#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ১৩
#ফারজানা_আক্তার
হাঁপাতে হাঁপাতে রিয়ার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে রাইসা। রাইসাকে এভাবে হাঁফাতে দেখে রিয়ার চোখ যেনো আকাশে উড়ছে। রিয়া দৌড়ে রাইসার কাছে গিয়ে বলে “ভাবি কি হয়েছে তোমার? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো?” রাইসা কিছু না বলে হাতের ইশারায় টেবিলের উপর রাখা পানি দেখিয়ে দেয় রিয়াকে। রিয়া দৌড়ে পানি এনে রাইসাকে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় নিয়ে বসায় আর কি হয়েছে সব জানতে চাই। রাইসা শান্তভাবে সব খুলে বলে রিয়াকে। রাইসার কথা শুনে হাঁসতে হাঁসতে কুটিকুটি রিয়া।
রাতে খাবার খাওয়ার জন্য রিয়া আর রাইসা একসাথে সিঁড়ি বেয়ে নামছে তখনই ওদের সাথে যোগ হলো আরেকজন আর সেই মানুষটা আর কেউ নয় সিয়াম। সিয়াম এসেই ওদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে নামতে লাগলো, অন্যসময়ে সিয়াম সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নামলেও আজ সে রাইসাদের সাথে ধীরে ধীরে পা মিলিয়ে হাঁটছে। রাইসা সিয়ামের দিকে আঁড়চোখে তাকায়, সিয়ামের ওষ্ঠ জোড়ে বাঁকা হাঁসি।
খাওয়া শেষে সবাই সবার মতো নিজ নিজ রুমে চলে গেছে কিন্তু রাইসা এখনো রান্নাঘরে পায়চারি করছে। রুমে যাওয়ার সাহস সে পাচ্ছেনা কারণ রাত হলেই সিয়াম অন্যরুপ নিয়ে নেয় যা রাইসার সহ্য করতে বড্ড বেশি কষ্ট হয়। তবুও ওকে সিয়ামের সামনাসামনি হতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে সকল পরিস্থিতির।
খুব ধীর পায়ে রাইসা রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা পা রুমে রাখতেই রাইসার চোখ ছানাবড়া। যে ছেলে রাত ২টা বাজলেও ঘুমানোর নাম নেয়না সেই ছেলে নাকি আজ রাত ১১টাই ঘুমিয়ে গেছে, বিশ্বাস হচ্ছে না রাইসার। রাইসা সিয়ামের সামনে গিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমা করে দেখলো কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই সিয়ামের। ঘুমে বিভোর হয়ে আছে সিয়াম কিন্তু তবুও রাইসা বিশ্বাস করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ সিয়ামের পাশে বসে থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের জায়গায় শুয়ে যায় রাইসা। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ দোয়া দরুদ পাঠ করতে করতেই রাইসার চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম ভর করে।
*
রাইসা কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হয় ঘর থেকে। গেইট থেকে বের হওয়ার আগেই রাইসা বাগানে গিয়ে একটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠে “কিছু ফুল গাছে নয় হাতেই মানায় ভীষণ।” গোলাপটাকে নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস নিতে থাকে রাইসা, গোলাপের ঘ্রাণে নবিজিকে স্মরণ করার মতো আনন্দ আর মুগ্ধতা অন্যকিছুতে পাওয়া মুশকিল। সিয়াম গাড়ি স্টার্ট দিতেই রাইসা ওইদিকে তাকায় কিন্তু রাইসাকে সিয়াম খেয়াল করেনি। রাইসা পেঁছনে ঘুরতেই দেখে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে তৈরি হয়ে। রাইসা অবাক কন্ঠে বলে “রিয়া তোমার ভাইয়া তো চলে গেছে তুমি তৈরি হয়েও যাওনি কেনো?” রিয়া রাইসাকে জড়িয়ে ধরে বলে “আমার কিউট ভাবিটাকে রেখে আমি কি একা যেতে পারি “রিয়ার এমন আহ্লাদ-ই কথায় হেঁসে ফেলে রাইসা। তারপর তারা একটা টেক্সি করে রওনা দেয় কলেজের উদ্দেশ্যে। রিয়া জীবনে এই প্রথম টেক্সিতে উঠেছে, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে রিয়ার।
