শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১১.
#লাবিবা_তানহা_লিজা?
তৃষা বাসায় আসতেই পারুল তৃষার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে “তর নামে পার্সেল এসেছে । ”
তৃষা অবাক হয়ে বলে ” কিন্তু আম্মু আমার তো কোন পার্সেল আসার কথা ছিলো না ।”
” দেখ কিসের পার্সেল ।”
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে তৃষা খামটা খুলে । একটা চিঠি আর আরেকটা খাম বের হয় । চিঠিতে লিনার নামটা দেখে খাম খুলে তৃষা । সামনে বেড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকটা ছবি । তৃষা প্রত্যেকটা ছবি দেখতে থাকে । রায়ান আর লিনার কাপল পিক সব গুলো । মাঝে মাঝে রোমান্স রত ছবিও আছে । লাস্টের ছবি গুলো দেখে তৃষা কান্নায় ভেঙে পড়ে । রায়ান লিনা আর ছোট একটা বাচ্চার ছবি । চিঠির দিকে নজর পড়তেই চিঠি পড়তে থাকে ।
” তৃষা ছবি গুলো দেখে নিশ্চয় তোমার মনে আর কোন সন্দেহ নেই । রায়ান শুধু আমার হাজবেন্ড নয় আমার মেয়ের পাপাও । আমি ভেবেছিলাম তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে । কিন্তু যখন জানতে পারলাম বিয়ের কথা চলছে তখন আর বসে থাকতে পারলাম না । একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের জীবন বাচাতে আমাকে এগিয়ে আসতেই হলো । রায়ানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে কিন্তু আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে রেখেছে । ভাবতে পারো তুমি একটা বাচ্চাকে তার মা থেকে আলাদা রাখলে তার মার কতটা কষ্ট হয় ! রায়ান অনেক গুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে তার জন্য আমার সাথে ডিভোর্স হয়েছে । তুমাকেও ইউজ করছে শুধু । নিচে কয়েকটা নাম্বার দিলাম যোগাযোগ করে দেখতে পারো । ওরা সবাই রায়ানের বেড পার্টনার । ”
চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে ছিড়ে ফেলে তৃষা । আবার বেরিয়ে যায় বাসা থেকে । রায়ানের অফিসে পৌছায় সরাসরি । রায়ানকে না পেয়ে মাসুদের কেবিনে যায় । মাসুদ তৃষাকে দেখে অবাক হয় । সচারাচর তৃষার সাথে তেমন কথা হয় না মাসুদের । তৃষা মাসুদের কাছে গিয়ে বলে ” রায়ান কোথায় ? ”
“রায়ান সিঙ্গাপুর গিয়েছে । তিন দিন থাকবে সেখানে।”
” কিহ! আমাকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না একটুও ? ”
“নেই তো । থাকলে তো করবে । ”
“আর চার পাচ জন মেয়ের মতো কি আমাকেও ভাবে?”
” আর চার পাচ জন কেনো বলছো ? আমি যতদূর জানি তোমার আর রায়ানের মধ্যে রিলেশন শিপ আছে এখনো । ”
” এখনো! না থাকার কথা বুঝি ?”
” তেমনটা বলিনি । ”
“আসছি ”
সেদিন আর তৃষা খাবার খায়নি । রাতে যখন কান্না গুলো জোড়ে জোড়ে দলা পাকিয়ে আসছিলো তখন তৃনার রুমের সামনে এসে দাড়ায় । দু বার নক করতেই দরজা খুলে তৃনা । তৃষা খাটের উপর গিয়ে বসে চুপচাপ। তৃনা তৃষাকে লক্ষ্য করে এসে পাশে বসে জিজ্জাসা করে ” কি হয়েছে তোর ? চোখ মুখ ফোলা ফোলা কেনো ?”
তৃষা ফুপিয়ে ফুপিয়ে হামলে পড়ে তৃনার বুকে । তৃনা কিছু বুঝে উঠতে পারে না । জড়িয়ে ধরে বার বার তৃষাকে চুপ করানোর চেষ্টা করে । তৃষা মুখ তুলে কাদতে কাদতে বলে ” আপু রায়ান আমার সাথে চিট করেছে । ওর অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক । আমাকে মিথ্যা বলেছে আপু । ওর বউ বাচ্চা সব ই আছে । আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম আপু । তোর কথা শুনিনি । আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ । আপু আমিতো সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। তবু কেনো ধোকা খেলাম?”
