#শূণ্য_কৌটা (পর্ব-০৩)
-সুহাসিনী
বাবার কথায় শিরিন চমকে ওঠে। যার কথা ভেবে নিজের রক্তের ভাই/বোনকে সে পৃথিবীতে আসতে বাধা দিচ্ছে, তারা কি সত্যিই মেনে নিবেন! ব্যাপারটা ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসার অবস্থা হয় ওর।
মেয়ের এই চরম উদ্বিগ্নতা টের পাচ্ছেন হামজা সাহেব। কিন্তু শিরিনকে কিছুই বুঝতে দিলেন না। এমন স্বাভাবিকভাবেই তিনি সোফা থেকে উঠে গেলেন, যেন এখানে এতক্ষণ কিছুই ঘটেনি। শিরিন চুপচাপ বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে ব্যস্ত। বাবাকে সে বোঝাতে পারবে না, নোমানকে সে কতখানি ভালোবাসে। বাবা কী ভালোবাসার মূল্যায়ন করতে জানেন? কে জানে! চাচাতো বোন নিশাত একদিন ছাদে ডেকে নিয়ে তাকে বলেছিল,
“শিরিন, তোর বড্ড বয়স কম। এই বয়সে মেয়েদের আবেগ থাকে বর্ষাকালের জলের মতো টইটুম্বুর। তোর মধ্যেও আমি সেগুলোর কোনটাই কমতি দেখছি না। কিন্তু ভালোবাসা প্রতি এতটা আবেগী হয়ে যাস না,যার কারণে তোকে একদিন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। সিদ্ধান্তহীন তাই ভুগতে হয়।”
মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। এক কাপ কফি বানাতে পারলে ভালো হতো। এত এত দুশ্চিন্তা নেওয়া যাচ্ছে না। শিরিন উঠে দাঁড়িয়ে সোজা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। মা এখন রান্নাঘরে নেই। মায়ের জন্য তার প্রচন্ড মায়া হচ্ছে, কিন্তু কেন জানি মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হয়তো নিজের সুখের প্রতি তীব্র আবেগ মায়ের প্রতি ভালোবাসাকে ফিকে করে দিচ্ছে।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর নোমানের বাবা জনাব রহমান সাহেব শিরিনদের বাসার কলিংবেল বাজালেন। শিরিন তখন নিজের ঘরে খাটে বসে আকাশ-পাতাল চিন্তায় ব্যস্ত। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে বের হতেই দেখে তার বাবা হামজা সাহেব ইতোমধ্যে দরজা খুলে দিয়েছেন।
– আসসালামু আলাইকুম, রহমান সাহেব। পথে কোন সমস্যা হয়নি তো?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি, না। তেমন কিছু না। সব ঠিক আছে?
– ঠিক ভুলের হিসাব করতেই আপনাকে ডেকে নিয়ে এসেছি ভাই। আসুন।
রহমান সাহেব ডাইনিং রুমে ঢুকে একটা মিষ্টির প্যাকেট শিরিনের দিকে এগিয়ে দিলেন।শিরিনের মুখটা শুকিয়ে আছে।
– কি ব্যাপার শিরিন, সারাদিন কি খাওয়া দাওয়া হয়নি? মুখটা অমন শুকিয়ে আছে যে…
– খেয়েছি, আঙ্কেল। আমি ঠিক আছি। আপনি বসুন আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
সে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেও ভিতরে ঢুকলো না। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বাবা এবং নোমানের বাবার কথা শুনতে থাকে।
হামজা সাহেব বলছেন-
– ভাই, এভাবে আত্মীয় বাড়ি মিষ্টি নিয়ে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না। এসব আমার ভালো লাগে না একদম। আপনি এসেছেন, এতেই অনেক কিছু।
রহমান হেসে উঠেন। যেন হামজা সাহেবের কথায় তিনি প্রচন্ড আনন্দ পাচ্ছেন।
– আসলে এটা আমার আজন্ম স্বভাব। কোথাও গেলে,খালি হাতে যেতে পারি না।। বংশগত অভ্যাস বলে কথা।