মাহিন রিয়াকে টেক্সি থেকে নামতে দেখে অবাক হয় অনেকটা। বড়লোকের মেয়ে আর টেক্সিতে, কি ব্যাপার? মাহিন একবার ভাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে আবার ভাবে যদি অপমান করে তাই আর সে কিছু না বলে ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। রিয়া লক্ষ করে মাহিন ওর দিকে তাকিয়েছিলো কিন্তু বুঝতে পারছেনা ছেলেটা ওকে ইগ্নোর করছে কেনো। মাঝে মাঝে মাহিনের কথা বেশ মনে পরে রিয়ার। কিন্তু সব অনুভূতি রিয়া নিজের মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই কারণ মহান আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে ওর।
ক্লাস শেষে সিয়াম রিয়ার কাছে এসে বলে রাইসাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে। এটা শুনে রিয়া খুব খুশি হলেও নিমিষেই ওর মুখের ঝলক থেমে যায় কারণ কিছুতেই গাড়িতে উঠতে রাজি হচ্ছে না রাইসা। সিয়াম মুখ গুমরা করে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের বউকে টেক্সিতে দেখতে খুশি লাগলেও নিজের বোনকে টেক্সিতে সে মানতে পারছেনা। খুব রাগ হচ্ছে সিয়ামের রাইসার উপর। রিয়া অনেক জোরাজোরি করার পর রাইসা বলে “তোমার ভাইয়া যদি সবার সামনে কোলে করে আমায় গাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসায় তবেই আমি যাবো তোমাদের সাথে।” রাইসার কথাটা শুনতেই রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যায় সিয়ামের। রাগে যেনো মাথা জ্বলে যাচ্ছে সিয়ামের। সিয়াম আর কিছু না ভেবেই রাইসাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবছে রাইসা “আব আইহে উঠ পাহাড়কি নিচে।” আর মুচকি মুচকি হাঁসছে।
বাসায় পৌঁছতেই রিয়া গাড়ি থেকে নেমে নিজের রুমে চলে যায়। রাইসা গাড়ি থেকে নামতে যেয়ে থেমে যায় আর তারপর সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু কণ্ঠে বলে “যেভাবে গাড়ি থেকে নামিয়ে সবার সামনে অপমান করেছিলেন আমাকে ঠিক তার ব্যতিক্রম ভাবে গাড়িতে তুলতে বাধ্য করেছি আপনাকে। কেমন লাগছে এখন বড়লোক বাবার বখাটে ছেলের?”
রাইসা কথাগুলো বলেই সিয়ামকে আর কিছু বলতে না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।
সিয়াম তখন আর ঘরে না গিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায় ঘুরতে। রাগে ফাঁস ফাঁস করছে আর ড্রাইভ করছে সিয়াম।
রাইসা ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে পড়তে বসেছে, পড়ার টেবিলেই মাথা বিছিয়ে ঘুমিয়ে যায় সে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে কিন্তু কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা রাইসার। আর মাত্র এক মাস পরই সিয়ামের অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা কিন্তু ওর কোনো চিন্তা নেই পড়ালেখা নিয়ে, বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। রাইসার ভাবতে ইচ্ছে করছেনা সিয়ামের কথা তবুও বারংবার সিয়ামের কথায়-ই ওর ভাবনাঘরে এসে ভীর জমায়। ঘুমন্ত রাইসার চুলগুলো উড়ছে বেশ। সিয়াম রুমে প্রবেশ করেই কুকুর নিয়ে খেলায় ব্যস্ত হয়ে পরে। হুম সিয়াম আসার সময় একটা পালিত কুকুর কিনে নিয়ে আসে। কুকুরের ঘেঁউ ঘেঁউ শব্দে রাইসার ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাইসা হামি দিয়ে চোখ খুলে দেখে সিয়াম বিছানায় বসে আছে আর একটা ছোট্ট ধবধবে সাদা কুকুর ওর কোলে। রাইসা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিয়ামের দিকে। সিয়াম বুঝতে পেরে বলে “এই কুকুরটা আমি কিনে এনেছি। আজ থেকে এই কুকুরটা আমার সাথেই থাকবে আর ওকে কখনোই কুকুর ডাকবেনা কারণ আমি ওর নাম রেখেছি টকি। টকি বলে ডাকবে ওকে বুঝেছো।” রাইসাকে কথাগুলো বলেই মনে মনে সিয়াম হাসে আর ভাবে “তুই কালো পরিকে শায়েস্তা করার জন্যই এই কুকুরকে এনেছি আমি। এই কুকুরের মালিক বলেছে লাল রং মোটেও পছন্দ করেনা এই কুকুরটা৷ আর তুই যখনই লাল রঙয়ের কাপড় পরিধান করবি তখনই ও তোর উপর আক্রমণ করবে। তারপর আমার আজকের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে।”
“কি ভাবছেন আপনি এভাবে আনমনা হয়ে?”