তৃনা চোখ মুছে বলে ” ধরে নে না এতোদিন এতোজনকে ঠকানোর পুরস্কার এটি । ”
তৃষা লিনার দেওয়া নাম্বার গুলোতে ফোন দিয়ে সবার সাথে কথা বলে । সবার একটিই জবাব রায়ানের সাথে অনেকদিন আগেই ব্রেকাপ হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে মিট করতে ইচ্ছা হলে মিট করে দেটস ইট । লিনার সাথে ডিভোর্স ও হয়ে গেছে । ঘরে বউ থাকলে যাবেই বা কেনো এসব মেয়ের কাছে ? আজ বাচ্চা সেটি তো রায়ানের বাবা মার কাছেই মানুষ । মাথা গুলিয়ে যায় তৃষার ।
রায়ান ফেরার পর রোহান রায়ানকে নিয়ে তৃষাকে দেখতে আসে । তৃষা যেমনটি ছিলো সেমনটিই তাদের সামনে যায় । পারুল কিছু বলতে গেলে রোহানা আটকিয়ে দিয়ে বলে ” থাকনা । যেমনি থাকে তেমনটিই তো চাই । এতো রুপ সাজগোজের আড়ালে ডাকা পড়লে তো দেখতেই পারতাম না । মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর।” তৃষার মুখ থেকে টু শব্দটি বের হয় না। তৃনা থাকলে ঠিক ই ধরে ফেলতো ব্যপারটা কিন্তু সে বাড়িতে নেই । রায়ান এসেছে শুনে বাড়ি ছেড়েছে । রবিন নিচের দিক তাকিয়ে আছে । মনোয়ারের সাথে কথা বলে সবাই চলে গেলে রবিন তৃষার রুমে আসে । দরজায় দাড়িয়েই বলে
” এতো ভালো দিনে এতো চুপ চাপ কেনো তুই ? ”
” এমনি ভাইয়া ”
” ছেলেটা সুন্দর । কিউট আছে । ”
” হুম ।”
চলে আসতে নিয়ে আবার থেমে গিয়ে বলে ” আচ্ছা ছেলেটার চেহারাটায় কেমন ওয়াইন খোর ওয়াইন খোর ভাব আছে না ? ”
” হুম । কিন্তু ও ওয়াইন খায় না এখন । আগে খেতো । আমিই কমিয়ে এনেছি । এমনিতেই ভালো ।”
“ভালো হলেই ভালো। হয়তো সুখিই হবি । ”
” সত্যি??”
অবাক চোখে তাকায় তৃষা । রবিন দুবার মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় ।
রায়ানের বাসায় এসেছে তৃষা রায়ানকে না বলে ।নিচে বসে রোহানার সাথে গল্প জমিয়েছে । রায়ানকে কাজের লোক দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । কাজের লোক রায়ানকে ডেকে আসলে রায়ান রুম থেকে বের হওয়ার সময় রুমু সামনে এসে দাড়ায় । চকলেট খেয়ে মুখে লাগিয়ে রেখেছে একদম । দেখেই রায়ান হেসে ফেলে । রুমু দু হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে উঠার জন্য । রায়ান কোলে না নিয়ে পারে না । রুমু কোলে উঠে বলে –পাপা তোমাল হাসি চুন্দল ।
–আচ্ছা । চল নিচে যাই । দাদু মনি ডাকছে ।
রুমুকে কোলে নিয়ে নিচে এসে তৃষা কে দেখে অবাক হয় । তৃষাও অবাক চোখে রায়ানের কোলে রুমুকে দেখতে থাকে । রায়ান নিচু স্বরে বলে –আগে বলবেনা যে তৃষা এসেছে ! এখন রুমুকে কোলে দেখে কি না রিয়েক্ট করে । তৃষাকে তো কিছুই বলি নি এসবের ।
–আমি কি করে জানবো যে তুই না জানিয়েই এগিয়েছিস !
রুমুকে রায়ানের কোল থেকে নেয় তৃষা । রায়ান অবাক হয় তৃষাকে দেখে । তৃষা রুমুকে কোলে নিয়ে বলে –তোমার বেবি ?
— হুম ।
— সো কিউট । বেবির মম কোথায় ?
— ডিভোর্স হয়ে গেছে ।
— এই টুকুন বাচ্চা মম ছাড়া থাকে !
