শুষ্ক_পাতার_ভাজে?৫

0
1939

শুষ্ক_পাতার_ভাজে?৫
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

— রাত বারোটার সময় বাসায় ফেরা হয় আমার অকর্মা ছেলের ।
বাবার কথা শুনে দাড়িয়ে পড়ে রবিন । এগিয়ে এসে বাবার পাশে বসে নিচু স্বরে বলে
–আমি জব করি বাবা । ঘুমোও নি যে এখনো ?
–তোমার জন্যেই অপেক্ষায় ছিলাম । আজকাল তো দেহটা বিছানায় দেওয়ার জন্য বাসায় আসো তুমি ।
–আহ বাবা। বকা ঝকা না করে আসল কথা টা বলো।
–আসল কথা হলো যে তৃনাটার জন্য আমার তৃষাটা তো ঘরে বসে থাকতে পারে না । দুটো মেয়ে বিয়ে দিতে পারছি না । তৃনাকে বুঝানোর দায়িত্বটা তোমাকে দিয়েছিলাম কিছুই করে উঠতে পারো নি । ওর বিয়েতে কি সমস্যা খোলসা করে বলেও না কখনো । শুধু এককথাই আমার জীবন এভাবেই কাটবে । তৃষাটাকে এবার বিয়ে দিতে চাই । হাতে অনেক ছেলে আছে । সুন্দরী মেয়ে বড় ঘরেই বিয়ে দিতে পারবো । এবার তোমার দায়িত্ব হলো শেষ বারের জন্য আবার বোনকে বোঝাও । মেয়ের বাবার যে কি চিন্তা তা তুমি কি করে বুঝবে? আমার বড় ছেলে তুমি । বাওয়ারী হয়ে ঘুরা ফেরা করছো ঘরে মন নেই । বিয়ে শাদীর ধারে কাছে নেই । এভাবে আর কতো দিন? সন্যাস ব্রতী পালন করতে চাও নাকি ?
–বাবা ঐ টা ফকির হবে । মুসলিমদের সন্যাসী বলে না।
–চুপ করো । সিরিয়াস কথার মধ্যে মসকরা করো আমার সাথে ।
–আচ্ছা বাবা আমি কথা বলবো তৃনার সাথে । তুমি ঘুমোতে যাও । আসছি ।
____________
এতো রাতে তৃষার ঘরে আলো জলা দেখে দরজায় টোকা দেয় রবিন । তৃষা দরজা খুলে হাসি দিয়ে বলে –মহারাজের তাহলে আসার সময় হলো তাইতো ? ভেতরে আসো ।
রবির রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে –আজকাল তুই বেশি বেয়াড়া হয়ে গেছিস তৃষা । এখনো ঘুমোস নি । এক বোন তো চিরকুমারী হওয়ার ব্রত পালন করছে আর এদিকে তুই টেস্ট করে করে ঘুরছিস ।
–টেস্ট কি গো ভাইয়া ? আমি আবার টেস্ট কোথায় করলাম ? আমার একটা বয়ফ্রেন্ড ও টিকে না । এখানে আমার কি করার আছে ? এখন বিয়েই করে নিবো । রায়ান চৌধুরীকে । পাগলা দিওয়ানা আমি তার প্রেমে ।
–সে তো প্রত্যেক বার ই হস । এ আর নতুন কি ?
–তোমার কথা বলো । কেমন চলছে জুথিকা ভাবীর সাথে ?
–ভালোই । তবে মেয়েটা অবুঝ । কোথায় কি করে আল্লাহ ই জানে। প্রস্তাব পাঠাতে হবে ওর গার্ডিয়ানের কাছে ।
–আজ দেখা হয়েছে ?
–হা । হলো । টেবিলে ঐটা কি ? ডায়েরি লিখছিলি তুই ? কয়টা জমিয়েছিস দেখি ?
–ভাইয়া হাত দিবে না । আমি নিজেই দ্বিতীয় বার আমার ডায়েরী ছুই নি একটাও ।
–ওরে বাবা । অনেক গুলো দেখছি । প্রত্যেকটাতে একেকটা এক্স কে নিয়ে লেখা তাই না ?
–তোমাকে বলবো কেনো ?