রাইসার কন্ঠ কর্ণকুহর হতেই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে সিয়াম। সিয়াম কিছু না বলে টকিকে কোল থেকে নামিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই রাইসা চেয়ারের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে যায় কারণ কুকুকে ভীষণ ভয় পায় রাইসা। সিয়াম বলে কিছু করবেনা টকি তবুও রাইসা ভয়ে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের উপর। সিয়াম ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে টকি রুমের কোথাও নেই আর রাইসাও নেই। পুরো রুমে টকিকে আর রাইসাকে খুঁজে না পেয়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখে রাইসা একা একা দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে। সিয়াম রাইসার পাশে এসে জিজ্ঞেস করে টকি কোথায় তখন রাইসা বলে “টকি যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে।”
“মানে? কি করেছো তুমি আমার টকির সাথে?”
“কিছু করিনি শুধু কাজের ছেলেকে দিয়ে টকিকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি অনেক দূরে।”
“পাগল হয়েছো তুমি? তুমি জানো কত শখ করে কুকুর পালবো বলে কিনে এনেছি আমি।”
“আপনি কি জানেন ইসলামে কুকুর পালন করার বিধান কি?”
“জানতেও চাইনা, তুমি আমার টকিকে এনে দাও।”
“বাচ্চাদের মতো জেদ না করে কফি খেয়ে নিন। আপনার জন্য বানিয়ে এনেছি মাত্র।”
“আমার টকিকে লাগবে মানেই লাগবে। আমি টকিকে পালবো, খুব শখ আমার কুকুর পালার।”
“এতো শখ ভালো না। শুনুন ইসলাম কি বলে। শখ করে ঘরে কুকুর রাখা, মানুষের চেয়ে কুকুরের যত্ন বেশি নেওয়া, কুকুরের সঙ্গে মানবীয় সম্পর্ক স্থাপন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিকার করা বা গবাদি পশু পাহারা অথবা শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া— কুকুর লালন-পালন করে, প্রতিদিন ওই ব্যক্তির দুই কিরাত পরিমাণ নেকি কমে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৭৫; তিরমিজি, হাদিস : ১৪৮৭)
অন্য হাদিসে আছে, ‘এক কিরাত হলো, উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং : ৪৬৫০)”
“সব কিছুতে তোমার এই বড় বড় লেখচার ভালো লাগেনা।”
“কিন্তু আমার বলতে ভালো লাগে।”
“তুমি মেয়েটা বড্ড বেশি বিরক্তিকর।”
কথাটা বলেই সিয়াম রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সিয়ামের উদ্দেশ্য সফল হলোনা তাই ও খুব আপসেট।
রাতে খাবার টেবিলে রাহেলা খাতুন বলেন সিয়ামের একমাত্র চাচার একমাত্র ছেলে দেশে ফিরছে আগামীকাল। ওর নাম তামিম। তামিম খুব ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়ে ফেলে আর তারপর থেকেই সে রাহেলা খাতুনের কাছে থাকতো। পরে তামিমের যখন স্কুললাইফ শেষ হয় তখন পড়ালেখা করার জন্য ওর বাবা মুশফিক রহমান ওকে লন্ডন নিয়ে যায় নিজের কাছে। তামিম লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে অফিস জয়েন্ট করেছে ইন্টার পরিক্ষা দেওয়ার পর পরই। তামিম আর ওর বাবা দুজনেই দেশে আসতেছে রাহেলা খাতুনের আমন্ত্রণে। রাহেলা খাতুন নিজের ছেলেমেয়ের থেকেও তামিমকে বেশি ভালোবাসে। রাহেলা খাতুন একটা নেক উদ্দেশ্যেই তামিমকে দেশে আসতে বলেছেন যেটা সবার অজানা। তামিমের আগমনের খবরে সবচেয়ে বেশি খুশি সিয়াম। সিয়াম আর তামিম একই বয়সের তাই ওদের মধ্যে সম্পর্কটাও বেশ ভালো। ভাই থেকে বন্ধু বেশি দুজন। তবে তামিমের চরিত্র অনেক ভালো, সিয়ামের মতো বখাটে হয়নি তামিম।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