শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা #পর্বঃ১১

0
595

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১১
#ফারজানা_আক্তার

অন্তরীক্ষে হাজার তারার মেলা। থালার মতো গোল হয়ে চাঁদ বসে আছে আকাশের বুকে। ছোট ছোট মেঘেরা ভেসে চলেছে গগন জুড়ে। এমন মুহুর্ত সত্যিই মনোমুগ্ধকর। একা একা এসব মুহুর্ত উপভোগ করা যায়না, কেউ একজন লাগে মুহুর্তগুলোকে রাঙ্গিয়ে তোলার জন্য কিন্তু হুসনার জীবনে তেমন কেউই নেই। পরিবার থাকলেও পরিবারে কারো সাথে কোনো ভাব নেই হুসনার। এই ঘরে হুসনার আপন এবং কাছের বলতে একজনই আছে আর সে হলো ডায়রি। হুম এই ডায়রিটা হুসনার ভীষণ কাছের। হৃদয়ের যত কথা যত চাওয়া পাওয়া যত নালিশ যত অভিযোগ সব এই ডায়রিটার সাথেই শেয়ার করে হুসনা। হুসনা অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে “কেউ একজনকে পাঠাও খোদা আমার ধুসর জীবনটাকে রাঙানোর জন্য, যে মানুষটা আমার জন্য দুনিয়াতে এবং আখেরাতে কল্যাণকর।”
কথাটি বলেই চোখ বন্ধ করে মৃদু বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছে হুসনা তখনই ফোনের রিংটোনের শব্দ ভেসে আসে ওর কর্ণধারে। বেলকনি থেকে ছুটে রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখে রাইসার কল, আর এক মুহুর্তও দেরি না করে ফোন রিসিভ করে সালাম দেয় হুসনা। তারপর অনেকক্ষণ রাইসার সাথে কথা হয় হুসনার। রাইসার শ্বাশুড়ি হুসনাকে আগামীকাল দেখা করতে বলেছে মূলতঃ এটা বলার জন্যই রাইসা হুসনাকে কল দিয়েছে। কল কেটে দেওয়ার পর হুসনা খুশি হওয়ার সাথে সাথে খুবই নার্ভাস হয়ে যায়। রাহেলা খাতুন কি বলবে হুসনাকে এটা এখনো কেউ জানেনা তাই এটা নিয়ে মোটামুটি রিয়া রাইসা হুসনা সবারই চিন্তা হচ্ছে। হুসনা ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

*
রাত প্রায়ই ১২টা ছুঁই ছুঁই কিন্তু সিয়ামের এখনোও ঘুমানোর কোনো নাম গন্ধ নেয়, সে তার ফোন নিয়েই ব্যস্ত। রাইসা অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ শুয়ে ছিলো কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলোনা কারণ সিয়াম মিউজিক চালু করেছে আবার। রাইসা দ্রুত উঠে যেয়ে মিউজিক বন্ধ করে দিয়ে এসে সিয়ামের পাশে বিছানায় বসে ওর হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলে “চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন কোনো কথা নয়।” এটা বলেই নিজের জায়গায় শুয়ে পরে রাইসা। হা হয়ে বসে আছে সিয়াম। সিয়াম ভীষণ অবাক হচ্ছে রাইসার সাহস দেখে। এতোটা সাহস মেয়েটা পেলো কোথায়? রাগে লাল হচ্ছে সিয়াম। কপালের রগ খাঁড়া হয়ে গিয়েছে সিয়ামের, চোখ দিয়ে যেনো অগ্নি ঝরছে। দাঁতে দাঁত চেপে মেজাজ কিছুটা গরম করে সিয়াম বলে “দেখো কালো পরি বারাবাড়ি করিওনা, মোবাইল দাও।”

“দিবোনা মোবাইল, ঘুমান।”
“রাগ বাড়াচ্ছো কিন্তু। ”
“চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে শুয়ে থাকুন তবে রাগও কমে যাবে আর ঘুমও চলে আসবে।”
“এই শুনো একদম বউ বউ সাজতে চাইবেনা বলে দিলাম।”
“আপনার বলাতে আর না বলাতে কি হবে? কিছুই হবেনা কারণ আমি সত্যি সত্যিই আপনার বউ।”
রাইসা কথাটা বলতে না বলতেই হিং’স্রর মতো ঝাপিয়ে পরে সিয়াম ওর উপর। রাইসা খুব করে ব্যস্ত নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কিন্তু পরিশেষে সে ব্যার্থ। স্বামীর সোহাগে বিলিয়ে দেয় রাইসা নিজেকে।