–বলতে হবে না জানি আমি ।
–হুহহ। আসছে সব জান্তা ।
–শোন আমি কাল অফিস থেকে বাইরে যাচ্ছি । দু দিন পর আসবো । তৃনার সাথে এবার একটা বোঝাপড়া করতে হবে । আমার সাথে থাকবি তুই । যা বোঝানোর দুজনকে এক সাথে বোঝাতে হবে । এবার একটা হিতের বিপরীত করতেই হবে আমাদের । হয় জয় নয়তো ক্ষয় । আসছি। দরজা লাগিয়ে ঘুমোবি এখন ।
–আচ্ছা।

হসপিটালের ইর্মাঞ্জেন্সিতে একটা বাচ্চা মেয়েকে ভর্তি করে তৃনা । মেয়েটা মারাত্বক আঘাত পেয়েছে। তৃনা কাপা হাতে মোনজাত ধরে শুধু বলছে আল্লাহ তুমি মেয়েটাকে বাচিয়ে দাও । ঐ টুকু নিষ্পাপ মেয়ে কতটা কষ্ট পাচ্ছে । না জানি ওর বাবা মার কি অবস্থা মেয়েটাকে না পেয়ে । রাস্তার পাশে দাড়িয়ে ছিলো তৃনা রিকশার অপেক্ষায় । রিকশা না পেয়ে সামনের দিকে হাটতে থাকে । কোথা থেকে জানি একটা বাচ্চা রাস্তার মাঝে এসে পড়ে । এক বেয়াড়া বাইক রাস্তা দিয়ে চলে যেতেই চিৎকার করে উঠে বাচ্চা মেয়েটা । তৃনা চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে । ছুটে যায় মেয়েটার কাছে । লোকজন ধাওয়া করেও বাইক টাকে আটকাতে পারে নি । চারিদিকে ভিড় জমে যায় । কার মেয়ে কার মেয়ে বলে হৈ হুল্লাড় বেধে যায় । অথচ রক্তাক্ত বাচ্চাটাকে কেউ ধরছেও না বাচানোর ট্রাই ও করছে না । তৃনা এসব সহ্য না করতে পেরে সি এন জি ডেকে এনে বাচ্চাটাকে তুলে হসপিটালের উদ্দ্যেশে রওনা দেয় । ভিড়ের লোকগুলো যদিও বার বার বাধা দিচ্ছিলো এক্সিডেন্ট হয়েছে পুলিশ কেস হবে বলে কিন্তু তোয়াক্কা না করে তৃনা জোর করেই চলে এসেছে । এদের কথা শুনে বসে থাকলে একটা জীবন শেষ হয়ে যাবে ।
বাচ্চা টিকে ডক্টর দেখতে এসেই ডাক পাঠায় তৃনাকে । তৃনা যেতেই ডক্টর বলে –এই বাচ্চাকে কোথায় পেয়েছেন আপনি ? এতো আমার ফ্রেন্ডের মেয়ে ।
–রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছিলো । আমি হসপিটালে নিয়ে এসছি । এমনিতে আমি চিনি না এই বাচ্চাকে ।
–ওকে আপনি থাকুন । আমি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় খবর দিয়ে দিচ্ছি ।
এতোক্ষনে অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয়ে গেছে বাচ্চাটিকে । তৃনা হসপিটালেই থেকে গেছে। কিছুক্ষন পর দুজন বয়স্ক লোক আসে । দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতোটা অস্থির তারা কান্না কান্না মুখ । নার্স কে দেখে বলে
–আমি রোহান চৌধুরী রুমু দাদু ভাই । আমার দুলি কোথায় ?
–ওহ আপনিই তাহলে বাচ্চাটির গার্ডিয়ান ! বাচ্চাটি অপারেশন থিয়েটারে আছেন । আপনারা ওখানে বসুন । আর উনিই বাচ্চাটিকে হসপিটালে নিয়ে এসেছেন । (তৃনাকে দেখিয়ে )।
রোহান রোহানা তৃনার কাছে গিয়ে অসংখ্য বার ধন্য বাদ দিতে থাকে । তাদের কলিজার টুকরা নাতনী কে বাচানোর জন্য । এতো এতো বার বলছে যে তৃনার অসস্তি হচ্ছে । কথা ঘুরানোর জন্য জিজ্ঞাসা করে –আচ্ছা রুমু রাস্তায় এলো কিভাবে ? আপনারা কেউ দেখেন নি ?