কথা বলতে বলতে রহমান সোফায় বসলেন। রেহেনা বেগম তখনো ঘর থেকে বের হননি। প্রচন্ড ভয় আর লজ্জা তাকে গ্রাস করে ফেলছে। তার সন্তানকে নিয়ে এখন মানুষের সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করতে হচ্ছে। একজন মায়ের কাছে এর চেয়ে অপমানজনক আর কি হতে পারে! তবে হামজা যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে কোন ভুল নেই। এক সন্তানের জন্য আর এক সন্তানের হবু শ্বশুরবাড়িতে সমস্যা হোক, সেটা তারা কেউই চান না। দেওয়ালে একরকম কান পেতে তিনি সবার কথা বোঝার চেষ্টা করছেন।
রহমান বললেন,
– কি হয়েছে বলুন তো? এভাবে জরুরি তলব। যদিও আমি মনে হয় কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি।
– জি ভাই। আমার ধারণা, আপনি সবটাই জানেন। তারপরেও একটু বিস্তারিত খুলে বলা ভালো। শিরিনের মা মানে আমার স্ত্রী রেহানা বেগম অন্তঃসত্তা হয়েছেন। আমাদের ঘরে আরও একটা সন্তান আসতে চলেছে।
রহমান মাথা দুলালেন। হয়তো কি বলবেন সেটাই ভাবছিলেন।
– বাচ্চা হবে, তা বেশ ভালো। কিন্তু হঠাৎ এই বয়সে এসে এই সিদ্ধান্ত! আসলে কি বাচ্চার প্রয়োজন ছিল? যাবতীয় সবকিছু তো শিরিন মা একাই সামলাতে পারতো।
– ব্যাপারটা এখন প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনের নয়। সৃষ্টিকর্তার মর্জি হয়েছে, তিনি কৃপা করেছেন।
-হ্যাঁ তাও বটে । কিন্তু এখানে আমার কার্যটা কী, যদি একটু বলতেন।
– দেখুন ভাই, আমি এবং রেহানা চাই, আমাদের সন্তানটা পৃথিবীতে আসুক। তাকে শিরিনের মত করে আমরা মানুষ করব। শেষ বয়সে না হয় বুড়ো বুড়ি আমাদের সন্তানটার সাথেই সময়টা কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু এখানে একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। কিছুদিন পরেই আমার শিরিন মা আপনার ঘরের বউ হতে চলেছে। আর এটা নিয়ে যত ঝামেলার সৃষ্টি। আজ আপনার ছেলে নোমান শিরিনকে ডেকে কড়াভাবে বারণ করে দিয়েছে, এই সন্তানটা জন্ম দেওয়া যাবে না। বাচ্চাটা পৃথিবীতে এলে নাকি ওর মানুষের কাছে নাক কাটা যাবে। অফিসের কলিগরা হাসি তামাশা করবে। এমনকি এটাও শুনছি, নোমান বিয়ে করতেও নারাজ হচ্ছে।
রহমান সাহেবের মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, কথাগুলো হয়তো চিবিয়ে হজম করছেন। এসব বিষয় নিয়ে তার যেন কোন মাথাব্যথাই নেই। কিছুটা আমতা আমতা করে তিনি উত্তর দিলেন,
– হামজা ভাই, নোমানের অবস্থাটা আপনি একবার বোঝার চেষ্টা করুন। সে কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না, তেমনি সমাজের সব মানুষও একরকম হবে না। এটাও বড়ই সত্য কথা। তা আপনিও জানেন এবং আমিও জানি। বিয়ের ব্যাপারব আপনি আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইছেন,তাইতো? আপনার সন্তান পৃথিবীতে আসবে, এখানে আমার কী বলার থাকবে? অসুস্থ প্রতিযোগিতার সমাজের কথা ভেবে আমি কোন পাপের ভাগীদার হতে চাই না। দুনিয়াতে আজ আছি,কাল নেই। আল্লাহ দিলে আগামী বছর হজ করব। আপনার একটা কেন, দশটা সন্তান হলেও আপনার মেয়ের সাথে নোমানের বিয়ে দিতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। তবে আপনার কাছে একটা অনুরোধ, বিয়ের আগে নোমান বা আমার পরিবারের কাউকে দয়া করে জানাবেন না। আমি ওদের সবাইকে বলবো বাচ্চাটা নেই।
হামজা চমকে ওঠেন। জেনেশুনে এতবড় মিথ্যা কথা কিভাবে বলবে সে। তাছাড়া আর কিছুদিন পরে বেবি বাম্প হবে। তার বিবেকে কখনোই এই বিষয়টি সাড়া দিবে না।
– এটা কি বলছেন! এত বড় সত্যিই আমি কিভাবে লুকাবো?
