শুষ্ক_পাতার_ভাজে?৮
#লাবিবা_তানহা_লিজা?
পাচ দিন পর তৃনা ফোন খুলে । তৃনাকে ফোনে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠে সবাই । কল ধরা মাত্র ই ওপাশ থেকে তৃনা মনোয়ারের কান্নার শব্দ পায় । বুক সহ সমস্ত শরীর যেন এই কান্না শুনে কেদে উঠে । ফোনের দু পাশে বাবা মেয়ের কান্না চলে কিছুক্ষন । রবিন ফোন নিতে নিলে মনোয়ার ফোন দেয় না । কিছুক্ষন পর মনোয়ার বলে –ঠিক আছিস মা ?
একথা শুনে তৃনা আরো জোরে কেদে উঠে । আজ কত বছর পর বাবা তার সাথে মা বলে কথা বলছে । কান্না কমিয়ে বলে
–কাদছো কেনো বাবা? আমিতো ঠিক আছি ।
–বাবারা যে কাদে মা ।
–আমি ঠিক আছি তো ।
–বাসায় ফিরে আয়। আর ফোর্স করবোনা ।
–তুমি ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছো না বাবা । আম্মুকে ফোনটা দেও ।
শিল্পিকে ফোনটা দিলে শিল্পি চিৎকার করে বলে
— ফোন অন করতে গেলি কেনো ? বন্ধ করে রাখতি । জাহান্নামে চলে যা তুই । আমার কথা ভাবতে হবে না তোকে । আমি তোর তোর মা নই । আমি তো তোকে ভালোবাসি না । তোর বাপ ভাইয়ের মতো তোর উপর ফোর্স করি তাই না ?
–আমি আসছি আম্মু ।
–কতক্ষন আর অপেক্ষা করবো আমি ? আমার কলিজা ছানারে দেখতে আর কতো দেরি হবে ।
–কাল ই ফিরছি আম্মু ।
–কোথায় তুই ?
–আছি কোথাও ।
–বল ।
–পুরান ঢাকাতেই আছি । রাখছি ।
–ভাইয়ার সাথে কথা বলবিনা ?
–ফিরে এসেই বলবো । আল্লাহ হাফেজ ।
ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছিলো তৃনা । আরো দুদিন ছুটি আছে । এই পাচ দিন হোটেলেই বন্ধ ঘরে দিন কেটেছে তার । এবার সে একটু বেরোতে চায় । বোরখা পড়ে ব্যাগ নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে । পুরান ঢাকার গিজগিজ করা মানুষের ভির ঠেলে একটা রিকশা ভাড়া করে । প্রায় প্রতিদিন ই রিকশা দিয়ে যাতায়াত করা হয় কিন্তু ঐ বড় জোড় এক ঘন্টা।
রিকশা করে পুরো শহর ঘুরবে আজ । রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঢাকা শহরের ধুলোমাখা হাওয়ায় দিন কাটালো । বিকালে হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার দিকে আবার বেড়োলো । এবার হাটছে ফুটপাত ধরে । কোথায় যাবে কোন গন্তব্য নেই । হোটেলে থাকতেও ভালো লাগছিলো না কিছুতেই । হটাৎ মনে পড়লো কয়েকদিন আগে যে রুমুকে হসপিটালে রেখে আসলো আর তো খবর নেওয়া হয়নি । মেয়েটার একটু খোজ নেওয়া উচিত । কিন্তু যদি রায়ান থাকে । থাকলে থাকবে । মেয়ের কাছে বাবা তো থাকবেই। বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছিলো খুব । ঐটুকুনি একটা বাচ্চা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে আসছে । সারা শরীরে ব্যান্ডেজ না জানি কতো কষ্ট হচ্ছে। এতো দিনে হয়তো রিলিজ দিয়ে দিয়েছে । নাও দিতে পারে যে পরিমাণ ব্যান্ডেজ দেখেছে সারতে সময় লাগবে । ভেবে ভেবেই সিএনজিতে উঠে পড়ে তৃনা । হসপিটালে এসে রিসিপসনে খবর নিয়ে জানে রুমুর রিলিজ হয়নি এখনো । দেখিয়ে দেওয়া কেবিনে যেতে থাকে । পথে লিনাকে দেখে থেমে যায় । নার্সকে ডেকে জিজ্জাসা করে –আচ্ছা ইনি এভাবে অদ্ভুদ আচরন করছেন কেনো ? একবার বসছেন তো একবার উঠছেন আবার পায়চারি করছেন ।
