শুষ্ক_পাতার_ভাজে?২১.

0
3003

শুষ্ক_পাতার_ভাজে?২১.
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

লিনার সাথে দেখা করতে এসেছে তৃনা । ক্ষমতাসীন রায়ান চৌধুরীর স্ত্রী হওয়ায় সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ মিলেছে । দারোগার হুকুম পেতেই একজন পুলিশ তৃনাকে নিয়ে যায় লিনার কাছে । আজ তৃনা বোরখা নিকাবে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেনি । বেশভুষায় হয়ে গেছে প্রায় আট বছর আগের ফাস্ট ইয়ারের রায়ান পাগল তৃনলতাটি । গোলাপি রংয়ের থ্রিপিচ হলুদ রংয়ের হিযআপে সাজিয়েছে নিজেকে । লিনা চেয়ারে বসেই ঝিমুচ্ছিলো । তার উপর অনেক চাপ পড়ে দেখেই বুঝা যায় । সম্প্রতি তার উপর আরো অভিযোগ যুক্ত হয়েছে । তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ড্রাগস ব্যবসায় যুক্ত ছিলো এবং ইদানিং শিশু পাচারেও তার নামের দেখা মিলে । স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য নাজেহাল অবস্থা করা হয়েছে । কিন্তু তৃনার এতটুকুও মায়া হয়না । কে জানে এর জন্যই হয়তো রুমুকে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো । এদের সঠিক জায়গা হলো জেলখানা । এরাই সমাজকে দূষিত করে । তৃনা সামনের চেয়ারে বসে আস্তে করে ডাক দেয় ” লিনা আপু …..”। দু একবার ডাকতেই উঠে পড়ে লিনা । সামনে বসা তৃনাকে দেখে চমকে উঠে । এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ” তুমি ? এখানে কি করছো ? তুমি কি পুলিশ তৃনলতা ? ”
তৃনা ভাবলেশহীন ভাবে বলে , ” নাহ আমি পুলিশ না । তবে আমার পরিচয় আছে । প্রথমত, আমি আপনার ভার্সিটির জুনিয়র । দ্বিতীয়ত , আমি এখন একজন প্রফেসর। তৃতীয়ত,আমি মিসেস রায়ান চৌধুরী। চতুর্থত, আমি রুমু চৌধুরীর মম । ”
“হা হা হা হা । সিরিয়াসলি ? আমার জায়গাটা নিতে চাইছো ? ”
” আমি আমার জায়গাটাই নিচ্ছি । ”
” না । ওটা আমার জায়গা । রায়ান আমার হাজবেন্ড আর রুমু আমার মেয়ে । যা পেয়েছো সব ই আমার ।”
” ছিলো । অস্বীকার করবো না । আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি শুধু । তা হলো আপনি আমার জায়গাটা জোর করে নিয়েছিলেন । রায়ান আমাকে ভালোবেসে জেনে জোর করে বিয়ে করেছিলেন । মূলত পক্ষে রায়ান আমার ই ছিলো আছে থাকবে । আর রায়ানের সন্তান আমার সন্তান ই হওয়ার কথা । সেই হিসেবে রুমু রায়ানের সন্তান মানে আমার সন্তান । লিনা নামক কালো ছায়াটা আমি আমার জীবনে আর দেখতে চাই না । জানি আপনি চাইলেও এখান থেকে বের হতে পারবেন না । আর বের হলেও যেনো আমাদের মাঝে আপনাকে না দেখি ।”
” থ্রেট দিচ্ছো তুমি আমাকে ?”
” নাহ কুফাকে উপড়ে ফেলতে চাইছি । ইন্সপেক্টর সাহেব …. উনি কি কিছু স্বীকারোক্তি করেছেন ?”
” না ম্যাম । উনাকে রিমাইন্ডে রাখা হয়েছে।”
” দেখি কিভাবে স্বীকারোক্তি নেন আপনারা আঙুল বাকা করে । ”
ইন্সপেক্টর হালকা হেসে লিনাকে প্রহার করতে থাকে । লিনা অকথ্য ভাষায় তৃনাকে গালি দিতে থাকে আর চিল্লাতে থাকে । তৃনা প্রশান্ত মনে বেড়িয়ে আসে ।

