শুষ্ক_পাতার_ভাজে?৬
#লাবিবা_তানহা_লিজা?
.
এতোক্ষন সবটা চুপচাপ দেখছিলো তৃনা । ভেতর থেকে একজন বাবার আর্তনাদ ভেসে আসছে কানে। কি নাম দেবে এই বাবাকে ? অসহায় বাবা । যে বাবার কোন দিন মেয়েকে ঠিক ভাবে ভালোবাসাই দিতে পারে নি অথচ তার বুকে অজস্র ভালোবাসা বিদ্যমান। তার জীবনেই তো ভালোবাসা নেই । কে বললো নেই !আছে তো । রুমু। তবু কেনো ভালোবাসে না ? বাচ্চাটার মুখটা রক্তে লেগে ছিলো । তাই ভালোভাবে দেখতেই পেলো না । রায়ানের মেয়ে নিশ্চয় অনেক কিউট হবে । তৃনার ঠোটের কোনে মৃদু হাসি দেখা মেলে । রায়ান চৌধুরীর মেয়েকে বাচিয়েছে সে । নয়তো আজ সেখানেই মরে যেতো সে । এভাবে তো একদিন রায়ান চৌধুরীকেও বাচিয়ে ছিলো সে ।
সময় টা ছিলো শীত কাল । ঘন চাদরে মোড়ানো চারিদিক । তৃনারা তখন ফরিদপুর দাদুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো । দাদুর বাসার সাইডেই হসপিটাল। হটাৎ চিৎকার চেচামেচি শুনা যায় । এইটা হসপিটালে হতেই থাকে তাই কেউ কানে নেয় না । মনোয়ার কিছুক্ষন পর এসে বলে –শিল্পী বড় সড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে । বড় রাস্তার মাথায় একটা বাইক উড়িয়ে দিয়েছে বাসে । বাইকে একটা ছেলে মরন দশা । ছেলেটার ব্যাগ কাগজ পাতি এই যে রেখে দাও । কারো কাছে দেওয়ার ভরসা পাচ্ছিলাম না । আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি । ডক্টর কে বলা আছে ছেলেটার পরিবারের এলে এই গুলো নিয়ে যাবে । রাখো এগুলো ।
শিল্পি রান্নাঘরে আটা গুলছিলো পিঠা বানানোর জন্য । তাই তৃনাকে ব্যাগ পত্র নিয়ে রাখতে বলে । তৃনা বাবার কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে আমানত যত্ম করে রাখতে রুমে নিয়ে আসে । আলমারি খুলে রাখতে গেলে দেখে ব্যাগের পকেটে আই ফোন । তখন আই ফোন তৃনার ড্রীম ছিলো কিন্তু একটা স্যামসাং ফোন থাকা সত্বে আবার ফোন কিনে দিচ্ছিলো না মনোয়ার । খুশিতে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকে । লক বাটনে ক্লিক দিতেই লক স্কিনে রায়ানের ছবিটা ভেসে ওঠে । হাসি মুখ থেকে উড়ে যায় । মনের ভিতর চিন্তা আর অস্থিরতা ভর করে । ফোন রেখে ওয়ালেট বের করে দেখে রায়ানের ছবি । ব্যাগ খুলে জিনিস পত্র দেখেই বুঝে যায় এগুলো রায়ানের। দু হাতে মাথার চুল খামচে ধরে । রায়ান রায়ান বলে দরজা খুলে দৌড় দেয় হসপিটালের দিকে । রিসিপসনে বলতেই ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখে রায়ান রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে । চোখ নিভু নিভু মানে এখনো জ্ঞান আছে । এই অবস্থায় রায়ানকে দেখে তৃনা জোরে জোরে কাদতে থাকে । নার্সরা বলে আপনি কি উনার কিছু হন ? উনাকে ইমার্জেন্সি ট্রিটমেন্ট দিতে হবে । আপনি রিসিপশনে যোগাযোগ করে টাকা জমা করে দেন ।
তৃনা নার্সকে ট্রিটমেন্ট শুরু করতে বলে দৌড়ে বাসায় চলে আসে । কিন্তু টাকা পাবে কোথায় ? মনোয়ার থাকলে চেয়ে নেওয়া যেতো কিন্তু এখন কার কাছে চাইবে ? চিন্তায় মাথা ঘুরতে থাকে । রায়ানের ওয়ালেটে হাত দিয়ে কয়েকটা পাচশ টাকার নোট পায় । কিন্তু এতে তো হবে না । তার পর কার্ড চোখে পড়ে । তৃনা কার্ড নিয়ে আবার দৌড় দেয় । দরজায় শব্দ হতেই রান্নাঘর থেকে শিল্পি বলে উঠে
–কোথায় যাচ্ছিস ?