নার্স লিনাকে দেখে নাক ছিটকে জবাব দিলেন
–ইনি তো কয়েকদিন থেকেই আসছেন । রায়ান স্যারের এক্স ওয়াইফ নাকি ! উনি রায়ান স্যারের মেয়ের জন্য এখানে এভাবে এসে বসে থাকে কাদে কিন্তু কেবিন অব্দি পৌছতে পারেন না । উনাকে কেউ রায়ান স্যার অব্দি পৌছতে দেন না । বাজে মহিলা নাকি একটা । যত্তসব ।
তৃনা এগিয়ে গেলো । লিনার সামনে দিয়েই কেবিনে ঢুকে গেলো । পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলো লিনা হা করে তাকিয়ে আছে । দরজা হালকা খুলে সামনে রোহানাকে দেখে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকলো । রোহানা কন্ঠ শুনেই বুঝে গিয়ে বললো –আসো আসো না বলে চলে গিয়েছিলে কেনো বলোতো আর আজ এতোদিন পর । এইটা কিন্তু ঠিক করোনি মা ।
–আসলে আন্টি আর্জেন্ট ছিলো তাই তাড়াহুড়া করে চলে যেতে হয়েছে । আর আজ সময় পেলাম ।
রোহানা বসতে বললো । তৃনা বেডের দিকে তাকিয়ে দেখলো বেডে বালিশে হেলান দিয়ে রায়ান বসে । তার বুকের উপর দু বাহুর মধ্যে ব্যান্ডেজ করা রুমু ঘুমিয়ে আছে । এ দৃশ্য মুগ্ধ নয়নে গিলে নিলো তৃনা । যে বাবা মেয়ের কাছে আসে না সে আজ কতো নিবিড় ভাবে আগলে ধরে আছে । আসলে যে ভালোবাসা গুলো প্রকাশ্য নয় তা একটু ধাক্কা খেলেই প্রকাশিত হয় । রায়ান চোখ বন্ধ করে আছে । মনে হয় ঘুমুচ্ছে । রোহানা কাধে হাত দিতেই রায়ান চোখ মেলে তাকায় । রোহানা বলে
–এই যে এই মেয়েটাই রুমুকে বাচিয়েছে । কাজ ছিলো বলে চলেগিয়েছিলো । আজ এসেছে ।
ইতোমধ্যে রুমুর ঘুম ও ছুটে গেছে । রায়ান সোজা হয়ে বসে বলে –ও হো । আপনি । বসুন। আপনি আমার মেয়ের জীবন বাচিয়েই তো ভেবেছেন দায়িত্ব শেষ আর চো দেখতেও আসলেন না ।
তৃনা বসতে বসতে বলল –একচুয়েলি বিজি ছিলাম ।
–দেখুন আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা । আমার মেয়ে আমার কাছে কি আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি আমার বেচে থাকার একজন প্রয়াস । ওর কিছু হয়ে গেলে আমার পাপা মম এবংকি আমি কেউ বাচতাম না । তবুও আপনাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে ।
রোহানা বলে উঠে –ধন্যবাদ দেওয়ার থেকে তোমাকে দাওয়াত দিলে ভালো হয় । আমাদের বাসায় তোমার স্বপরিবারে দাওয়াত রইল মা স্পেশালী তোমার । একদিন সময় করে এসো কিন্তু ।
তৃনা মাথা নাড়ালো । তার চোখ এখোনো রায়ান আর রুমুর দিকে । রুমু আর রায়ানের চেহারার মিল ঠিক কতটুকু সেটাই খেয়াল করছে তৃনা । রুমুর চোখ নাক রায়ানের মতো । খোচা দাড়ি ওয়ালা সুকুমার মুখটি দেখে আজো বুক কেপে উঠে তৃনার । চোখ ফেরাতে পারে না । একবার রুমুর দিকে আরেকবার রায়ানের দিকে তাকাচ্ছে । রোহানা টুক টাক কথা বলছে ।
বাইরে বসে লিনা ফুসছিলো । কে এই বোরখাওয়ালী? এরি মধ্যে দুজন নার্স আলাপ করতে করতে যায় ।
–এই কেবিনে একটা মহিলা ঢুকলো ।
–হুম দেখলাম তো । হবে হয়তো বাচ্চাটির মা ।
–রায়ান স্যারের বউ নাকি ! বাহ দারুন তো । রায়ান স্যার পর্দাশীল বউ পেয়েছে । মাশাআল্লাহ।
