#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ০৩
#ফারজানা_আক্তার
সিয়াম দূরে দাঁড়িয়ে রাইসাকে দেখছে আর অদ্ভুত ভাবে হাঁসছে। ক্লাস শেষে রাইসা আর রিয়া ক্যাম্পাসে বসে কিছু পড়া নোট করতেছে। সেদিন রাহেলা খাতুনের রাইসাকে খুব পছন্দ হয়েছিলো। গোলগাল চেহারা উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং চিকন ঠোঁট আর নেশা লাগানোর মতো চোখ সব মিলিয়ে অপূর্ব লেগেছে রাইসাকে রাহেলা খাতুনের। সেদিন ফজলুর রহমান একেবারে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে চলে যায়। রাহেলা খাতুনেরা সেদিন চলে যাওয়ার পর খুব রেগে গিয়েছিলো রাইসা, সে সরাসরি জানিয়ে দেয় এতো দ্রুত পড়ালেখা শেষ করার আগে সে বিয়ে করতে চাইনা, পরে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করে ফারুক আহমেদ রাইসাকে। রাইসা এই বিয়েতে রাজি হলেও এখনো সে জানেনা বর কে। হবু বরকে একটা নজর দেখার আগ্রহ জন্ম নেয় রাইসার মনে। ইসলামেও বিয়ের আগে ছেলেমেয়ে এক নজর একে-অপরকে দেখে পছন্দ করার নিয়ম রয়েছে। রাইসা লজ্জার কারণে নিজের অপ্রকাশিত ইচ্ছে টা কিছুতেই বাবা মায়ের সামনে প্রকাশ করতে পারছেনা। একটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে তেমন রাইসারও বেশ কিছু স্বপ্ন রয়েছে কিন্তু যখন রাইসা তার হবু বরকে সরাসরি দেখবে তখন হয়তো রাইসার সব স্বপ্ন কাঁচের মতো ভাঙ্গবে কেননা রাইসা মোটেও পছন্দ করেনা সিয়ামকে।
পড়া নোট করা হয়ে গেলে রাইসা যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলো তখনই রিয়া বলে ওদের সাথে গাড়িতে যেতে কিন্তু রাইসা এতে অমত প্রকাশ করে। রাইসা আর রিয়ার সাথে আরেকটা মেয়ে মিশেছে ইদানীং, মেয়েটার নাম হুসনা। হুসনা সম্পূর্ণ পর্দা না করলেও বেপর্দাও চলাফেরা করেনা, সে সবসময়ই হিজাব নিকাব পরে তবে হাত মোজা আর পা মোজা পরেনা এর কারণ রাইসা আর রিয়ার জানা নাই তারা জিজ্ঞেসও করেনি কখনো।
সিয়াম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর ওইদিকে রিয়া গাড়িতে বসে রাগে ফুঁসছে। প্রতিদিন এভাবে গাড়িতে এসে বসে থাকতে বিরক্ত লাগে ওর কিন্তু ভাইয়ের সামনে কিছু বলার সাহস সে পায় না। রিয়া বিরক্ত হয়ে বসে বসে কাগজ ছিঁড়তেছিলো তখনই সেইদিনের সেই ছেলেটি রিয়াকে ডেকে বলে “কি ম্যাডাম আপনার ভাই এখনো আসেনি? আপনি চাইলে কিন্তু আমার এই ভাঙ্গা সাইকেলে উঠতে পারেন।”
“অদ্ভুত, ছেলেটি জানলো কিভাবে যে আমি আমার ভাইয়ার সাথে যাওয়া আসা করি।”
মনে মনে ভাবছে রিয়া।
“কি ম্যাডাম কি ভাবছেন?”
