শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ১৭

0
1687

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২,পর্ব ১৭
লেখক-এ রহমান

ইফতি খাবারটা মাত্র মুখে পুরেছিল। ইভানের কথা শুনে সেটা চিবুতেই ভুলে গেলো। বড় চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কোন রকমে সেটা গিলে ফেললো। অবাক কণ্ঠে বলল
–কিন্তু ভাইয়া এটা তো তোমার ড্রিম জব ছিল।

–ছিল কিন্তু এখন নেই।

ইভান খুব দ্রুত জবাব দিলো। কাল রাতেই অফিসের মেইল এড্রেসে নিজের রিজাইন এর মেইলটা সেন্ড করে দিয়েছে সে। আর তখনই ভেবে নিয়েছে ঠিক কি ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে। ঠিকঠিক সেসব সাজিয়ে নিয়েছে। কার প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিলে সেটা নিয়ে আর কোন কথা হবে না সেসব ভেবে নিয়েছে খুব সূক্ষ্ম ভাবে। তাই ইফতির প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি হল না। কিন্তু এখন বড় সমস্যা হল ঈশা। ঈশার কাছে সে মিথ্যা বলতে পারেনা। আর ঈশার অভ্যাস বড়ই খারাপ। বিষয়টা তার কাছে ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত সে কোনভাবেই ছাড়বে না। ওটা নিয়ে প্রশ্ন করতেই থাকবে। মানসিকভাবে নিজেকে তার প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রস্তুত করে নিলেও বিষয়টা বেশ জটিল। অযথা ঈশা সিন ক্রিয়েট করবে। ইফতি আবারো বলল
–এখন নেই মানে কি? এই জবের জন্য তুমি অনেক কষ্ট করেছো। আর এখন ছাড়তে চাইছ বুঝতে পারলাম না।

ইভান ইফতির দিকে তাকাল। কঠিন গলায় বলল
–৫ বছর আগে আমি করতে চেয়েছিলাম। আর এই জবের কারনে অনেক কষ্ট করেছিলাম। কিন্তু এখন আর ইচ্ছা নেই। আমি টায়ার্ড। জবটা ছেড়ে দিয়ে একটু রিলাক্স থাকতে চাই। এতো প্রেসার আর নিতে পারছি না।

থেমে যেতেই ঈশা বলল
–তাহলে এখন কি করবে?

ইভান খাবার মুখে পুরে দিলো। কিছুক্ষন চুপ করে ভাবল। তারপর বলল
–আমি চাকরি না করলেও সংসার চালাতে পারব। সেই ক্ষমতা আমার আছে।

ঈশা থমকে গেলো। তার কথার মানে ঠিক এরকম কিছু ছিল না। সে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি।

ইভান তাকাল। খুব শান্তভাবে বলল
–আমিও সেরকমভাবে কিছুই বলিনি। আসলে আমার চাকরিটা আর ভালো লাগছিলনা। তুমি জানো বরাবর আমার এই জীবন পছন্দ ছিল না। আমি প্রথম থেকেই চাকরি নিয়ে এতো ভাবিনি। চাকরিটা করতে চেয়েছিলাম শুধু নিজেকে সর্বচ্চ ব্যস্ত রাখার জন্য। এখন আর চাকরির দরকার নেই।

ঈশা কিছু বলল না। শুধু ইভানের দিকে চেয়ে থাকলো। বোঝার চেষ্টা করছে ইভান ঠিক কি করতে চাইছে। ইফতি ভীষণ অবাক হয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি কি ঠিক বলছ? মানে সত্যি সত্যি রিজাইন দিলে?