এটুকু শুনেই লিনার মাথা গরম হয়ে যায় । সিকিউরিটিকে ধাক্কা দিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে । তৃনার কোলে রুমুকে দেখতে পায় । রায়ান রেগে লিনার সামনে এসে দাড়িয়ে বলে –হাউ ডেয়ার ইউ ? কিভাবে ডুকলে তুমি ? বের হও এখান থেকে । এক্ষুনি বের হও।
–ঐ মেয়েটা কে ? তোমার বউ নাকি ঐ মেয়েটা ?
–হ্যা আমার বউ , আমার মেয়ের মম ।
–কিসের মা ? আমি জন্ম দিয়েছি ও কিভাবে মা হয় ?
–আমি তোমাকে চিনি না । বের হও তুমি আমার সামনে থেকে । এক্ষুনী বের হবে ।
লিনাকে এমন করা দেখে রুমু ভয়ে তৃনাকে জড়িয়ে ধরেছে । সিকিউরিটি এসে টানতে টানতে লিনাকে নিয়ে চলে যায় । রায়ান তৃনার দিকে ফিরে বলে
–সরি , আই এম সরি ফর দিজ । একচুয়েলি ইটস ফেমেলি প্রবলেম ।
রোহানা বলে –বুঝলে মা ..এই সে রাক্ষসী টা যার কথা তুমাকে বলেছিলাম । আমার ছেলের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে ।
–আহ মম । চুপ করো ।
কোন কথাই তৃনার কানে যাচ্ছে না । আমার বউ , আমার মেযের মা কথাটা বার বার তার কানে উচ্চারিত হচ্ছে । শরীরের শিরা উপশিরায় যেন রক্ত চলাচল থেমে গেছে । ধপ করে বসে পড়ে । রুমু কোলে ছিলো তৃনাকে আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরে ।
কোর্টে দুই পক্ষের উকিলের বয়ান শেষ হলো । একটা মেমরি কার্ড গিয়ে পড়লো জজের হাতে । জজ ভিডিও টা অপেন করতেই ভেসে উঠে লিনার সাথে এক লোকের নিষিদ্ধ ভিডিও । সেদিন লিনাকে রায়ান একটা হোটেলে নিয়ে যায় । লিনা মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলো । রায়ান তার দিকে ফিরে তাকিয়েছে । রায়ানকে সে আবার ফিরে পাবে । হোটেলে ডুকে রায়ান একটা রুম বুক করে । লিনার মুখ থেকে যেন কথা বের হচ্ছে না আনন্দে । লিনার ভিতরে গিয়ে কেমন জানি লাগে । এই হোটেলটা কেমন জানি এবনরমাল লাগছে পরিবেশ দেখে । কিন্তু রায়ানকে কিছু জিজ্জাসা করে না এগিয়ে যায় । রুমে ডুকতেই লিনা রায়ানকে জড়িয়ে ধরে । মুখ ধরে ঠোটে চুমু খেয়ে বলে ” আমি জানতাম তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো । তুমি আমাকে চাও । প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও । আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করবো । ” রায়ানের শরীরটা জ্বলে যাচ্ছিলো । ঠোট টা ইচ্ছা করছিলো কেটে ফেলতে । কিন্তু সহ্য করে গেলো । লিনাকে বসিয়ে নিজেও সামনে বসে । কচি কলাপাতা রংয়ের শাড়ি , কালো টিপ, দু হাতে চুড়ি, চোখে কাজলে মোহনীয় রুপে রায়ানের চোখ জ্বলে যাচ্ছিলো । ভয়ংকর চাহনীতে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছিলো । লিনার হাত দুটো ধরে মুখের দিক তাকিয়ে ছিলো । এই রুপেই অন্ধের মতো দুইটা বছর কেটেছে রায়ানের । অন্য কোন দিকেখেয়াল ছিলো না । কিন্তু রুপধারী কালো মনের মানুষ টি যে কতটা নিকৃষ্ট তা সে হারে হারে জানে । লিনাকে বললো –আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য সেই আগের সাজ তাইনা ?