রায়ান আর কিছু বলে না । রোহানা কিচেনে চলে যায় । তৃষা রুমুর সাথে কথা বলতে থাকে । ঘন্টা খানিক থেকে যাওয়ার সময় বলে ” তোমার মেয়ে টাকে দেখতে আসছিলাম । ভয় পেও না । আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো না যদিও জানি তোমার জন্য মেয়ের অভাব হবে না । আমি শুধু তোমার মেয়েকে মম পাইয়ে দিবো।”
রায়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় তৃষা ।
রায়ান যেনো হাফ ছেড়ে বাচে । তৃষা তাহলে সত্যি মেনে নিয়েছে রুমুকে । রাতের ডিনারের সময় মনোয়ার বলে ” মেয়েরা শপিং শুরু করে দাও । দুই তারিখ আমি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেছি । আমার তৃষা মা যখন তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় তখন দুই তারিখ শুক্রবারের দিন টিই বিবেচনা করে বের করলাম । বড় মেয়েকে তো আর বিয়ে দিতে পারলাম না । ছোট মেয়ের বিয়েতে পুরো এলাকার লোকজন খাওয়াবো আমি । সবাই খুশি হয়ে যায় ।
দুপুরে কড়া রোদে রবিন আর তৃনাকে বসে থাকতে দেখে তৃষা ছাদে ওদের পাশে বসে পড়ে । তৃনার দিকে তাকিয়ে বলে ” আপু আমি জানি তুমি খুশি হও নি । এরকম ছেলের কিছে কেউ ই বোনকে বিয়ে দিতে চায় না । কিন্তু অতীত অতীত ই রয়ে যায় । বর্তমানে যেনো না আসে সেই দিকেই নজর রাখবো আমি । আমি আমার জায়গা থেকে পিছপা হবো না । তুমি দেখো আমি সুখী হবো রায়ানকে নিয়ে । ”
” এই বিয়েতে সকলের ই মত আছে । তাই আমার বলার কিছু নেই । রায়ানকে হয়তো অনেকেই ভালোবাসবে এটা নিয়ে দুজনের মাঝে কখনো অশান্তি বাধিয়ে বসিস না । ”
” থ্যাংকিউ আপু । ”
রবিন বলে , ” তৃনা মেনে নিলেও আমি মানতে পারবো না কোনদিন । ”
” তোকে মানতেও হবে না ভাইয়া । আমি মনে করিনা তুই ফেমেলিতে আছিস । বছরে থাতে গুনা দুই তিনদিন তোকে চোখে দেখতে পাই । কি করেছিস আমার জন্য যে তোর মেনে নেওয়ায় আমার কিছু যায় আসবে । তুই আমার ভালো কখনোই চাস না । ভালো চাইলে রায়ানকে বলতিনা আমাকে বিয়ে না করার জন্য ? ”
” ঐ রায়ানের থেকে ভালো ছেলে আমি তোর জন্য আনতে পারবো । আর আমি না থাকলে আজ তুই থাকতি না । মুখ সামলে কথা বল । বড় তোর সম্মান দিয়ে কথা বল। ”
তৃনা বলে ,” ঝগড়া করিস না ভাইয়া ।”
” ইস….আসছে আমার সম্মান ওয়ালা । কিসের ঝগড়া ! সব সময় তো ওই ঝগড়া করিস আমার সাথে । কিসের সমস্যা তোর আমাকে নিয়ে ? যুথিকার সাথে অসভ্যতামি করে আমার মাথা হেড করে দাও ঐগুলো বিচার দেই মামার কাছে তার জন্য আমার পিছু লেগেছো ? নোংরা মন মাইন্ডের লোক কথাকার । মান ইজ্জতের ভয়ে আমি মুখ খুলতে পারি না জন্য এমন করিস তাই না ? ”
চটে যায় রবিন । এক লাফে দাড়িয়ে বলে
