শুষ্ক_পাতার_ভাজে?পর্ব_১

0
3657

সাত বছর থেকে যাকে ভালোবাসলাম আজ সে আমার বোনের সাথে হোটেলের বিছানায় শুয়ে । এ দৃশ্যও যে আমাকে কখনো দেখতে হবে তা আমার কল্পনারো অতীত । কলেজের ছুটি পেয়ে কক্সবাজার দুই বোনে বেড়াতে এসেছি । বিচ থেকে ঘুরে এসে হোটেলে নিজের রুমে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে তৃষার রুমের সামনে আসতেই দরজার এপাশ থেকে রুমের ভিতরের কোন ছেলের ভয়েজ শুনি । দরজা নক না করেই ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যা দেখি তাতে আমার চোখ পুরো ছানাবডা । তৃষা শব্দ পেয়ে চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়েই । তারাহুরো করে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নেয় । আমার পক্ষে এই দৃশ্য আর এক সেকেন্ড দাড়িয়ে দেখা সম্ভব না। এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসি আমি ।
হটাৎ দরজার শব্দ পেয়ে তাকায় তৃষা। তৃনাকে দেখে রায়ান কে ধাক্কা দিয়ে উঠে বসে খুলে রাখা শার্টটা না পড়েই গায়ে জড়িয়ে নেয়। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। রায়ান রেগে উঠে বলে
– শিট , ওমেন । ডোর লক করবে না ? ওকে আমি লক করে আসছি ।
তৃষার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না । রায়ানের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে – রায়ান আপুতো সব দেখে ফেললো । এখন আপুর সামনে দাড়াব কোন মুখে ? আপু যদি এখন সবাইকে বলে দেয় ? উফফ এত্তোবড় ভুল কি করে করলাম আমি ? চিন্তায় দেহের ঘাম গুলো বরফের কনায় জমা হয়ে গেছে। রায়ান একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দরজা লক করে এসে বলে
— কাম অন বেবি । যে ইচ্ছে সে দেখুক আমার কোন যায় আসে না ।
–আপু ..আপু এসেছিলো । দেখে ফেলেছে আমাদের । বুঝতে পারছো তুমি !
–আমি দেখি নি তোমার আপুকে ওকে ? যা দেখার তা দেখেছেই । এবার চিল মুডে আমার কাছে আসোতো সোনা ।
তৃষা রায়ানের ডাকে সাড়া না দেওয়াতে রায়ান রেগে উঠে যায় । শার্ট ফোন ওয়ালেট হাতে নিয়ে একবার তৃষার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তৃষা কি করবে এবার ? ভাবতে ভাবতে কেদেই ফেলে । কি জবাব দিবে এবার জানাজানি হয়ে গেলে ? টেনশনে নিজের মাথার চুল নিজেই ছিড়তে থাকে । এতো ঘৃন্য একটা কাজ করতে যাচ্ছিলো দেখে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেয়।
রায়ান কক্সবাজার ছিলো তাই তৃনাকে রাজি করিয়ে এখানে এসেছে সে । বিচে ঘুরতে যাওয়ার পর আনমনা তৃনা যখন তৃষার একহাত ধরে ঘুরছিলো তখন তৃষা আরেক হাতে ফোনে চ্যাটিং করছিলো রায়ানের সাথে । তৃষা রায়ানকে বলে সেও এসেছে কক্সবাজার স্পেশালি তাকেই সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে । রায়ান এতোবড় সারপ্রাইজে অভিভুত হয় । প্রেয়সিকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে জানায়। হোটেলের নাম শুনে তাড়াতাড়ি ব্যাক করতে বলে কারন পাশের হোটেলেই রায়ান আছে । কিন্তু তৃনাকে নিয়ে গেলে তো রায়ানের সাথে দেখা করতে পারবে না । তাই তৃষা অনেক ভেবে তৃনাকে বলে
–উফফ আপু এতো রোদ…আমার স্কিন পুড়ে যাচ্ছে । আর এখানকার খাবারে আমার পেটে প্রবলেম ও হচ্ছে । আমি আর হাটতে পারবো না । আমি হোটেলে ব্যাক করছি । তুমি বিচে থাকো । তারপর বিকালে সানসেটের সময় বিচে আসবো।
তৃনা তৃষাকে ভালোভাবে আপাদমস্তক দেখে অস্হির হয়ে বলে
–বেশি প্রবলেম হচ্ছে তোর? আচ্ছা চল হোটেলে চলে যাই ।
