#শূণ্য-কৌটা (পর্ব-০৪)
-সুহাসিনী
আমার বাবা কি বলেছে জানো, তার সন্তানের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার তুমি কে? তবুও তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছে। কেন জানো? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। পাগলের মতো ভালোবাসি । আমার বাবা জানেন, তোমাকে ছাড়া বাঁচতে আমার কষ্ট হবে । আচ্ছা নোমান, তুমি কি এখন আমাকে প্রতারক বলবে?
নোমান কোন জবাব দিতে পারে না। নির্বাক চেয়ে থাকে ওর দিকে। শিরিন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বদ্ধ জানালা খুলে দিয়ে পিছন ফিরে তাকালো ওর দিকে। নোমানের প্রতিক্রিয়া জানবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, নাকি নিজের অনাগত ভবিষ্যতের সংশয়- ঠিক কোন বিষয়টি তাকে গ্রাস করছে, তা নিজেই উপলব্ধি করতে পারছে না সে। দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে সে বলল,
– আচ্ছা এর জন্য কি তুমি অপরাধীর কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড় করাবে? নাকি আমাকে আমার বাবার কাছে ফিরে যেতে হবে? আমি সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত আছি। কিন্তু এভাবে এত বড় একটা সত্যিকে লুকিয়ে তোমার সাথে সংসার করতে পারবো না। এমনকি আমি এটাও জানি না, যেখানে আমারই সমস্যা হচ্ছে না, সেখানে তুমি আমার মায়ের রক্তের কেউ না হয়েও কেন এত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছ! যাই হোক, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটা সম্পূর্ণই তোমার নিজস্ব অধিকার। তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমি কোন মতবিরোধ করবো না।
শিরিন একবার দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো। কয়েকটা দিন তার ভিতর-বাহির দাবানলের মত জ্বলছিল। আজ তা থেমে গেছে। বুকের উপর থেকে বিশাল একটা পাথর সরে গেল যেন। সে কী এখন মায়ের যোগ্য মেয়ের মতই কথা বললো? রেহানা বেগম কি মেয়ের এই পরিবর্তন দেখে খুশি হতেন? কে জানে! এই কথাগুলো আগেভাগে নোমানকে বললেও সে পারত। কিন্তু পারেনি। কী জানি সংশয় গ্রাস করেছিল এতদিন। আজ মানুষটাকে নিজের করে পেয়েই হয়তো হারানোর ভয়কে ধোয়ার মত উড়িয়ে দিয়েছে অজান্তেই।
নোমান এসে শিরিনের হাত ধরলো। তারপর আড়কোলা করে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
-আমাকে এতটা খারাপ ভাবো তুমি?
-মানে!
-আমি মানছি, এই বাচ্চার জন্য সোস্যাইটিতে অনেক উপহাস শুনতে হবে। কারণ, আমার সামাজিক কালচার একটু ওভাররেটেড মানসিকতা পোষণ করে, তা তুমিও জানো। সমস্যা এইটুকুই যা। কিন্তু, আমি এতটাও খারাপ নই শিরিন। তোমাকে আমি যখন ভালোবাসি, তোমার সবটাই ভালোবাসি। আমার আচরণ অতিরিক্ত নেতিবাচক হয়ে গেছিল। আমিও বুঝতে পারছি এখন। আমার আচরণের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী, শিরিন।
নোমানের কথা শুনে শিরিনের দুই চোখ ছলছল করে উঠলো। আজকের নোমানের চরিত্র যেন সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। খুশিতে আত্মহারা হয়ে নোমানকে সে জড়িয়ে ধরে। নোমানও দুই হাতের বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করে নেয়। শুধু তার দৃষ্টি পড়ে থাকে জানালার ওপারে বকুল গাছের ছায়ায়।