আজ রবিন তৃষার বিয়ে । বিয়ের বর খুশিতে নাচতে নাচতে আসে বিয়ে করতে । সাথে রায়ান রুমু তো আছেই । মামার কোলে চড়ে হৈ হৈ করতে করতে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মামীকে নিয়ে যেতে আসছে ।বিয়েতে রায়ান রুমু চলে গেছে বর পক্ষের দলে আর তৃনা চলে এসেছে কনে পক্ষের দলে । জামাই নামানোর জন্যে গেইটে দাড়িয়ে আছে পারুল শিল্পি আরো অনেকে । আম্মু আর ফুপিকে একসাথে দেখে রবিন বলে ” আম্মু আমি তোমার ছেলে । ”
” তৃষাও আমার মেয়ে । ছোট থেকে কোলে পিঠে করে বড় করেছি ।”
রায়ান বলে , ” হ্যা আম্মু । আপনার দুই জামাইকে বরন করুন । সাথে নানতীকেও । ”
সবাই একযোগে হেসে ওঠে । শিল্পি মিস্টি খাওয়াতে গেলে রবিন আবার আপত্তি জনক মুখ করে বলে ,
” আম্মু আমি তোমার পেটের ছেলে । ”
” তো আমার পেটের ছেলে আপনি আমার কোলের মেয়ের দিকে নজর দিতে গেলেন কেনো ? দেশে কি মেয়ের অভাব ছিলো নাকি ?”
” তোমার জন্য ই তো । তৃনা চলে যাবে এখন তৃষা চলে গেলে তো কান্না কাটি করে ঘর ভাসাবে দুই মেয়েকে হারিয়ে । তাই একটু টেকনিক করে তোমার কোল ভরিয়ে রাখলাম । ”
পারুল চোখ মুছে বলে , ” আর আমার কোল খালি হয়ে গেলো । ”
রায়ান টিপ্পনি কেটে বলে ,” আর কতো কোলে নিবেন ফুপি ? এখন তো আপনার কোলে উঠার দিন । ফুপা তো পুরোপুরি ওয়েল । ”
সবাই হো হো করে হেসে ফেলে । পারুল রায়ানের কান মলে দেয় আচ্ছা মতো । রবিন বলে, ” এইযে শাশুড়ীমা গন ঢুকতে দিন তো আপনাদের মেয়েকে দেখবে এবার আপনাদের জামাই । ”
রায়ান বলে, ” আমার বউ কোথায় ? রুমু গালে হাত দিয়ে বলে ” ওমা .. আমার মম কোথায় ?” ভিড় ঠেলে সবাই হলে ঢুকে যায় । রবিন এগিয়ে যায় তৃষার দিকে । বধু সেজে বসে আছে তৃষা রায়ানের অপেক্ষায় ।দোপাট্টায় বড় করে ঘোমটা টানা মুখের উপর । থুতনি টা বেরিয়ে আছে শুধু । রবিনকে দেখে দাড়িয়ে পড়ে তৃষা । কালো শেরোয়ানিতে ফর্সা গায়ের রং এ জ্বল জ্বল করছে । মুখে বাকা হাসিটাই ঘায়েল করে দিয়েছে তৃষাকে । রবিন থুতনি দেখেই পাগল প্রায় । তৃষার কাছে আসতেই বসিয়ে দেয় সবাই । রুমু দৌড়ে তৃষার কোলে উঠে বসে । পিচ্ছিল শাড়িতে কমফোর্ট না পেয়ে রবিনের কোলে চলে যায় । রবিন একটু হেলে কানের কাছে এসে বলে ” তৃষা….”
তৃষা একটু কেপে উঠে ।
” ঘোমটাটা একটু তুলি ? ”
তৃষা চুপ ।
” একটু । শুধু দেখবো । ”
তৃষা কাচুমাচু করে । কাবিনের আগে ঘোমটা তুলতে না করা আছে ।
” এই তৃষা প্লিজ জানটা আমার । একটি বার শুধু দেখবো । ”
তৃষা চুপ । বিরক্তি লাগে রবিনের । এবার বলে, ” আহা আমার ময়দা সুন্দরী গো …. পাল্লারে গিয়ে আমার টাকায় কত মন আটা ময়দা মাখলি সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম । তোক কে দেখবে রে পেত্মী ?”
রুমু দু হাতে গাল ধরে বলে ” ওমা.. আটা তো ঝুর ঝুর কলে পলে । তাহলে পলছে না কেনো ?দেখি দেখি ” বলেই ঘোমটা তুলে দেয় । ঘুমটা তুলেই চিল্লিয়ে উঠে বলে ” খালামনি তুমি খুব চুন্দল মামী । ” ফিক করে হেসে দেয় তৃষা । রবিন তো আগে থেকেই হা হয়ে ছিলো এবার তো হাসিতে মরে যায় যায় অবস্থা । ফট করে হাত ধরে বলে , ” বউ তুমি এতো সুন্দর কেনো ? চল আমরা বাসর ঘরে চলে যাই । ” তৃষা জোরে হাত ছাড়িয়ে নেয় । এমন কথায় লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলে । আশে পাশে তো হাসির রোল পড়ে গেছে । শালীরা বলছে ” আরেকটু অপেক্ষা করুন ভাইয়া । বাসর ঘরে তো যাবেন ই । ” রুমু বলে, ” মামা বাসর ঘর চুন্দল ফুল । আমিও যাবো । ” রবিন ঠোটে আঙুল দিয়ে বলে , ” তুই চুপ কর মা । আর লজ্জায় ফেলিস না আমায় ।”