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল
–তোর কি মনে হয় আমি সবার সাথে মজা করছি? কেন অযথা জটিল করছিস বিষয়টাকে? আমি বলেছি আমার ইচ্ছা নেই তাই করবো না। এটা নিয়ে আর কোন কথা হবে না।

ইফতি ঈশা দুজনেই থেমে গেলো। কেউ আর এসব নিয়ে কথা বলল না। কারন ইভান এই বিষয়ে কথা বলাটাকে ভালভাবে নিচ্ছে না। সবাই চুপ করে নিজেদের খাবার শেষ করে ফেললো।

————–
কুয়াশার মোটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে পুরো শহরটাকে। বৃষ্টির মতো টুপটুপ আওয়াজে শিশির পড়ছে। গাছ পালা গুলো ঠাণ্ডায় যেন জমে গেছে। শিরশির হাওয়াটা শরীর কাঁপিয়ে তুলছে। অনেক আগেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সোফায় বসে ইভান টিভি দেখছিল। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েই উঠে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখে ঈশার বাবা গায়ে মোটা সোয়েটার পরে দাড়িয়ে আছে। মোটামুটি কাঁপছে। তার অবস্থা বুঝেই ইভান বাইরে শীতের অবস্থাটা আন্দাজ করে ফেললো। প্রশস্ত হেসে বলল
–মেজ বাবা ভেতরে আসো।

ঈশার বাবা ভেতরে ঢুকেই ইভানের কাঁধে হাত রেখে মলিন হেসে বললেন
–কেমন আছিস?

ইভান তার হাসিটা খেয়াল করলো। কিন্তু তেমন গুরুত্ব না দিয়েই বলল
–ভালো আছি। ভেতরে আসো।

ঈশার বাবা ভেতরে ঢুকে সোফায় বসলেন। ইভান দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল
–চা খাবে তো?

ঈশার বাবা মাথা নাড়লেন। ইভান একটু গলা তুলে নাজমাকে রান্না ঘর থেকে চা দিয়ে যেতে বলল। ঈশার বাবা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাত আরেক হাতের উপরে রেখে চেপে ধরে আছে। ইভান তার ঠিক সামনের সোফায় বসে বলল
–তোমার কি খবর বল? বাইরে খুব ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে।

তিনি অল্প বিস্তর মাথা নাড়লেন। ইভান খেয়াল করলো। তাকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে। কিছুটা এলোমেলো। কোন বিষয় নিয়ে তিনি হয়তো খুব চিন্তিত। ইভান নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল
–তোমাকে এমন কেন দেখাচ্ছে? কি হয়েছে?

তিনি একবার ইভানের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। মলিন চেহারা তার। আবার নিচের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ধরা গলায় বললেন
–আমি ইলহামের কাছে গিয়েছিলাম ডায়াবেটিক টেস্ট করাতে। সেখানে গিয়েই তাকে ঈশার রক্ত দেয়ার কারণটা জিজ্ঞেস করি। প্রথমে বলতে চাইছিল না কিন্তু আমার জোর করাতে বলতে বাধ্য হয়। আর সাথে এটাও বলে তুই কাউকেই জানাতে নিষেধ করেছিস।

ইভানের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। এই কারনেই সে কাউকে জানাতে নিষেধ করেছিলো। কোনভাবে এই অবস্থা যদি ঈশা দেখত তাহলে প্রশ্ন করতে শুরু করত। আর কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর না পেলে কোনভাবেই থামত না। ঈশার বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো?

ইভান তাকাল তার মুখের দিকে। ভীষণ হতাশ লাগছে দেখতে। গলাটাও ধরে এসেছে। ইভান আশস্ত করে বলল
–কি বলছ এসব? একদম ঠিক আছে।

ঈশার বাবা ইভানের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। চোখ ছলছল করছে তার। ইভান বিষয়টা বুঝেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল
–মেজ বাবা আমার উপরে তোমার ভরসা নেই? আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমার মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হতে দেবো না। এই বিশ্বাসটা তোমার রাখা উচিৎ।

ঈশার বাবার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তিনি সেটা মুছে নিয়েই বললেন
–তুই চাকরিটা কেন ছেড়ে দিলি বাবা? আমাদেরকে একবার বলতে পারতিস। আমরা সবাই মিলে ঈশার খেয়াল রাখতাম। তোকে এতো বড় ত্যাগ করতে হতোনা। তোর সামনে দাড়িয়ে আজ ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। কি করিস নি তুই আমার মেয়েটার জন্য।