— না না আপু তুমি থাকো । আমিই বরং যাই । তুমিতো ঘুরাফেরা খুবই কম করো । কখনো নিজেকে প্রকৃতিতে বিলিয়ে দিয়েছো একা ? আজ নিজেকে একবার বিলিয়ে দিয়ে দেখোইনা আপু ।দেখবে সব কষ্ট ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে । তৃনা সন্ধিহান চোখে তাকিয়ে তৃষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে
— আচ্ছা ঠিক আছে। ট্যাবলেট খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে । এমনিতেই কাল রাতে জার্নি করে এসেছিস রেস্ট নেওয়াই হয়নি তেমন । তোর কাছে না থাকলে আমার ব্যাগের সাইট পকেটে দেখবি স্যালাইন আছে গুলে খেয়ে নিবি‌ ।
–আচ্ছা আপু।
রায়ানকে জানিয়ে দেয় সে আসছে ।
সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের দিকে পা বাড়ায় তৃনা । তৃষা হোটেলে এসে রুমের সামনে এসে দাড়াতেই দেখে দুহাত ভাজ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে রায়ান । মুখে প্রসস্ত হাসি ফুটিয়ে এক দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে রায়ানের । রায়ান মাথাটা তুলে মুখটা সামনে নিয়ে ঠোটে চুমু দিতেই লজ্জা পেয়ে যায় তৃষা । নিচের দিকে চোখ গলিয়ে বলে
–আমি এই রুমে আছি জানলে কি করে ?
–রিসিপশনে নেইম আস্ক করতেই বলে দিলো । দেন এখানে এসে মহারানীর জন্য ওয়েট করছি । দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তো পা তো ব্যথা হয়ে গেলো । এবার অন্দরে যাওয়া যাক ।
রুমে এসেই রায়ান বিছানায় আধশোয়া হয়ে শোয়ে পড়ে । তৃষা দরজা লাগাতে গেলে বাধা দেয় রায়ান। কেন জিজ্জাসা করতেই বলে সারপ্রাইজ জানু। তৃষা সারপ্রাইজ কথাটা শুনে বেশি এক্সাইটেড হয়ে পড়ে । পা এগিয়ে রায়ানের পাশে গিয়ে বসে পড়ে । কিছুক্ষনের মধ্যে হোটেল বয় একটা ট্রে নিয়ে আসে । রায়ান রিসিভ করে হোটেল বয়কে বকশিশ মিটিয়ে দেয় । তৃষা ট্রের দিক তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় । ট্রেতে দুটো রেড ওয়াইন বোতল, দুটো গ্লাস , কয়েকটি লাল গোলাপ রয়েছে । তৃষা তার ফ্রেন্ডদের থেকে শুনেছে তারা তাদের বিএফ এর সাথে মাঝে মাঝেই তারা ড্রিংকস করে । এতে নাকি ভালোবাসার সমস্ত ফিলিংস জড়িয়ে থাকে । আর এই ড্রিংস গুলো নাকি অনেক দামি আর অনেক টেস্টি। আজ কি সে এগুলো খাবে? মনে মনে আনন্দিতো হতে থাকে আবার ভয় ও হয় । রায়ান গ্লাস এগিয়ে দিলে তৃষা হাতে তুলে নিয়ে বলে
–এটা খেলে মাতাল হবো না ? কোনো সাইড ইফেক্ট নেইতো ? রায়ান তৃষার মুখের সামনে ঝুকে মুখে হালকা ফু দিয়ে বলে
–মাতাল তো আমি হয়েই আছি সুন্দরী তোমার প্রেমে আরো হলে ক্ষতি কি?আর রইলো সাইড ইফেক্ট..সব দিক থেকেইতো তুমি ইফেক্ট করে আছো আর কি ইফেক্ট হবে বলো ? কোন নেশা হবে না আমাকে বিলিভ করতে পারো ।
তৃষা আরো লজ্জা পেয়ে যায় । নিচের দিকে মুখ করে নেয় । দুজনেই চিয়ারস বলে ড্রিংকস করতে থাকে । প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও তারপর ভালোই খেতে লাগে তৃষার। গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে দুজনেই দুজনাতে ডুব দেওয়ার জন্য আকুল হয়ে যায় । অনেককিছু হয়ে যাবার আগেই তৃনা এসে তাদের এই নিষিদ্ধ অনুভুতির নিঃশেষ ঘটায়।

নিজের রুমে এসে ডোর লক করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তৃনা ।
ধরনী আর কতো আমার সাথে প্রতারনা করবে । ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন আল্লাহ ? যদি এতো কষ্টই থাকে তাহলে কেন দিয়েছিলে এ বুকে ভালোবাসা ? নাকি একতরফা ভালোবাসায় এতো কষ্ট। এ দৃশ্য দেখার আগে আমার মরন হলো না কেন ?
