শুষ্ক_পাতার_ভাজে? ৪

0
2098

শুষ্ক_পাতার_ভাজে? ৪
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

তৃনলতা মাথায় যেনো ঝেকে বসে একেবারে । বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও ঘুমোতে পারছে না । এতো বছরেও কেনো ভুলতে পারেনি মেয়ে টাকে ? না মনে আছে মেয়েটার ঠিক ঠাক চেহারা না মনে আছে কন্ঠ। দেখেও চিনবে কি না কে জানে ? এতো দিনে হয়তো মা হয়ে গেছে সে । দীর্ঘ এক বছর তার পেছনে পড়ে ছিলো মেয়েটা ।এক বারের জায়গায় দুবার দেখেও দেখেনি । কিন্তু ফিল করেছিলো যে সত্যিই মেয়েটা ভালোবাসে তাকে । ডুব দিতে ইচ্ছে করে পুরোনো সেই দিনে ।
বসন্তের ছোয়া লাগলো প্রানে । চারিদিকে ফাগুন হাওয়ার মাতামাতি । কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কংক্রিটের বাধানো বৈঠক খানা । সেখানে আড্ডায় মেতে ছিলো রায়ান গ্রুপ । ভার্সিটির হার্ড থ্রোক ড্যাসিং চার্মিং রিচ এক্যাউন্টিং ডিপান্টমেন্টের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট প্লাস ভি পি হচ্ছে রায়ান চৌধূরী । তার বিহেভিয়ার , লুক, বসগিরির জন্য ভার্সিটির অনেক মেয়ের ড্রিম বয় ছিলো সে । প্রত্যেকবার ফাস্ট ইয়ারের হাতে গুনা দু একজন মেয়ে ছাড়া সবাই তাকে প্রপোজ করতো । সেও সুযোগে ফ্লাট করতো । যাকে বলে রোমিও গিরি। সেরকমি একদিন হলুদ এর মাঝে কমলা রং এর ফুল ফুল একটা থ্রি পিচ পরিহিতা ফাস্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট হাতে একটি গাদা ফুল নিয়ে হাজির হয় রায়ানের সামনে । একঝলক তাকায় রায়ান । সুশ্রী মুখয়ব মোটামুটি ফর্সা গড়নের বাচ্চা চেহারার একটি মেয়ে । একপাশে উড়না টানা মাথায় গাদার মালা ক্রাউন আকারে দেওয়া , লম্বা নিতম্ব পর্যন্ত চুল গুলো একপাশে দিয়ে সামনে আনা । মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে যাকে । শুশীল মার্জিত স্মার্ট মেয়েই বলা যায় তাকে । তবুও ভার্সিটির হাই সোসাইটির জিন্স ,টপস, মিনি স্কার্ট পরিহিতা স্টুডেন্টদের মাঝে বেমানান । ফ্রেন্ডদের থেকে দু পা এগিয়ে এসে বলে
— ফাস্ট ইয়ার ??
মেয়েটা মুচকি হেসে মাথা ঝাকায় ।
–কি চাই ?
হাটু মুড়ে বসে গাদা ফুলটা এগিয়ে দিয়ে কোন ভনিতা ছাড়াই এক নিশ্বাসে বলতে শুরু করে
–আপনাকে আমার অনেক ভালোলাগে । নবীন বরন অনুষ্টানে প্রথম দেখেছিলাম আপনাকে বক্তৃতা দিতে । আপনার কথা চালচলন ব্যবহার আস্তে আস্তে আমাকে মুগ্ধ করতে থাকে । একসময় সেটা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে আমি বুঝতে পারি আমি আপনাকে ভালবাসি । একেবারে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে । আপনি হয়তো আমাকে দেখেন নি আগে । কিন্তু আমি আপনার আশে পাশেই ছিলাম । আপনার প্রেমে অনেক মেয়েই পাগল । আশে পাশে তারাই থাকে । তাই হয়তো আপনার চোখ তাদের ভেদ করে আমার দিকে পড়েনি। কিন্তু আমার চোখ সব সময় আপনাতেই আটকে রয়েছে । আমি জানি আপনি এই এতো মেয়েদের মধ্যে কাউকেই ভালোবাসেন না । শুধু টাইম পাস ছাড়া আর কিছুই নয় । একটু ভালোবাসবেন আমায় ??