–আম্মু এখানেই । টেনশন করো না পিঠা বানাও ।
শিল্পি কাজে মন দেয় । এমনিতেই কাজিনদের কাছে আড্ডা দিতে গেছে মনে করে ।
তৃনা হসপিটালে এসে বিল পে করে । ডক্টর এসে জানায় রক্তের প্রয়োজন নয়তো অপারেশন করা সম্ভব না । তৃনা এবার রক্ত কোথায় পাবে ? কাকে বলবে ? বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে এ নিগেটিভ ব্লাড কার আছে । দুই একজন পাওয়া গেলেও ওরা এক দু মাস আগে ডোনেট করেছে । চিন্তায় মাথা চেপে ফ্লোরে বসেই কাদতে থাকে । নার্স রা এসে বলতে থাকে –দেখুন কারো না কারো কাছে তো পাওয়া যাবে । আপনার পরিবারের , বন্ধুর কারো তো আছে । তৃনা তখন বলে –আমি তো নিজেই নিজের টা জানি না অন্যদের টা কিভাবে জানবো ? একথা শুনে নার্স তৃনা ব্লাড পরিক্ষা করে দেখে সেইম ব্লাড গ্রুপ। তারপর আর সময় নষ্ট না করে একে একে দুই ব্যাগ ব্লাড দিয়েছিলো তৃনা । তার পর অবশ্য বাসায় অনেক জবাবদিহি করতে হয়েছে । অনেক অসুস্থ ও হয়ে পড়েছিলো । পরের দিন ই রায়ানের গার্ডিয়ান রায়ানকে নিয়ে ঢাকায় ব্যাক করেছিলো । দারোয়ানকে দিয়ে সব কিছু পাঠিয়ে দিয়েছিলো রায়ানের গার্ডিয়ানের কাছে ।
বুকের মধ্যে এক অন্যরকম শান্তির হাওয়া বয়ে যায় । চোখ বন্ধ করে বলে “শুকরিয়া । আল্লাহ আমি তোমার কাছে এতোই প্রিয় যে আমার হাতে দু দুটো প্রান বাচানোর সুযোগ দিলে । তোমার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া । ” ব্যাগ হাতে উঠতে যেতে নিয়ে আবার বসে পড়ে । কেনো জানি যেতে ইচ্ছে করছে না । এই মানুষ গুলোর পাশে থাকতে ইচ্ছা করছে । পরক্ষনেই তৃষার কথা মনে পড়ে যায় । তৃষা যে পাগল প্রায় রায়ানের প্রেমে । তাকে কি করে এই ঘোর থেকে বের করবে ? রায়ানের মেয়ে আছে এটি জানলে কি হতে পারে ভেবেই বুক কেপে উঠে । কিন্তু তৃষার জানা উচিত ।সে যে অনেক সিরিয়াস হয়ে পড়েছে রায়ান কে নিয়ে । যদি আমি বলি তাহলে তো কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে । অনেক প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে যা আমি কখনোই পারবোনা । এসব ভাবতে ভাবতেই কান্নার আওয়াজে বলতে শুনে
–আমার রুমু কোথায় আমার রুমু ? আমার রুমু ঠিক আছে তো ? রুমুর কাছে যাবো আমি ।
রোহান রোহানাকে এড়িয়ে দৌড়ে ভিতরে যেতে নিলে রোহানা আটকে দেয় । ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে –এই মেয়ে কেনো এসেছো তুমি ? বের হও এখান থেকে ।
–আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দিন । ওর কিভাবে কি হলো ? কেমন আছে ও ?
