শূণ্য_কৌটা(পর্ব-২)

0
349

#শূণ্য_কৌটা(পর্ব-২)
-সুহাসিনী

মেয়ের কথায় একরকম নিরুপায় হয়ে পড়লেন তিনি। কিছুক্ষণ ভেবে ধীর গলায় জানালেন,
– আচ্ছা, তোকে কিছু করতে হবে না। আমি এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবো। তোর বাবা কুমিল্লা গেছেন। উনি ফেরার আগেই নষ্ট করবো। নাহলে সে কখনোই করতে দিবে না।

শিরিন ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকালো।
-ঠিক বলছো তো?
-ঠিক আর ভুলের কী আছে! তুই চাস না, এই সন্তান আসুক। কষ্ট করে এত বড় করা সন্তানকে জলাঞ্জলি দিয়ে অনাগত সন্তানকে কীভাবে সমর্থন করবো আমি!

শিরিন মায়ের দিকে এগিয়ে আসে। তারপর সোফায় রেহেনাকে বসিয়ে ক্ষণিক মুহুর্ত তার পেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দুই চোখ ছলছল করছে। রেহানা বেগম স্পষ্ট সেটা টের পেলেন। মেয়ের মুখটা আলতো করে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন,
-এত কষ্ট পাচ্ছিস কেন? আমাকে আর কী করতে হবে বল, করছিই তো।

-না, মা। কিছুই করতে হবে না। এই বাচ্চাকে নিয়ে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু মা, নোমানকে আমি কত ভালোবাসি, তুমি তো সবই জানো। কবে কবে ওর প্রতি এত দুর্বল হলাম আমি! চাইলেও এখন নিজেকে দূরে সরাতে পারছি না। ভালোবাসা জিনিসটাই বোধহয় এমন ম্যাজিক, সময়ে অসময়ে যন্ত্রণার আগুনে পোড়াবে। নির্বোধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলবে- এটাই ঠিক। মা, ওকে ছাড়া আমি নিশ্বাসও নিতে পারি না যে! তোমার এই সন্তান জন্মালে ওর অফিসের কলিগরা টিটকারি করবে, আমার শশুরবাড়ির লোকেরা সমালোচনা করবে।

রেহানা বেগম ছোট্ট করে একবার শ্বাস ফেললেন। শিরিন আবার বলতে থাকে,
-মা, শুধু নোমানের বাসা নয়। তুমি আমাকে যেখানেই এখন বিয়ে দাও না কেন, সবখানেই এই কথা নিয়েই হাসি তামাশা চলবে। তুমি কি চাও আমরা এই অবস্থার মধ্যে পড়ি?

-না, চাই না। তুই খেতে বস। আমি সব গুছিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। আমার সাথে যাবি?

শিরিন আমতা আমতা করে বললো,
-অসম্ভব। ডাক্তার আমাকে দেখলে আগেই ভাববে, আমি বাচ্চা নষ্ট করতে এসেছি। তারপর যখন জানবে, বাচ্চাটা তোমার। আর তুমিই নষ্ট করছো। তখন কী একটা অবস্থা হবে, জানো তুমি?

রেহেনার মুখটা মলিন হয়ে গেল। পৃথিবীর কোথাও যেন বিন্দুমাত্র তল খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। চুপচাপ রান্নাঘর থেকে মেয়ের জন্য খাবার এনে টেবিলে রাখলেন। তারপর হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আলনায় কালো বোরখাটা ঝুলছে। খাটের উপর বসে করুণ দৃষ্টিতে একবার নিজের পেটের দিকে চেয়ে ঝপ করে উঠে দাঁড়ান। দ্রুত বোরখাটা পরে নিয়ে বাইরে এসে দেখলেন, শিরিন তখনো খাবার খাচ্ছে। মেয়েকে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। হয়তো ছিল, তবে তার গুরুত্ব এখন নেই। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন, হামজা সাহেব ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন! রেহেনার বুকটা ধক করে উঠলো। ঠিক দেখছে তো!
-তুমি?
– হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে দেখে এভাবে ভয় পেলে কেন? কোথায় যাচ্ছো তুমি?

রেহানা বেগম একবার ঘরের ভিতর উঁকি দেয়। তারপর ফিসফিস করে স্বামীকে বলতে থাকেন,
-বলছি, একটু নিচে চলো। এখানে বলতে পারবো না।
-কিন্তু কেন?
-আহা, চলোই না। এত কথা বাড়িও না।

রেহেনা বেগম স্বামীর হাত ধরে টেনে বাইরে বেরিয়ে আসে। শুনশান রাস্তা, নিস্তব্ধ পরিবেশ। পৃথিবীটা হঠাৎ থমকে গেছে যেন। হামজা সাহেবের চোখেমুখে একরাশ প্রশ্ন।
-কী হয়েছে রেহানা? তুমি এমন ভয় পাচ্ছো কেন?
-আমার গর্ভের এই সন্তান।
– হ্যাঁ, আমাদের সন্তান। কেন, ওর কী হয়েছে?
-কিছু হয়নি। কিন্তু এই বাচ্চা রাখা যাবে না। আমি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলবো।

