শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১৫

0
1784

শুষ্ক_পাতার_ভাজে?১৫
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

.

বাসায় ফিরে রুমের দরজা বন্ধ করে ফ্লোরেই বসে পড়ে রায়ান । পকেট থেকে চিঠিটা বের করে এক পলক তাকিয়ে থাকে । টেবিলে গিয়ে ডায়রীটা বের করে হাতের লেখা এক দেখে বুঝতে পারে এতোদিন তার হাতে তৃনলতার ডায়েরীই ছিলো । পাতা উল্টিয়ে আগের পড়া পৃষ্টার পর পৃষ্টাগুলোয় চোখ রাখে ।
ডায়েরীতে —

“তুমিযে ভালোবাসো আমাকে তা আমার অজানা নয় । তুমি আড়ালে আবড়ালে ঠিক ই আমাতে নজর রাখো । তোমার একটু একটু প্রশংসায় তা প্রকাশ্য ।আজকাল সাজতে ইচ্ছা হয় খুব তোমার একটুকু প্রশংসা পাওয়ার লোভে। ”

” বাবা বলল একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে । জিনিসপত্রগুলো হাতে নিয়েই তোমাকে আবিষ্কার করি । দৌড়ে গিয়ে তোমাকে দেখেই আমার কলিজা কেপে উঠে । শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম সারাজীবনের জন্য । তুমি মরে গেলে আমার বেচে থাকার সব টা শেষ হয়ে যাবে । বাবা আম্মুর জন্য ভাইয়া আছে । তোমার ক্রেডিট কার্ডের টাকা দিয়ে আর আমার রক্ত দিয়ে বাচিয়েছিলাম তোমায় । আমার রক্ত তোমার শিরায় শিরায় মিশে গেছে । এবার দেখি ভালোনাবেসে থাকো কোথায় ! ”

” লিনা আপু, মিম আপু, জারা আপু প্রায়ই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে । আমি তোমাকে কিছুই বলিনা ।কারন আমি জানি তুমি ওদের উচিত জবাব দিবে । তারপর তারা আমার উপর হিংস্র হয়ে উঠবে । লিনা আপু মিসবিহেব ও করে । আমার তাতে দুঃখ নেই । কারন দিন শেষে তুমি আমার ই । ”

” আজ এতটা কাছে পাবো তোমায় সপ্নেও ভাবি নি । বুকের ঠিক মাঝখানটায় ছিলে তুমি । এতোটা কঠিন যন্ত্রনার সুখ আমি কখনো পায়নি । ক্ষতস্থানের জালায় আমার পিঠেও নখ বসিয়ে দিয়ে ক্ষত করে দিয়েছো তুমি । এই ক্ষত যেনো কখনো না মিশে । আমার প্রথম ভালোবাসার পরশ অক্ষত যেনো থাকে । তোমার তপ্ত নিঃশ্বাস বুকটাকে জালিয়ে দিয়েছে আমার । হায় ..এই পুড়া বুক আমি কাকে দেখাই !”

” আজ আমি তোমায় দেখিলাম অন্য একজনের সাথে
যেভাবে সপ্নে এসে চুম্বন দিয়ে যাও আমার শুষ্ক ওষ্ঠে।”

” তোমাকে নিয়ে হাটতে চেয়েছিলাম,
জীবনভর মরন ডরে ..
সে বোধয় আর হয়ে উঠবেনা , মনে হচ্ছে বাধা পড়বে
আমার এই শুষ্ক পাতার ভাজে ___”

” অপেক্ষা করবো আজীবন , জানে এই নরাধম
ফিরে আসিবে তুমি এই তটিনীতে । ”

” তোমার চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি। সময় কথা বলে । একবার কাছে এসো । অফুরন্ত ভালোবাসা আদায় করে নিবো একটু ভালোবাসবেন আমায় বলে বলে । ”

” আমি ভুল ছিলাম । ব্যর্থ আমি । তোমার হৃদয়ে এতোটুকু জায়গা করতে পারিনি বলে । আমি ছুয়ে দিতে পারিনি তোমাকে । আমার কান্না কষ্ট রক্ত কোন কিছুই ব্যথিত করতে পারেনি তোমাকে । ”