ভোরবেলায় রাইসা ঘুম থেকে জেগে দেখে অঘোর ঘুমে বিভোর সিয়াম। ঘুমন্ত অবস্থায় সিয়ামকে খুব নিষ্পাপ লাগছে। এতোটা সুদর্শন পুরুষ এর আগে যেনো আর একটাও দেখেনি রাইসা। নিজের অজান্তেই রাইসা মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছে সিয়ামকে।
রাইসা গোসল করে ওজু করে এসে সিয়ামকে ডেকে দেয় গোসল করে নামায পড়ার জন্য। কিন্তু সিয়াম কিছুতেই উঠছেনা। সিয়ামকে ডেকে তুলতে ব্যার্থ হয়ে এক গ্লাস পানি এনে ওর মুখে ঢেলে দেয়, সিয়াম সাথে সাথে উঠে বসে যায়। লাল লাল চোখ করে সিয়াম তাকিয়ে থাকে রাইসার দিকে। সিয়ামের এমন রাগ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে ঢুক গিলে রাইসা। সিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে রাইসার দুই বাহু চেপে ধরে বলে “আমার ছোঁয়া পেতে খুব ভালো লাগে তোর তাই না? আমার ছোঁয়া পেলে খুব শিহরণ জাগে, খুব ভালো অনুভূতি হয় তোর তাই না?”

কপাল কুঁচকে রাইসা বলে “ছিঃ কি বলছেন কি এসব আপনি?”

“ভুল কি বললাম? বারবার আমার ছোঁয়া পাওয়ার জন্যই তো এসব উল্টাপাল্টা কাজ করো তুমি।”
“ভুল ভাবছেন আপনি, ছাড়ুন ব্যাথা লাগে।”
এটা বলেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রাইসা। মুখ গুমরা করে দাঁড়িয়ে থাকে সিয়াম। রাইসা ছোট ছোট চোখ করে বলে “অনেক হয়েছে যান এবার গোসল করে নামায সেরে নিন। তারপর ব্যায়াম করতে হবে।”
সিয়াম বিরক্ত হয়ে বলে “কেনো শুনতে হবে তোমার কথা আমাকে? পারবোনা কিছু করতে ঘুমাবো আমি। বিরক্ত করিওনা নিজের কাজে যাও তো।”
এটা বলেই সিয়াম বিছানায় বসতে যাবে তখনই রাইসা বলে “এবার কিন্তু পুরো বালতি এনে ঢেলে দিবো। যা বলছি তা-ই করুন।” সিয়ামের বুঝা হয়ে গেছে তার আর শান্তিতে ঘুমানো হবেনা। কেনো যে এতো দ্রুত বিয়ে করতে গেলো কে জানে। সিয়াম রাগ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই পেঁছন থেকে মুচকি হাঁসে রাইসা। ছেলেটা ত্যাঁরা হলেও কিউট। রাইসা নামায শেষ করে কোরআন তেলাওয়াত করতে বসে। সিয়াম নামায শেষ করে রাইসার কথা অনুযায়ী ব্যালকনিতে যেয়ে ব্যায়াম করতেছে। রাইসার তেলাওয়াতের সুর সিয়ামের কানে আসতেই সে থেমে যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে সিয়াম শুনে রাইসার তেলাওয়াত করা। মুগ্ধ হয় সিয়াম, এর আগে আর কখনো যেনো এতো সুন্দর তেলাওয়াত সে শুনেনি। সিয়াম ধীরে ধীরে এসে রাইসার পাশে এসে বসে। রাইসা খেয়াল করে সিয়মাকে আর মুচকি হাসে। রাইসা তেলাওয়াত শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে সিয়াম ঘুমিয়ে গেছে। রাইসা বুঝতে পারে যে সিয়াম ওর তেলাওয়াত শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে গেছে। রাইসা রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে এনে সিয়ামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সিয়াম জেগে যায়। সিয়াম জাগতেই ছিঁটকে কিছুটা দূরে সরে যায় রাইসার থেকে আর বলে “শুনো কালো পরি আমার ক্লোজ হওয়ার একটুও চেষ্টা করবেনা। দূরে দূরে থাকবে আমার থেকে।”