– ভাই সাহেব, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার কিংবা আমার কাছে যতটা সহজ মনে হয় , দুনিয়ার সবার কাছে ততটা সহজ না। নোমান হয়তো এখন ফ্যান্টাসির জগতে আছে। যুগ পাল্টেছে । একসময় আমি আর্মিতে চাকরি করতাম, আর এখন আমার ছেলে করে কর্পোরেট লেভেলে। সবার অবস্থা সমান হবে না। আমরা আসলে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করতে পারিনি। আর একারণেই বিয়ের ব্যাপারে আমাকে ডাকতে হলো আপনার। যাইহোক, আমরা পুরুষেরা যত সহজেই মেনে নিই না কেন, ঘরের মহিলারা একটু আধটু এ বিষয় নিয়ে কথা তুলবেই। তাই আপাতত বিষয়টি এড়িয়ে গেলেই ভালো।
রহমান সাহেবের কথা হামজার কাছে খুব একটা সুবিধের লাগে না। কিন্তু মানুষটা ভালো। কথায় এবং কাজে তিনি সব সময় একই রকম থাকেন। মানুষটার কথা ও ফেলে দেবার মত নয়। দূরে শিরিন তখনো দাঁড়িয়ে আছে। নাস্তা নিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। রহমানের প্রতি বিশ্বাস এবং মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর দ্বিমত করতে পারলেন না। রহমান ভাই যখন কথা দিয়েছেন, তখন এটা নিয়ে খুব একটা সমস্যা আর হবেও না। এইটুকু ভরসা ওই মানুষটার প্রতি তার আছে।
সবকিছু প্রায় একরকম গোপন রেখেই শিরিন এবং নোমানের বিয়ে সম্পন্ন হয়। নরম কোলবালিশের পাশে বসে তিনবার কবুল বলে চরম সুখের ফ্যান্টাসির মুহূর্তেও নোমান জানে না, তার কাছে এখনো কত বড় সত্য লুকায়িত আছে। বাসর ঘরে ঢুকে নববধূকে একান্ত নিজের করে পাবার আকাঙ্ক্ষায় যেন সে ভেসে যাচ্ছে মেঘেদের দলের সাথে।
সেই ভেসে যাবার ঘোর কাটে বাসরঘরে শিরিনের হাত ধরার পূর্বেই। শিরিন ঘোমটা নামিয়ে ইতঃস্তত করে নোমানকে বলল,
-আমাকে পেয়ে তুমি কি খুশি?
– অবশ্যই খুশি। নানান সমস্যা সমাধানের পর আমি তোমাকে পেয়েছি। তুমি আমার জীবনের কাঙ্খিত নারী। তোমাকে না পেলে হয়তো আমার জীবনটাই বৃথা হয়ে যেত।
– তবে সেদিন কেন বলেছিলে, আমার ভাই বা বোন জন্মালে তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? তুমি কি জানতে না, আমি এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোটা তোমাকেই বাসতাম?
নোমান যেন এই প্রথম নারীদের মতো তীব্র লজ্জা অনুভব করতে থাকে। তার কাছে যথাযথ উত্তর নেই। স্ত্রীর প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে সে বলে,
– যা হবার, তা হয়েছে। বাদ দাও তো এখন। আজকে আমাদের এসব বিষয়ে আলোচনা করার সময়?
– আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটাই উপযুক্ত সময়। আমাকে স্পর্শ করার আগেই তোমার জানা দরকার। কারণ, তুমি জানো না, আমার মায়ের সন্তানটি পৃথিবীতে আসছে। আর এটা তোমার বাবাও খুব ভালো করেই জানেন। আমি তোমাকে বিয়ে করলেও সে জন্মাবে, না করলেও জন্মাবে। বাবা হয়তো তোমার সাথে আমাকে বিয়েই দিতেন না।
নোমান, আমার পরিবারের কাছে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি এখনো এটা ভেবে পাচ্ছি না, তোমার কাছে কেন বিষয়টা এত অস্বাভাবিক। অতিরিক্ত সামাজিক হতে গিয়ে কেন এমন অসামাজিক সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলে তুমি? আমার বাবা কি বলেছে জানো, তার সন্তানের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার তুমি কে? তবুও তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছে। কেন জানো? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। পাগলের মতো ভালোবাসি । আমার বাবা জানেন, তোমাকে ছাড়া বাঁচতে আমার কষ্ট হবে । আচ্ছা নোমান, তুমি কি এখন আমাকে প্রতারক বলবে?
নোমান কোন জবাব দিতে পারে না। নির্বাক চেয়ে থাকে ওর দিকে।
(উন্মুক্ত প্রশ্নঃ- শিরিনের বাবা-মায়ের জায়গায় থাকলে আপনি কি নিজের মেয়েকে রহমান সাহেবের কথা মেনে ম বিয়ে দিতেন?)
( চলবে…)