“স্বজ্ঞানে ফিরে আসার জানতে পারি তিনদিন পেরিয়ে গেছে এই হসপিটালের বেডে । জ্ঞান না ফিরলে একটু হয়তো সুখ পেতাম কারন জানি তুমি হীনা হবোনা কখনোও সুখী ।
তোমাকে নিয়ে লেখার ছিলো অনেক কিছু কিন্তু ভাষা হারিয়েফেলেছি ছন্দ হারিয়ে ফেলেছি যতটুকু ছিল সবটাই চাপা পড়ে থাকুক ডায়েরির শুষ্ক পাতার ভাজে ভাজে ”
বুকের ভেতর কি হচ্ছে একমাত্র সেই বুঝছে । চিঠিটা সহ ডায়েরীটা বুকে জড়িয়ে চোখের দু ফোটা জল ফেলে বলে ” আমি ব্যর্থ তৃনলতা । আমার জন্য ই তুমি আজো একা । নিজের সাথে অন্যকাউকে জড়াতে দাও নি । এতোটা ভালোবাসো আমাকে তুমি । তৃনলতা…আমি তোমার অযোগ্য তৃনলতা । তুমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো । তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয় আমি । আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি তৃনলতা । দিনের পর দিন আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে গেছি । আমি তোমাকে সামনে পেয়েও চিনতে পারিনি । কিন্তু দিন শেষে আমি তোমার ই রয়ে গেছি । তোমাকে পারিনি কিছুতেই ভুলতে। তুমি থাকাকালীন আমি কাউকে চুমু দেই নি । জারা হুটহাট চুমু দিয়ে বসে । ওকে সরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। তার আগেই তুমি দেখে নিয়েছিলে । আমি স্বজ্ঞানে তোমার বুকে মাথা রেখেছিলাম । কারন আমি আমার মমের পরে তুমার বুকে আশ্রয় খুজেছিলাম । তোমার কান্না তোমার কষ্ট তোমার ঠোটের রক্ত আমাকে স্তব্দ করেছিলো তৃনলতা । আমার প্রতিবাদ তোমার চোখে পড়েনি । আই এম সরি তৃনলতা । আই এম সরি । ”

বৃষ্টি রাতেই থেমে গিয়েছে । সকালের মধ্যে তারাহুরা করে বাইরেরটা ডেকোরেট করা হয়ে গিয়েছে । তৃষাকে সাজাতে পার্লারের মেয়েরা এসেছে । রায়ানের দেওয়া হলুদের লেহেংগা টি পড়ছে তৃষা । পড়া শেষে আয়নায় নিজেকে দেখে লাফিয়ে উঠে । গোলাপী শরীরে গোলাপী লেহেংগা সৌন্দর্য হাজার গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে । লেহেংগা উচিয়ে ধরে আনন্দে একবার ঘুরে । তুলিকে বলা ছিলো ভিডিও করতে । ভিডিও টি সহ আরো কয়েকটি সেলফি কুলফি রায়ানকে সেন্ড করে দেয় । গায়ের গহনা গুলো পড়ে নিয়ে ফটোশুট করতে থাকে । তৃনার একটা স্পেশাল ক্লাস নেওয়ার ছিলো বলে কলেজে আসতে হয়েছে । কলেজের গেইটে ডুকতেই দাড়িয়ে পড়ে । কয়েকজন ছাত্র বসে বসে মেয়েদের দেখে দেখে গান গাইছে ।
— আইতেও দেখি , যাইতেও দেখি, দেখি সারাক্ষন
তোমায় না দেখিলে ভাল্লাগেনা
ও ভার্সিটির ছোট বউ , সরি বোন ।
টুনি নামের একটা মেয়েকে দেখে গাইতে থাকে
ঐ টুনির মা তোমার টুনি দুই দিন ভার্সিটি আসে না
টুনিরে না দেখলে আমার মন ভরে ।
টুনি মেয়েটি পেছন থেকে লাথি দেখিয়ে চলে যায় ।
আরেকটা মেয়ে সামনে দিয়ে যেতেই ডাক দেয়
–এই এই এই ময়দা সুন্দরী কাম হেয়ার ।
মেয়েটা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।গুটি গুটি পায়ে ছেলে গুলোর সামনে চলে যায় ।
— ফাস্ট ইয়ার ?
মেয়েটা মাথা নাড়ায় ।
–আরে..ভাই .. আমাদের ভার্সিটির মধ্যে এতো ময়দা সুন্দীর উপদ্রব বেড়েছে আগে কইবিনা ? স্প্রে মাইরা দিতাম।তো আপু কোন ব্রান্ডের ময়দা মেখেছো দেখি ।
গালে হাত দিতেই মেয়েটা সরে দাড়ায় ।ভয়ে ভয়ে বলে
— এটা আমার ন্যাচারাল স্কিন ভাইয়া ।
–আরে মাইয়া কি বলে ? ন্যাচারাল স্কিন নাকি !
–জি ভাইয়া ।
— তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করলাম তাই না ? কই দেখি দেখি ।
আবার গালে হাত দিলে মেয়েটি সরিয়ে দিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে –বার বার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো ?
এবার আর তৃনা সহ্য করতে পারে না । এগিয়ে গিয়ে ছেলেগুলোর সামনে দাড়িয়ে বলে
” কলেজে কি মেয়েরা কি করলো কি না করলো সেটা দেখার জন্য এসেছো ? এসব কি হচ্ছে টা কি? ”
” মেম আমি শুধু দেখছিলাম ছোট বোনের ন্যাচারাল কি না । ”
” ও বলেনি ন্যাচারাল স্কিন ? যারা সেজে গুজে আসে তাদের পিছু তো লাগতে পারো না । যেই দেখেছো সুন্দরী আর ফাস্ট ইয়ার সেই ছলে বলে গালে হাত দিচ্ছো । বিশ্বাস হয়না না ? এটাও কি বিশ্বাস হয় না ?
মুখ থেকে নেক আপ খুলে বলে — ধরো । ধরে দেখো ন্যাচারাল কি না ? নাকি এটাও বলে আর্টিফিসিয়াল বিশ্বাস হচ্ছে না ব্লা ব্লা ?
ছেলেগুলো থতমত খেয়ে যায় তৃনার এমন বিহেব দেখে । এই প্রথম তৃনা নিজের মুখ খুলেছে ভার্সিটি প্রাঙ্গনে । আশেপাশের ছেলে মেয়েরাও তাকিয়ে আছে স্মিগ্ধ মায়াময়ী মুখপানে । সাথে গেইটের বাইরে গাড়ি থেকে আরো দু জোড়া চোখ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে । ছেলেগুলো ভয় পেয়ে তৃনার পায়ে পড়ে যায় । মিনতি করে বলে — মেম মেম এবারের মতো মাফ করে দেন । আর হবে না এমন । এবারের মতো মাফ করে দেন ।
— তোমাদের ব্যান করার ব্যবস্থা করছি আমি ।