ইভান হেসে ফেললো। বলল
–এভাবে কেন বলছ? শুধু কি তোমার মেয়ে বলেই করেছি? যা করেছি নিজের জন্য করেছি। নিজে ভালো থাকার জন্য করেছি। আমার উদ্দেশ্য সুখে থাকা। আর তোমার মেয়ে ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব। তাই তোমার মেয়েকে ভালো রাখার জন্য সবকিছু করতে পারব আমি।

ঈশার বাবা মলিন হেসে বললেন
–তোর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কি বলবো বুঝতে পারছি না।

কথাটা শেষ করতেই তার চোখ ভরে এলো। ইভান বুঝতে পেরেই একটা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। তার পায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়লো। হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল
–তুমি এভাবে কথা বললে আমার ভীষণ অসস্তি হয়। আমি তোমার মেয়েকে খুব ভালোবাসি মেজ বাবা। ওর জন্য সবকিছু করতে পারি। তুমি শুধু দোয়া করো। আমি যেন সারাজীবন তোমার মেয়েকে ভালো রাখতে পারি।

ঈশার বাবা ইভানের মাথায় হাত দিলেন। বেশ আবেগি কণ্ঠে বললেন
–তুই যখন আমার কাছে ঈশাকে বিয়ে করার কথা বলেছিলিস সেদিন আমি কোনকিছু না ভেবেই মেনে নিয়েছিলাম। আজ অব্দি তুই আমাকে কোনদিন এই কথাটা ভাবার সুযোগ দিস নি যে তুই কি আসলেই আমার মেয়ের জন্য উপযুক্ত। বরং ঈশা যখন তোকে ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেদিন আমি বেশ হতাশ হয়েছিলাম। নিজের মেয়ের এমন ভুল সিদ্ধান্তে তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার আশংকা করেছিলাম। মেয়েটা না বুঝেই তোকে কষ্ট দিয়েছে অনেক।

ইভান এবার হাসল। বলল
–ঈশা সত্যিই এতো গভীর ভাবে ভাবে না। আর ওর যে একার দোষ তাও না। আমি নিজেই ওকে সবকিছুই করতে দেই যা ও করতে চায়। ঠিক ভুল হিসেব করিনা। কারন আমার কাছে ওর ভালো থাকাটাই মুখ্য বিষয়। আমি এখনো সেটাই ভাবি। আর একটা কথা এসব বিষয় নিয়ে তুমি কারো সাথে কোন কথা বলবে না। ঈশা যাতে কোনভাবেই না জানে। জানলে ওর ভালো থাকাটা আর হবে না।

ঈশার বাবা ইভানের মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–তুই জিবনে অনেক সুখী হ বাবা। অনেক সুখী হ।

ইভান হেসে ফেললো। ঈশার বাবাও মৃদু হাসলেন।

————–
সন্ধ্যা থেকে অনেকটা সময় ঘুমানোর পরে ঈশার এখন আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছা করছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। হিম শীতল মেঝেতে পা রাখতেই গা শিরশির করে উঠলো ঠাণ্ডায়। পাশ থেকে চাদরটা উড়ে নিলো। জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরে তাকাল। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় শিশির পড়ার দৃশ্যটা বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছে তার কাছে। একদৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার সরে আসলো। ইভান ঘরে নেই। ঈশা তখনও জানে না তার বাবা এসেছে। সে ভেবেছে ইভান হয়তো কোন কাজে বাইরে গেছে। সে এখন বেশী সময় ঘরেই কাটায়। তার জন্য ইভান ঘরেই সবকিছু ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। তবুও বেশী খারাপ লাগলে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে। সারাদিনে একবার ইভানের মায়ের ঘরে গিয়ে দেখা করে আসে। খোঁজ খবর নেয়। ঈশা আশে পাশে তাকাল। এদিক সেদিক দৃষ্টি ফেরাতেই আলমারির উপরে চোখ পড়লো। পুরনো এলবাম দেখেই মুচকি হাসল ঈশা। সেদিকে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু নিচে থেকে কোনভাবে সেদিকে হাত যাবে না। তাই পাশ থেকে চেয়ার টেনে সেটার উপরে উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়াতেই পেছন থেকে কানে এলো নিজের নামটা। পেছন ফিরে তাকাতেই কেঁপে উঠলো পা। নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পড়ে যেতে লাগলো ঈশা।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here