পেছনে থাকা ফ্রেন্ড ছোট ভাই সবাই অবাক হয়ে এতোক্ষনে রায়ানের পাশে এসে দাড়িয়েছে । রায়ান অবাক ও হয় । এ যাবত এরকম স্ট্যাট ফরোয়ার্ড কেউ এভাবে প্রপোজ তো থাক কথাও বলে নি । সবাই ন্যাকামি করতে করতে গায়ে ডলাডলি করতে করতে কথা বলে । রায়ান প্যান্টের দু পকেটে হাত দিয়ে বলে
— মুখস্ত করে এসেছিলে নাকি ?
— হ্যা । তা বলতে পারেন । একবার কাগজে লিখে দু বার দেখে নিয়েছি তাতেই মুখস্ত হয়ে গেছে ।
পেছন থেকে সবাই হেসে ফেলে । প্রপোজ করতে এসে মুখস্ত পড়া দিচ্ছে । আর এই ভার্সিটিতে থ্রি পিচ পরিহিতা রমনী দেখাও খুব রেয়ার ব্যপার ।
রায়ান হাত দিয়ে থামিয়ে বলে –উঠে দাড়াও । এবার বলো নাম কি তুমার ?
–আবিশা রহমান তৃনা ।
–নিক নেইম?
–তৃনা ।
পেছন থেকে আবারো হাসির রোল উঠে । বলে উঠে ও হো তৃনলতা….। একজন ফ্রেন্ড এগিয়ে এসে বলে –তা তৃনলতা তুমি জানো তুমি কাকে প্রপোজ করছো ? তুমার থেকে হাজার গুন বেশী সুন্দরীরা রায়ান চৌধুরীর পিছু লেগে থাকে । ওদের রেখে তোমার কাছে কেনো যাবে রায়ান ?
— কারন ভাইয়া সেই সুন্দরীরা রায়ান চৌধুরীকে ভালোবাসে কিনা জানিনা তবে আমি ভালোবাসি ।
রায়ান চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বলে
–শোন । আই থিংক তুমি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। লেখাপড়ায় মন দাও নিজের ক্যারিয়ার গড়ো । এইসব ক্রাস খাওয়া বাদ দিয়ে ক্যারিয়ারে ফোকাস করো । আর আমি তোমাকে ভালোটালো বাসিনা ওকে ? আমার অলরেড়ি গার্লফ্রেন্ড আছে । থার্ড ইয়ারের লিনা চিনো ? দ্যা মোস্ট বিউটিফুল গার্ল মেইড ফর অনলি মি । ভাবী বলে ডাকবে ওকে ?? যাও ।
— আমি জানি ঐটাও আপনার টাইম পাস বরাবরের মতো । ফুলটা নিন । অন্তত ফুলটা নিলে খুশি হবো ।
–তোমার ফুল তোমার কাছেই রাখো ।
–প্লিজ নিন । চলে যাচ্ছি তো ।
অগত্যা ফুল টা নেয় । ফুল তো মেয়েদের হাতে থাকার জন্য । যার ফুল তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাক । ভেবেই পেছন থেকে ডাক দেয় — ওয়ান মিনিট তৃনলতা ।
তৃনা এগিয়ে আসলে গাদা টা চুলে গুজে দিয়ে বলে যাও । তৃনা ফুলটা হাত দিয়ে ছুয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায় । সেখানেই থেমে থাকেনি সে । প্রতিদিন কিছু না কিছু বাহানা নিয়ে সামনে আসতো । রায়ানের কাছে ছেসরাই মনে হয় তৃনাকে । কিন্তু আবার তাও মনে করতে পারে না । কারন তৃনা খুব কম ই কথা বলতে আসতো । রায়ান এড়িয়ে যেতো । এইটা খুব ভালোই জানে রায়ান । শিখে গেছে বলতে গেলে । রায়ানের পা বাড়ানো দেখেই তৃনা একবার বলতো একটু ভালবাসবেন আমায় ?? একবার তো লিনা শুনে ফেলেছিলো । তার পর একজনকে দিয়ে হল রুমে ডাকিয়ে আনে তৃনাকে । তৃনা ভয়ে চুপ চাপ হয়ে ছিলো । সে জানতো এরা কিছুটা হলেও বিকৃত মস্তিষ্কের গায়ে হাত তুলতে পারে তাই চুপ করে ছিলো । লিনা একের পর এক গালাগালী করার পরও কথা বলেনি তৃনা । তৃনাকে চুপ করা দেখে রাগ বেড়ে যায় লিনার । জোরে দেয় কয়েকটা থাপ্পর । তৃনা একটা কথাও বলেনি । তৃনা জানে এরা জিদের ভাত কুকুরকে খাওয়াও । না জানি পরে কোন ক্ষতি করে দেয় তার ।রায়ান ঘটনা শুনে তাড়াতাড়ি হল রুমে এসে লিনাকে আটকায় । তৃনা রায়ানকে দেখে ছল ছল নয়নে একবার তাকিয়ে ছিলো । সেই চোখে তাকিয়ে সেদিন রায়ানের কলিজা কেপে উঠেছিলো । তৃনাকে নিয়ে চলে যেতে বললে তৃনা সেভাবেই দাড়িয়ে বলেছিলো –আপনি কিছু বলবেন না ? দেখুন আমার গাল লাল হয়ে গেছে । আমার ঠোট কেটে রক্ত বের হচ্ছে । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । রায়ান দেখুন না আপনি । আমি তো শুধু আমার মনের কথা ব্যাক্ত করেছি । আমার কোন অপরাধ ছিলো না আপনি বলুন না
প্লিজ ।
একটা টু শব্দ করেনি রায়ান । তখন রায়ান তৃনার বিভৎস মুখ আর অসহায় আকুলতা ভরা চাহনি তে নিজের অস্তিস্ত ভুলে গিয়েছিলো কিছুক্ষনের জন্য । তৃনা উত্তর না পেয়ে সেভাবেই চলে আসছিলো । লিনার উগ্ৰ মেজাজি কথায় যখন রায়ানের হুস ফিরে তখন লিনাকে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে তৃনাকে যে ভাবে প্রহার করা হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই লিনার চেহারা বিভৎস করে তৎক্ষনাত ব্রেকাপ করে দেয় ।

ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছিলো তৃষা । রাস্তায় ফুচকা দোকান দেখে রিকশা থেকে নেমে পড়ে । ফুচকা অর্ডার দিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে । তৃনাকে টেক্সটে জানিয়ে দেয় “আপু আমি তোমার ভার্সিটির এপারে রাস্তায় বসে ফুচকা খাচ্ছি । তাড়াতাড়ি এসো । ”
কিছুক্ষন পর তৃনাও চলে আসে । তৃষা ফুচকা এগিয়ে দেয় তৃনার দিকে । তৃনা আশে পাশে তাকিয়ে বলে –কোথায় গিয়েছিলে ? আজ তোমার ভার্সিটিতে পিকনিকের জন্য বন্ধ ছিলো কিছুক্ষন আগেই জানলাম।
–আপু রায়ানের সাথে মিট করতে গিয়েছিলাম ।
মুখ থেকে ফুচকা টা পড়ে যায় । তৃষা তাকিয়ে থাকে । তৃনা কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে বলে
–খোজ নিয়েছিলে তুমি রায়ান চৌধুরীর ব্যপারে ?