–হুম । আমি আবার তোমার জন্য সেজেছি ।
–আমার সাথে থাকতে চাও তাইনা ?
লিনা খুশিতে মাথা নাড়ায় । রায়ান লিনাকে জড়িয়ে ধরে । নিজের মাঝে নিয়ে নেয় । এতো দিনের প্রত্যেকটা যন্ত্রনার শোধ তুলে । লিনা যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে । শরীরে কোন ঠোটের ছোয়া পায়নি লিনা । পেয়েছে হাতে ছোয়া । পুরো শরীরে খামচির দাগ থেকে রক্তও পড়ছিলো । ঐভাবেই রেখে আসছিলো রায়ান । তারপর আরেকজন লিনাকে সেভাবেই ভোগ করে যেভাবে রায়ান করেছে । সেই ভিডিও ক্লিপ ই এখন জজের হাতে । লিনা চিৎকার করে উঠে রায়ানে ঝাকাতে থাকে আর বলে –রায়ান এই ভিডিও কেন করলে তুমি ? কেনো দিলে এখানে ? আমাকে এভাবে নোংরা প্রমান না করলে কি তোমার চলতো না । রায়ান হাত ঝাড়া দিয়ে সরে যায় । লিনা সেখানে বসেই কাদতে থাকে । সেদিনের পর থেকে অসুস্থ ই সে । তবুও হসপিটালে গিয়ে থেকেছে । তাই আর রায়ানের সাথে পেরে উঠে না । রায়ান মুচকি হেসে বলে –বারে! আপনি প্রস্টিটিউট হয়ে হোটেলে পরপুরুষের সাথে থাকতে পারেন আর আমি সেই ভিডিও কি ভাইরাল করে দিতে পারিনা ?
–রায়ান আমি তোমার সাথে গিয়েছিলাম ।
–তো ? আমার সাথে গিয়ে আপনি অন্য একজনের সাথে থেকেছেন । এইটা আর নতুন কি ? এইটা আপনার মতো প্রস্টিটিউটের কাছে ওয়ান টু ব্যপার । আপনার তো একজন কে দিয়ে হয়না অনেক গুলো লাগে । তাই লেগেছে । আর আমিও তো আপনার পর পুরুষ ই ।
–আমাদের ডিবোর্স হয়নি রায়ান ।
–তুমি যেটা অফিসিয়ালি বলছো সেটা তো মাত্র একটা কাগজ কলমের খেলা । ছিড়ে ফেললেই শেষ । তেমনি সম্পর্ক টাকেও তুমি ছিড়ে ফেলেছো অনেক আগেই । ডিবোর্স না হওয়ার পরেও আরেক জনের সংসার করেছো । আর তালাক তো আমি তোমাকে অনেক আগেই দিয়েছি । শুধু বাকি ছিলো সাইন টা করার ।
লিনা কাদছে ।
–আমাকে ক্ষমা করো রায়ান ।
–লোভে পাপ পাপে মৃত্যু ।দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তোমার । তুমি মরে গেছো আমার কাছে লিনা । তোমার লোভ তোমাকে মেরে ফেলেছে । তোমাকে এক্সেপ্ট করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় । সব প্রমান লুটিয়ে নিয়েছিলে তুমি । তাই এই প্রমানটা দিয়ে ডিবোর্স টা করিয়ে নিচ্ছি আমি ।
একটা চেকে সাইন করে লিনার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে বলে –গো আউট অফ মাই লাইফ।
চলবে?