গাড়ি থেকে নামতেই রায়ান বলে ,” মাসুদ কোথায় যাস?” ” তোর তৃনলতাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগটা কাজে লাগাতে যাচ্ছি । ”
মাসুদ তৃনার সামনে যেতেই তৃনা বলে , ” আপনি রুমুর আংকেল তাইনা ?”
” আর আপনি তৃনলতা । ”
চমকে উঠে তৃনা । কিছু না বলে জোরে হেটে প্রস্থান করে ।

তৃনাকে ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দেয় তৃষা । হাতে গোলাপি পাড়ের একটা হলুদ শাড়ি দিয়ে বলে, ” আজকে না শুনবোনা আপু । আজকে সাজতেই হবে । আমি সাজিয়ে দিবো তোমাকে । ”
” আমি সাজি না তৃষা। ”
” মানলাম তুমি সাজো না । আমার গায়ে হলুদের দিন তো সাজতেই পারো আপু । তোমাকে আমার পাশে দেখতে চাই । চলেই তো যাবো । এই টুকুনিই তো চাওয়া । ”
তৃনাকে শাড়ি পরিয়ে দেয় তৃষা । চুলগুলো খোলে দেয়।কানের পাশে হলুদ গাধা ফুল আটকে দেয় । মুখে একটু সাঝ । তাতেই যেনো চোখ ফেরানো দায় । তৃষা বোনকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা । গালে চুমু দিয়ে বলে ” আল্লাহ আপু তুমার এতো রুপ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে ?”
তৃনা মুচকি হাসে । তৃষা অনেকগুলো সেলফি তুলে রায়ানকে পাঠিয়ে দেয় । তৃষার পাশে এই সাঝে তৃনাকে দেখে রায়ানের নয়ন জোড়ায় ।
সন্ধ্যায় আনন্দে হৈ হুল্লা করে হলুদ অনুষ্টান হয় ।রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তৃনা বেরিয়ে যায় বাসা থেকে । ভিতরের কষ্ট গুলো চারদেয়ালে আর বন্দি না করে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে চাইছে । ঠান্ডা হাওয়ায় রাস্তার পাশ দিয়ে আনমনে হাটতে থাকে । এলোমেলো চুল গুলো হাওয়ায় আরো এলোমেলো হয়ে গেছে । শাড়ির লম্বা আচল উড়ে যাচ্ছে পার বার । হাটতে হাটতে কখন যে রাস্তার মাঝে এসে পড়ে খেয়াল করেনি । একটুর জন্য গাড়ি চাপা পড়ে না । গাড়ির ড্রাইভার বকতে বকতে চলে যায় । হাটতে হাটতে নদীর পাড়ে চলে আসে ।নদীর তীরে দাড়িয়ে আধো আলোয় ঢেউয়ের খেলা দেখতে থাকে । এই ঢেউগুলো সবাই দেখতে পায় আর বুকের মধ্যে যে ঢেউ চলছে সেটা কে দেখবে ? কে গুনবে এই উত্তাল গুলো ? ঘাসের উপর বসে ভেতরের আর্তনাদ গুলো বের করে দেয় । রাতের পরিবেশ হয়ে উঠে এক নারী অসহায়ের চিৎকারে অশান্ত। আধার কেটে সকালের আলো ফুটে উঠে । কেটে যায় এক নির্ঘুম রাত । বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে উঠে দড়ায় তৃনা । পেছন ঘুরতেই চমকে উঠে । এক পা দু পা পিছিয়ে চলে যেতে চেয়ে পিছু ঘুরতেই হাতে টান পড়ে । হলুদে হলুদ হয়ে যায় শক্ত বাধনে আটকানো হাত টুকু । ঝাঝরা করে দেয় এক মোহনীয় ডাক ” তৃনলতা………”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here