“আচ্ছা থাকবো দূরে। আর আমি তো দূরেই থাকি আপনি নিজেই তো বারবার কাছে টেনে নেন আমায়।”
মৃদু হাঁসির সাথেই বলে রাইসা। আগুন উঠে যায় সিয়ামের মাথায় আর গিজগিজ করতে করতে বলে “তুমি ইচ্ছে করেই রাগাও আমায় আমার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য। তোমাদের মতো মেয়েকে খুব ভালো করেই চিনি আমি।”
“আচ্ছা চিনলে তো ভালোই। নিন আপনার কফি।” এটা বলেই রাইসা সিয়ামের হাতে কফি ধরিয়ে দিয়ে রুম ত্যাগ করে।

*
রিয়া আর রাইসা গাড়িতে বসে আছে সিয়ামের অপেক্ষায়। এইদিকে কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রিয়া বিরক্ত হয়ে বলে “সবসময়ই ভাইয়া আগে এসে অপেক্ষা করে আমার জন্য আর আজ ভাইয়ার আসার কোনো নাম গন্ধ নাই।” রাইসা শান্তভাবে বলে আচ্ছা আমি দেখছি কোথায় আছে তোমার ভাইয়া। এটা বলে রাইসা গাড়ি থেকে নামতেই সিয়াম হুটহাট কোথায় থেকে এসে যেনো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেয়। রিয়া চমকে গিয়ে ভাইকে বলে “আরে ভাইয়া কি করছো কি তুমি? গাড়ি থামাও, ভাবি যাবে তো আমাদের সাথে।”
সিয়াম শান্তভাবেই বোনের প্রশ্নের উত্তরে বলে “দেখ নিজের চিন্তা নিজে কর, অন্যের চিন্তা করতে হবেনা। রাইসা রিক্সা বা টেক্সি নিয়ে চলে আসবে সবসময় যেভাবে যায়।”
রিয়া খুব আপসেট হয়ে বলে “এটা তুমি ঠিক করোনি ভাইয়া। আমাদের বাসা থেকে রিক্সা করে কলেজ যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” সিয়াম আর কিছু না বলে চুপচাপ ড্রাইভ করে। মন খারাপ করে বসে থাকে রিয়া।
এভাবে গাড়ি স্টার্ট হয়ে যাওয়াতে রাইসা খুব অবাক হয় কিন্তু মুহুর্তেই ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে। মেসেজটা আর কেউ নয় ওর স্বামী সিয়াম রহমান সেন্ড করেছে। মেসেজে লেখা ছিলো “তোমার মতো দুই টাকার মেয়েকে শুধু সিয়াম রহমানের বিছানায় মানায় এতো দামি গাড়িতে নয়। তুমি রিক্সাই বা টেক্সি তে সবসময় যেমন আসা যাওয়া করো তেমনই চলে এসো কলেজ।”
রাইসার খুব কান্না আসে সিয়ামের এসব কথায়। কষ্ট হচ্ছে খুব। বুকে চিনচিন ব্যাথার সৃষ্টি হচ্ছে। আজকের আগে কখনোও এমন অপমানবোধ করেনি রাইসা। নিজেকে খুব ছোট লাগছে রাইসার। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই অনবরত অশ্রু ঝরছে। রাহেলা খাতুন জানালা থেকে দেখে রাইসা খুব চটপট করছে সেটা। রাইসা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু ফেলছে তখনই কেউ এসে ওর কাঁদে হাত রাখতেই চট করে সে চোখের জল সব মুছে ফেলে। রাহেলা খাতুন বলে “লুকিয়ে লাভ নেয় মা, আমি দেখেছি সব। আমার ছেলেটা এমনই, আমি পারিনি ওকে মানুষ করতে। আমি তোমাকেই সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিলাম সিয়ামকে চেঞ্জ করার জন্য। মন খারাপ করিওনা। আমি ড্রাইভার কে বলতেছি আরেকটা গাড়িতে চলে যাও তুমি।”
শ্বাশুড়ীর এমন কথা শুনে মুচকি হাঁসে রাইসা। “না থাক আম্মু। আমি সবসময়ই এর মতো চলে যেতে পারবো। অভ্যাস আছে আমার।”
এটা বলে রাইসা আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়।
কলেজে পা রাখতেই রাইসার চোখাচোখি হয় সিয়ামের। সিয়াম বন্ধুদের নিয়ে উচ্চস্বরে হাঁসিতে মেতে উঠে। এসব দেখে খুব খারাপ লাগলেও রাইসা পাত্তা না দিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here