হামজা সাহেব চমকে উঠলেন। রেহানা এসব সজ্ঞানে বলছে তো?
-মানে কী? কী বলছো তুমি! বাচ্চা নষ্ট করবে মানে? এত বড় পাপের চিন্তা কীভাবে করলে!
-অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই বাচ্চা হলে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। সবাই মুখ টিপে হাসাহাসি করছে আমাদেরকে নিয়ে।
-তো? আমরা কোনো অবৈধ বাচ্চার জন্ম দিচ্ছি না, রেহেনা। এটা আমাদের সন্তান। বৈধ সন্তান। তোমার বুক কাঁপলো না এটা বলতে? কীসের লোকের ভয়! চুপ করো একদম। মানুষের সমালোচনার মুখে আমি থু থু দেই। জীবনের বড় একটা সময় না খেয়ে, ভালো কাপড়ের অভাবে আমি বেঁচে থেকেছি। মানুষ তখন আমাকে নিয়ে আলোচনাও করতে আসেনি। আর এখন আমি তাদের সমালোচনার ভয়ে নিজের সন্তান নষ্ট করবো? যুগ পাল্টেছে, সমাজ পাল্টেছে, কিন্তু আল্লাহর নিয়ম পাল্টায়নি।

-আমার কিছু ভালো লাগছে না। তুমি যত সহজে বলে যাচ্ছো, পৃথিবীর মানুষ তত সহজ নয়।

-সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। হাঁটতে যাবে? চলো, পার্ক থেকে হেঁটে আসি। মন ফ্রেশ হবে। আমার হাত ধরো দ্রুত। আজকে আমাদের অনাগত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা সেলিব্রেট করবো।

রেহেনার ঠোঁট কাঁপছে। কিন্তু একটাও শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না সে। স্বামীর হাত ধরে রাস্তায় নেমে পড়ে।

পার্কে মানুষের ভীড়, দূরে আড়ালে আবডালে প্রেমিক প্রেমিকার লুকোচুরি। এই সবকিছুকে ছাপিয়ে রেহেনার নজর কাড়ছে ছোট বাচ্চাদের ছুটোছুটি। তার গর্ভের বাচ্চাটিও তো এভাবেই ছুটে বেড়াবে ছোট ছোট হাত পা নিয়ে। অথচ তাকে কীভাবে সে মেরে ফেলবে!

রেহেনার মনে পড়ে, তারই বয়সী এখনো বহু নারীই গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে মা হচ্ছেন। কেবল সে এই শিক্ষিত সমাজে বাস করে বলে নিজের অস্তিত্বটাকেই মুছে ফেলবে নাকি? যে মিথ্যে হাইফাই সোসাইটির জন্য এত বড় ত্যাগের সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হচ্ছে, সেই সোসাইটি তাকে কীইবা দিচ্ছে। রেহেনার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। আল্লাহ রব্বুল আ’লামিন ঠিক সময়েই হামজাকে তার কাছে পাঠিয়েছেন। এত বড় ইশারা সে বুঝতে পারেনি।

“আসতাগফিরুল্লাহাল আজিমাল্লাজি লা-ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।”

মনে মনে বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান রেহেনা বেগম। হামজা থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,
-কী বলছো একা একা? আমার উপর রাগ নেই তো?

-ছিঃ ছিঃ, এসব কী বলো তুমি! আমি ক্ষমা প্রার্থণা করলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ইশারা দিয়েছেন তোমাকে এত দ্রুত বাসায় পাঠিয়ে। এরপরও আমি ভুলের মধ্যে থাকি কী করে?

হামজা সাহেব মুচকি হাসলেন। তবে কোনো কথা বললেন না।

প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি দুজনেই বাড়ি ফেরে। শিরিন উদ্বিগ্ন হয়ে মায়ের অপেক্ষা করছে। একসাথে বাবা মা দুজনেই ফিরবে, এমনটা সে কল্পনাও করেনি। কিছুটা ভয় ভয় নিয়ে সে দুজনের জন্য দরজা ছেড়ে দেয়। মা কী কাজটা করতে পেরেছেন? জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না শিরিনের।

হামজা সাহেব স্ত্রীকে ঘরে যেতে বলে শিরিনকে ডাক দিলেন,
-শিরিন, আমার পাশে বসো।

শিরিন চুপচাপ বাবার পাশে বসলো।
-দেখো মা, তোমরা শিক্ষিত হয়েছো। আধুনিক সমাজে তোমাদের জীবনযাপন। সবই ঠিক আছে। কিন্তু একটা বাচ্চা নিয়ে এত সীতাকান্ড ঘটে যাবে, আমি কখনো কল্পনাও করিনি। তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। তবে নোমান এমন সমস্যা সৃষ্টি করবে, এটা আমাকে অবাক করেছে। যাই হোক, নোমানের বাবাকে কল দিয়েছিলাম। ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় আসবেন। সব কিছুর একটা সহজ সমাধান হওয়া দরকার।

-আর বাচ্চাটা?

-সে আছে। আর পৃথিবীতেও আসবে। অনেক হয়েছে এই বিষয় নিয়ে। আর নয়। তোমার হবু শশুর আসছেন। উনার সাথে খোলামেলা আলোচনা করবো। আমার অনাগত সন্তান নিয়ে তাদের সমস্যা হলে এই বিয়ে হবে না। তারা নিজেদের বিবেকহীনতার পরিচয় দিলে, এমন পরিবারে তোমাকে বিয়ে হলে তুমি কোনোদিনই সুখী হতে পারবে না। এটা মনে রেখো।

বাবার কথায় শিরিন চমকে ওঠে। যার কথা ভেবে নিজের রক্তের ভাই/বোনকে সে পৃথিবীতে আসতে বাধা দিচ্ছে, তারা কি সত্যিই মেনে নিবেন! ব্যাপারটা ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসার অবস্থা হয় ওর।

(কী মনে হচ্ছে, নোমানের বাবা কি মেনে নিবেন? এই ধরণের ঘটনা ২০২২ এসে আপনার সমাজে কেমন প্রভাব পড়ে)

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here