হেঁসে হেঁসে জিজ্ঞেস করে মাহিন।
রিয়া কিছু না বলে গাড়ির জানালার গ্লাস গুলো সব তুলে দেয়। মাহিন বুঝতে পারে রিয়া বিরক্ত ওর প্রতি তাই সে চলে যায় নিজ গন্তব্যে।
মাহিন খুব গরিব ঘরের ছেলে। মাহিনের আপন বলতে ওর মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউই নেই। কলেজ শেষে কয়েকটা টিউশনি করেই নিজের খরচের টাকা সে জোগাড় করে আর বাবার পেনশনের টাকায় চলে যায় ঘর খরচা। আবার মায়ের ওষুধের পেঁছনেও অনেক টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জীবন উপভোগ করছে মাহিন। কলেজে কয়েকটা বন্ধু হয়েছে মাহিনের কিন্তু সবাই বড়লোক তাই তাদের সাথে খুব কম মিশে মাহিন। মাহিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে সে আর রিয়াকে বিরক্ত করবেনা, বড় লোকের মেয়ে যদি প্রিন্সিপালের কাছে একবার বিচার নিয়ে যায় তবে এই কলেজে পড়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।
রাইসা আর হুসনা এক সাথেই একই রিক্সা করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। রাইসাদের বাসা আগে হওয়ায় রাইসা নেমে যায়, যদিও হুসনাকে বাসায় ডাকে রাইসা কিন্তু হুসনা নামেনি রিক্সা থেকে। রাইসা ঘরে চলে গেলে হুসনা রিক্সা নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়। রিক্সাওয়ালা বেশ বৃদ্ধ দেখে হুসনা উনাকে ভাড়া একটু বাড়িয়ে দিলে তিনি অনেক দোয়া করে দেয় হুসনাকে। হুসনাদের বাসা দুতলা কিন্তু হুসনা কখনোই দুতলায় পা রাখেনি। হুসনা রা চার বোন কিন্তু সে ওর বড় বোন রিহা ছাড়া আর কোনো বোনের সাথে কথা বলেনা। হুসনা খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, সবসময়ই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে সে। হুসনা ওর মায়ের সাথে টুকটাক কথা বললেও ১৫বছর বয়সের পর থেকে কখনো বাবার সাথে কথা বলেনি এমনকি ওর বাবার দিকে থাকাইও না আর তাই ওর বাবা সবসময়ই দুতলায় থাকে, নিচের তলায় কোনো প্রয়োজন ছাড়া আসেনা। হুসনা ঘরে খাবার দাবার খেলেও নিজের পোশাক আশাক আর পড়ালেখার খরচ নিজেই চালায় টিউশনি করে। হুসনার হৃদয়ে অনেক ক্ষত যা এখনো সবার কাছে অস্পষ্ট।
*
আজ রাইসাকে দেখতে রিয়া শাহিল আর সিয়াম আসবে কেননা আর মাত্র ৪দিন পরেই তাদের বিয়ে। ওদের দুজনের পরিবারই চাই বিয়ের আগে ছেলেমেয়ে দুজন দুজনকে একবার হলেও দেখুক নয়তো পরে সমস্যা হতে পারে। রাইসা জানে আজ ওকে দেখতে আসবে ওর হবু বর কিন্তু সে এখনো জানেনা ওর হবু বর টা আসলে কে। রাইসা প্রচুর নার্ভাস, মনে মনে ভয় হচ্ছে কেননা এই প্রথম রাইসা কোনো ছেলের সামনে নিকাব ছাড়া যাবে যদিও সম্পূর্ণ পর্দা থাকবে শুধু নিকাব ছাড়া।
অবশেষে সেই ক্ষণ এসেছে, ফাহিমা আসছে রাইসাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতে। রাইসার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, শ্যামলাবর্ণ লালচে হলে দেখতে নিদারুণ লাগে। রাইসা নিচের দিকে তাকিয়েই হাঁটছে, সবার সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে রিয়ার পাশে বসেছে রাইসা কিন্তু এখনো খেয়াল করেনি রিয়াকে। রাইসাকে দেখে গোল গোল চোখ করে এক নজরে তাকিয়ে আছে সিয়াম। “একটা মেয়ে এতোটা পরিপূর্ণ কিভাবে হতে পারে?” ভাবছে আনমনা হয়ে সিয়াম।