” তোর মান ইজ্জত আছে নাকি ? না আছে তোর মান সম্মান না আছে তোর মায়ের মান সম্মান । থাকলে আমার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারতি না । তোর মা এক লোকের সাথে ভেগে গিয়ে তোকে হাতে করে পোড়া মুখ নিয়ে এই বাড়িতে এসে দাড়িয়েছে। এসেই মিথ্যা বলেছে যে তোর বাবা মারা গেছে আমার বাবার থেকে সিমপ্যাথি আদায় করার জন্য । এতো বছর থেকে এই বাড়িতে থাকছে খাচ্ছে আর সুযোগ পেলে আমাদের নিয়েই কোট কাচালি শুধু করছে । ছোট বেলা থেকে এই আমার জন্যেই তুই টিকে আছিস । রুপ দেখিয়ে স্কুল লাইফ থেকে ছেলেদের মাথা পাগল করে আসছিস । মনে নেই ক্লাস সেভেনে যখন ধর্ষন হতে যাচ্ছিলি এই আমি মাথা ফাটিয়ে বাচিয়েছি তোকে । এরপর একটা জাল কেসে যখন লকাবে গেলি কাউকে না জানতে দিয়ে আমার সেমিস্টারের টাকা দিয়ে বাচিয়েছিলাম তোকে । সেদিন যখন রায়ানের সাথে হোটেলে ছিলি তখন খবরটাও আমি দিয়েছি তৃনাকে তোকে বাচানোর জন্য । নয়তো এতোদিনে রায়ান চৌধুরীর অনান্য সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডের মতো বেডপার্টনার ই হয়ে থাকতি ঘরের বউ হওয়ার আশাও করতে পারতি না । এই আমি যদি যুথিকার সাথে বেড শেয়ার ও করি তাতে তোর কি ? তোর কেনো এতো জলে ? হুহ? তোর কেনো জলবে এতো ?
চেচামেচি শুনে নিচ থেকে সবাই ছাদে চলে এসেছে । মনোয়ার ধমক দিয়ে বলে ” রবিন হচ্ছেটাকি এখানে ? আমার মা কাদছে কেনো ? তৃনা কি হয়েছে রবিন চেচাচ্ছে কেনো ? ” তৃনা একবার তৃষার দিক তাকায় । তৃষা মুখ চেপে কাদছে । রবিনের দিকে তাকাতেই রবিন মাথা নাড়িয়ে না করে । তৃনা বলে , ” এটা আমাদের ভাইবোনের মধ্যে ঝগড়া বাবা । আমরা ঠিক করে নিতে পারবো ।নিচে চলো। ”
পারুলের কাছে বসতেই পারুল জিজ্জাসা করে
“রবিন তোকে কি বলেছে তখন যার জন্য তুই কাদলি ”
তৃষা বলে, ” আমার বাবা কোথায় আম্মু?”
” সাত আসমানে । ”
” আমার বাবা কোথায় আম্মু ? ”
” জানিস ই তো মরে গেছে । ”
” মিথ্যা কেনো বললে ? বাবা থাকতেও আমাকে বাবার থেকে আলাদা কেনো করে রাখলে ?”
” তৃষা । বাজে কথা বলিস না । তোর বাবা নেই । ”
” আমার বাবা আছে আর বেচেও আছে । আমি আজ দেখে এসেছি আমার বাবাকে । ”
” চুপ চুপ । একদম চিল্লিয়ে কথা বলবি না । কে নিয়েগিয়েছিলো তোকে ? ঐ রবিন তাইনা ? ছেলেটা বড্ড বার বেরেছে । ”
” আম্মু…এতো স্বার্থপর কেনো তুমি ? আমার বাবার পা ভেঙেগিয়েছিলো বলে তাকে সরাসরি মৃত বানিয়ে দিলে ! আমাকে নিয়ে এসে ভাইয়ের সংসারে ভাগ বসিয়ে রাজার হালে খাচ্ছো যেখানে তুমি স্ত্রী ধর্ম পালন করবে আমার বাবাকে সেবা করবে সেখানে ফেলে রেখে আসলে ? অথচ দেখো আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী কিন্তু রোজগার করেই আমার বাবাকে খাইয়ে বাচিয়ে রেখেছে। ”
” খবরদার আর যেনো না শুনি আমি যে তুই ঐ বস্তিতে আর গিয়েছিস । আমার কসম খা রবিনের সাথে আর যাবিনা ঐ লোকের কাছে । আমি যা করেছি বেশ করেছি । আজ যদি তোর বাপের পিছু ধরে থাকতাম তাহলে আজ তুই ঐ বস্তিতে ছেড়া কাপড় পড়ে ইট ভেঙে পানতা ভাত খেতি । এতো ভালো পরিবেশে লেখাপড়া শিখে এতোবড়ো হতে পারতি না । তোর মুখ চেয়েই আমি তোর বাবাকে ছেড়েছি । এর জন্য আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই । ”
চলবে?