বিছানার চাদর জড়িয়ে কাদতে লাগলো । মনে মনে তৃষাকে ছি ছি করলো । এতো বড় হারাম কাজ কিভাবে করলো সে ? তৃষা তৃনার ফুপির মেয়ে । ফুপা মারা যাওয়ার পর থেকে ফুপি আর তৃষা আমাদের বাসায় থাকে । সে হিসাবে তৃষা আর তৃনা অনেক বছর থেকে একসাথে আছে । যদিও তৃষা তৃনার থেকে চার বছরের ছোট তবুও বন্ধুর মতোই দুজনে। দুজন মায়ের পেটের বোনের থেকেও বেশি । ছোট বোনের মতোই ভালবাসি তৃষাকে । দুজনের অনেককিছুই দুজনে শেয়ার করে। কিন্তু আজ যা দেখলো তাতে তৃনা নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা । এতোদিন যাকে এতোটা যত্ম নিয়ে শিক্ষা দিয়ে ছায়াতলে বড় করলো আজ তার নোংরা চেহারাটা তাকে অবাকের থেকেও বেশি কিছু করে দিয়েছে। তৃষা সুন্দরী স্টাইলিশ আধুনিক মানা যায় । রিলেশনে থাকবে সেটাও মেনে নেওয়া যায় । কিন্তু ও এমন নোংরা কিছু করবে তা ধারনার অতীত । ফুপিকে কি জবাব দিবে সে ? রায়ান চৌধুরীর মতো একজন প্লে বয় কি আদৌ বিয়ে করবে তৃষাকে ? কখনোই না । এ তুই কি করলি তৃষা । নিজেকে এতো সস্তা করে দিলি । আমি কি ভাবে সহ্য করবো এতো কিছু ? আর কতো সহ্য করবো আমি ? চোখের সামনে নিজের বোনের সাথে ভালোবাসার মানুষটিকে কিভাবে দেখবো আমি ? যদিও এটি নতুন নয় । রায়ান …তুমি দুরে ছিলে দুরেই থাকতে.. কাছে এসে কেনো এতো পোড়াও আমায় ? আমার বোনের সাথে রিলেশনে কেনো জড়াতে হলো তোমাকে ?কেন ?
চোখ মুছে উঠে দাড়ালাম । এ আমি হতে দিবো না ।ওদেরকে আটকাতে হবে । নিজের রুম লক করে তৃষার রুমে এসে দেখি দরজা খুলা। ভেতরে গিয়ে দেখি ওভাবেই বসে কাদছে । আমাকে দেখেই লাফ দিয়ে নিচে নেমে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে
–আপু আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ । আমি বুঝিনি এমনটা হবে । আমি আমার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছিলাম । আমি এতোটাও খারাপ নয় আপু তুমিতো জানো সেটা। আমি তোমার বোন আমাকে ক্ষমা করে দাও আপু ।
মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বোন আমার ঠিক আছে । ভাগ্যিস ভয়ংকর কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই চলে এসেছিলাম। কিন্তু ঘৃনা লাগছে আমার সব কিছু । চোখ মুখ শক্ত করে বললাম
–ছেলেটা কে?