তৃনাকে খুজতে খুজতে রায়ান হয়রান । কোথাও নেই । ফোনে বার বার কল দেওয়ার পর ফোন রিসিভ করতেই বলে ” তৃনলতা…..কোথায় তুমি ?”
” ওয়াস রুমে । ”
” ওয়াসরুমে কেনো ?”
” শাড়ি চেঞ্জ করছি । আগের টায় দই পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে । ”
” আসছি আমি । ”
” আরে না । শোনেন । ”
ফোন কেটে গেছে । রায়ান ওয়াশরুমে এসে প্রত্যেকটা ওয়াশরুমে খোজ করে লাস্টের টায় তৃনাকে পায় । দরজা ধাক্কাতেই তৃনা ভিতর থেকে বলে উঠে
” আসছি । এক মিনিট দাড়ান আমি তিন মিনিটে বের হচ্ছি। ”
” কিহহ!! তাড়াতাড়ি বের হও । ”
তৃনা দরজা খুলে বের হয়ে বলে ” কিহ? এতো জরুরী তলবে যে ? শাড়িটাও পরতে দিলেন না ভালো করে । বলেন কি বলবেন ? মেয়ে কার কাছে ?”
রায়ানকে চুপচাপ দেখে আবার বলে , ” কি হলো ?”
আচমকা রায়ান তৃনাকে জড়িয়ে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে ঠোটে ঠোট মিশিয়ে দেয় । তৃনা উম উম করে কাধে হাত ঠেকিয়ে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারে না । শেষে সেও জড়িয়ে ধরে । বেশ কিছুক্ষন পর রায়ান ছেড়ে দিলে তৃনা ঠোট বাকিয়ে কাদো কাদো হয়ে বলে , ” আমার সব লিপিস্টিক খেয়ে নিলো । এখন আমার কি হপ্পে !”
” আর যাই দাও না কেনো এখন লিপিস্টিক দিও না প্লিজ । আমি নিজেকে সামলাতে পারি না বউ । ”
” আচ্ছা । ছাড়েন । কেউ এদিকে এলে দেখে ফেলবে।”
” দেখলে দেখুক । আমার অন্য কারো বউকে ধরিনি আমার বউকেই ধরেছি । তৃনলতা …আমার বউ… অনেক সুন্দর লাগছে। এতো সুন্দর কেনো তুমি ? বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে যাও । ”
” নেভানোর দায়িত্ব টাও আমিই পালন করি । ”
” কচু করো । দুই দিন থেকে তোমাকে না দেখে আমি শেষ প্রায় । কেমন কাটলো আমি ছাড়া এই দুদিন । ”
” ভেবেছিলাম ঘুমোবো । কিন্তু বিয়ে বাড়ি ঘুমোনো যায় নাকি ! । ”
” আমিও ঘুমাতে পারিনি । নরম কোলবালিশ ছাড়া ঘুম আসে না । ”
” উফফ চুপ করুন না । চলুন তো । ”
” ওকে চলো । ”