রোহানা বলে — আর বলো না মা …নাতনী আমার শান্ত খুব কিন্তু দুষ্টুও ভারী । ওর সাথে কয়েক দিন না থাকলে বুঝতে পারবে না ।আমাদের কাউকে না বলে দারোয়ানকে গিয়ে টাকা দিয়েছে রাস্তার ওপাশ থেকে বেলুন এনে দেওয়ার জন্য ।দারোয়ান তো ওকে বসিয়ে দিয়ে বেলুন আনতে গেছে । দারোয়ানকে দেখে ওও রাস্তা খালি পেয়েছে তাই দৌড় দিয়েছে । এক্সিডেন্ট হলে দোরোয়ান ওর কাছে না গিয়ে সরাসরি বাসায় এসে আমাদের জানিয়েছে । আমরা গিয়ে শুনি কে নাকি হসপিটালে নিয়ে চলে গেছে । কোন হসপিটাল কিছুই বলেনি । তারপর ডক্টর শুভ ফোন করে জানালো তো আসলাম ।
ঘন্টা দুয়েক পর ডক্টর বলে রুমুর অপারেশন সাক্সেস ফুল । বেডে দেওয়া হয়েছে । অল্পের জন্য মেয়েটা বেচে গেছে । রোহান রোহানা কেবিনের দিকে যেতে থাকে । পিছু পিছু তৃনাও যায় । গ্লাসের দরজা দিয়েই দেখে হাত পা মাথায় বেন্ডেজ করা ছোট একটা পুতুল শুয়ে আছে । কতই আর বয়স হবে ? তিন – চার বছর হবে । এই ছোট্ট বয়সে কতোইনা কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে মেয়ে টাকে । বুকের ভেতর ব্যথা অনুভব হয় তৃনার । দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে । রোহান -রোহানা চৌধুরীও মুখ চেপে কাদছে । তৃনা উনাদের দিয়ে চেয়ারে বসায় । নানা রকম শান্তনা দিতে থাকে । কিন্তু তাদের একমাত্র নাতির জন্য বুকের ব্যথা কমাতে পারেনি । রোহানা বলতে থাকে ” জানো মা আমার নাতনী টা হতভাগী ভিষন । জন্মের নয় মাস পর ওর মা ওকে আর আমার ছেলেটাকে ছেড়ে চলে যায় । ছেলেও আমার মেয়ের দিকে কয়েকদিন পর নজর দেওয়া বন্ধ করে দেয় ওর মার উপর রাগে দুঃখে বেয়াড়া হয়ে যায় । মেয়ের সাথে হটাৎ হটাৎ কথা বলে । রুমুটা পাপা মাম্মা করে শুধু । পাপা তো আসেই না ওর কাছে । এখন ওর চার বছর । আমি এই বুকে করে বড় করছি ওকে মায়ের মতো করে । কিন্তু মায়ের অভাব কি অন্য কেউ মেটাতে পারে ? পারে না । মার অভাব মা ই মেটাতে পারে । তার জন্য ছেলেটাকে বার বার বললাম বিয়ে করে ওর একটা মা এনে দিতে কিন্তু আনলো না । আজ এই ভাবে আমার কলিজার টুকরাকে দেখতে পারছি না আর আমি ।
রোহান বলে –আহহহ রোহানা চুপ করো । এটা হসপিটাল । আমার রুমুর কিচ্ছু হবে না । তাড়াতাড়ি ঠিক হবে আ্ল্লাহ কে ডাকো ।
তৃনাও শান্তনা দিতে থাকে রোহানাকে জড়িয়ে ধরে –আন্টি আপনি আর কাদবেন না । আল্লাহ সহায় আছেন । রুমু বেচে আছে এতেই বা কম কি ! ঠিক মতো ট্রিটমেন্ট হলে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে ।
–ও আগের মতো চলাফেরা করতে পারবে তো ?হাটতে পারবে ? বসতে পারবে ?