তৃনা উঠে দাড়িয়ে বললো
–হি ইজ রায়ান চৌধুরী। মাই বয়ফ্রেন্ড। আমি এবার সিরিয়াস আপু।আই লাভ হিম সো মাচ।
কথাটা শুনেই হাসি পেলো । আজকাল অনেককিছু শুনেই হাসি পায় । কিন্তু হাসলাম না । কারন হাসি পেলেও হাসতে ভুলে গেছি আমি ।
—রায়ান চৌধুরী। কতো বছর থেকে চলছে রিলেশন? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি একটা ধরবে তো একটা ছাড়বে । এর জন্য তোমার সাথে না পেরে ফিজিক্যাল রিলেশন করা যাবে না এই শর্ত দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম তোমাকে । এভাবে সিরিয়াস হবে কারো প্রতি জানতাম না । কতোটুকু চিনো তুমি রায়ান চৌধুরীকে ? যে তার প্রতি এতোটা সিরিয়াস হয়ে গেলে ?
—আপু ও একজন বিজন্যাসম্যান । পাশাপাশি যখন যা ভালো লাগে সেই কাজেই ইনভল্ভ হয় । আমাদের দুই বছর থেকে রিলেশন । কিন্তু অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি আমি তাকে । এখন আমি আর ও দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসি । আপু আমি সত্যিই ভালোবাসি। আমি তোমার মতোই পাগলের মতো ভালোবাসি।
— আমার মতো তুমি হতে পারোনা তৃষা। চেষ্টা করো আমাকে ফলো করার বাট হতে পারোনি । তোমার আর আমার মাঝে অনেক পার্থক্য তার মধ্যে একটা পার্থক্য দেখাচ্ছি । এই মুহুর্তে আমিও যেখানে তুমিও সেখানে । আমার হাত পা মুখ ছাড়া পুরো শরীর ঢাকা আর তোমার গায়ে ..থাক আর না বললাম । একটা পরপুরুষের সামনে শার্ট পর্যন্ত যে খুলে দিতে পারো আজ তা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতামনা কখনো । ভেবেছিলাম তুমি বড় হয়ে গেছো মানুষ চিনতে শিখেছো । কিন্তু না তুমি এখনো মানুষ চিনতে শিখোনি । যে ছেলে জিএফকে নিয়ে বিছানায় যেতে পারে সে অন্তত ভালো হতে পারে না । আল্লাহর অশেষ কৃপা যে আমি চলেএসেছিলাম নয়তো একটা ভুল সারাজীবন তুমাকে কাদাতো । তুমি ঐ ছেলের সাথে ব্রেকাপ করবে আজি ।
–ভুলতো আমারো ছিলো আপু শুধু ওর না । তুমি কি আমার ভালোবাসা মেনে নিতে পারছো না ? আমাকে কি তুমার মতো সারাজীবন কাদতে বলতে চাও ?
–এটা তোমার মোহ তৃষা । ভালোবাসা নয় ।আমার সাথে তুমার তুলনা হয় না কখোনোই ।
–এটা আমার ভালোবাসা আপু । আমি শুধু রায়ান চৌধুরীকে চাই । আমি তোমার মতো কাদতে পারবো না আপু। তুমি আমার বোন হয়ে আমাকে কাদাতে চাইছো আমার কষ্ট চাইছো এটা আজকের দিনটা না আসলে আমি জানতেই পারতাম না ।

পুরো রাত দু বোনের মধ্যে কথা হয়নি । কথা ছিলো আজ রাতে দুজনেই সমু্দ্রের পাড়ে বসে কাটাবে । তারা ভরা আকাশের নিচে আছড়ে পড়া ঢেউয়ে পা ভিজাবে আর চকলেট খাবে । কিন্তু দুজন দুজনের রুমে শুয়ে বালিশ ভেজাচ্ছে । দুজনের মনে দুজন মানুষের ব্যবহার ই ব্যথা দিচ্ছে । তৃনার মনে তৃষার ব্যবহার দাগ কেটেছে আর অনেক বছর পর চেনা মানুষটাকে দেখে পুরোনো ব্যথা ফিরে ফিরে আসছে । তৃষা মেনে নিতে পারছেনা তার আপু তাকে ব্রেকাপ করতে বলছে তাকে কষ্টে দেখতে চায় । আর যাওয়ার পর থেকে রায়ান একটা বারের জন্যেও ফোন ধরেনি । রায়ান কি রাগ করে আছে ? ও কি আর ফিরবে না তার কাছে ? ব্রেকাপ হয়ে যাবে তাদের ? এসব ভেবেই বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে বার বার ।
শুষ্ক_পাতার_ভাজে?পর্ব_১

#লাবিবা_তানহা_লিজা?

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here