দুজন থেকে কবুল নিয়ে খুব ভালোভাবেই হৈ চৈ এর মাধ্যমে বিয়ে হয়ে যায় । বাসর ঘরে তৃষাকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায় সবাই । তৃষা পা ঝুলিয়ে বসে বসে পা দুলোচ্ছে । ঘন্টা খানেক পর আসে রবিন । তৃষাকে এভাবে দেখে বলে , ” ঐ তুই এইসব ময়দা এখনো তুলিশনি ? এই গুলো দিয়ে বসে বসে সারারাত রুটি বানাবো আমি ? ”
” রাস্তাঘাটে মেয়েদের কাছে গিয়ে মেখে মেখে ডো তৈরী করো রুটিটা না হয় আমার কাছেই করলে। ”
” সব বানানো কথা তৃষা। তোর জেলাসটা দেখার জন্য করেছিলাম এমনটি । ”
” জানি । ”
” ভালো । এখন ঘুমা । ”
” ঘুমা মানে। আজ রাতে ঘুমায় নাকি কেউ ?”
” তো কি করে?”
” ভালোবাসে । ”
” যা ভালোবাস গিয়ে । তোর তো ডজন ডজন ভালোবাসা দেশে পড়ে আছে । ”
” টপ লেভেলে তো তুমিই আছো । বাকি গুলো ভুলে গেছি। ওগুলো বাই বাই টা টা । ”
রবিন তৃষার কাছে এসে মুচকি হেসে বলে , ” আমাকে যাতে না ভুলিস সেই ব্যবস্থাই করবো। ”
তৃষা রবিনের চোখে রেখে বলে, ” সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি রবিন । একটু ভালোবাসবে আমায়?”
” অনেক ভালোবাসবো । অনেক। ”

রুমুকে ঘুম পাড়িয়ে শুয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলছে তৃনা । রায়ান এসে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলে , ” ঘুমাও নি এখনো ? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে ?”
” হুম”
তৃনার ভাঙা গলা শুনে নিজের দিকে ফেরায় তৃনাকে। চোখ মুছে দিয়ে বলে ” তৃনলতা…… বউটা আমার কাদছো কেনো তুমি ? কি হয়েছে বলো আমাকে ।”
” কাদছিনা তো । আজ আমি খুব খুশি । ভাইয়া তৃষার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো । ”
” হুম । এর জন্য কেউ কাদে নাকি ?”
” রায়ান আই লাভ ইউ সো মাচ । ”
” হুম । আই নিড ইউ তৃনলতা। ”
” আই লাভ ইউ রায়ান । ”
” আই নিড ইউ ।”
“আই লাভ ইউ । ”
” জানিতো । ”
” রায়ান আমি ভালোবাসি তোমাকে । ”
রায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে চিৎকার করে কাদতে থাকে তৃনা । রায়ান থিতু হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে । রাত পেরিয়ে মধ্যরাত চলে আসে । তৃনা বারান্দায় ফ্লোরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে । পায়ের আওয়াজে তাকায় তৃনা । রায়ান তৃনার সামনে বসে তৃনার হাত দুটো নিজের হাতে নেয় । চুমু দিয়ে তৃনার চোখে চোখ রাখে বলে,
” আই লাভ ইউ তৃনলতা … একটু ভালবাসবে আমায় ?”
ভেতরের কষ্টের সমুদ্রে সুখের ঝড় উঠে তৃনার । ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠে । রায়ান শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে তৃনাকে । কানে চুমু দিয়ে বলে , ” তৃনলতা ……..বউ আমার … ভালোবাসি । অনেক ভালোবাসি । ঠান্ডা হয়ে গেছে হাত পা । চলো রুমে চলো । ”
তৃনা আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরে ।
” তৃনলতা …. আমি এতোদিন ভালোবাসাহীন জীবন কাটিয়ে ছিলাম । এবার সময় এসেছে তোমার আমার ভালোবাসায় ভালোবাসার ঘর বাধার । ”
তৃনা মাথা তুলে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে ” আর ভালোবাসার ঘরে যে আরেকটা ভালোবাসা আসতে চলেছে সেই খেয়াল কি আছে আপনার ? ”
কপাল কুচকে তাকায় রায়ান । তৃনার মুখের দুষ্টু দুষ্টু হাসি বাজেয়াপ্ত করে ঠোট মেলে হেসে বলে ,
” রিয়েলি ? কখন জানতে পারলে ?”
” আজ সকালে । কিটে দুইটি দাগ উঠেছে । ”
” হায় হায় বলে কি ? আর আমি কিনা বারান্দায় বসিয়ে আমার বউয়ের ঠান্ডা লাগাচ্ছি !”
” এখনি শুরু হয়ে গেলো না ?”
” এই শুরু শেষ হবার নয় । লেটস গো মেডাম ।”
শুষ্ক পাতার ভাজে আটকে থাকা ভালোবাসা প্রান পাওয়ার রাত আজ ।

{সমাপ্ত}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here