ঈশার দিকে এগিয়ে দিলো। বলল
–তুই নিজেই দেখ।

ঈশা কৌতূহলী হয়ে হাতে নিলো। কাগজটা মেলে চোখের সামনে ধরতেই সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। মস্তিষ্কের চিন্তা ধারা অগোছালো হয়ে উঠলো মুহূর্তেই।

————
চাবি দিয়ে দরজা খুলে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল ইভান। পুরো বাড়ি অন্ধকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষনে। ইফতি হয়তো জেগে আছে কিন্তু নিজের ঘরে। এগিয়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। ঈশা এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা আজকাল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। ভাবতেই মনে পড়ে গেলো আজ ঈশার রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। ইলহাম তাকে ফোনও দিয়েছিলো। কিন্তু ব্যস্ত থাকায় ধরতে পারেনি। একটা অপরাধ বোধ কাজ করলো নিজের মধ্যে। প্রচণ্ড হতাশায় ভরা একটা শ্বাস ছেড়ে ভাবল একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ইলহাম কে ফোন দেবে। খুব সাবধানে দরজার হাতল ঘোরাল। ভেতরে ঢুকে দেখল অন্ধকার ঘরে রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলো আসছে। বারান্দার দরজাটা খোলা। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখল ঈশা নেই। কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। হাতের ব্যাগটা রেখে বারান্দার দিকে এগুতেই দেখল ঈশা দাড়িয়ে। রাস্তার আলোয় পেছনের দিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে গ্রিলে হাত রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আধ খোলা খোপা থেকে বের হওয়া এলোমেলো চূলগুলো বাতাসে উড়ছে। শাড়ী পরেছে। কিন্তু গায়ে কোন শীতের কাপড় নেই। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–এখানে কেন দাড়িয়ে আছো? ঠাণ্ডা লাগছে না?

ঈশা কিছুটা চমকে উঠলো। অস্থির হয়ে তাকাল। তার মুখ দেখেই ইভানের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের সাদা অংশটা গোলাপি বর্ণ ধারন করেছে। চোখের পাতায় মুক্তো দানার মতো পানি জমে আছে। ইভান অস্থিরভাবে বলল
–তুমি কাদছ? কি হয়েছে?

ঈশা এগিয়ে এলো। ইভানের কাছাকাছি দাড়িয়ে মৃদু হেসে বলল
–দেখো আমি সেজেছি। কেমন লাগছে?

ইভানের দৃষ্টিতে বিস্ময়। ঈশার আচরন অদ্ভুত। তারপরেও সে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। সাদা আর নীলের সংমিশ্রনে একটা শাড়ী পরেছে। কপালে নীল টিপ। চোখের কাজল লেপটে ছড়িয়ে গেছে। তবুও যেন অসীম মায়া সেই দুচোখে। শরীর জুড়ে শুভ্র নীলের ছড়াছড়ি। ইভান মুগ্ধ হল। মুগ্ধ কণ্ঠে বলল
–খুব সুন্দর লাগছে।

ঈশা শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। তৃপ্ত হেসে বলল
–শুভ জন্মদিন প্রিয় বর।

ইভান থমকে গেলো। কথাটা মাথায় ঢুকতেই হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাল। ১১ বেজে ৫৫ মিনিট। হেসে ফেললো। বলল
–এখনো তো ৫ মিনিট বাকি।

ঈশা ইভানের দুই গালে আলতো করে হাত রেখে ঠোঁটের কোনে গভীর চুমু খেয়ে বলল
–অপেক্ষার প্রহরটা বড্ড নিষ্ঠুর। কিছুতেই কাটতে চাইছে না। এই সুন্দর মুহূর্তটা তোমার সাথে অনুভব করার লোভটা সামলাতে পারলাম না। তাই সময়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে অনুভূতিটাকে গুরুত্ব দাও। কথা দিচ্ছি এই মুহূর্তের অনুভূতিটা তোমার পেছনের সমস্ত অনুভূতি ছাপিয়ে যাবে।

ইভান স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ঈশার কথা গুলো। কিছুটা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে তার দিকে। জন্মদিনের সারপ্রাইজটা তার কাছে বেশ লাগলো। ঈশা ইভানের বুকের বা পাশে হাত রাখল আলতো করে। মাথাটা অপরপাশে রেখে নীরবে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে দিলো। ইভানও চুপ করেই দাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে ঈশা কি করতে চাইছে। খানিকবাদে ফুপিয়ে কেদে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে ধরা গলায় বলল
–তোমার ভালবাসার কাছে সমস্ত অপূর্ণতা হার মেনে দমে গেছে। তোমার পবিত্র স্পর্শ আজ আমাকে পুরোপুরি পূর্ণ করেছে। সৃষ্টিকর্তা তোমার সকল আক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে তোমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে জীবনের সব থেকে বড় সুখটা তোমাকে দিয়েছে।

ইভান থমকে গেলো। ঈশার মুখটা তুলে দুই গালে হাত রেখে বলল
–ঈশা?

ঈশার চোখের পানিটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিরতিহীন ভাবে। কিন্তু সে ব্যকুল হয়ে কাঁদছে না। চোখের ভাষা অন্যরকম। ঈশা প্রশস্ত হেসে বলল
–শুভ জন্মদিন প্রিয় সাথে অনাগত সন্তানের জন্য অভিনন্দন।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here