–খোজ নেওয়ার কি আছে আপু ? যত টুকু জানার ততো টুকু তো জানিই আমি । আপু জানো হি ইজ এ নাইস গাই । আমাকে অনেক লাভ করে । আজো একটা গিফ্ট দিয়েছে দেখো । বলেই নাকে হাত দিয়ে নোজ পিন দেখায় । ডায়মন্ডের ছোট্ট একটা নোজ পিন । চোখের কোনা ভিজে উঠে তৃনার । রায়ান নোজ পিন পছন্দ করতো । এরকম ছোট্ট একটা নোজ পিন ছিলো তৃনার নাকে । ডায়মন্ড ওয়াল্ড থেকে শখ করে কিনেছিলো সে । সব সময় নাকে জ্বল জ্বল করতো । একদিন ক্যাম্পাসে পড়ার বাহানায় সামনে গিয়ে বই নিয়ে বসেছিলো সে । রায়ানের চোখ পড়েছিলো তার দিকে বিশেষ করে সেই নোজ পিনের দিকে । মুখ এগিয়ে নিয়ে একবার ভালো করে খেয়াল করে বলেছিলো
–সুন্দর মানিয়েছে ।
নিচু হয়ে বই পড়ছিলো তৃনা । রায়ানের কথায় মুখ তুলে তাকিয়ে না বুঝা মুখে তাকিয়ে ছিলো । রায়ান বুঝতে পেরে আবার বলেছিলো –নোজ পিনে দারুন মানিয়েছে তোমাকে । তখন সে কি লজ্জা তৃনার । বসে না থেকে উঠে চলেই আসতে হয়েছিলো ।

এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে তৃনা । দুধে আলতা রংয়ের মুখে দারুন মানিয়েছে তাকে । অনেক সুন্দর লাগছে তৃষাকে । তৃনা আর দ্বিতীয় বার মুখে কুলুপ টি কাটে না । নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় এমন অস্থিরতা থেকে । আরো কিছু জিজ্জাসা করলে হয়তো তৃষা অনেক কিছুই বলবে যা তৃনা বিন্দু মাত্র শুনতে ইচ্ছুক নয় । তবুও যেনো রেহাই হলো না । তৃষা বলতেই থাকলো । –জানো আপু আমি প্রথমে এই রায়ানকে চিনতাম ই না । কিন্তু যখন চিনলাম তখন ভালোলাগলেও অন্য কারো সাথে রিলেশনে ছিলাম । একদিন ওয়াটার পার্কে নজরে পড়ে যাই তার । তার পর আমার ব্রেকাপ হয়ে গেলে সে আসে আমার জীবনে । অনেক কিছু মেইনটেইন করতে হয় তাকে তবুও আমাকে সময় দেয় । জানো আপু রায়ান খুব ই রোমান্টিক একজন পারসন আর কেয়ারিং ও । আমি যা বলবো তার সাধ্য মতো তাই শুনতে রাজি সে । আমাকে কখনো কষ্ট দেয় না বকা ঝকা দেয় না । তবে অস্থিরতা বাড়ায়। আসলে দোষ টা আমারি । আমিই তাকে স্পেস দেই না । আসলে সে অনেক বিজি থাকে অলটাইম আর আমাকে সময় খুবি কম দিতে পারে । এতো বড় বিজনেসম্যান বিজি তো থাকবেই । বেচারা আমিই সেটি বুঝি না । সেদিন কি বলেছে জানো ? আমাকে বিয়ে করবে । খুব শীঘ্রই ।
অবাক হয় তৃনা । মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় –কিহ বিয়ে করবে বলেছে ? এটা কিভাবে সম্ভব ? আর বিয়ে করবে শুনে এতো খুশি হওয়ার ই বা কি আছে ? তুই কি এটাও টাইম পাস করছিস ?
–আরে না আপু কি বলো এসব ! আমি আর এসব খেলা খেলতে চাই না । এবার সেটেল হবো নিজের ভালোবাসার সাথে ।
অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে তৃষা । এসব কথা তৃনার একদম ভালো লাগছে না । ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে বলে –বাসায় যাবো চল। আমার ক্লাস নেওয়া শেষ ।বেশি কথা বলবিনা । মাথা ব্যথা করছে ।
সারা রাস্তা মুখে আর কুলু কাটে নি তৃষা । বাসায় এসে সরাসরি রুমে এসে বোরখা খুলে শুয়ে পড়ে ।মাথাটা সত্যিই ধরেছে । তৃষা কিচেনে শিল্পির থেকে মুভ নিয়ে গান গাইতে গাইতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে । পারুল হাতে মুভ দেখে বলে –কিরে মাথা ব্যথা নাকি তোর ?
–আমার না আম্মু । আপুর মাথা ব্যথা । তাই একটু মুভ লাগাতে যাচ্ছি ।
–এ বাড়িতে থাকছি খাচ্ছি বলে কি খাটিয়ে নিতে চাচ্ছে নাকি ?
–কই আমিতো কখনো তোমাকে খাটতে দেখি না। দিব্যি তো পায়ের উপর পা তুলে খাও । আর বোনের সেবা করলে পূন্য হয় বুঝলে ? চেঞ্জ ইউর মাইন্ড।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here