একটু পর রিয়া রাইসাকে বলে “ভাবি একটু চোখ তুলে দেখো, ভাইয়া তোমাতে মগ্ন হয়ে গেছে মুহুর্তেই”।
রিয়ার কণ্ঠস্বর টা বেশ পরিচিত মনে হলো রাইসার কাছে তাই রাইসা পাশফিরে হুট করে দ্রুত চোখ তুলে তাকাতেই দেখে রিয়াকে, রাইসা রীতিমতো অবাক সে রিয়াকে এই জায়গায় দেখবে সেটা কখনোই ভাবেনি আর ওর মুখে এভাবে হঠাৎ ভাবি ডাক শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রাইসা। রাইসা একনজর সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর ওর আব্বু আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে “এই বিয়েটা আমি করতে পারবোনা, আমাকে তোমরা জোর করিওনা প্লীজ। পড়ালেখা শেষ হোক আগে তারপর বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবো।”
এটা বলেই রাইসা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। তখনই সিয়াম বলে উঠে “বিয়ের সব আয়োজন করা শেষ মিস কালো পরি, সমাজে একটা ছেলের বিয়ে ভাঙ্গাটা স্বাভাবিক নিলেও একটা মেয়ের বিয়ে এভাবে হুট করে ভেঙ্গে যাওয়া স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া হয়না। যেদিন প্রথম তোমায় দেখেছি সেদিনই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তাই বাবা মাকে পাঠিয়ে বিয়েটা ফিক্সড করেছি। ভেবে নাও আরো একবার সময় আছে হাতে এখনো চারদিন।”
কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটা ধরে রাইসা, সে নিজের রুমে যেয়েই দরজা বন্ধ করে দেয়। সিয়ামের সাথে কি এমন হয়েছে যে রাইসা এমন রিয়েক্ট করলো বুঝতে পারছেনা রিয়া আর বাকি সবাই তো অবাক হয়ে দেখছে দুজনের কান্ড।
সিয়াম রা বিদায় নিয়ে চলে যায়। এরপর রিয়া অনেকবার কল করলেও রাইসা রিসিভ করেনা। রিয়ার উপর ভীষণ রাগ রাইসার কারণ রিয়া সব জেনেও গোপন রেখেছে ওর থেকে। রিয়ার মন খারাপ হয়।
পরেরদিন কলেজে রিয়ার সাথে একটা কথাও বলেনি রাইসা। হুসনা ওদের রাগ অভিমানের কারণ খুঁজলেও কিছু জানতে পারেনি যদিও রিয়া কিছুটা বলেছে কিন্তু তবুও কিছু বুঝেনি ও।
সন্ধ্যাবেলা রিয়া রাগ নিয়ে সিয়ামের রুমে গিয়ে ওর কাছে জানতে চাই রাইসার সাথে সে কি করেছে কেনো রাইসা এমনটা করতেছে? সিয়াম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে “তুই ছোট মেয়ে, ছোটমেয়েদের এসব জানতে নেই। যা পড়তে বস।”
এভাবে কেটে গেলো আরো দুইদিন। আর মাত্র বাকি আছে একদিন। রাইসা ফারুক আহমেদ এর রুমে যেয়ে দরজায় নক করতেই তিনি বলেন “আয় মা আয়। আর তো মাত্র একদিন তারপর তুই আমাদের ছেড়ে নিজের সংসারে চলে যাবি।”
কথাটা বলতেই গলা ধরে আসছে ফারুক আহমেদ এর। রাইসার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে। রাইসাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারুক আহমেদ বলে “কিছু কি বলবি মা?”
ছোট থেকেই রাইসা কিছু বলতে আসলে বাবার পাশে এভাবে চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাই ফারুক আহমেদ এর বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে রাইসা কেনো এসেছে উনার রুমে।
প্রায়ই ১০মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে রাইসা বলে “আব্বু ওই লোক টা তো এখনো স্টুডেন্ট আর আমিও স্টুডেন্ট। কেনো তোমরা এই বিয়েতে রাজি হলে?”
ফারুক আহমেদ হালকা কাঁশি দিয়ে বলেন”_________
#চলবে_ইনশাআল্লাহ