শিরিনের সংসার বেশ জোর কদমেই চলছে। ভালোবাসাবাসি, খুনসুঁটি, অফিসে যাবার আগে নোমানের চুম্বন, দুই পরিবারের ফোনালাপের আত্মীয়তা।
সব আলো যেন একদিন হঠাৎ ফিকে হয়ে গেল ডাইনিং টেবিলে খাবার সময়। নিজের প্লেটে শিং মাছের ঝোল তুলতে তুলতে শিরিনের শাশুড়ী বলে উঠলেন,
-পাঁচ কানে নানান কথা শুনছিলাম শিরিন।
শিরিন তখন নিজের লোকমার ভাতটুকু মুখে নিচ্ছিল। শাশুড়ীর হঠাৎ কথায় সেটুকুও সে মুখে নিতে পারল না। শাশুড়ির দিকে নির্বাক হয়ে পরবর্তী কথাটুকু শোনার জন্য নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল।
সাহারা জামান বললেন,
-তোমার বিয়ের আগে শুনেছিলাম, তোমার আম্মা এই বয়সে এসেও গর্ভবতী হয়েছেন। নোমানের বাবা বলেছিল, বিয়ের আগে বাচ্চাটা নাকি নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু গতকাল শুনতে পেলাম-তোমার মায়ের বাচ্চাটা নাকি হচ্ছে। তার মানে আমাদেরকে মিথ্যে বলে সব ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। এখন হয়তো বাচ্চাটা ছোট আছে, কিছু মাস যেতেই পেট উঁচু হবে। মাঝে মাঝে নোমান শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেলে তোমার মা পেট উঁচু করে ঘুরে বেড়াবেন । মেয়ের জামাইয়ের সামনে ব্যাপারটা কেমন বিদঘুটে দেখাবে, তা হয়তো উনি কল্পনাও করেননি এখনো। যাইহোক, তোমার মায়ের এ বিষয়ে বোধশক্তি না থাকলেও আমার তো আছে। আমি আমার ছেলেকে এই অবস্থায় পাঠাতে পারি না। দেখো শিরিন, তুমি আবার ব্যাপারটা অন্যভাবে নিয়ে কষ্ট পেও না যেন। যত যাই হোক, সত্যিটা তো আর মিথ্যা হচ্ছে না। আমার যেটা মনে হয়েছে, স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিলাম। ও হ্য্য,তোমার হাতের শিং মাছের ঝোলটা বেশ সুস্বাদুই হয় দেখছি। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে পেট ভরে ভাত খেতে পারব আজ।
সাহারা জামান পেট ভরে ভাত খেতে পারলেও শিরিনের গলা দিয়ে আর একটি দানাও নামলো না। চুপচাপ কিছুক্ষণ প্লেটের ভাতগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে প্লেটটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সাহারা জামানের কথাগুলো তার হজম করতে বেশ কষ্টই হচ্ছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি যে একরকম অপমান করার চেষ্টা করলেন, তা সে খুব ভালোমতোই বুঝতে পারছে।
বাবার বাড়িতে শিরিনকে একাই যেতে হলো। শাশুড়ি মায়ের কথার উপর নোমান খুব একটা জোর করতে পারল না। শিরিন একবার বলেছিল,
– নতুন জামাই, শ্বশুরবাড়ির না গেলে ওরা কী ভাববে বলতো?
জবাবে নোমান জানিয়েছে,
– আমার যাওয়া না যাওয়া নিয়ে তো আত্মীয়তা বন্ধ হচ্ছে না। দেখো মা যেটা চাচ্ছেন না, সেটা না করাই ভালো হবে। কী দরকার, নতুন সংসারে এমন ঝামেলা বাধানোর? তার চেয়ে বরং তুমি ঘুরে এসো।
বাবার বাড়িতে আসার পর থেকে যেন ওবাড়ি থেকে একরকম দূরত্বেই হারিয়ে যেতে শুরু করল সে। সেখান থেকে খুব কম পরিমাণই কল আসে। সাহারা জামান এখনো রেহানা বেগমের সাথে কথা বলেননি। শিরিন একবার দিতে গেছিল, কিন্তু চুলার ভাত পুড়ে যাবার অজুহাত দেখিয়ে তিনি ছুটে গেছেন।
প্রায় আট দিন কেটে গেলেও শিরিনকে নিয়ে ওবাড়িতে তেমন মাথা ব্যথা নেই। নয় দিনের দিন সন্ধ্যাবেলা নোমান শিরিনকে কল দিয়ে বলল,
– অনেক তো থাকলে, এবার বাসায় আসো।
শিরিন কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
– আমি একা যাবো? আমাকে কেউ নিতে আসবে না?