–পারবে আন্টি পারবে । সব ঠিক হয়ে যাবে । আপনি কাদবেন না । পরে আবার আপনি অসুস্থ হয়ে গেলে রুমুর খেয়াল রাখবে কে ! আপনিই তো ওর মা দাদুমনি দুটোই ।
তখনি হসপিটালে দেখা মিলে রায়ান আর মাসুদের । এলোমেলো চুল, আতঙ্কে গভীর চাহনি , ডুলু ডুলু শরীর, লাল গেঞ্জি আর তথা কথিত হাটুতে ছেড়া ফুল প্যান্টে দৌড়েই এগোচ্ছে সে। রায়ানকে বার বার ফোন দিয়েও ফোনে পায়না রোহান । তার পর মাসুদ কে ফোন দিয়ে জানায় । মাসুদ সরাসরি রোহানের ফ্ল্যাটে গিয়ে তার হাতে থাকা এক্সটা চাবি দিয়ে ডোর খুলে ভিতরে ডুকে । বেডরুমে এসে দেখে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ভুস ভুস করে ঘুমুচ্ছে । মাসুদ গিয়ে লাথি দেয় জোরে একটা । রায়ান লাফ দিয়ে উঠে মাসুদকে দেখে বিরক্তি নিয়ে বলে –ডিস্টাব করবিনা । একটু আগে ঘুমিয়েছি । সারা রাত মনির সাথে ছিলাম । শান্তিতে ঘুমোতে দে এবার । ডাকবিনা আমাকে ।
রায়ান শুয়ে পড়তেই মাসুদ চিৎকার করে উঠে –আজ মনি তো কাল সাহা তো পরশু ছোয়া এইভাবেই দিন কাটা তুই । আর তো কিছু নেই তোর জীবনে ।কোন থার্ড ক্লাস লেডি তোকে ছেকা ছিলো সেইটাই তোর কাছে মুখ্য আর এদিকে যে নিজের একটা সন্তান আছে তার কথা ভেবেছিস কখনো তুই ? নাকি তোর মনেই নেই যে তুইও একজন বাবা । সত্যি বলতে তুই কুলাঙ্গার বাবা ।
–মাসুদ… মুখ সামলে কথা বল ।
–আর কি মুখ সামলে কথা বলবো বলতে পারিস ? আজকে রুমুর একটা কিছু হয়ে যাক আমি তোর মুখ অব্দি দেখবো না কখনো ।
মাসুদ রাগে গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ায় । রায়ান জ্ঞানে আসে ।
–কি কি রুমুর কি হয়েছে?
–মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছে । হসপিটালে এখন ।আংকেল ফোন দিয়েছিলো আমাকে ।
কিছুক্ষনের জন্য রায়ান থ খেয়ে যায় । মাসুদ ধাক্কা দিয়ে বলে
–শালা তুই উঠবি নাকি ? চলে গেলাম আমি ।
হাতের কাছে গেঞ্জি পেয়ে পরতে পরতে বেরিয়ে আসে ফ্ল্যাট থেকে । এক দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে । মাসুদ ফ্ল্যাট লক করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে ড্রাইভিং সিট থেকে রায়ানকে উঠিয়ে দিয়ে বলে –তুই ড্রাইভ করতে পারবি না। আমি করছি ।
সারা রাস্তা এই এসি গাড়িতেও কপাল গাল ঘেমে উঠেছিল রায়ানের । চোখ বন্ধ করে দাতে দাত লাগিয়ে ছিলো । কানে শুধু রুমুর পাপা ডাকটা বার বার ফিরে ফিরে আসছিলো । চোখের সামনে মেয়ের মুখটা ভেসে উঠছিলো বার বার । একমাসের বেশি হবে মেয়েটাকে দেখেছিলো সে । সে কি আর মেয়েকে দেখতে পারবে না এটা ভেবেই মাথা ভারী হয়ে আসছিল ।

রায়ান এসেই চিল্লাতে থাকে শুভ শুভ বলে । শুভ গলা শুনেই দৌড়ে আসে । শুভ কে দেখে বলে –শুভ আমার মেয়ে আমার মেয়ে কোথায় ? মম পাপা রুমু কোথায় ?
শুভ রায়ান কে নিয়ে রুমুর কেবিনের সামনে যায় । রায়ান কেবিনে ঢুকতে গেলে শুভ বলে –দোস্ত এখানেই থাক । তোর ভিতরে না যাওয়াই বেটার ।
–রাখ তুই তোর বেটার ।
ভিতরে গিয়ে রুমুকে ব্যান্ডেজে আবৃত দেখে রায়ান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে । শুভ কাধে হাত রেখে শান্তনা দিচ্ছে রায়ান কে । মাসুদ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাতে দাত চেপে এই দৃশ্য সহ্য করে যাচ্ছে । যে রায়ানের চোখে কোনদিন জল দেখেনি আজ তার গলা ফাটানো কান্না শুনছে । পুরুষ মানুষ কখনো কাদে না । কিন্তু একজন বাবা ঠিক ই কাদে তার সন্তানের জন্য ।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here