–কিসের মেয়ে ? কার মেয়ে ? তুমার কোনো মেয়ে নেই এখানে । রুমু শুধু আমার রায়ানের মেয়ে । বের হয়ে যাও তুমি এখান থেকে ।
–আপনি বললেই আমি শুনবো কেনো ? রুমু আমার আর রায়ানের মেয়ে ভুলে যাবেন না । নয় মাস এই গর্ভে রেখেছি আমি রুমুকে ।
–আর নয় মাস বয়সেই ত্যাগ করে অন্য সংসার গড়েছি তাই তো ? নয় মাস গর্ভে রেখে আর নয়মাস লালন পালন করে ঐ আঠার মাস সময় ই তুমি রুমুর মা ছিলে । আর সেই সময় অনেক আগেই চলে গেছে । অধিকার ফলাতে আসবেনা । কোথা থেকে এসে আমার নাতনীকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আমি সহ্য করবোনা কিছুতেই ।
–আমার মেয়ে আমি একশবার বাড়াবাড়ি করবো ।
–ও তুমার মেয়ে নয় । তোমাকে আমরা চিনি না ।
শুভ লিনার কথা শুনে ঘটনাস্থলে এসে হসপিটালে কর্মরত কয়েকজন কে বলে –এই মেয়েকে এখনি এখান থেকে বের করো ।
লিনার দিকে তাকিয়ে বলে
–খবর পেলে কিভাবে?
–বাতাসে খবর ভাসে। আর আমি মা তাই আমি বুঝি ।
–ওহ চুপ করো । তুমি কখনো মা হতে পারো না । তোমার কথা রায়ানের কানে পৌছানোর আগে বের হয়ে যাও । নয়তো খুন হতে সময় লাগবেনা তুমার ।
–কে খুন করবে ? তুমি? রায়ান? কেউ পারবে না । একটা মায়ের থেকে সন্তানকে দূরে রেখে কি পাও তোমরা ? কেনো আমার মেয়েটাকে মায়ের অভাব দিচ্ছো ?
–রুমুর মা আছে ওকে ? ওর মা ওকে খুব ভালোবাসে। ওহ সিট, তোমাকে কেনো বলছি আমি! এই তোমরা এই মহিলা টাকে বের করো এখান থেকে ।
–মা আছে মানে ? রায়ান বিয়ে করেছে নাকি?
–হ্যা করেছে । তোর কোন সমস্যা? এখন যা এখান থেকে নয়তো রায়ান কিছু করুক না করুক আমি তোকে কি করি যাস্ট দেখবি ।
লিনাকে ধরে বেধে বের করে দেওয়া হয় ।এদিকে তৃনা দাড়িয়ে সবটা দেখছিলো । আস্তে আস্তে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসে । চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে আসে ।
চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখতে পায় । জ্ঞান ফিরতে দেখে পাশে দাড়ানো নার্স বলে উঠে –এখন কেমন লাগছে ? আপনাকে তো সিটিং এ ভালোই বসে থাকতে দেখলাম । হটাৎ কি হলো যে মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে গেলেন ?
–আমি ঠিক আছি । ঐটা কোন ব্যপার না । বাসায় যেতে পারি ?
–হ্যা অবশ্যই ।
তৃনা উঠে দাড়ায় । ব্যাগ হাতে নিয়ে হসপিটাল থেকে প্রস্থান করে । তার কিছুক্ষনপর রোহানা এসে বলে –আরে আরে মেয়েটা গেলো কোথায় ?