– বাবা একটু অসুস্থ আছেন। বড় ভাইয়া, ভাবি, তারাও কাজে ব্যস্ত। এদিকে আমি অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছি না। কি করবো বলো? তুমি একটু ম্যানেজ করে চলে আসো প্লিজ।
এতদিন পর নোমানের অনুনয় শুনে শিরিনের মনটা যেন হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতই গলে যেতে শুরু করল। তারমানে ওবাড়িতে কেউ তাকে ভোলেনি। বাবাকে কোনরকম বুঝিয়ে শিরিন পর দিনই শ্বশুরবাড়িতে হাজির হয়। রিক্সাওয়ালা লাগেজগুলো ডাইনিং রুমে এগিয়ে দিলেন।
শিরিনের একমাত্র বড় জা ফাইজা তখন নিজের ছোট বাচ্চাটাএ জন্য খিচুড়ি রান্নায় ব্যস্ত। শিরিনকে দেখেই সে বলল,
– আরে! শিরিন যে! একা একাই এলে? নাকি তোমার বাবা দিয়ে গেলেন? এ বাড়ি থেকে তো কেউ নিতে যায়নি মনে হয়।
– হ্যাঁ ভাবি। নোমান বললো, ওর অফিস থেকে ছুটি দিচ্ছে না। তাই বাবাকে ভুলভাল বুঝিয়ে ম্যানেজ করতে হলো।
– চাচাকে না হয় ভুলভাল বোঝানো যায়, মানুষকে কিভাবে বোঝাবে বলো? এ বাড়িতে কেউ তো চাচ্ছিলোই না, তোমাকে এত তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে। শাশুড়ি মা একেবারে রেগে আগুন হয়ে আছেন। নোমান তোমাকে চলে আসতে বলাই উনি বলছিলেন-” এত তাড়াতাড়ি আসার কি দরকার? মায়ের সেবা যত্ন করে একবারে ভাই বোন কোলে নিয়েই আসুক।”
শিরিন আর কোন জবাব দিতে পারে না।। তার অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে নানান বিষয়ের চর্চা হয়েছে। আর ঠিক এই কারণেই কেউ তাকে নিতে যায়নি। এর চেয়ে করুণ গল্প একজন নববধূর জন্য আর কীইবা হতে পারে!
সেদিন রাতে মেয়েটা আর খেতে বের হলো না। ঘরের কোণে আড়ালে আবডালে চোখের জল ফেললো শুধু। পুরনো সংসারে হঠাৎ গুরুত্ব কমে গেলে “যা হবার, হয়েছে” বলে সয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু নতুন সংসার হবার আগেই সেটা বিষ হয়ে উঠলে সেই মুহূর্তটা একজন নারী কিভাবে সামলায়?
শিরিন কিছুই ভেবে পায় না। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এই পরিবারের মানুষ এতদূর ভাবছে। অথচ এখানে ভাবার মতো কোনো বিষয়ই নেই। ভালোবাসায় পাগল হয়ে সিদ্ধান্তটা এত তাড়াহুড়ো করে না নিলেও পারত সে। বুঝতে বড় দেরি হয়ে গেল তার!
(প্রিয় পাঠক, শিরিনের অবস্থানে আপনি থাকলে কীভাবে বিষয়টি সামলাবেন?)