–উনি তো চলে গেছেন।
–একি কথা ! যাওয়ার সময় বলে যেতে পারতো তো । আমার নাতনীর জীবন বাচালো রায়ান তো ওর সাথে কথা বলতে চাইলো । কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইলো । ঠিকানা নাম্বার কিছুই তো নেওয়া হলো না ।
বাড়ি ফিরে আসতেই শিল্পি দৌড়ে আসে । মনোয়ার চিন্তা মুক্ত হয়ে বলে –ফোন দিলে যে ফোনটা তুলতে হয় সেই জ্ঞান বোধ করে হবে তোমার ? এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার মানে কি ? কোথায় ছিলে সারারাত ? তুমাকে কিছু বলি না দেখে যে তুমি উড়বে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ির বাইরে থাকবে সেটা আমি মেনে নিবো না । আমার বাড়িতে থাকতে হলে এতো উড়া উড়ি চলবে না ।
তৃনা বাবার দিক তাকিয়ে বলে –আমি তাহলে চলে যাচ্ছি এ বাড়ি ছেড়ে ।
মনোয়ার রাগ দেখানোর আগেই পারুল বলে উঠে –হায় হায় শুনেছো মেয়ের কথা ? তৃনা বাবার সাথে বেয়াদবিও করছিস দেখছি । সারা রাত বাইরে কাটিয়ে এসে মুখের উপর কথা বলছিস । কিরে লজ্জা করে না তোর এই মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ।
শিল্পি ধমকের সুরে বলে –পারুল চুপ করো তুমি । ঠিক করে কথা বলো। তৃনার মুখে হাত দিয়ে বলে –কোথায় ছিলি মা ? চিন্তা হচ্ছিল তো আমার ।
তৃনা ছল ছল চোখে মায়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে — সাবলেট বাসা ভাড়া তো পাবো না .. হোস্টেলে উঠার চেষ্টা করবো ।
কথাটা শুনে মনোয়ার আরো রেগে যায় । পারুল মুখ খুলতেই শিল্পি কঠিন চাহনি দেয় । তৃনা সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে –আমি হসপিটালে ছিলাম আম্মু। শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল হটাৎ। রুমুর কথা না বলাই থাকে।
একথায় বাবা মা দুজনের হৃদয় কেপে উঠে । শিল্পি পিছু গিয়েও তৃনাকে আওড়াতে পারে না তার আগেই তৃনা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে । পিছু পিছু মনোয়ার পারুল ও চলে আসে । মনোয়ার শিল্পিকে বলে –ভিতরে যাও তুমি । কি হয়েছে ওর কেনো হসপিটালে ছিলো জেনে আসো । আমাকে তো বলবে না ।
–কোন দিন যেন না বলে ।
–শিল্পি!
–যার যার জীবন তার তার । মেয়ের জীবন মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে না । এটা তার অধিকার । বিয়ে করবে না বলেই যে বাবা ভাবতে পারে তার মেয়ে সারারাত বেলাল্লা পনা করে বাড়ি ফিরে___।
–চুপ করো তুমি । আমার মেয়ে কখনো তেমন হতে পারে না । আমার মেয়ের মতো ভালো পরহেযগার মেয়ে লাখে একটা পাওয়া যায় ।
–কিন্তু একটু আগে তো তাই বলেছিলে।
চুপ করে যায় মনোয়ার । মেয়ের প্রতি রাগ থেকে যে মেয়েকে ঐ সব উল্টা পাল্টা কথা অব্দি বলে ফেলে বুঝতে পারে । মনে মনে অস্থিরতা থেকেই যায় মেয়ের অসুস্থতার ব্যাপারে ।
তৃনা বাথরুমে এসে সাওয়ার ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে । কেনো করে সে জানে না । এই চিৎকার অনেক বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে আজ হটাৎ আবার কেনো ব্যাক করলো তার জীবনে ? এতো নতুন কিছু নয় । এতো হয়েই ছিলো । বহুদিন পর আবার এই মুখ গুলো দেখে হৃদয়ে জমা থাকা শুকতো চিৎকার গুলো কি আবার বেরিয়ে আসছে ? এতো হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।
চলবে?